বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
 

হেমন্তের দুর্গা 
সুখেন বিশ্বাস

মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের স্বপ্নে পাওয়া জগদ্ধাত্রী। এই পুজো এখন আর কৃষ্ণনগর বা চন্দননগরে সীমাবদ্ধ নেই। ছড়িয়ে গিয়েছে বাংলার সর্বত্র। হেমন্তকালের শুক্লা কার্তিকের নবমীতিথিতে তাই বাংলায় নতুন করে দেখা যায় শরতের রোদ্দুর। আকাশবাণীর প্রভাতী অনুষ্ঠান বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের ‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জীর’ নেই... তবু প্রবাসীরা ঘরে ফেরে। দুর্গাপুজোর মতোই নতুন পোশাকে মানুষ বেরিয়ে পড়ে ঠাকুর দেখতে। রাস্তায় বাড়ে ট্রাফিকের ব্যস্ততা। পাড়ায় পাড়ায় পুজো, প্যান্ডেল, প্রতিমা, আলোর রোশনাইয়ের পাশাপাশি মনটা ভরে যায় নস্টালজিয়ায়। কৃষ্ণনগরে একদিন হলেও চন্দননগরসহ অন্যান্য জায়গায় দুর্গাপুজোর মতোই জগদ্ধাত্রীর আরাধনা হয় চার দিন ধরে।
ভারতীয় পুরাণে আছে, মহিষাসুর বধের পর দেবতাদের উল্লাসের কথা। দেবতাদের ধারণা হয়েছিল, ব্রহ্মার বর ও তাঁদের সম্মিলিত শক্তিতে ভর করেই দেবীর পক্ষে মহিষাসুর বধ সম্ভব হয়েছিল। তাই দেবতাদের শক্তি পরীক্ষার জন্য দেবী স্বয়ং অলক্ষে থেকে একটি তৃণখণ্ড নিক্ষেপ করেছিলেন তাঁদের সামনে। দেবতারা সেই তৃণখণ্ডের কিছুই করতে না পারলে সালঙ্কারা চতুর্ভুজা মূর্তির বেশে আবির্ভূত হয়েছিলেন এক পরমাসুন্দরী দেবী। তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং জগদ্ধাত্রী। জানা গিয়েছে, দেবী দুর্গার রূপভেদে কার্তিক মাসের শুক্লা নবমীতিথিতে জগদ্ধাত্রীর আরাধনা করে বৃত্তাসুরকে বধ করেছিলেন দেবরাজ ইন্দ্র। এটিই ছিল দেবতাদের পক্ষ থেকে দেবী জগদ্ধাত্রীর প্রথম আরাধনা।
জগদ্ধাত্রীকে বলা হয় জগতের ধারণকর্ত্রী। ব্যাপক অর্থে দুর্গা, কালীসহ সকল শাক্ত দেবীই জগদ্ধাত্রী রূপে পরিচিত। উপনিষদে জগদ্ধাত্রীকে বলা হয়েছে উমা হৈমবতী। দেবী দুর্গার বিকল্প রূপ এই জগদ্ধাত্রী। মার্কণ্ডেয় পুরাণে বলা হয়েছে, দুর্গা ও জগদ্ধাত্রী অভিন্ন। তাই তিনি পূজিত হন জগদ্ধাত্রী দুর্গায় নমঃ মন্ত্রে। শ্রীশ্রীচণ্ডীতে বলা হয়েছে, যুদ্ধকালে মহিষাসুর বিভিন্ন রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। একবার তিনি হস্তিরূপ ধারণ করে দেবীকে বিভ্রান্ত করেছিলেন। সেই হস্তি দেবীকে বধের চেষ্টা করলে দেবী দুর্গা স্বয়ং চতুর্ভুজার রূপ ধারণ করেন। এবং চক্র দিয়ে তিনি হস্তির মুণ্ডচ্ছেদ করেন। তাই দেবীমূর্তিতে দেখা যায়, দেবীর বাহন সিংহ এক মৃত হস্তির উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। সংস্কৃতে হস্তির অপর নাম করী। সেই অনুসারে অসুরটির নাম করীন্দ্রাসুর। করীন্দ্রাসুরকে দেবী বধ করেছিলেন বলে তিনি ‘করীন্দ্রাসুরনিসূদিনী’ নামেও পরিচিত। জগদ্ধাত্রী করীন্দ্রাসুরকে বধ করেছিলেন বলেই হয়তো ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, ‘মন করীকে যে বশ করতে পারে তারই হৃদয়ে জগদ্ধাত্রী উদয় হন।’
পুরাণের জগদ্ধাত্রী সিংহের স্কন্ধে বসে রয়েছেন। সালঙ্করা দেবীর গলায় ঝুলছে নাগযজ্ঞোপবীত। তাঁর চারটি হাতে রয়েছে শঙ্খ, চক্র, ধনু ও বাণ। দেবী সত্ত্বগুণের প্রতীক, তাই প্রভাতের সূর্যের মতো তাঁর গাত্রবর্ণ কমলা রঙের হলেও দুর্গার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র তাঁকে রাঙিয়ে দিয়েছিলেন তপ্তকাঞ্চনে। অর্থাৎ কাঁচা সোনার রঙে। জগদ্ধাত্রী স্তোত্রে আছে, “জয়দে জগদানন্দে জগদেক প্রপূজিতে/ সর্ব্বগতে দুর্গে জগদ্ধাত্রি নমোহস্তুতে।”
ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল, কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল, বারোদোল, অগ্রদ্বীপের মেলা, শিবনিবাস, সাধক রামপ্রসাদ, গোপাল ভাঁড়, নবদ্বীপ-শান্তিপুরের শাক্ত-রাস উৎসব—কত কিছুর সঙ্গেই না জড়িয়ে আছেন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র। চৈতন্য সমসাময়িক স্মার্তপণ্ডিত রঘুনন্দন তাঁর ‘দুর্গোৎসতত্তম’ গ্রন্থে বলেছিলেন যে, শুক্লা নবমীতিথিতে সকালে সাত্ত্বিকী, দুপুরে রাজসিকী ও বিকেলে তামসিকী—এই ত্রিকালীন পুজোই শ্রীশ্রীজগদ্ধাত্রী পুজো। নিরবচ্ছিন্নভাবে একই আসনে বসে দফায় দফায় সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্তের আগে পর্যন্ত এই পুজো করে যেতে হয়। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রও একদিনেই (শুক্লা নবমীতিথিতে) সাত্ত্বিকী, রাজসিকী ও তামসিকী নিষ্পাদ্য দুর্গা পুজো করে এই বাংলার হেমন্তে শারদ উৎসবের সূচনা করেছিলেন। জানা যায়, মা কালীর নিরাকার মূর্তিকে সাকার করেছিলেন কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। তারপর তিনি অবিভক্ত বাংলায় কালীপুজোর প্রবর্তন করেন। তবে জগদ্ধাত্রী পুজোর পাশাপাশি কালীপুজো অর্থাৎ বাংলাদেশে শক্তি পুজোর দরজা সকলের জন্যে প্রথম খুলে দিয়েছিলেন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র।
জনশ্রুতি আছে, আনুমানিক ১৭৫৪ সালে বাংলার নবাব ছিলেন আলীবর্দী খাঁ। সেই সময়ে ১২ লক্ষ টাকা রাজকর দিতে না পারার অভিযোগে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে মির্জা মহম্মদের (সিরাজউদ্দৌলা) তৎপরতায় বন্দি করেছিলেন নবাব আলীবর্দী। তাঁর সেনারা নাকি রাতারাতি এক পোশাকে মহারাজকে পেটাতে পেটাতে ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন। উল্লেখ্য, সেইসময় অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গের হিন্দুধর্মের মাথা ছিলেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র। ফলে হিন্দুধর্মের দিকপালরা ১২ লক্ষ টাকা রাজকরের হিসেব চাইলে তা দিতে অস্বীকার করেছিলেন নবাব আলীবর্দী। অবশেষে নবাবের কারাগার থেকে অনেক টালবাহানার পর মুক্তি পেয়েছিলেন মহারাজ। নদীপথে কৃষ্ণনগরে ফেরার সময় রুকুনপুরের ঘাটে রাজা শুনেছিলেন বিসর্জনের বাদ্যি। জানতে পেরেছিলেন, সেদিন ছিল দুর্গাপুজোর বিজয়া। মায়ের দর্শন এবার হল না, মায়ের পুজো এবার আর দেওয়া হল না—এইরকম ভাবতে ভাবতে আক্ষেপে, অবসাদে, ক্লান্তিতে নৌকোর মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তিনি। সেইসময় এক রক্তবর্ণা চতুর্ভুজা কুমারী দেবী (‘রক্তবস্ত্রাপরিধানাং বালার্কসদৃশীতনুম্‌’) তাঁকে আদেশ দিয়েছিলেন, আগামী কার্তিকের শুক্লা নবমীতিথিতে তাঁর পুজো করতে। কথিত আছে, অমাবস্যার রাতে এই দেবী মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে পূর্ণিমার চাঁদ দেখিয়েছিলেন।
কৃষ্ণনগরে জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন সম্পর্কে অন্য একটি মতও প্রচলিত আছে। জনশ্রুতি, ইংরেজদের বন্ধু সন্দেহে ১৭৬২ সালে মিরকাসিম মুঙ্গেরের কারাগারে বন্দি করেছিলেন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ও তাঁর পুত্র শিবচন্দ্রকে। সেই সময় কৃষ্ণচন্দ্রকে প্রাণদণ্ডের আদেশ দিতেও দ্বিধা করেননি মিরকাসিম। কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর দূত মারফত এই সংবাদ প্রসিদ্ধ তান্ত্রিক কালীশঙ্কর মৈত্রের কাছে পৌঁছে দেন। সঙ্গে নিজের প্রাণরক্ষার আবেদনও করেছিলেন তান্ত্রিকের কাছে। কারাগারেই কৃষ্ণচন্দ্র এক কুমারী দেবীর স্বপ্নাদেশ পান। অতঃপর সেখান থেকে মুক্তিলাভের প্রতিশ্রুতি পেয়েছিলেন মহারাজ। তবে এই জনশ্রুতিটি জনমানসে আগের মতটির মতো গ্রহণযোগ্য হয়নি।
কথিত আছে, রাজা-মহারাজাদের কাছে পৌরাণিক দেবদেবীরাই ছিলেন আরাধ্য। তাঁদের স্বপ্নাদেশে রাজারা নতুন পুজোআচ্চা শুরু করার অনুমতি পেতেন। কিন্তু সবসময়ই রাজগুরুর অনুমতি নিতে হত। কৃষ্ণচন্দ্র তখনকার নিয়ম অনুযায়ী তাঁর রাজগুরু বৈষ্ণবাচার্য, কারও কারও মতে বিখ্যাত তান্ত্রিক কালীশঙ্কর মৈত্রের কাছে পুজো শুরু করার অনুমতি নিয়েছিলেন। তারপর স্বপ্নাদেশ মতো দেবীর চারপোয়া (আনুমানিক সাড়ে পাঁচ ফুট) কুমারী (আনুমানিক ১৩-১৪ বছর) মূর্তি বানানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। উল্লেখ্য, পুজোর আগে পুত্র শিবচন্দ্র এবং গোপাল ভাঁড়কে সমস্ত দায়িত্ব দিয়ে তিনি সরাসরি চলে গিয়েছিলেন চন্দননগরে। সেখান থেকে পুজোর আগের দিন মধ্যরাত্রে ফিরে পরের দিন উপবাস থেকে শ্রীশ্রীজগদ্ধাত্রীর অঞ্জলি দিয়েছিলেন মহারাজ।
কৃষ্ণনগরে জগদ্ধাত্রী পুজোর সূচনা যে ১৭৫২ সালের পরে হয়েছিল, সে ব্যাপারে কোনও সংশয় নেই। আগে হলে অবশ্যই রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের লেখা ‘অন্নদামঙ্গল’ (১৭৫২) কাব্যে এই পুজোর বিবরণ পাওয়া যেত। অনুমান করা হয়, ১৭৫২ সালের পর থেকে ১৭৫৬-এর মধ্যেই কৃষ্ণনগরে এই পুজোর সূচনা করেছিলেন মহারাজ।
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের ইচ্ছেয় জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু হলেও চন্দননগরে একদিনের পরিবর্তে সর্বজনীন পুজোমণ্ডপে চারদিন পুজো হয়। সপ্তমীতে সাত্ত্বিকী, অষ্টমীতে রাজসিকী ও নবমীতে তামসিকী পুজো। দশমীতে বির্সজন হয় দেবী দুর্গার মতোই। চন্দননগরের অধ্যাপক শান্তনু চট্টোপাধ্যায় বলছিলেন, ‘শাক্ততন্ত্রাচার মতে আমাদের বাড়ির পুজো এবারে ১৫৯ বছরে পড়ল। চারদিন নয়, আমাদের পুজো ত্রৈকালীন মতে একদিনেই সম্পন্ন হয়।’ তবে প্রতিবার বিসর্জনের পরই নাকি গঙ্গার জলে শুশুক বা সাপ উঠতে দেখা যায়। কৃষ্ণনগরে প্রতিমা বিসর্জনের আগে ঘট বিসর্জনের রীতি বহুকাল ধরে চলে আসছে। আগে রাজবাড়ির পুজোর ঘট বিসর্জন হয়, তারপর অন্যান্য পুজোর। তবে বিসর্জনের দিন সব পুজোর ঠাকুরকেই কৃষ্ণনগর রাজবাড়ি প্রদক্ষিণ করিয়ে শোভাযাত্রা সহকারে জলঙ্গির ঘাটে বিসর্জন দিতে হয়। কৃষ্ণনগরের ক্ষেত্রে রাজবাড়ির পুজো নয়, চাষাপাড়ার পুজো ‘বুড়িমা’-কে জাগ্রত বলে মানেন এখানকার মানুষ। এখানে মানত বা পুজো করলে ভক্তের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবেই হবে—এইরকমই বিশ্বাস মানুষের। চন্দননগরের মানুষ ভদ্রেশ্বরের তেঁতুলতলার জগদ্ধাত্রী মাকে খুব জাগ্রত বলে মনে করেন। তাঁদের বিশ্বাস, এখানে পুজো দিলে বা মানত করলে ভক্তের মনোবাসনা পূর্ণ হয়।
চন্দননগরে আলোকসজ্জা, দেবীমূর্তি ও শোভাযাত্রা বিশ্ববিখ্যাত। এখানকার পুজোর জাঁকজমক কৃষ্ণনগরের থেকে অনেক বেশি। অনেকের মতে বাংলাদেশের কৃষ্ণনগরে নয়, চন্দননগরেই জগদ্ধাত্রী পুজোর সূচনা হয়েছিল। কিন্তু ইতিহাস বলছে অন্য কথা। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী... চন্দননগরের দেওয়ান। চালের ব্যবসা এবং ফরাসিদের সঙ্গে যোগসাজসে তিনি বিত্তশালী হয়েছিলেন। তিনি প্রথম জগদ্ধাত্রী পুজো দেখেছিলেন মহারাজের নাটমন্দিরে। অতঃপর মুগ্ধ হয়ে লক্ষ্মীগঞ্জের চাউলপট্টির নিচুপাটিতে তিনি জগদ্ধাত্রী পুজোর সূচনা করেছিলেন। সেই থেকে এই পুজো আদি পুজো নামে বিখ্যাত। এখনও ইন্দ্রনারায়ণের উত্তরসূরিদের নামে আদি মায়ের সংকল্প করা হয়। ‘ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী নন, চন্দননগরের ফেরিঘাটে জগদ্ধাত্রী পুজোর সূচনা করেছিলেন দাতারাম সুর। সেই পুজোটাই পরবর্তীকালে সরে যায় ভদ্রেশ্বরের তেঁতুলতলায়।’ এমনই দাবি করে বসলেন চন্দননগরের ইতিহাসবিদ অধ্যাপক বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর মতে, চন্দননগরের ‘আদি মা’-র পুজোর সূচনা করেছিলেন কৃষ্ণনগর থেকে আসা চাউলপট্টির ব্যবসায়ীরা। সালটা ছিল সম্ভবত ১৭৬৩ বা ১৭৬৪।
একসময় কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজোয় পশু বলি দেওয়ার প্রথা থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে এই প্রথা বন্ধ। কিন্তু চন্দননগরের বিভিন্ন পুজোয় পশু বলি দেওয়ার রীতি আজও বিদ্যমান। প্রতিবার এখানকার পুজোয় আনুমানিক তিন হাজারেরও বেশি পাঁঠা বলি হয়ে থাকে। কৃষ্ণনগরের মালোপাড়ায় জলেশ্বরী মায়ের পুজোতে নবমী পুজোর রাতে আগুন খেলার রীতি আজও চলে আসছে। কিন্তু রানি মা কর্তৃক নির্বাচিত সেরা জগদ্ধাত্রী প্রতিমাকে পুরস্কার দেওয়ার রীতি রাজবাড়ি থেকে উঠে গেছে।
কৃষ্ণচন্দ্র যেমন দুর্গাপুজোর বিকল্প হিসেবে কৃষ্ণনগরে জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন করেছিলেন, ঠিক সেইমতো চন্দননগরেও ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর হাত ধরে দুর্গাপুজোর বিকল্প হয়েছে জগদ্ধাত্রী পুজো। পাশাপাশি জানা যায়, মহারাজ নরেন্দ্রনারায়ণ কোচবিহার রাজবাড়িতে আনুমানিক ১৮৫৩ সালে জগদ্ধাত্রী পুজোর সূচনা করেছিলেন। সেইসময় কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির পৃষ্ঠপোষকতায় ওখানে জগদ্ধাত্রী পুজোর সূচনা হয়েছিল। সেই ধারা আজও অব্যাহত। ‘শ্রীবাম লীলা’ (১৪১৬) গ্রন্থে শাস্ত্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, “তিনি তারাশিলায় জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন করেন। তাহা অদ্যবধি হইয়া আসিতেছে। তাহাঁর শেষ জীবনের সহিত বামের মধ্য জীবন সংশ্লিষ্ট।” অর্থাৎ মোক্ষদানন্দ (মাণিকরাম মুখোপাধ্যায়) ১২৬০ বঙ্গাব্দ নাগাদ তারাপীঠে যে জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন করেছিলেন, তা আজও চলছে। এইভাবে নদীয়া থেকে হুগলি, কোচবিহার, বর্ধমান, বীরভূম, ২৪ পরগনা, কলকাতাসহ বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে জগদ্ধাত্রীর মহিমা। কোথাও কোথাও তা দুর্গোৎসবের রূপ পেয়েছে।
তবে মা সারদার বংশে জগদ্ধাত্রী পুজো বিখ্যাত হলেও তা দুর্গাপুজোর বিকল্প হয়ে ওঠেনি। জনশ্রুতি আছে, মা সারদার মা শ্যামাসুন্দরী দেবী প্রতিবার নব মুখোপাধ্যায়ের বাড়ির কালীপুজোয় চাল পাঠাতেন। ঝগড়ার জন্য একবার সেই চাল নিতে অসমর্থ হয়েছিলেন মুখোপাধ্যায় পরিবারের মানুষেরা। দেবী জগদ্ধাত্রী সেই রাতেই শ্যামাসুন্দরীকে স্বপ্ন দেখা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন তাঁকে পুজো দিতে। সেই থেকে আজও জয়রামবাটিতে জগদ্ধাত্রী পুজো হয়ে আসছে। স্বামী বিবেকানন্দ তো বটেই, বেলুড় মঠের অন্যান্য সন্ন্যাসীও মা সারদাকে সাক্ষাৎ জগদ্ধাত্রী মেনে পুজো করেন।
কৃষ্ণনগরের বেশিরভাগ প্রতিমা বিশাল আকারের। সব দেবীরই অবস্থান সেখানে আড়াআড়িতে। কিন্তু রাজবাড়ির প্রতিমা আকারে ছোট, কুমারী মেয়ের মতো। দেবী সাদা ঘোড়ারূপী সিংহের (পৌরাণিক সিংহ) পিঠে বসা। তবে আড়াআড়িভাবে নয়, দেবী সোজাসুজি আসীন সিংহের উপরে। দেবীর দক্ষিণ পা ঝোলানো, বাম পা সিংহের পিঠে ভাঁজ করা। সবচেয়ে আশ্চর্যের, কৃষ্ণনগর রাজবাড়ি ও কলকাতার শোভাবাজারে বীরকৃষ্ণ দাঁয়ের বাড়ির পুজো ছাড়া বাংলার কোথাও এইরকম জগদ্ধাত্রী প্রতিমা নেই। কিন্তু চন্দননগরের জগদ্ধাত্রীর বৈশিষ্ট্য সনাতন রীতির প্রতিমায় সাদা সিংহ ও তাঁর বিপরীতমুখী অবস্থানে রয়েছে হাতি। কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির পঙ্খ অলংকৃত নাটমন্দিরে মহারাজের আমল থেকে এখনও জগদ্ধাত্রী পুজো হয়ে আসছে। চন্দননগরেও দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণের কাল থেকে হয়ে আসছে জগদ্ধাত্রীর আরাধনা। প্রতি বছর শুক্লা কার্তিকী নবমীতিথিতে তাই তো কৃষ্ণনগর-চন্দননগরে যেন ফিরে আসে শরৎ। পাড়ার চেনা মাঠটা হঠাৎ কাপড়ের মোড়কে ঢেকে রাজস্থানের সোনার কেল্লা, কখনও কলকাতার নন্দন, রাজভবন বা পঞ্জাবের স্বর্ণমন্দির হয়ে যায়। চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পুজোয় প্রাধান্য পেয়েছে পাড়াভিত্তিক নাম। কিন্তু কৃষ্ণনগরের পাড়ায়-পাড়ায় জগদ্ধাত্রীর বিভিন্ন নাম দেওয়ার হিড়িক পড়ে গিয়েছে। প্রাচীন মা, বড় মা, আদি মা, নতুন মা... আরও কত কি! সম্প্রীতি মা নামেও জগদ্ধাত্রীর পরিচিতি হয়েছে। কৃষ্ণনগরের মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের উত্তরসূরি মণীশচন্দ্র রায় বলছিলেন, ‘পুরাণপ্রথা অনুযায়ী আমাদের পুজো এখনও একদিনেই সম্পন্ন হয়। ভাসানের আগে রাজাকে প্রতিমা দেখানোর রীতি আজও চলে আসছে। মহারাজের চকে বসিয়ে রানিদের ঠাকুর দেখানো হয়। শুরুতে কৃষ্ণনগরের মহারানি মালোপাড়ার জলেশ্বরী পুজোকে পনেরো টাকা দান করেছিলেন। সেই প্রথা আজও চলে আসছে।’
ক্লাব বা সর্বজনীন পুজোগুলিতে জাঁকজমক থাকলেও আলোর রোশনাই নেই রাজবাড়ির পুজোয়। জৌলুসও হারিয়েছে। তবে আছে নস্টালজিয়া, পুরাতনী গন্ধ। তাই তো রাজবাড়ির পুজোয় বেদমন্ত্রের সঙ্গে কাঁসর-ঘণ্টার ধ্বনি মনকে নিয়ে যায় সেই কবেকার বেদ পুরাণের দেশে...।
 লেখক: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়
(ছবি: নিজস্ব চিত্র ও কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির সৌজন্যে পাওয়া)
 গ্রাফিক্স : সোমনাথ পাল
 সহযোগিতায় : স্বাগত মুখোপাধ্যায় 

22nd     November,   2020
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা