বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
 

লাল গ্রহের মাটিতে পা
চীনের নীল প্রজাপতির

২৭০ কোটি টাকার ‘রোবোটিক জিওলজিস্ট’ পারসিভিয়ারেন্সের ‘শার্লক’ আর ‘ওয়াটসন’ পাথরের খাঁজে লেপটে থাকা প্রাণের অনুসন্ধান চালাবে মঙ্গলে। যখন ৯ কোটি ৭০ লক্ষ অপুষ্টি জর্জরিত অভুক্ত শিশু মরছে পৃথিবীতে, তখন বিপুল অর্থব্যয়ে, সৌরশক্তি ব্যবহারে আলো জ্বলবে মঙ্গলে। যেখানে পুয়ের্তো রিকো আজও ডুবে ঘন অন্ধকারে, সেখানে ০.০৮ শতাংশ ধনকুবেরের জন্য নাকি পাঁচ তারা বসতি গড়ে উঠবে লালগ্রহে। ৯৯.৯২ শতাংশ নুন আনতে পান্তা ফুরনো মানুষের এই তেতে পুড়ে হেজে যাওয়া পৃথিবীর দুর্বিষহ দূষণ আর গরমে নাভিশ্বাস উঠছে। ধনী দেশের ধনকুবেরদের টাকার ঝনঝনানি নাকি আগামীর পৃথিবীকে যাবতীয় অঘটন, অনিষ্ট থেকে রক্ষার পাশুপত অনুসন্ধান— কোনটার জন্য জরুরি মঙ্গল অভিযান? উত্তর খুঁজলেন মৃন্ময় চন্দ।

 এলন মাস্ক— নামটা চেনা চেনা লাগছে। লাগারই কথা। টেসলার কর্ণধার, স্পেসএক্স-এর মালিক। ‘স্পেসএক্সে’র তৈরি করা ‘র্যা পটর’ ইঞ্জিনই ২০২২-এ মহাকাশ-ফেরি ‘স্টারশিপ’ আর ‘সুপার হেভিকে’ পৌঁছে দেবে মঙ্গলে। ‘সুপার হেভি’র সৌজন্যে অত্যাবশ্যকীয় নানা সরঞ্জাম প্রথম মঙ্গলের মাটি ছোঁবে। তারপর ২০২৪ সালে পৌঁছবে মানুষ। স্বনির্ভর, সমৃদ্ধশালী মাঙ্গলিক সভ্যতার গোড়াপত্তনে বদ্ধপরিকর মাস্ক হিসাব কষে দেখেছেন, মঙ্গলে ২০২৪-এ পদার্পণ করতে খরচ পড়বে মোটামুটি ৫ লক্ষ ডলার। সে খরচই নেমে আসবে ১ লক্ষ ডলারে মঙ্গলে ‘ডেলিপ্যাসেঞ্জারি’ শুরু হলে। প্রতি ১ টন মাল-বহনে খরচ পড়বে ১ লক্ষ ৪০ হাজার ডলার। দিনে দিনে নিম্নগামী হবে তাও। করোনার জ্বালায় অতিষ্ঠ ধনী দেশগুলোর মানুষরা তাদের ঘরদোর বিক্রি করে বনি’এমের ‘টেন থাউজেন্ড লাইট ইয়ারস’ গাইতে গাইতে সানন্দে পাড়ি জমাবেন মঙ্গলে। যাতায়াত খরচ আর একটু কমলে স্বয়ং মাস্কই পাড়ি জমাবেন মঙ্গলে।
মঙ্গলের তাপমান মোটামুটি শূন্যের ৭৫ ডিগ্রি নীচে, ধুলোর ঝড় বা ‘ডেভিলস স্টর্ম’ মঙ্গলে প্রাত্যহিক। একে প্রচণ্ড ঠান্ডা, অবিরাম ধুলোর ঝড়, ভয়ঙ্কর প্রতিকুকূল পরিবেশ, দিনরাত মুখে অক্সিজেন মাস্ক এঁটে থাকা, তারপর এক পা এগনোর চেষ্টা করলেই এক কিলোমিটার দূরে উড়ে গিয়ে ধপাস। কারণ মঙ্গলের অভিকর্ষ পৃথিবীর ০.৩৭৫ ভাগ মাত্র অর্থাৎ পৃথিবীর অভিকর্ষের তুলনায় ৬২ শতাংশ কম। পৃথিবীতে কারুর ওজন ১০০ কেজি হলে মঙ্গলে তার ওজন দাঁড়াবে সাকুল্যে ৩৮ কেজি। মঙ্গলের পাতলা ফিনফিনে বাতাসে ৯৬ শতাংশই কার্বন-ডাই অক্সাইড আর মাত্র ০.১ শতাংশ অক্সিজেন। উঁচুনিচু এবড়োখেবড়ো বন্ধুর পথ, দিগন্তবিস্তৃত নিষ্প্রাণ লাল মাটির হিমশীতল নিঃসঙ্গতাকে সঙ্গী করে মানুষ কতদিনই বা রক্তকরবীর মরা ব্যাঙের মতো পাথরের খাঁজে টিকে থাকার স্বপ্ন দেখবে? সঙ্গত কারণেই মঙ্গলে যাওয়ার একপিঠের ভাড়াই কেবল নেবেন মাস্ক। মঙ্গল থেকে সুস্থ শরীরে বেঁচে ফেরার সম্ভাবনা যেহেতু নেই বললেই চলে, তাই এলন মাস্কের ‘স্পেসএক্সের’ ফিরে আসার টিকিট ‘ফ্রি’।
মঙ্গলের মাটি লবণাক্ত, ভুসভুসে, পুষ্টিকর নানা খনিজ লবণে পূর্ণ। আলু, টমেটো, মুলো, ছোলা বা রাই মঙ্গল তোফা ফলবে। ‘দি ইন্টারন্যাশনাল পটেটো সেন্টার’ (আলুরও আন্তর্জাতিক সহায়তা কেন্দ্র) ‘মঙ্গলমুখী’ (চন্দ্রমুখী হলে, মঙ্গলমুখী নয় কেন!) আলু ফলানোর ব্যাপারে রীতিমতো আশাবাদী। কিউবস্যাট উপগ্রহে পেরুর মরুভূমির মাটিতে মঙ্গলের কৃত্রিম পরিবেশ তৈরি করে চোখ-ধাঁধানো আলুর ফলন মিলেছে। আন্তর্জাতিক আলু কেন্দ্র নিশ্চিত, মঙ্গলে আলুর বাম্পার ফলন শুধু সময়ের অপেক্ষা। মানুষ বসতি স্থাপন করার পর গাছদের সারের অভাব হবে না। লালগ্রহ রূপান্তরিত হবে প্রাণোচ্ছল সবুজগ্রহে।
সুরাপায়ীদের জন্য মঙ্গলে রয়েছে বিশেষ সুখবর। ‘আভা ওয়াইনারি’ জানাচ্ছে মঙ্গলের ‘মাইক্রোগ্রাভিটি’তে চমৎকার সুরা তৈরি করা যাবে। স্বাদে গন্ধে যা হবে অতুলনীয়। মাইক্রোগ্রাভিটিকে কাজে লাগিয়ে ‘ব্যারেট ইসোফেগাস’ ও তজ্জনিত প্রাণঘাতী ক্যান্সারকেও তুড়ি মেরে ভাগানো যাবে। কার্ডিয়াক ফাইব্রোসিস বা অ্যাওর্টিক ভালভ স্ক্লেরোসিসের মতো ডিজেনারেটিভ হার্ট ডিজিজকেও সারিয়ে ফেলা যাবে অক্লেশে। মঙ্গলে হেলথ ট্যুরিজমের হবে রমরমা। অত্যুৎকৃষ্ট সুরা মিললেও মঙ্গলে মিলবে না তৃষ্ণার জল। এক-বোতল পানীয় জল পৃথিবী থেকে মঙ্গলে বয়ে নিয়ে যেতে খরচ পড়বে ৪৩ হাজার ডলার। তেজস্ক্রিয় বিকিরণের দাপটে ক্যান্সারের সমস্যা মঙ্গলে সবসময়ই পৃথিবীর তুলনায় ১ শতাংশ বেশি। ধূমপায়ীদের ক্ষেত্রে সেই ক্যান্সারের সম্ভাবনাই মঙ্গলে ২০ শতাংশ বাড়বে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, ৪২০ কোটি বছর আগে পৃথিবীর মতোই সুজলা সুফলা ছিল মঙ্গল। বিধ্বংসী মহাজাগতিক ঝঞ্ঝায় মঙ্গলের চৌম্বকক্ষেত্রের হঠাৎই মৃত্যু-ঘণ্টা বাজে। চৌম্বকক্ষেত্রের এই সুরক্ষাচক্রই মঙ্গলকে যাবতীয় অমঙ্গল-অঘটন থেকে রক্ষা করত। চৌম্বকক্ষেত্রের অনুপস্থিতিতে সুবিধা হল সৌরঝড়ের। সৌরঝড়ের তাণ্ডবে মঙ্গল তার শান্ত-সবুজ প্রকৃতিকে হারিয়ে ক্রমশ হয়ে উঠল রুখা শুখা। বিষাক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাসে ভরে গেল মঙ্গলের চরাচর। তাপমাত্রা নেমে গেল মাইনাস ৭৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নীচে। তেজস্ক্রিয় সৌরঝড়ে পাততাড়ি গোটাতে বাধ্য হল প্রাণের ঝরনাধারা। যাক সে কথা, কম খরচে ‘মার্স ওয়ান’ নামে আরেকটি সংস্থার মঙ্গল ভ্রমণের বিজ্ঞাপনেও কিন্তু বিপুল সাড়া মিলেছিল। প্রথমে দু’হাজার জন ডাকাবুকো আবেদন করলেও বর্তমানে সংখ্যাটা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র একশোতে। মঙ্গল-যাত্রা আসলে অগস্ত্য যাত্রা বলে?
সর্বনেশে সাত-মিনিট ও পারসিভিয়ারেন্স
মহাকাশ বিজ্ঞানীদের ভাষায় ‘ইডিএল’— এন্ট্রি-ডিসেন্ট অ্যান্ড ল্যান্ডিং। ভয়-ত্রাস-আশঙ্কা-অনিশ্চয়তার প্রহর গোনা ৭ মিনিট। মঙ্গল যাত্রাপথে যাবতীয় দুর্ঘটনা বা অনিষ্ট এই সাত মিনিট সময়কালেই ঘটে থাকে। হয় মহাকাশযান চিরতরে হারিয়ে যাবে কালের কপোল-তলে অথবা রোভার হুমড়ি খেয়ে পড়ে মহানির্বাণ প্রাপ্ত হবে। পারসিভিয়ারেন্সের অবতরণের পূর্বমুহূর্তে ২৮টি সেন্সর প্রতিমুহূর্তের তাপমাত্রা, উত্তপ্ত গ্যাস আর বাতাসের গতিবেগ মেপেছে এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতলেছে পরবর্তী কর্মপন্থা। অবতরণের ব্রাহ্মমুহূর্তে তাপমাত্রা পৌঁছেছিল ১ হাজার ৩০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে। সর্বোচ্চ তাপ-নিরোধক জ্যাকেটে সর্বাঙ্গ মোড়া ছিল পারসিভিয়ারেন্সের।
৩০ জুলাই, ২০২০। অ্যাটলাস ফাইভের পিঠে চেপে ফ্লোরিডার কেপ ক্যানাভেরাল থেকে তীক্ষ্ণ কানফাটানো আওয়াজ আর সাদা ধোঁয়ার মেঘ-পাহাড় ডিঙিয়ে লালগ্রহ বা মঙ্গলের পথে পাড়ি জমাল রোভার পারসিভিয়ারেন্স। ২৯২.৫ মিলিয়ন মাইলস বা ৪৭ কোটি ৭ লক্ষ ৩৩ হাজার ১২০ কিলোমিটার পথ উজিয়ে ২০২১-এর ১৮ ফেব্রুয়ারি মাঝরাতে মঙ্গলের সীমানায় ঢুকে পড়ল পারসিভিয়ারেন্স। অবতরণের মুহূর্তে পারসিভিয়ারেন্সের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৯ হাজার ৫০০ কিমি। রেট্রোরকেট আর বিশালকায় প্যারাসুট ঝটাপট ডানা মেলল। গতিবেগ ধীরে ধীরে কমে এল। কোলে কাঁখে করে পারসিভিয়ারেন্সকে মঙ্গলের মাটিতে নামিয়ে দিল প্যারাসুট। রাত তখন ১২টা ৫৫ মিনিট, বৃহস্পতিবার। অবশ্য তার ১১ মিনিট আগেই মঙ্গলের মাটিতে শুভ পদার্পণ ঘটেছে পারসিভিয়ারেন্সের। পৃথিবীতে খবর পৌঁছেছে ১১ মিনিট বিলম্বে।
টানা ২০৩ দিন নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের প্রাণান্তকর যাত্রার শেষে লালমাটির দিগন্তবিস্তৃত নির্জন ঊষর প্রান্তর দু’হাত বাড়িয়ে আলিঙ্গন করল পারসিভিয়ারেন্সকে। চারিদিকে শুধুই মিঠে আলোর রক্তিম ঝরনাধারা। ১ হাজার ২৬ কেজির পারসিভিয়ারেন্সের রয়েছে ৬টি চাকা, সে আসলে একটি রোবোটিক জিওলজিস্ট। তার শরীরে রয়েছে মাল্টি মিশন রেডিওআইসোটোপ থার্মোইলেক্ট্রিক জেনারেটর (এমএমআরটিজি)। মাইনাস ৯০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রাতেও পারসিভিয়ারেন্সকে সজীব-সচল-কর্মক্ষম রাখবে এমএমআরটিজি। সাবধানে হাটি-হাটি পা পা করে পারসিভিয়ারেন্সকে সদাসর্বদা আগলে নিয়ে চলবে টেরাইন রিলেটিভ নেভিগেশন সিস্টেম। খেয়াল রাখবে অসাবধানে উঁচুনিচু পথে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাতে তার হাত-পা না ভাঙে। পারসিভিয়ারেন্স তার মাথাকে যেদিকে যেমন-খুশি ঘোরাতে বা নাড়াতে পারে। রিমোট সেন্সিংয়ের মাধ্যমে মাথার নড়াচড়া নিয়ন্ত্রিত হয়। মাথার সামনে বড় বড় গোল গোল চোখ— মাস্টক্যাম-জেড। দু’টি বিশাল হাই রেজোলিউশন জুম ক্যামেরা দুচোখ ভরে মঙ্গলের অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে উপভোগ করছে, আর অনবরত রঙিন ত্রিমাত্রিক ছবি পৃথিবীতে পাঠাচ্ছে। চোখের পাশেই রয়েছে আরেকটি লেজার পালসড ক্যামেরা—সুপারক্যাম। লেজারের অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে মঙ্গলের ছোট বড় অজস্র পাথরের চরিত্র বিশ্লেষণ করবে সে।
বিশাল সিরিঙ্গে রোবোটিক হাতের শেষপ্রান্তে পারসিভিয়ারেন্সের রয়েছে প্ল্যানেটরি ইনস্ট্রুমেন্ট ফর এক্স-রে লিথোকেমিস্ট্রি আর ‘শার্লক’ (স্ক্যানিং হ্যাবিটেবল এনভির্য়নমেন্ট উইথ রামন অ্যান্ড লুমিনেসেন্স ফর অর্গানিকস অ্যান্ড কেমিক্যালস)। শার্লক হোমসের মতোই, গোয়েন্দার মর্মভেদী দৃষ্টিতে আলট্রাভায়োলেট লেজার আর স্পেকট্রোমিটারের সাহায্যে লালগ্রহের রূপ-রস-গন্ধ-বর্ণের চুলচেরা বিশ্লেষণে করবে পারসিভিয়ারেন্স। খুঁজে ফিরবে পাথরের খাঁজে লেপটে থাকা কোটি কোটি বছর আগের অবলুপ্ত প্রাণ-স্পন্দন। শার্লকের সঙ্গী ওয়াটসন— ‘ওয়াইড অ্যাঙ্গল টোপোগ্রাফিক সেন্সর ফর অপারেশনস অ্যান্ড ই-ইঞ্জিনিয়ারিং। দু’জনে মিলে মঙ্গলের মাটি-পাথর ঢুঁড়ে সুলুকসন্ধান চালাবে কোনও অনাদি অনন্তে মানুষের মতো বুদ্ধিমান-বিচক্ষণ প্রাণীরা দাপটে রাজত্ব চালিয়েছে কি মঙ্গলের বুকে! দুটি যন্ত্রের বিশালকায় নামের আদ্যক্ষর মিলিয়েই শার্লক আর ওয়াটসনের জন্ম।
পারসিভিয়ারেন্সের বুকে লটকানো রেডার ‘রিমফ্যাক্স’। যা ১০ মিটার পাথরের গভীর থেকেও জলের ঠিকানা বাতলাবে। পেটের নীচে রয়েছে ‘মক্সি’। কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে ভেঙে যা সতত অক্সিজেনের জোগান দেবে। ভবিষ্যতে মানুষের পা পড়তেই পারে, তাই অক্সিজেনের ভাঁড়ার প্রস্তুত রাখা। মঙ্গলের রোজকার ঝড়-ঝঞ্ঝার পূর্বাভাসে পারসিভিয়ারেন্সের পেটের মধ্যে অতন্দ্র-প্রহরী ‘মেডা’। মাথায় বসানো সেন্সরের সাহায্যে অতর্কিত ‘আঁধি’র অগ্রিম খবর পেয়ে নিজেকে সুরক্ষিত রাখবে পারসিভিয়ারেন্স। ঝড়ের বিধ্বংসী আওয়াজ রেকর্ড করবে পেটের মধ্যের দু’টি সুপ্ত মাইক্রোফোনে।
ক্যাঙারুর মতো পেটের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে থাকা ১ কেজি ৮০০ গ্রামের লিলিপুট হেলিকপ্টার ‘ইনজেনুইটি’ নিজে থেকেই উড়ে এসকর্টের মতো পারসিভিয়ারেন্সের কণ্টকাকীর্ণ চলার পথকে সুগম করবে। পৃথিবীর বাইরে, ভিনগ্রহ মঙ্গলে এই প্রথম উড়বে হেলিকপ্টার। অধরা সাফল্যের প্রতিস্পর্ধী অভিজ্ঞানে রাইট ভাইদের চোখ থেকে তখন অলক্ষ্যে ঝরে পড়বে দু-ফোঁটা আনন্দাশ্রু। পারসিভিয়ারেন্সের প্রতিটি যন্ত্রই মহাকাশবিজ্ঞানে প্রথম ব্যবহৃত। অভূতপূর্ব, অতুলনীয় অসূর্যম্পশ্যা প্রযুক্তি প্রকৌশলের নৈপুণ্যে, সীমাহীন জ্ঞান-গরিমার কৌলীন্যে মানুষই যে জগৎশ্রেষ্ঠ— পারসিভিয়ারেন্সের সফল অবতরণে তা আরেকবার প্রমাণিত।
সাড়ে তিনশো কোটি বছর আগে বিরাট এক উল্কার রামধাক্কায় মঙ্গলের নিরক্ষীয় অঞ্চলের কাছে তৈরি হয়েছিল ৪৫ বর্গ কিমির জ্বালামুখ ‘জেজেরো ক্রেটার’। সেখানে কুলকুল করে বয়ে যেত তটিনী। প্রায় ৩৭০ কোটি বছর আগে বিরামহীন অগ্ন্যুৎপাতে মঙ্গলের আকাশে তৈরি হয়েছিল ঘনঘোর কাজলকালো মেঘ, সেই মেঘ থেকে বৃষ্টি, বৃষ্টি থেকে শস্যশ্যামলা মঙ্গল। নদী তৈরি করেছিল হ্রদ। উল্কার ধাক্কায় উপচে ওঠা জলের শুকনো অবসৃত ধারার পাশে মিলেছে চুনাপাথর— স্ট্রোমাটোলাইটস। প্রবাল প্রাচীরে সচরাচর যার দেখা মেলে। লালগ্রহের বহমান নদীর ফেলে যাওয়া পলির স্মৃতিচিহ্ন যেন হুবহু আজকের ইয়োলোস্টোন ন্যাশনাল পার্ক। তাই বিজ্ঞানীরা উদ্দাম আশাবাদী, মঙ্গলে প্রাণের অস্তিত্ব অবশ্যই ছিল। এক মাঙ্গলিক বর্ষ ৬৮৭ দিনে। পারসিভিয়ারেন্স জেজেরো ক্রেটারের ৬.৬ X ৭.৭ বর্গ কিমি জায়গা চষে ফেলে আঁতিপাঁতি অনুসন্ধান চালাবে বিলুপ্ত প্রাণের অবগুণ্ঠিত অহমিকার। তারপরেও কলজের জোর থাকলে পা বাড়াবে নিলি প্লেনামের দিকে। হৃত প্রাণের স্পন্দন সেখানেই মেলার সমূহ সম্ভাবনা। ৪৩টি টেস্ট টিউবের অর্ধেকে পারসিভিয়ারেন্স মাটি-বালি-কাঁকর থেকে ভরবে হেজে যাওয়া প্রাণের অফুরান চিহ্ন, বাকি অর্ধেক যত্ন করে সাজিয়ে রাখবে ‘জেজেরোর’ তীরে। ভবিষ্যৎ অনুসন্ধানের সুবিধার্থে। ২০২৬ থেকে ’৩১-এর মধ্যে জেজেরোর সংগৃহীত নমুনা ফিরে আসবে নাসায়। শুরু হবে পূর্বসূরি খোঁজার মাঙ্গলিক পালা।
এদিকে, ‘তিয়ানওয়েন-ওয়ান’— চীনের মঙ্গল অভিযান। গত ১৪ মার্চ মঙ্গলের মাটিতে নেমেছে রোভার ‘ঝুরং’। নাসার ‘কিউরিওসিটি’ বা ‘পারসিভিয়ারেন্স’-এর মতোই ছ’টি চাকা ঝুরংয়ের। ঝুরং মঙ্গলগ্রহের ভূতত্ত্ব আর মাটির খনিজ লবণের চরিত্র বিশ্লেষণ করবে। জল, অভিকর্ষজ ত্বরণ, বরফ, তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ আর আবহাওয়ার তত্ত্বতালাশও চালাবে। ঝুরংয়ের আয়ু ৯০ দিন। কিন্তু এর র্যা ডার পারসিভিয়ারেন্সের তুলনায় ১০ গুণ শক্তিশালী। মাটির ১০০ মিটার নীচে থেকেও জল বা বরফের হদিশ দিতে পারবে ঝুরং।
২.৭ বিলিয়ন ডলার অপচয়
গ্রেটা থুনবার্গ এমনটাই মনে করেন (ফ্রাইডেস ফর ফিউচার)। বিশ্ব উষ্ণায়নে ধ্বংসের মুখোমুখি পৃথ্বী আর মঙ্গলে বিকল্প বাসস্থান খোঁজার অলীক কুনাট্যে মেতেছে নাসা বা মার্কিন সরকার। ১ শতাংশ বিপুল ধনী মানুষ প্রমোদভ্রমণে যেতেই পারেন মঙ্গলে আর নুন আনতে পান্তা ফুরনো ৯৯ শতাংশ মানুষকে তেতেপুড়ে হেজে যাওয়া এই পৃথিবীতেই কেঁদেকঁকিয়ে দিনগুজরানো করতে হবে। মঙ্গলের ‘মাইক্রোগ্রাভিটি’ কি অগণিত নিরন্ন শিশুর মুখে অন্ন জোগাবে? সৌরশক্তি ব্যবহারে মঙ্গলে আলো জ্বললেও পুয়ের্তো রিকো ডুবে থাকবে অন্ধকারে! ১৯৭০-এ ‘অ্যাপোলো’র সফল অবতরণের পর জাম্বিয়ার এক সন্ন্যাসিনী সিস্টার মেরি জুকান্ডা নাসাকে একটি খোলা চিঠি লেখেন। খাদ্য বিনা, ওষুধ বিনা অগণিত শিশু যখন জন্মেই মারা যাচ্ছে, তখন চাঁদে কেলি করতে চন্দ্রযান পাঠানোর অর্থ কী? নাসার তৎকালীন বিজ্ঞান বিষয়ক সহযোগী অধিকর্তা ও অপারেশন পেপারচিপে’র প্রবীণ বিজ্ঞানী আর্নস্ট স্টুলিঙ্গার মর্মস্পর্শী ভাষায় ব্যক্ত করেছিলেন কেন ভুখা শিশুদের বাঁচানোর জন্যই আরও বেশি মঙ্গল বা চন্দ্রাভিযান জরুরি।
উপগ্রহ/মহাকাশযান/মঙ্গল-যান মহাশূন্যে পাড়ি জমিয়েছে বলেই জানা যাচ্ছে কোথায় কীভাবে কত জমি পতিত রয়েছে। উপগ্রহ বাতলে দিচ্ছে কখন বৃষ্টি আসবে, খরাই বা কখন শুখা মারবে। রোদ-জল-বৃষ্টিকে সুচারুভাবে ব্যবহার করে যে ফসল সারা পৃথিবীতে ফলছে তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট। তথাপি মানুষ নিরন্ন স্রেফ মনুষ্যকৃত হানাহানি আর নিদারুণ স্বার্থপরতায়। জলসেচ, শস্যাবর্তন, সার-কীটনাশকের নিপুণ ব্যবহার, জলবায়ুর আগাম সতর্কবার্তায় রাশি রাশি ভারা ভারা সোনার ফসলে ধরিত্রী যে অকৃপণ, তা শুধুমাত্র চন্দ্রাভিযান বা মঙ্গলাভিযানের পারম্পর্যেই।
‘এ পৃথিবীকে এ শিশুর বাসযোগ্য’ করার জন্যই আরও বেশি মহাকাশ অভিযান প্রয়োজন। একটি উদাহরণে বিষয়টা পরিষ্কার হবে— নাসার ঈর্ষণীয় সাফল্য ও শ্লাঘার উদ্ভাবন হাবেল টেলিস্কোপ হঠাৎই ঝাপসা ছবি পাঠাতে শুরু করল। শুরু হল দিনরাত এককরে কার্যকারণ খোঁজা। ১৯৯৩-তে ত্রুটি শুধরনো গেল। সেই গবেষণার সূত্রেই আবিষ্কৃত হল একটি অ্যালগরিদম। এক্স-রের মাধ্যমে (ম্যামোগ্রাম) প্রাথমিক পর্যায়ের স্তন ক্যান্সার নির্ধারণে আজ সেই অ্যালগরিদম অপরিহার্য। বহু মানুষের প্রাণ বাঁচাচ্ছে মহাকাশ গবেষণার একটি তুচ্ছ, পড়ে পাওয়া উপজাত।
যাক সে কথা, প্রতি ২৬ মাস অন্তর মঙ্গল আর পৃথিবী সবচেয়ে কাছাকাছি আসে। আর সেইসময় হিসেব করে পৃথিবী থেকে রওনা দিলে ৬ মাসে মঙ্গলে পৌঁছনো সম্ভব। কিন্তু কেন ২৭০ কোটি টাকা খরচ করে মঙ্গল গমন? যদিও বছরে ৭০০ কোটি টাকা পটেটো চিপস খেয়েই উড়িয়ে দেন আমেরিকানরা। মঙ্গল একসময় সমুদ্র-নদী-নালা-হ্রদ-উপহ্রদে টইটম্বুর ছিল। মঙ্গলের মেরু অঞ্চলে ঢাকা-চাপা বরফে আজও জল বিদ্যমান। মিথেন গ্যাসের অস্তিত্বের প্রমাণও মিলেছে। গ্রিনহাউস গ্যাস থাকার অর্থ মঙ্গলের তাপমাত্রা কোনও এক সময় পৃথিবীর মতোই মনোরম ছিল। আণুবীক্ষণিক জীবের জীবাশ্ম যেমন মিলেছে মঙ্গলে, তেমনই বৃহৎ বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্বের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
প্রকৃতির রুদ্র-রোষে দৈত্যাকার ডাইনোসররা বিলুপ্ত হয়ে গেলে চুনোপুঁটি মানুষ তো কোন ছার! বিজ্ঞানীদের অনুমান, ৪৫০ কোটি বছর আগে বিরাট এক মহাজাগতিক গ্রহাণুর প্রলয়ঙ্কর ধাক্কায় মঙ্গলের প্রাণ চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। ডাইনোসরদের বিলুপ্তির কারণও প্রকাণ্ড এক উল্কার অতর্কিত হানাদারী। মানুষ এবং পৃথিবীর পরিণতিও যাতে একইরকম দুর্ভাগ্য-তাড়িত না হয়, তার জন্যই মঙ্গলে প্রাণের অনুসন্ধান জরুরি। কীভাবে পৃথিবীর নিকটাত্মীয় মঙ্গল ধ্বংসস্তূপে পরিণত হল জানতে পারলেই মিলবে পৃথিবীকে রক্ষা করার বিশল্যকরণী। পৃথিবীর মানুষের বেঁচেবর্তে থাকাকে সহজ-সুন্দর-সাবলীল-নিরুদ্বিগ্ন করতেই তাই নিরন্তর মঙ্গল অভিযান জরুরি।
 ছবি সৌজন্যে: জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরি, নাসা
 গ্রাফিক্স : সোমনাথ পাল
 সহযোগিতায় : উজ্জ্বল দাস 

23rd     May,   2021
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা