বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
 

নতুন স্ট্রেইনে ভ্যাকসিন কতটা কার্যকরী?

আমরা যেমন বেঁচে থাকার জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করি, প্রয়োজন মতো নিজেদের বদলাই, ভাইরাসও ঠিক তাই। সেও বেঁচে থাকতে চায়। বংশবৃদ্ধি করতে চায়। এদিকে আমরা তাকে মারার জন্য লাগাতার চেষ্টা চালাচ্ছি। তাই দু’জনের মধ্যে শুরু হয়েছে লড়াই। গোড়াতেই বলে রাখি, রোগটার নাম করোনা ভাইরাস বা কোভিড-নাইন্টিন। আর ভাইরাসটার নাম ‘সার্স কোভ-টু।’ শুনি, অনেকেই বলেন ভাইরাসটার নাম করোনা। তা কিন্তু নয়। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ভাইরাসটা অত্যন্ত চালাক প্রজাতির। বিজ্ঞানীদের ধাঁধা লাগাতে নিরন্তর নিজেকে বদলে চলেছে। পরিবর্তন ঘটাচ্ছে জিনের। নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সেটা ও করবেই। আরএনএ ভাইরাসের চরিত্রই তাই। 
তবে আমাদের দেখতে হবে এটি ঘাতক কি না। অর্থাৎ হয়তো মিউটেশন হওয়া ভাইরাস দ্রুত সংক্রমণে সক্ষম, কিন্তু সেই হারে মানুষকে মেরে ফেলছে কি? সে ইউকে (ব্রিটেন) ভেরিয়েন্টসই হোক বা ব্রাজিল কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকার। এখানে একটি বিষয় বলে রাখতে চাই, তা হল, এই যে ‘দেশের নাম’ করে বিভিন্ন ভেরিয়েন্টকে চিহ্নিত করা হচ্ছে, এটা ঠিক নয়। এতে ওই দেশ তথা সেই দেশের নাগরিকদের সম্পর্কে একটা ছুঁৎমার্গের সমস্যা তৈরি হয়। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরকেও বিষয়টি বলা হয়েছে। কিন্তু মুশকিল হল, বৈজ্ঞানিক নাম দিয়ে বললে সহজে বোধগম্য হয় না। তাই যে দেশে ওই নতুন চরিত্রের ভাইরাসের সন্ধান মিলল, তার নামেই ডাকা হচ্ছে। আর যাইহোক, ভাইরাস কোনও দেশ, জাতি, ধর্ম, বর্ণ দেখে বেছে বেছে আক্রমণ করে না। যেখানেই ও নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার সুযোগ পাবে, সেখানেই হামলা করবে। তবে যে ভেরিয়েন্টসই হোক, তা দ্রুত ছড়ালেই যে ভয়ঙ্কর হবে, তার কোনও মানে নেই। কারণ, ভাইরাস নিজে বাঁচতে পারে না। তার দরকার মানব কোষ। তাই যাকে ধরে ভাইরাসটা ছড়াবে, সেই হোস্টকেই যদি মেরে ফেলে তাহলে বাঁচবে কীভাবে? মৃতদেহ তো হাঁচবে, কাশবে না। আর তা না হলেই ভাইরাসেরও নিজেকে ছড়ানোর ক্ষমতা থাকবে না। তবে বয়স্কদের যদি হামলা করে, যাঁদের কোমর্বিডিটি আছে, তাঁদের তো সমস্যা হবেই। সেটা নতুন ভেরিয়েন্টের সার্স কোভ-টু হোক বা অন্য যে কোনও ভাইরাস। এখনও পর্যন্ত দেখা গিয়েছে, নতুন স্ট্রেইনের ভাইরাস সংক্রমণ ছড়াতে পারে। কিন্তু নট টু কিল। সেই হারে মানুষকে মেরে ফেলছে না। এবার লক্ষণীয় ভ্যাকসিনে কাজ হচ্ছে কি না। কারণ, জিনের একাধিকবার পরিবর্তন ঘটছে। নিজেকে কপি করছে। আর তা করতে গিয়েই অনেক সময় ভুল বা এরর হয়। এই ভুলটাই হল মিউটেশন। সেটা যখন কারও শরীরে গেল, সেখানে সে মিউটেট করল। 
ঠিক যেমনটা করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কারের লক্ষ্যে গোড়ার দিকে লক্ষ করা গিয়েছিল। ২০২০ সালে যখন ভারতে প্রথম সংক্রমণের খবর এল, তখন প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল ভাইরাসকে কব্জা করা বা ধরা। সেই পর্বটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ভাইরাসটাকে না কব্জা করতে পারলে ভ্যাকসিন তৈরিও সম্ভব নয়। জানুয়ারি মাসের শেষে চীনের উহান থেকে কেরলে আসা ভারতীয় নাগরিকের মধ্যে প্রথম করোনা রোগে আক্রান্ত হওয়ার খবর এল বটে, কিন্তু করোনার ভাইরাস ‘সার্স কোভ-টু’কে ধরা গেল না। 
প্রথম ধরা সম্ভব হল ইতালি থেকে আসা ইতালিয়ান এবং ভারতে সংক্রামিত তাঁদের আত্মীয় পরিজনের থেকে। সঙ্গে আগ্রায় খবর এল সংক্রমণের। সেখান থেকেও ভাইরাসটা পাওয়া গেল। সেই হিসেবে প্রথম করোনার ভাইরাস সার্স কোভ-টু পরীক্ষার জন্য মিলল মার্চ মাসে। পাঠানো হল মহারাষ্ট্রের পুনেয়। আইসিএমআরের প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজিতে। সার্স কোভ-টুর ১২টা পজিটিভ স্পেসিমেন নিয়ে পরীক্ষা হল। এর মধ্যে আটটা ইতালিয়ান এবং তাঁদের আত্মীয়দের। বাকি চারটে আগ্রা এবং ইতালি থেকে আসা তাঁদের পরিচিত দিল্লির বাসিন্দাদের। এক মাসের কিছু সময়ে চলল পরীক্ষা। জীবন্ত ভাইরাসকে নিয়ে চলল কালচার। তারই একটি অংশ ভ্যাকসিন তৈরির জন্য ‘ভারত বায়োটেক’কে দিল আইসিএমআর। ভা‌ইরাল ট্রান্সপোর্ট মিডিয়ায় জীবন্ত ভাইরাস ওদের দেওয়া হয়েছে। ভারত বায়োটেক সেটাকে নিষ্ক্রিয় বা ইনঅ্যাক্টিভ করেছে। তারপর সেটার থেকে তৈরি হয়েছে ভ্যাকসিন। এখন ভারতে তিনটি ভ্যাকসিন দেওয়ার ছাড়পত্র মিলেছে। অন্য বিদেশি টিকা প্রস্তুতকারকদেরও এদেশে আসার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। এখন প্রশ্ন হল, ভারতে এখন যে কোভ্যাকসিন ও কোভিশিল্ড নামে যে দু’টি ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু হয়ে গিয়েছে, তা নতুন প্রজাতির ভাইরাসটাকে আটকাতে পারছে কি না। রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি টিকাও যে আসছে, তারই বা কী শক্তি? এখনও পর্যন্ত দেখা গিয়েছে, ভ্যাকসিন কাজ করছে। ভাইরাসটার চরিত্র বুঝতে বা নতুন প্রজাতির ভাইরাসের উৎস কী, তা জানতে জিনোম সিকোয়েন্স করা হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের কল্যাণীতে থাকা কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্থা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োমেডিক্যাল জিনোমিক্স সহ দেশের অত্যাধুনিক ১০টি গবেষণাগারে এই পরীক্ষা হচ্ছে। তাতে  দেখা গিয়েছে, ভাইরাসের যে চরিত্র বদল হয়েছে, তা সামান্য চিন্তার বিষয়। যাকে বলে ভেরিয়েন্টস অব কনসার্ন। 
এখনও পর্যন্ত পরীক্ষাগারে ১৩ হাজার ৬১৪টি সম্পূর্ণ জিন বিন্যাসের  তথ্য প্রক্রিয়াজাত করা হয়েছে। এর মধ্যে থেকে পরীক্ষার সময় ১ হাজার ১৮৯টি নমুনায় ভারতে সার্স কোভিড-টুর বিপজ্জনক ভেরিয়েন্টস পাওয়া গিয়েছে। এর মধ্যে ইউকে ভেরিয়েন্টের ১ হাজার ১০৯ নমুনা, দক্ষিণ আফ্রিকা ভেরিয়েন্টের ৭৯টি নমুনা এবং ব্রাজিল ভেরিয়েন্টের ১টি নমুনা পাওয়া গিয়েছে। ভারত ছাড়াও বেশ কয়েকটি দেশে ভাইরাসের বেশ কয়েকবার মিউটেশন হয়েছে।  
এর মধ্যে ইউকে (১৭টি মিউটেশন), ব্রাজিল (১৭টি মিউটেশন) এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় (১২টি মিউটেশন) ভেরিয়েন্ট পাওয়া গিয়েছে। এই ভাইরাস প্রজাতিগুলির সংক্রমণের ক্ষমতা অনেক বেশি। ব্রিটেনের ভেরিয়েন্ট বেশিরভাগই ইংল্যান্ড সহ গোটা ইউরোপে পাওয়া গিয়েছে। এশিয়া ও আমেরিকাতেও ছড়িয়েছে। দু’বার  মিউটেশন  হওয়া একটি অন্য ভেরিয়েন্ট  অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড, নামিবিয়া, নিউজিল্যান্ড, সিঙ্গাপুরেও পাওয়া গিয়েছে। আমাদের এখানে করোনার যে আরটি-পিসিআর টেস্ট হচ্ছে, সেখানে এই মিউটেন্ট ধরা পড়ছে। কারণ, ভারতে যে পরীক্ষা হচ্ছে, তা দু’টিরও বেশি জিন চিহ্নিত করতে সক্ষম। আর এই সক্ষমতা থাকলে ভাইরাসকেও কাবু করার রাস্তা খুঁজে বের করা যায়। তবে ভাইরাসের জিনের যত পরিবর্তনই হোক, যে চেহারাই নিক না কেন, তা মাস্কে আটকানো সম্ভব। একইসঙ্গে ভ্যাকসিনেও। জাপানে যে ভাইরাস পাওয়া গিয়েছে, তার ফাইলোজেনেটিক অ্যানালিসিস করে দেখা হয়েছে। যে ব্যক্তি টিকা নিয়েছেন, তাঁর মধ্যে ইমিউনিটি কতটা তৈরি হয়েছে, তার নমুনা সংগ্রহ করেই ভাইরাসের ওপর পরীক্ষা করা হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, ভ্যাকসিন কাজ করছে। এদেশেও দেখা যাচ্ছে, ডবল মিউট্যান্ট স্ট্রেইনের বিরুদ্ধে ভারতীয় ভ্যাকসিন কার্যকরী। তাই অহেতুক প্যানিক না ছড়িয়ে আর ঘাবড়ে না গিয়ে ভাইরাস মোকাবিলার যে উপায়, তা কার্যকর করুন। সুস্থ থাকবেন। জানেন তো, করোনার ল্যাতিন শব্দের মানে হল ‘মুকুট’। ভাইরাসের ছবির আকৃতি থেকেই এই নাম। তাই করোনার ভাইরাস যতই মুকুট পরে আপনার চারপাশে ঘুরে বেড়াক, আপনি সতর্ক থাকলে সে কিছুতেই আপনাকে কাবু করতে পারবে না।

25th     April,   2021
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা