বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
 

মোদির মিশন বিহার
সমৃদ্ধ দত্ত

নরেন্দ্র মোদি রেকর্ড গড়তে ভালোবাসেন। যে কোনও একটি সাফল্যকেই তাঁর অনুগামী ও দল রেকর্ড হিসেবে প্রচার করে এবং বিশ্বাসও করে। রেকর্ড করতে কে না ভালোবাসে? তাই এটা কোনও অন্যায় নয়। অপার জনপ্রিয়তা, অপরিসীম ক্যারিশমা, দল ও সরকারের উপর একচ্ছত্র অথরিটি। এই তিনটি বিষয় তাঁর করায়ত্ত। যে কোনও রাজনীতিবিদের যা প্রধান লক্ষ্য। অথচ তাও নরেন্দ্র মোদির জীবনে রয়েছে ট্র্যাজেডি... তিনি এত সাফল্য পেলেও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রেকর্ড অধরাই থেকে গেল। নরেন্দ্র মোদি খুব খুশি হতেন, যদি স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতে সবথেকে বেশিবার একটানা জয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসার রেকর্ড একমাত্র তাঁর নামের পাশেই থাকত। কিন্তু তা হওয়ার নয়। ১৯৫২, ১৯৫৭ এবং ১৯৬২ সালে পরপর তিনবার জয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার রেকর্ড ইতিমধ্যেই করেছেন জওহরলাল নেহরু। সুতরাং নরেন্দ্র মোদি আগামী ২০২৪ সালে পুনরায় জয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রী হলেও তিনি শুধু নেহরুর রেকর্ড স্পর্শ করতে পারবেন। সেটা টপকে যেতে পারবেন না। ২০২৯ সালে তাঁর পক্ষে ফের প্রধানমন্ত্রী হওয়া নিশ্চয়ই বয়সের কারণে সম্ভব হবে না।
আটের দশকের শেষভাগ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত জোট রাজনীতির বাধ্যবাধকতাকে ছুঁড়ে ফেলে আবার একক একটি দলের গরিষ্ঠতা অর্জন করেছেন মোদি। সুতরাং তাঁর চাহিদা থাকতেই পারে যে, তাঁর নেতৃত্বাধীন দলটি সবথেকে বেশি আসন পেয়ে সরকারে আসবে, যা হবে রেকর্ড। ২০১৪ সালে তাঁর দল পেয়েছিল ২৮২। ২০১৯ সালে পেয়েছে ৩০৩। যা সাম্প্রতিককালে রেকর্ড। কিন্তু সর্বকালীন রেকর্ড নয়। কারণ ১৯৭১ সালে ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেস সরকার গড়েছিল ৩৫২ আসনে জয়ী হয়ে। ১৯৮৪ সালে রাজীব গান্ধীর বিপুল জয়ে (৪০৪) অন্যতম ভূমিকা ছিল সহানুভূতি ভোট। তাই সেটি ধরা হচ্ছে না। অর্থাৎ সবথেকে বেশি আসনে জয়ী হওয়ার সর্বকালীন রেকর্ড করার সুযোগ একমাত্র আগামী ২০২৪ সালে থাকছে। পারবেন মোদি? তৃতীয় ট্র্যাজেডি হল, নরেন্দ্র মোদি নিজেকে সবথেকে বেশি পাকিস্তান-বিরোধী এক শাসক হিসেবে প্রতিভাত করতে মরিয়া। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে পাকিস্তানকে সবথেকে বড় ধাক্কাটি দিয়েছেন ইন্দিরা গান্ধী। পাকিস্তান দেশটাকে ভেঙে দিয়ে। এতবড় সাফল্য বিশ্বেই খুব কম আছে যে, প্রতিপক্ষ দেশকে দু’টুকরো করে দেওয়া। সুতরাং আগামী দিনে মোদির ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আবার একটি যুদ্ধ হলেও পাকিস্তানকে বিভাজিত করার সাফল্য আর আসবে না।
সুতরাং মোদির কাছে এখন রেকর্ড গড়ার মতো যে বিষয়টি পড়ে আছে তা হল, দেশের প্রায় সব রাজ্যেই বিজেপি শাসন গড়ে তোলা। অর্থাৎ তিনি হবেন আধুনিক ভারতের প্রকৃত সম্রাট। আর্যাবর্ত থেকে দাক্ষিণাত্য, রাজস্থানের মরুভূমি থেকে অরুণাচল প্রদেশের পাহাড়, সবই হবে বিজেপি শাসিত রাজ্য। ঠিক এই লক্ষ্যেই মোদির প্রধান সেনাপতি অমিত শাহ প্রথম থেকেই ডাক দিয়েছিলেন কংগ্রেস মুক্ত ভারত। কিন্তু ছ’বছর কেটে গেলেও কংগ্রেস মুক্ত ভারত হওয়ার বিশেষ লক্ষণ নেই। বরং নেতা, সংগঠন না থাকা কংগ্রেস বিভিন্ন রাজ্যে আবার শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। এটা বেশ বিস্ময়কর। ২০১৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত কোনও রাজ্যেই বিজেপি আশানুরূপ ফল করতে পারছে না। একের পর এক রাজ্য হাতছাড়া হচ্ছে। অথবা কোনওক্রমে হরিয়ানার মতো জোট করে সরকার গড়তে হচ্ছে। আর আছে মধ্যপ্রদেশের ফর্মুলা। অর্থাৎ, অন্য দল থেকে বিধায়ক ভাঙিয়ে সরকার গড়া। অথচ একটি দলের শক্তি প্রতিষ্ঠিত হয় তখনই, যখন প্রচুর ভোট পেয়ে সরাসরি সে নির্বাচনে জয়লাভ করে।
বিহারের ভোটে জয়ী হওয়া মোদির কাছে তাই অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। শুধুই একটি রাজ্যে সরকার ধরে রাখা নয়, আর একটি কারণও আছে। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হতে না দেওয়া। ইতিহাসটি খুবই বিপজ্জনক। ইন্দিরা গান্ধী ও নরেন্দ্র মোদির মধ্যে যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে। দু’জনেই নিজেকে দলের সমার্থক হিসেবে তুলে ধরেছেন। ইন্দিরা গান্ধীর তো এক সময় দলেরই নাম দিয়েছিলেন নিজের নামে। কংগ্রেস(ই)। আজও বিজেপি মাইনাস মোদি কি ভাবা যায়? নামে বিজেপি হলেও দলটি ক্রমেই হয়েছে মোদির দল। ইন্দিরা গান্ধী আর নরেন্দ্র মোদির সরকারে আরোহণের পর প্রায় একইরকম রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ১৯৬৭ সালে লোকসভা ভোটে ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেস জয়ী হয়েছিল ২৮৩ আসন পেয়ে। ২০১৪ সালে মোদির বিজেপি পেয়েছিল ২৮২ আসন। ১৯৭১ সালে ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেস এককভাবে পেয়েছিল ৩৫২ টি আসন। আর ২০১৯ সালে মোদির বিজেপি এককভাবে পেয়েছে ৩০৩, কিন্তু এনডিএ পেয়েছে ৩৫১। অর্থাৎ প্রায় একই পরিসংখ্যান। এখানেই ইতিহাসের বিপদ শুরু। ওই ১৯৭১ সালে পাকিস্তানকে হারিয়ে ইন্দিরা গান্ধী বিপুল সাফল্য অর্জন করেন। কিন্তু পরের বছর থেকেই তাঁর জনপ্রিয়তায় ধাক্কা লাগা শুরু হয়। এবং ক্রমেই একটি রাজ্য তাঁর কাছে প্রধান মাথাব্যথা হয়ে যায়। বিহার। জয়প্রকাশ নারায়াণের আন্দোলনের জেরে ইন্দিরা-বিরোধী তুমুল হাওয়া তৈরি হয়। অর্থাৎ পরপর দু’টি নির্বাচনে একক সাফল্য পাওয়ার পর তৃতীয় নির্বাচনের ঠিক আগে ইন্দিরা গান্ধীর গদি টলমল হতে থাকে। ১৯৭৭ সালে তিনি আর ফিরে আসতে পারলেন না। দল তো বটেই, পরাজিত হলেন নিজেও।
সুতরাং এই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হোক, এটা মোদি চাইবেন না। অর্থাৎ তিনিও ঠিক একইভাবে পরপর দু’বার লোকসভা ভোটে জয়ী হয়ে তৃতীয়বার, অর্থাৎ ২০২৪ সালে পরাস্ত হবেন, এটা অবশ্যই তাঁর কাছে এক দুঃস্বপ্ন। তাই আপাতত সর্বাগ্রে প্রয়োজন বিহারকে বশে রাখা। এক্সিট পোল যাই বলুক, যতক্ষণ না ১০ নভেম্বর বিহার ও মধ্যপ্রদেশের ভোটগণনা সম্পূর্ণ হচ্ছে, ততক্ষণ মোদি স্বস্তি পাচ্ছেন না। কারণ, বিহারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভবিষ্যতের পূর্বাভাস। আগামী বছর পশ্চিমবঙ্গ, অসম, কেরল, তামিলনাড়ুর ভোট। বিহারের ভোটে পুনরায় এনডিএ জয়ী হওয়ার অর্থ—ওই রাজ্যগুলিতে বিজেপি প্রচার করতে পারবে যে তারা জনপ্রিয়। কিন্তু বিহারে খারাপ ফল হলে মনোবল ও আত্মবিশ্বাস দুইই ধাক্কা খাবে। একইভাবে মধ্যপ্রদেশের ২৮টি আসনের উপনির্বাচন একপ্রকার সামগ্রিক বিধানসভা ভোটই। কারণ, এই ২৮টি আসনের সিংহভাগ কেন্দ্রেই ২০১৮ সালে জয়ী হয়েছিল কংগ্রেস। চলতি বছরের মার্চ মাসে সেই বিধায়কদের সঙ্গে নিয়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন কংগ্রেসের এতকালের ঘরের ছেলে গোয়ালিয়রের যুবরাজ জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া। ওই বিধায়কদের দলত্যাগের কারণে কংগ্রেসের মধ্যপ্রদেশ সরকারের পতন ঘটে। অর্থাৎ ঘুরপথে সে রাজ্যে সরকার গঠন করতে হয়েছে বিজেপিকে। এবার তাই ২৮টি আসনে জয়ী হয়ে মোদিকে প্রমাণ করতে হবে, মধ্যপ্রদেশ তাঁর দলের সমর্থক হয়েছে। কিন্তু যদি এই ২৮টির সিংহভাগ আসনে বিজেপি পরাজিত হয়? তাহলে সংখ্যার খেলায় রাজ্য সরকারে বিজেপি যতই বিরাজমান থাকুক, মোদির কাছে সেই পরাজয় হবে যথেষ্ট অসম্মানের। সেক্ষেত্রে প্রমাণিত হবে, বিজেপি ভোটে জিততে পারছে না। অন্য উপায়ে সরকার গড়ছে।
মোদির হয়ে অমিত শাহ দেশের অধিকাংশ রাজ্যেই সরকার গড়ার জন্য মরিয়া হয়ে থাকেন। যেনতেনপ্রকারে। এই তাগিদের কারণও সহজবোধ্য। প্রথমত, দেশবাসীর কাছে প্রমাণ করা যে ভারত নামের একটি বিপুল বৃহৎ দেশের প্রায় সবটাই বিজেপির দখলে। আর দ্বিতীয় কারণ হল, রাজ্যে দলের সরকার থাকলে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে রাজস্ব, সবকিছুই হয় অপরিসীম। কিন্তু সমস্যা হল, এই স্বপ্নটি কিছুতেই পূরণ করা যাচ্ছে না। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে ওই বিপুল জয় সত্ত্বেও এখন ভারতের মানচিত্রের দিকে তাকালে মোদির বিজেপির রাজ্যওয়াড়ি পারফরম্যান্স মোটেই সুখপ্রদ নয়। বৃহৎ রাজ্য বলতে একমাত্র মোদির হাতে এখন উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাত ও কর্ণাটক। জোট হিসেবে রয়েছে বিহার। বাকি উত্তরাখণ্ড, হিমাচল প্রদেশ, অসম এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্য। আজ থেকে ২০ বছর আগেও বিজেপির অস্তিত্ব দাক্ষিণাত্যে ছিল বলতে শুধু‌ই কর্ণাটকে। আজও তা‌ই। কেরল, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, তেলেঙ্গানায় বিজেপির সংগঠন দাঁত ফোটাতে পারছে না ভোটারদের কাছে। যা বড়সড় ব্যর্থতা। অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গে বিজেপি এককভাবে ক্ষমতা দখলে ব্যর্থ। কারণ আজও বিহারে বিজেপি নীতীশ কুমার নির্ভর একটি দল। আর বঙ্গ ও কলিঙ্গে মহাশক্তিধর দুই মুখ্যমন্ত্রী দুর্গ রক্ষা করে চলেছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও নবীন পট্টনায়েক। তাঁদের একক ক্যারিশমা আর দলীয় সংগঠন, দু’টিই বেশি বিজেপির তুলনায়। বিগত বছরগুলিতে এই দুই রাজ্যে বারংবার বিজেপির অশ্বমেধের ঘোড়া প্রতিহত হয়েছে। সুতরাং মোদির রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য প্রথমে বিহার এবং তারপর আগামী বছর পশ্চিমবঙ্গ দখল প্রয়োজন। ২০২১ সালে বাংলা দখল করতে ব্যর্থ হলে গোটা ভারতের সাফল্য মুখ থুবড়ে পড়বে, সেটা নিয়ে সংশয় নেই।
জাতপাত, হিন্দু মুসলিম, সরকারি প্রকল্প, নতুন প্রতিশ্রুতি, পাকিস্তান, যুদ্ধ ইত্যাদি নানাবিধ ইস্যু যে কোনও ভোটকে প্রভাবিত করে। প্রচারও চলে এই ইস্যুগুলিকে কেন্দ্র করে। কিন্তু একটি নিঃশব্দ ভোটব্যাঙ্ক সর্বদাই ফল্গুস্রোতের মতো কাজ করে সংসদীয় রাজনীতিতে। সেটি হল মহিলা ভোট। অবশ্যই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মহিলা ভোটব্যাঙ্ক নামে কোনও পৃথক আইডেন্টিটির স্থান কমই থাকে। অর্থাৎ ঘরের পুরুষরাই ডিকটেট করে দেয় যে, কাকে ভোট দিতে হবে। কিন্তু সাম্প্রতিক অতীতে সেই প্রবণতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। কারণ, সরাসরি মহিলাদের উপকার হচ্ছে এরকম সরকারি প্রকল্প ঘোষণার দিকে কৌশলগতভাবে জোর দিয়েছে তাবৎ রাজনৈতিক দল। উজ্জ্বলা গ্যাস যোজনা থেকে কন্যাশ্রী। স্কুলছাত্রীদের সাইকেল বিতরণ থেকে স্বনিযুক্তি প্রকল্পে ঋণদান। এই প্রকল্পগুলি নিয়ে মহিলাদের মধ্যে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। একটি পরিসংখ্যান দিলে স্পষ্ট হবে যে, কেন এখন মহিলা ভোটব্যাঙ্ক একটি তাৎপর্যপূর্ণ ফ্যাক্টর। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, গ্রামীণ এলাকায় মহিলাদের ভোটদান শহুরে এলাকার তুলনায় ৬ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে। অথচ ১৯৭১ সালে গ্রামীণ এলাকার মহিলাদের ভোটদানের হার শহরের থেকে ছিল ৮ শতাংশ কম। মহিলাদের ভোটদানের প্রবণতায় দেশের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ প্রথম। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে পশ্চিমবঙ্গে মহিলা ভোটদাতার হার ছিল ৮২ শতাংশ। সবথেকে কম মহিলাদের ভোটদান প্রবণতা কোন অঞ্চলে? হিন্দি বলয়ে। উত্তরপ্রদেশ (৫৭ শতাংশ), বিহার (৫৭ শতাংশ) এবং মধ্যপ্রদেশ (৫৬ শতাংশ)। ভারতের ৭০ শতাংশ মানুষ থাকে গ্রামে। তাই গ্রামীণ এলাকাবাসী মহিলাদের সামাজিক ও আর্থিকভাবে শক্তিশালী করার কৌশল নিয়েছে রাজনৈতিক দল ও সরকারগুলি। কিন্তু তা সত্ত্বেও মহিলাদের ভোটার তালিকায় নাম তোলার হার অনেক কম এখনও। ২০১৯ সালের হিসেবে দেখা যাচ্ছে মহিলা ভোটার রেজিস্ট্রেশন মাইনাস সাড়ে ৪ শতাংশ। অর্থাৎ যতটা হওয়া উচিত ছিল, তার থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ কম।
ঠিক এই প্রেক্ষাপটে বিহারে নিজের কয়েক শতাংশ কুর্মি ভোট ছাড়া নীতীশ কুমারের আশা মহিলা এবং ইবিসি সমর্থন। অর্থাৎ এক্সট্রিম ব্যাকওয়ার্ড ক্লাস। এই দুই ভোটব্যাঙ্ক আশা করছেন নীতীশ কুমার। বিগত ১৫ বছরে নীতীশ কুমার একটি অবিশ্বাস্য ভারসাম্যের খেলা দেখিয়েছেন। তাঁর দলের ক্যাপটিভ ভোটব্যাঙ্ক কিছু না থাকা সত্ত্বেও, তিনি নিখুঁত টাইমিংয়ে স্রেফ জোটবদল করে ১৫ বছর ধরে মুখ্যমন্ত্রী হয়ে রয়েছেন। তাঁর জোটসঙ্গীরা অর্থাৎ বিজেপি কিংবা লালুপ্রসাদ যাদবের আরজেডি নীতীশ কুমারকে নিজেদের ভোটব্যাঙ্ক উপহার দিয়েছে লাগাতার। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রিত্ব পায়নি কেউ। এবারও বিজেপি জেডিইউয়ের জোট জয়ী হলে নীতীশই হবেন মুখ্যমন্ত্রী। আর যদি একক গরিষ্ঠতা এই জোট না পায়? তাহলে নীতীশ কুমারের পক্ষে পুনরায় জোটবদল করতে কোনও সমস্যা নেই। সেক্ষেত্রে বিপদে পড়বে বিজেপি। পক্ষান্তরে বিহারে বিজেপি এবার একদিকে যেমন জোট হিসেবে জিততে চায়, তেমনই একটি গোপন লক্ষ্যও আছে। সেটি হল, যেভাবেই হোক নীতীশ কুমারের দলের থেকে যেন বিজেপির প্রাপ্ত আসন বেশি হয়। অর্থাৎ এবার থেকে বিজেপি বিহারে হতে চায় বিগ ব্রাদার। অর্থাৎ নীতীশ কুমারের দল যেন সংখ্যার বিচারে হয় ছোট শরিক। সেক্ষেত্রে আগামী দিনে বিজেপি দাবি করবে মুখ্যমন্ত্রীর পদ।
এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার সময় এক্সিট পোলের ফলাফল জানা হয়ে যাবে। কিন্তু মঙ্গলবার ফল প্রকাশিত হওয়ার পর দেখা যাবে বিহারের ভোটের ভোটপ্রদানের প্রবণতার বিশ্লেষণ। বিহারের দুই জোটের কাছে দু’টি দল আছে, যারা তাদের নিজস্ব ভোটে ভাগ বসাবে। যাকে পরিভাষায় স্পয়লার বলা হয়। এনডিএর কাছে স্পয়লার হল প্রয়াত রামবিলাস পাসোয়ানের দল। আরজেডি জোটের কাছে আসাদউদ্দিন ওয়াইসি। সীমাঞ্চল হিসেবে পরিণত কিষাণগঞ্জ, কাটিহার, পূর্ণিয়ায় ওয়াইসি মুসলিম ভোটে কতটা ভাগ বসাবেন, সেটার উপর অনেকটাই নির্ভর করবে তেজস্বী যাদবদের ভাগ্য। মধ্যপ্রদেশ ২৮টি আসনে এবার কোনও ইস্যু নেই। একমাত্র প্রচার বিশ্বাসঘাতকতা। কংগ্রেস সহানুভূতির ভোট চাইছে। অর্থাৎ ২৪টি আসনে গিয়ে কংগ্রেস স্রেফ বলছে আপনারা যাঁকে ভোট দিয়ে বিধানসভায় পাঠালেন, সে বেইমানি করে বিজেপিতে চলে গেল। অথচ আপনারা তো কংগ্রেস প্রার্থীকেই জয়ী করেছিলেন। তাই এবার আপনাদের জবাব দেওয়ার পালা। এই প্রচারকে পরাজিত করে এই আসনগুলিতে জয়ী হওয়ার ক্ষেত্রে প্রেস্টিজ ফাইট জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ার। কারণ, এই ২৮টি বিধানসভা আসনের উপনির্বাচনে বিজেপি প্রার্থীরা যদি সিংহভাগ ক্ষেত্রে জয়ী না হন, তাহলে বিজেপির অন্দরেও প্রশ্ন উঠবে সিন্ধিয়ার ক্ষমতা নিয়ে। বিজেপির মধ্যে থাকা তাঁর বিরোধীরা বলবে, কী লাভ হল সিন্ধিয়াকে নিয়ে এসে?
তাহলে একটি রাজ্যের বিধানসভা ভোট এবং অন্য রাজ্যের ২৮ আসনে উপনির্বাচনের জয় পরাজয় কেন নরেন্দ্র মোদির আত্মপরীক্ষা? কারণ, এই দুই রাজ্যের ফলাফল প্রমাণ করবে, মোদির ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা ঠিক কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে! বিহার থেকে শুরু হয়েছিল ইন্দিরা গান্ধীর পিছু হটা। এবার বিহার ফ্যাক্টর কতটা তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠবে মোদি-মিথে?
মহিলা ও মহাদলিত যদি নীতীশ কুমারের দিকে থাকে, তাহলে রাজপুত, ব্রাহ্মণ, ভূমিহার উচ্চবর্ণের দিকে আশা করে রয়েছে বিজেপি। তাহলে পড়ে রইল কী? মুসলিম ও যাদব। অর্থাৎ লালুপ্রসাদ যাদবের সেই পুরনো ফর্মুলা এমওয়াই। কিন্তু সকলের অলক্ষে ২০২০ সালের ভোটে বিহারে হাজির হয়েছে একটি অন্য ভোটব্যাঙ্ক। তার নামও ‘ওয়াই’। অর্থাৎ ‘ইয়ুথ’। লালুপুত্র তেজস্বী যাদবের কাছে মুসলিম, যাদবের পাশাপাশি এই ইয়ুথ অর্থাৎ যুবা ভোটের একটি বড় অংশ আসতে পারে। তাঁর সভা সমাবেশে যে বিপুল ভিড় হয়েছে, সেখানে দেখা গিয়েছে বিহারে যুব সম্প্রদায়কে। সেই ভিড় ভোটে পরিণত হয়েছে কি না, সেটাই বোঝা যাচ্ছে মঙ্গলবার। বস্তুত আপাতত নতুন ভারতে জাতপাতের পাশাপাশি দু’টি নতুন ভোটব্যাঙ্ক আবির্ভূত হয়েছে—মহিলা ও যুবা। এই দুই ভোটব্যাঙ্কের মধ্যে একটি সাদৃশ্য আছে। এরা অত্যন্ত বাস্তবধর্মী চিন্তাভাবনা করছে। সোজা কথায় ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ হচ্ছে কি না, আগে সেটা এই ভোটাররা পরখ করছে। বিপুল অংশের যুব সম্প্রদায়ের কাছে চাকরি, কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর মহিলাদের কাছে তাঁর সংসার, পরিবার, সমাজের প্রত্যক্ষ কী কী উপহার হচ্ছে, সেটা ম্যাটার করছে। ঠিক যে পরিণতমনস্কতা দেখা যায়নি এতদিন ট্র্যাডিশনাল ভোটারদের মধ্যে। তাদের মধ্যে দলের প্রতি আনুগত্যই ছিল শেষ কথা। সেই আনুগত্য মোটেই শেষ হয়নি। আজও বিহার ইউপিতে নিজের কমিউনিটি, কাস্টের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার রীতি পুরোদস্তুর আছে।
কিন্তু মহিলা ও যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে সেই প্রবণতা কমছে। পুরনো ভারতে ভোটের ভাগ্য নির্ধারণ করেছে কমিউনিটি ভোট। অর্থাৎ সমষ্টির হোমোজিনিয়াস ভোটিং প্যাটার্ন। আমার কী লাভক্ষতি, সেটার থেকেও বেশি দেখা হয়েছে আমার জাত, আমার সম্প্রদায়, আমার দল ইত্যাদি। ২০২০ সালের নতুন ভারত ইনস্ট্যান্ট ডেমোক্র্যাসিতে বিশ্বাসী। এই ডাউনলোডিং সোসাইটি চায় দ্রুত পারফরম্যান্স, আর আমার ব্যক্তিগত কী লাভক্ষতি হবে তার হিসেব। এই প্রবণতাকে নেতৃত্ব দিচ্ছে মহিলা এবং যুব ভোটব্যাঙ্ক। নতুন মন্ত্র ‘পার্সোনাল ভোটিং’! লক্ষ করলে দেখা যাবে, ক্যাপটিভ ভোটের থেকেও রাজনৈতিক দল এই পার্সোনাল ভোটিংকে এখন বেশি টার্গেট করছে। কারণ, হিন্দু-মুসলিম, জাতপাতের ভিত্তিতে যারা ভোট দেয়, তাদের ভোট নিশ্চিত। তাদের তেমন গুরুত্ব দেওয়ার দরকার নেই। মাঝেমধ্যে একটা দু’টো ইস্যু দিলেই তারা ওই নিয়ে মেতে থাকে। তার থেকে ঢের বেশি ইম্পর্ট্যান্ট এই স্যুইং ভোটার। অর্থাৎ যারা ব্যক্তিগত লাভক্ষতি হিসেব করে ভোট দেয়। এদের খুশি করার চেষ্টা করবে সব দল। বিহার তো ব঩টেই, আগামী দিনে সব নির্বাচনেই মহিলা ও যুবদের ভোটই হবে অন্যতম নির্ণায়ক। যারা ভোটার, কিন্তু ভোটব্যাঙ্ক নয়! 

8th     November,   2020
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা