বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
 

সত্যধর্মের দোলোৎসব
সুখেন বিশ্বাস

ফাগুনের দোলপূর্ণিমা। গাছে গাছে নতুন পাতা। শাখায় শাখায় শিমুল-পলাশের রোশনাই। ফুলে-ফলে ফাগুন যেন এক নতুন পৃথিবী। দোলের আবিরে একদিকে রঙিন বাংলার আকাশ-বাতাস, অন্যদিকে ডালিমতলা, হিমসাগর আর বাউল-ফকিরদের আখড়া। কে আসেননি এই মেলায়? একাধিকবার এসেছেন স্বয়ং লালন ফকির। হাতে একতারা, তালি দেওয়া জোব্বা পরে ‘মনের মানুষ’-এর খোঁজ করেছেন তিনি। জনশ্রুতি আছে, লালন এই মেলায় এসে আসর জমাতেন। হিমসাগরের উত্তর দিকে সেই যুগেই আখড়া বসিয়েছিলেন তিনি। মেলার দিনগুলিতে গানবাজনার বিরাম থাকত না। সঙ্গে চলত আধ্যাত্মিক আলোচনা। লালনের আখড়ার জায়গাকে চিহ্নিত করে কল্যাণী পুরসভা তাঁর একটি পূর্ণাবয়ব মূর্তি তৈরি করেছে। সেই মূর্তি ইতিহাসকে মনে করায়, নস্টালজিয়ায় মনকে ভুলিয়ে দেয় এক নিমেষে। তবে, এবারের ‘নিউ নর্মাল’ দোলে এই মেলার উপর জারি হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। দোলপূর্ণিমার পুজো রীতি মেনে অনুষ্ঠিত হলেও করোনার বাড়বাড়ন্ত দেখে মেলা নৈব নৈব চঃ।   
বাড়ির কাছেই আরশিনগর, সতীমায়ের মেলা। ধর্মবিশ্বাসী মানুষ নিজেকে খুঁজে বেড়ায় এই মেলায়। আর মনে মনে বলে—
‘ডালিম গাছে বাঁধো ঢিল,
বাঁধো মাটির ঘোড়া,
ওরে মন! মন রে!
তোর ইচ্ছে বাঁধনহারা।’
হিন্দু, মুসলিম বা খ্রিস্টান নয়— সতীমায়ের মেলা কর্তাভজা তথা সাধারণ মানুষের মেলা। এই সম্প্রদায়ের কর্তা হলেন স্বয়ং ঈশ্বরের প্রতিনিধি। তাঁকে ভজনা করলেই ঈশ্বরের ভজনা করা হয়। এখানে গুরুরা মহাশয়, শিষ্যরা বরাতি নামে পরিচিত। কর্তাভজাদের মূলমন্ত্র গুরুসত্য। কোনও প্রতিশ্রুতি নয়, কোনও রাজনৈতিক দলের সভা নয়, অলৌকিক কিছু থাকুক বা না থাকুক এখানে মানুষ আসে মনের টানে। ‘এ ভাবের মানুষ কোথা থেকে এল।/ এর নাইকো রোষ, সদাই তোষ...।’ বাউল  নয়, এ গান দেহতত্ত্বের। মেলায় আসা বাউল-ফকিরদের গাওয়া এ গান ভাবের গীতি। রং খেলার পাশাপাশি মেলায় আসা কর্তাভজার দল হঠাৎ হঠাৎই মুখরিত হয় ‘জয় সতীমা-র জয়’ ধ্বনিতে। 
কর্তাভজা ধর্মসম্প্রদায়ের আকর গ্রন্থ ‘ভাবের গীত’। সতীমা-পুত্র দুলালচাঁদ (রামদুলাল) এটি লিখেছিলেন। কবি নবীনচন্দ্র সেন এই গান শুনে ‘ঘোষপাড়া মেলা’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘উহা কর্তাভজাদের একমাত্র ধর্মশাস্ত্র বা বেদ। এই অপরাহ্ণ বা সন্ধ্যায় আমি যেন ইহলোকে ছিলাম না। আমি এমন মধুর প্রাণস্পর্শী কীর্তন আর কখনো শুনি নাই। সমস্ত রাত্রি যেন স্বপ্নেও আমি সেই কীর্তন শুনিতেছিলাম।’
