বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিকিকিনি
 

চিল্কার পাখপাখালি

অপার জলরঙের স্বচ্ছতা ও নমনীয়তা নিয়ে বিস্তৃত ওড়িশা উপকূলের হ্রদটি। লিখছেন মধুছন্দা মিত্র ঘোষ।

যেন তাদের হট্টমেলা। আকাশে তাদের সুদৃশ্য ডানার হেঁয়ালি। কী পাখি যেন সব? সিগাল, স্যান্ড-পাইপার, স্পুনবিল, পিনটেইলস! পক্ষ্মীবিশারদ নই। অপলক দেখে যাই ওদের সাদা অথবা রঙিন ডানার ঝলকানি। চোখের ধরাছোঁয়ায় অপার জলরঙের স্বচ্ছতা ও নমনীয়তা নিয়ে বিস্তৃত ওড়িশা উপকূলের চিল্কা হ্রদ।
শ্রীক্ষেত্র পুরীর মুখ্য প্রবেশদ্বার থেকে চিল্কার দূরত্ব ৪৮ কিলোমিটার। পুরীর সাগরমুখী হোটেলগুলো থেকে চিল্কার দূরত্ব ৫৫ কিলোমিটার। আগের সন্ধেবেলায় স্থানীয় ড্রাইভারের সঙ্গে চিল্কার সাতপাড়া যাওয়া-আসার বন্দোবস্ত পাকা করে ভোর ছ’টায় রওনা দিলাম। নেতাজিচক, রেডক্রস রোড, নবকলেবর রোড ধরে এসে অথরনালা হল পুরীর মুখ্য প্রবেশদ্বার। কথিত আছে, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু মাত্র চোদ্দো বছর বয়েসে পদব্রজে এই পথ ধরে, অথরনালা প্রবেশপথে পুরীতে আসেন। মঙ্গলা নদীর ক্ষীণ শাখানদী ভার্গবী, এখানে প্রবাহিত। যাত্রাপথে নরম স্নিগ্ধতায় গরুয়াল গ্রাম। আমাদের ভাড়া-গাড়ির প্রৌঢ় সারথি প্রফুল্ল মোহান্ত জানালেন, গরুয়াল গ্রামে দু’হাজার কুম্ভকার পরিবারের বসবাস। যাঁদের মূল জীবিকা রান্নার কাজে ব্যবহৃত মাটির বাসনপত্র নির্মাণ। প্রভু জগন্নাথধামের বিশ্বের বৃহত্তম রন্ধনশালার বাসনপত্রের সরবরাহ হয় গরুয়াল গ্রাম থেকেই। জগন্নাথদেবের প্রখ্যাত মহাপ্রসাদ প্রস্তুত হয় এই গ্রামেরই কুম্ভকারদের নির্মিত মৃৎপাত্রে। যাত্রাপথের বাঁ দিকে ব্রহ্মগিরি গ্রামসংলগ্ন অলরনাথ মন্দির, যেখানে শ্রীচৈতন্য ও রামানন্দস্বামীর মধ্যে সাতদিনব্যাপী গভীর তর্কশাস্ত্র আলোচনা হয়েছিল। ব্রহ্মগিরি দূরপাল্লার বাসের প্রধান বাসস্ট্যান্ড, এখানেই শুরু হচ্ছে জাতীয় সড়ক ৩১৬। জাতীয় সড়কপথের বাঁয়ে হান্তিয়ালি, গোখারা, গোপীনাথপুরগোলা, পানসপাড়া সব মৎস্যজীবী অধ্যুষিত গ্রাম। ডাইনে চিল্কার অজস্র খাঁড়িতে আল বেঁধে চলছে নানা প্রজাতির চিংড়ি চাষ।
চিল্কার প্রধান তিনটি স্পট হল রম্ভা, বরকুল, সাতপারা। পুরীর সবচেয়ে নিকটবর্তী সাতপাড়া পৌঁছতে সওয়া ঘণ্টা লাগল। সাতপাড়া চিল্কার ২২৯ নম্বর স্থল। ‘চিল্কা ডেভেলপমেন্ট অথরিটি’ ভবনের উল্টোদিকে উদ্যান, ‘ডলফিন মোটর অ্যাসোসিয়েশন’ ফেরিযাত্রার টিকিটঘর। এখানে রুট-১ দেড় ঘণ্টার ডলফিন দর্শন, রুট-২ সাড়ে তিন ঘণ্টার জলসফরে ডলফিন-সাগরমুখ-রাজহাঁস দ্বীপ ও রুট-৩ সাড়ে ছ’ঘণ্টায় ডলফিন-নলবন ঘোরার ব্যবস্থা। এক একটি মোটরযানে দু’টি শিশু সহ আটজন প্রাপ্তবয়স্ক বাধ্যতামূলক।
 ভারতের পূব উপকূলে ১,১০০ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত, ৬৪.৩ কিলোমিটার লম্বা চিল্কা হ্রদ ভারতের একমাত্র  সর্ব বৃহৎ লোনাজলের উপকূলীয় হ্রদ, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম লেগুন। পুরী, খুরদা ও গঞ্জাম জেলার ধার বরাবর হ্রদের বিস্তার। ভার্গবী, দয়া, মাকরা, লুনা, মালাগুনি নদী-উপনদীর জলধারাপুষ্ট চিল্কা। দয়া নদীটি হ্রদকে বঙ্গোপসাগরে যুক্ত করেছে। চিল্কার অন্তর্গত ছোট ছোট কিছু দ্বীপ রয়েছে। হানিমুন, ব্রেকফাস্ট আইল্যান্ড, বরাকুদা, নলবন, কালিজাঈ, নোয়াপাড়া, সানাকুড়া, সোমোলো, ডামকুদি, কণ্ঠপান্থ ইত্যাদি। সবজে পাহাড়টিলা আগলে রেখেছে চিল্কাকে। হ্রদকে ঘিরে ১৩২টি গ্রামে প্রায় লক্ষাধিক মৎস্যজীবী পরিবারের দিনযাপন। চিল্কার রুপোলি শস্যই যাদের রুজি-রোজগার। সাতপাড়া ‘ডলফিন পয়েন্ট’ রূপে পরিচিত। ডলফিন পয়েন্ট ট্যুরে সরকারি কড়া নিষেধ, কোনওরকম খাদ্যবস্তু, কঠিন বা তরল অব্যবহার্য সামগ্রী জলে ছুড়ে ফেলা যাবে না। ডলফিন খুবই স্পর্শকাতর জীব, বিষাক্ত পরিবেশে এদের জীবন কষ্টকর হয়ে পড়ে। সতর্কীকরণ রয়েছে ডলফিনের যেন কোনওরকম হানি না হয়। মাছ ধরার ট্রলার ডলফিন অবজারভেশন জোন থেকে প্রায় ৩০০ মিটার নিরাপদ দূরত্ব দিয়ে যাওয়া-আসা করে। তবে পর্যটকদের নৌকা আবশ্যিকভাবে ডলফিন অবজারভেশন জোন থেকে প্রায় ৫০ মিটার নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে ধীর গতিতে চলাচল করে। নির্ধারিত সর্বসাকুল্যে ৫টি পর্যটক নৌকা এই ডলফিন জোনের নিরাপত্তাবেষ্টনীর বাইরে কিছু সময় পরই ফিরে যাবে। পর্যটক ও নৌকার সারেঙদের কঠোরভাবে সাবধান করে দেওয়া রয়েছে, কোনও ডলফিন যদি নৌকার কাছাকাছি চলেও আসে, সেই ডলফিনদের নিরাপদে ফিরে যাওয়ার সময়টুকু যেন মানবিকতার খাতিরে দেওয়া হয়। কখনই উচিত নয় ছবি তোলার আতিশয্যে ডলফিনদের পিছু ধাওয়া করা। প্রসঙ্গগত, একমাত্র ওটিডিসি বোটে সাইলেন্সার ইঞ্জিন লাগানো থাকে, ফলে নৌকা চলার সময় ইঞ্জিনের আওয়াজ না থাকায় ডলফিন দেখার সুযোগ বেশি। পরিবেশবান্ধব নীতি ইদানীং চিল্কাজুড়ে। জুলাই-জানুয়ারি ডলফিনের প্রজননের সময়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সারেঙরা এইসময় ডলফিন এলাকার কিঞ্চিৎ দূরত্ব রেখে যাতায়াত করেন। 
মৃদুমন্দ হাওয়ায় কেঁপে উঠছে চিল্কার বুকে ছোট ছোট ঢেউ। উড়তে দেখা যাচ্ছে রকমারি প্রজাতির পাখি। হ্রদের মাছকে নিপুণ দাপটে ছোঁ মেরে মুখে তুলে উড়ে যাচ্ছে। যেন ‘অ্যানিম্যাল প্ল্যানেট’ বা ‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক’ চ্যানেলের তথ্যচিত্রের জীবন্ত ছবি দেখছি। গাংচিল, হাড়গিলে, ব্রাহ্মণী চিল, বালিহাঁস, সমুদ্র ঈগল, শামুকখোল, বক, সারস, মাছরাঙা, পানকৌড়ি ইত্যাদি পাখি ছাড়াও দূর-দূরান্তের নাম না জানা যাযাবর শ্রেণির পাখিরা তো আছেই। যাযাবর-পাখিরা অক্টোবর থেকে আসতে শুরু করে। পরিসংখ্যানে চিল্কায় প্রায় ৪৫ শতাংশ জলজ পাখি, ৩২ শতাংশ মরাল, ২৩ শতাংশ জলচরা-পাখি কাস্তেচরা, মদনটাক, শামুকখোল, বক, হাড়গিলে ইত্যাদি। আছে ১৪ প্রজাতির শিকারি পাখিও। রয়েছে বিরল, বিপন্ন প্রজাতির ‘ইরাবতী ডলফিন’, যারা লবণাক্ত জলেও থাকতে পারে। প্রসঙ্গত, হ্রদের কোথাও সাগরের লবণতা, কোথাও মিষ্টিজলের মিশ্রণ-অনুপাত নামমাত্র। নদী-হ্রদের মোহনায় অবিমিশ্র মিষ্টি জলপ্রবাহ। 
চিল্কার পটভূমিতে ইতস্তত ছড়িয়ে সবুজ টিলা। কোথাও হ্রদে পলি জমে চরা মাথাচাড়া দিয়েছে। শীত লগ্নে সুদূর পথের উড়ানে চিল্কার চরাগুলোয় পরিযায়ী-পাখিদের হট্টমেলা। নৌকা চরাগুলোর কাছাকাছি এলেই সন্ত্রস্ত পাখির ঝাঁক নিমেষে উধাও। তারপর নৌকার সঙ্গে তাদের নিরাপদ ব্যবধানের নিশ্চয়তা দেখেই ফেরে। চিল্কার মাঝে অসাধারণ স্থাপত্যের কালিজাঈ মন্দির। দেবীমাতা কালিজাঈ মন্দির-দর্শন না করে ধীবর সম্প্রদায় চিল্কায় পাড়ি জমান না। চিল্কার নলবনে পাখপাখালির রাজ্যপাট। চারপাশে পাখিদের চমকদমক, কিচিরমিচির। শীতে প্রায় শ’দুয়েক প্রজাতির পরিযায়ী পাখির অগাধ বিচরণক্ষেত্র। বৈকাল হ্রদ-কাস্পিয়ান সাগর-ওরাল সাগর-মঙ্গোলিয়া-রাশিয়া-লাদাখ, মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া থেকে আসে ওই পরিযায়ীরা।
কীভাবে যাবেন: পুরী থেকে প্যাকেজ ট্যুরে/গাড়ি ভাড়ায় পর্যটকরা চিল্কাভ্রমণে আসেন। দক্ষিণ-পূর্ব রেলপথের ট্রেন চিল্কায় থামে। সড়কপথে জাতীয় সড়ক ৫ অথবা বিমানপথে ভুবনেশ্বর থেকে গাড়িভাড়া। 
কী দেখবেন: নৌকা-প্যাকেজ ভ্রমণে হ্রদ, পাখি এবং ডলফিন দর্শন। 

 

27th     May,   2023
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