দুলালচাঁদের সময়েই কর্তাভজা সম্প্রদায়ের নাম দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। বাংলার অনেক মনীষীই সেইসময় তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। আলেকজান্ডার ডাফসহ উইলিয়ম কেরি, মার্শম্যান প্রমুখ। স্বয়ং রামমোহনও দেখা করেছিলেন। পঞ্চানন অধিকারীর লেখা পুঁথিতে তাঁর আগমনের কথা লেখা আছে এইভাবে—
‘রাজা রামমোহন রায় যেতেন তাঁর পাশ
অমৃত রস পান করি মিটাইতে আশ
অনেকেই সাহেব তিনি সাথে লয়ে যান
অনেকেই লন আশ্রয় করি প্রণিধান।’
ঘোষপাড়ায় ডাফ সাহেবের স্কুল তৈরির কথাও লেখা আছে ওই পুঁথিতে। ভূকৈলাসের জমিদার জয়নারায়ণ ঘোষাল ছাড়াও প্রসিদ্ধ গণিতজ্ঞ অধ্যাপক গৌরীশঙ্কর দে কর্তাভজা সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন। কলকাতাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের বহু অভিজাত পরিবারে আজও সতীমার-ঘটে নিত্য পুজো হয়। সতীমায়ের উত্তরসূরি ভাস্বতী পাল জানালেন, দেশবিদেশে তাঁদের শিষ্য সংখ্যা দশ লক্ষেরও বেশি। তার মধ্যে মুসলিম শিষ্য লাখখানেক হবে। সম্প্রতি শিষ্যদের মিলিত প্রচেষ্টায় তৈরি হয়েছে ‘ভক্ত সম্মেলন কমিটি’ নামে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ। সেখানে ভাবের গীত নিয়ে নিত্য আলোচনা হয়। 
১৮৯৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার শিকাগোতে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বধর্ম সম্মেলন। সেখানে দুলালচাঁদ আমন্ত্রিত হয়েছিলেন ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য। তার আগেই অবশ্য তিনি দেহত্যাগ করেন। সে খবর বিশ্বধর্ম সম্মেলন কর্তৃপক্ষের জানা ছিল না। সেইসময় কর্তাভজা সম্প্রদায়ের কোনও ডাকসাইটে পুরুষ প্রতিনিধি না থাকায় শিকাগোতে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তার পরের ঘটনা তো ইতিহাস। আমন্ত্রিত ছিলেন না, তবুও সেই সম্মেলনে বক্তৃতা দিয়ে বিশ্বজয় করেছিলেন স্বয়ং বিবেকানন্দ। তবে আমেরিকা থেকে ১৮৯৩ সালের ১৭ এপ্রিল দুলালচাঁদকে পাঠানো চিঠিটি আজও তাঁর উত্তরসূরিদের কাছে সংরক্ষিত আছে।
সরস্বতী দেবীই ফাগুনের দোলপূর্ণিমায় গুরুপুজোর আয়োজন করেন। সেই থেকেই ঘোষপাড়ায় শুরু হয় দোলমেলা। সতীমায়ের মেলা নিয়ে রবীন্দ্রনাথেরও বেশ আগ্রহ ছিল। সব শুনে বিষয়টা নিয়ে তিনি নবীনচন্দ্রকে একটা লেখা দিতে বলেছিলেন। ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণও সত্যধর্মের টানে এই মেলায় এসেছিলেন, এমনই দাবি সতীমায়ের অষ্টম উত্তরসূরি সুবীরকুমার পালের।
একসময় লক্ষ লক্ষ মানুষ আসতেন এখানে। এক মাস ধরে মেলা চলত। এখন সেটা কমে সাত দিনে ঠেকেছে। এই মেলা আউল-বাউলের মেলা নামেও পরিচিত। আউলচাঁদ যেহেতু বাইশ শিষ্যকে দীক্ষা দিয়েছিলেন, তাই এই মেলা বাইশ ফকিরের মেলা নামেও পরিচিত। কর্তাভজার দল এই মেলায় এসে গেয়ে থাকে—
‘কার বা খাঁচা, কার বা পাখি
কারে আপন কারে বা পর দেখি
কার জন্যে বা ঝুরে আঁখি
পাখি আমারে মজাতে চায়।’
দু’শো বছরেরও বেশি সময় ধরে কল্যাণীর ঘোষপাড়ায় কর্তাভজা সম্প্রদায়ের মহোৎসব হয়ে আসছে। ইতিহাস বলছে, এক সময় এই জায়গাটি ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। বাঘ, হাতি, শেয়ালের বেশ উৎপাত ছিল এখানে। সেই সময়ে নদিয়ার চাকদহ থেকে এখানে এসে বসবাস শুরু করেছিলেন রামশরণ পাল ও তাঁর স্ত্রী সরস্বতী পাল। হঠাৎই তাঁরা একদিন জানতে পারেন বাড়ির দক্ষিণে অবস্থিত হিমসাগর পুকুরপাড়ে অচেনা এক ফকির অলৌকিক কাণ্ড দেখাচ্ছেন। তাঁর অলৌকিক ক্ষমতাবলেই পুকুরপাড়ের আমগাছের আম এত সুস্বাদু হয়েছিল। কথিত, পুকুরের নামানুসারে তিনি ওই আমের নামকরণ করেছিলেন ‘হিমসাগর’। খোঁজ নিয়ে পাল দম্পতি জানতে পারেন, ওই বাউল-ফকিরের আসল নাম ছিল পূর্ণচন্দ্র। উলা বীরনগরের পানের বরজ থেকে তাঁকে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন পানচাষি মহাদেব বারুই। বাড়িতে এনে লালনপালনের পাশাপাশি বিভিন্ন বিদ্যায় তাঁকে পারদর্শী করিয়েছিলেন মহাদেব। তাঁকে সংস্কৃত শেখানো হয়েছিল সেইসময়ের বিখ্যাত বৈষ্ণবাচার্য হরিহরের কাছে। অতঃপর বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে পূর্ণচন্দ্র বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানার্জন করেন। সিদ্ধিলাভ করার পর তাঁর নাম হয় আউলচাঁদ, কেউ কেউ বলেন ফকিরচাঁদ।
আউলচাঁদকে কর্তাভজা সম্প্রদায়ের মানুষজন আজও শ্রীচৈতন্যদেবের অবতার হিসেবে মানে। তাঁদের বিশ্বাস, সংসারী মানুষদের বৈরাগ্য শেখাতে স্বয়ং শ্রীচৈতন্যদেব ফকির আউলচাঁদের বেশে এই ধরাধামে আবির্ভূত হয়েছিলেন। বহু জায়গা ঘুরে তিনি শেষপর্যন্ত ঘোষপাড়ায় এসেছিলেন। পোশাক-আশাক, চালচলন, কথাবার্তা যথাযথ না হওয়ায় স্থানীয় বাসিন্দারা প্রথম প্রথম পাগল ভেবে তাঁকে উত্যক্ত করত। কিন্তু পাল দম্পতি অলৌকিক কর্মকাণ্ড দেখে তাঁকে নিজেদের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন। সত্যধর্মের প্রচারের জন্যেই আউলচাঁদ একসময় নদীপথে ত্রিবেণী থেকে কল্যাণীর ঘোষপাড়ায় এসেছিলেন। জনশ্রুতি আছে, সেইসময় প্রকৃতিতে দুর্যোগ থাকায় কোনও মাঝি তাঁকে নিয়ে নদী পারাপারে রাজি হননি। উপায় না দেখে তিনি জহ্নমুনির মতো মন্ত্রবলে জল শুষে গঙ্গাপথে হেঁটে এসেছিলেন। 
আউলচাঁদের মতো রামশরণও জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে শিষ্যত্ব দিয়েছিলেন। মধ্যযুগীয় ভাবনা ও ব্রাহ্মণ্যবাদকে অস্বীকার করে নতুন ধর্ম প্রচার করা সে যুগে সহজ ছিল না। মূর্তিপুজো না করে ওই যুগে গুরুপুজো করাটা যেমন চাপের ছিল, তেমনই ছিল সকল ধর্মকে সত্য ভেবে স্থান দেওয়া। ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ উনিশ শতকে বলেছিলেন, ‘যত মত তত পথ’। তাঁর অনেক আগেই বিভিন্ন মতের একাধিক পথের সন্ধান দিয়েছিলেন রামশরণ। নবীনচন্দ্রের মতে, ‘তিনি সামান্য মানুষ ছিলেন না। ...তিনি বুঝাইয়াছিলেন যে, সকল ধর্ম সকল আচার সত্য, এমন উদার মত এক ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভিন্ন অন্য কোন ধর্ম সংস্থাপক প্রচার করেন নাই।’ 
জানা গিয়েছে, দীক্ষা নেওয়ার আগে রামশরণের স্ত্রী সরস্বতী দেবী আউলচাঁদকে বলেছিলেন—
‘যে ধনে হইয়া ধনী, মনিরে মানো না মনি,
তাহারই খানিক আমি মাগি নত শিরে।’
শিষ্যত্ব দেওয়ার আগে সরস্বতী দেবীর মন পরীক্ষার জন্য মোহরের লোভ দেখিয়েছিলেন আউলচাঁদ। কিন্তু সরস্বতী দেবীর ওই উত্তরে খুশি হয়েই তাঁকে ঐশ্বরিক ক্ষমতা দিয়েছিলেন আউলচাঁদ। সেই ক্ষমতাবলেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন সতীমা। যেন জীবন্ত কিংবদন্তি। ইতিহাস বলছে, একবার সরস্বতী দেবী খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। হিমসাগরের জল ও ডালিমতলার মাটি তাঁর গায়ে লাগিয়ে বাঁচিয়ে তুলেছিলেন আউলচাঁদ। সেই থেকেই হিমসাগরের জল, ডালিমতলার মাটি এত পবিত্র। আজও কর্তাভজা সম্প্রদায়ের মানুষজন ঘোষপাড়ার মেলায় এসে হিমসাগরের জলে মনস্কামনা করে পয়সা ফেলে স্নান করে। ডালিমতলার মাটি শরীরে লাগায়। ডালিম গাছের ডালে লাল সুতো দিয়ে মাটির ঘোড়া বাঁধে। মানত থাকলে হিমসাগরে স্নান সেরে দণ্ডি কাটতে কাটতে ডালিমতলায় আসার রীতি এখনও বিদ্যমান। কর্তাভজাদের বিশ্বাস, ডালিম গাছটি কল্পতরু। এই গাছের নীচে দাঁড়িয়ে যে যা মনস্কামনা করে সে সেটাই লাভ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গাছটি ধ্বংস করার চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু সম্ভব হয়নি। ২০০০ সালের বন্যায় আশপাশের অনেক গাছ নষ্ট হলেও ডালিম গাছটি এখনও অক্ষত আছে। গাছটির মাহাত্ম্য এইরকম—
‘ঘোষপাড়া মহাতীর্থ নিত্যদরশন
ডালিম গাছের তলা পবিত্র মহান।’
জনশ্রুতি আছে, অলৌকিক ক্ষমতাবলে বন্ধ্যা নারীকে সন্তান দান করার বিষয়টি সতীমাকে রাতারাতি বিখ্যাত করেছিল। তা ছাড়া বোবাকে বাক্‌দান, অন্ধকে দৃষ্টিদান এসব বিষয় তো ছিলই। আউলচাঁদের পরে দুলালচাঁদই চৈতন্যদেবের অবতার এই বিশ্বাস বুকে নিয়ে কর্তাভজা সম্প্রদায়ের মানুষরা সতীমাকে বলত ‘শচীমাতা’। কেউ কেউ আবার ডাকত ‘কর্তা মা’ নামে। সেই সময় একটি কথা সমাজে প্রচলিত ছিল ‘যার কেউ নেই, তার আছে সতীমা’। ‘ভক্তদের অধিকাংশই দরিদ্র ও নিঃস্ব কৃষি সমাজের মানুষ। তারা সমাজ জীবনে অন্ত্যজ, অর্থনীতিতে নিঃস্ব। সম্ভবত বাঁচার আশাতেই তারা সতীমার উপর নির্ভর করেছিল।’ পশ্চিমবঙ্গ (২৯ জুন ১৯৭৩) পত্রিকায় লেখা এই কথাগুলি বলে দিচ্ছে সেই সময়ের মানুষজন কতটা নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল সতীমায়ের উপর।   
একসময় সতীমা দৈববাণী পেয়ে অকালে (বৈশাখী কৃষ্ণপক্ষের সপ্তমী তিথি) রথযাত্রার সূচনা করলে নদিয়ার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র স্বয়ং তা বন্ধ করার জন্য ঘোষপাড়ায় ছুটে এসেছিলেন। ‘কিন্তু সেদিন সতীমার অলৌকিক ক্ষমতাবলে রথ আপনাআপনিই চলা শুরু করেছিল। সকলে তো হতবাক। কুর্নিশ জানিয়ে সেদিন সতীমাকে মহারাজ কয়েকশো একর জমি দান করেছিলেন,’ এমনই বললেন ডালিমতলার পুরোহিত স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়। এখানে রথযাত্রা, দুর্গাপুজো, রাস উৎসব অনুষ্ঠিত হলেও সেরা উৎসব দোলমেলা। দোলের আগের দিন এখানে চাঁচর উৎসব হয়। দোলের দিন ভোরে দেবদোল। প্রথমে রাসমঞ্চে রাধাকৃষ্ণকে আবির দেওয়া হয়। পরে ডালিমতলা, সতীমায়ের সমাধিতে। তারপর শিষ্যরা গুরু-পায়ে আবির দেয়, গুরুরা শিষ্যদের কপালে আবিরের তিলক কাটেন।
ইতিহাস বলছে, দীক্ষা দিয়ে রামশরণ ও সরস্বতী দেবীকে আউলচাঁদ বলেছিলেন, ‘সত্যই সার, সত্যই ধর্ম, সদা সত্যের অনুসরণ করবে। যত দিন সত্যকে আশ্রয় করে থাকবে ততদিন ধর্মই তোমাকে রক্ষা করবে।’ মৃত্যুর সময় রামশরণের মুখ নিঃসৃত শেষ কথা ছিল, ‘এক সত্য কর সার, ভরা নদী হবে পার।’ আউলচাঁদের মতো রামশরণ, সতীমা বা দুলালচাঁদের মনে গাঁথা ছিল পৃথিবীতে মানুষ এক, ধর্মও এক। সেই ধর্ম সত্যধর্ম। এই ভাবনাকে সামনে রেখেই পাল পরিবারের অনেকের নামের সঙ্গে ‘সত্য’ শব্দটি যুক্ত হয়েছে। সত্যশীল, সত্যশিব, সত্যসুন্দর, সত্যশান্ত, সত্যশোভন প্রমুখ। বর্তমানে ধর্ম নিয়ে হানাহানি, রক্তপাত, রাজনীতির শেষ নেই। কিন্তু আজ থেকে বহুদিন আগে সত্যধর্মের যে মেলা ঘোষপাড়ায় বসেছিল সেই ধারা আজও অব্যাহত। এই মেলা দাঁড়িয়েই আছে সত্যধর্মের উপরে।
শান্তিনিকেতনের উপাসনা মন্দিরে লেখা আছে, ‘তিনি আমার প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ, আত্মার শান্তি।’ এই মেলাও যেন ঠিক তাই। প্রকৃতিপ্রেমিক বিভূতিভূষণের জন্ম এখানে। শৈশব-কৈশোরও কেটেছে এখানে। বিখ্যাত হওয়ার পরও তিনি মামার বাড়ি ঘোষপাড়া-মুরাতিপুরে একাধিকবার এসেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘কাঁচরাপাড়া ছাড়িয়ে রাত প্রায় সাড়ে ন’টার সময়ে ঘোষপাড়ার মেলা স্থানে পৌঁছে গেলাম। মেলার স্থান, ডালিমতলা ইত্যাদি হয়ে পালেদের বাড়ির মধ্যে গেলুম। গোপাল পাল সেখানে মোহান্ত সেজে বসে যাত্রীদের কাছে পয়সা আদায় করছে।’
বর্তমানে পৃথিবী থেকে মেলার ধরনটাই পাল্টে গিয়েছে। আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে লোকমেলা। হারিয়ে যাচ্ছে লোকজীবন, লোককথা, লোকগান। সমরেশ বসু লোকজীবনের সন্ধানেই এই মেলায় বারবার ছুটে এসেছেন। ‘কোথায় পাবো তারে’ এই বোধ তাঁকে অমৃত কুম্ভের সন্ধান দিয়েছে। ‘সমরেশ বসু নয়, কালকূট-সত্তাকে টেনেছিল সতীমায়ের মেলা। কারণ এই মেলায় অন্য ধরনের মানুষ আসে। আমার মনে পড়ছে, বিনয় ঘোষকে সঙ্গে করে বাবা একবার ঘোষপাড়ার দোলে সারারাত কাটিয়েছিলেন,’ টেলিফোনে এমনটাই জানালেন লন্ডন-প্রবাসী লেখক নবকুমার বসু। মেলার শুরু থেকে আজও এখানে শোনা যায় পুরাতনী গানের সুর— 
‘কে গড়েছে এমন ঘর
ধন্য কারিগর।
ঘরের মাপ চৌদ্দ পোয়া,
চৌদ্দ ভুবন তার ভিতর।’
বর্তমানে এই মেলায় নগর সংস্কৃতির হাত পড়েছে। একসময় এখানে শুধুই পাওয়া যেত লোকজ জিনিসপত্র, শাকসব্জি থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস। এখন সেখানে থাবা বসিয়েছে হাল আমলের সার্কাস, ইলেকট্রিক নাগরদোলা, মরণকূপ, ডিস্কো, বুলেট ট্রেনের মতো চোখ ধাঁধানো আইটেম। একসময় মেলার ভিড় উপচে পড়ত ঠাকুরবাড়ির বিস্তীর্ণ জমিতে। পাঁচশো একর জমি দখল হতে হতে বর্তমানে তা এক একরে ঠেকেছে। 
তবুও দোলের দিন রাস্তা জুড়ে থাকে লোকমেলা। সকালের মেলার এক রূপ, গোধূলিতে অন্য রূপ। পথ জুড়ে আবির রাঙা মানুষের মিছিল। সব মিলিয়ে এক মায়াবী জগৎ। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুবে ওঠা পূর্ণিমার চাঁদটা আকাশ থেকে ঢলে পড়ে গঙ্গার ওপারে। সেই সময় গাইতে ইচ্ছা করে সুরজিৎ ও তার বন্ধুদের গাওয়া ফাগুনের গান— আজ ফাগুনি পূর্ণিমা রাতে চল পলায়ে যাই...!

(ছবি: লেখকের সৌজন্যে)

28th     March,   2021
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা