বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিকিকিনি
 

চায়ের আড্ডায় মনযাপন 
 

আড্ডার শুরু
বছর আটেক আগে একটা কর্পোরেট ট্রেনিং কোম্পানি চালাতেন সৌভিক বিশ্বাস। এই সংস্থার মাধ্যমে তাঁরা বিভিন্ন কর্পোরেট কর্মীদের ‘সফট স্কিল ট্রেনিং’ করাতেন। যাতে থাকত অনুপ্রেরণামূলক বিভিন্ন অনুষ্ঠান। এই সেশনগুলোয় তাঁরা দেখেছিলেন, অনেকে অনেক কথা বা প্রশ্ন ওই সময়ে, ওই পরিবেশে হয়তো বলে উঠতে পারছেন না। কারণ পাশে সহকর্মীরা আছেন। দেখা গেল, সেশন শেষে অনেকে পরবর্তীকালে সৌভিককে ফোন করে আলাদা করে কথা বলতে চাইছেন। তাই থেকে তাঁর মনে হয়েছিল, আলাদা করে কিছু করা দরকার। তাই ২০১৭ সালে শুরু হয় সৌভিকের নতুন উদ্যোগ, ‘টি-টকার্স’ (tea-talkers)। এই গ্রুপটি শহরের বিভিন্ন কাফেতে বসতে শুরু করল। 
হঠাৎ কাফে কেন? সৌভিকের কথায়, ‘যাঁরা কাফেতে আড্ডা দেওয়ার জন্য যান, খেয়াল করে দেখবেন তার মধ্যে ৮০-৮৫ শতাংশ মানুষ বিভিন্ন সমস্যার কথা আলোচনা করেন। কারও কর্মক্ষেত্রে সমস্যা, কারও পরিবারে, কারও বা কেরিয়ার। দু’তিন ঘণ্টা কাটিয়ে চা-কফি-স্যান্ডউইচ খেয়ে তাঁরা বেরিয়ে আসছেন। কিন্তু সমস্যার সমাধান হচ্ছে কি? তিন-চার মাস পরে কাফেতে ফিরে হয়তো একই সমস্যা নিয়ে আলোচনা করছেন। অর্থাৎ সমস্যার হিল্লে হল না। আবার কেউ এমনও আছেন, কোথাও গিয়ে এমন কথা আলোচনা করতেই চাইছেন না। তাঁরা হয়তো অবসাদে ভুগছেন, কিন্তু বুঝতে পারছেন না। এধরনের নানারকম প্রবণতা তৈরি হচ্ছে আমাদের গ্যাজেট নির্ভর যান্ত্রিক জীবনযাত্রায়। আজ থেকে তিরিশ-চল্লিশ বছর আগে যা এভাবে ছিল না। তখন সামাজিক জীবন অনেক প্রাণবন্ত ছিল। এখনও সামাজিক জীবন নেই তা নয়, কিন্তু তা অনেকটাই যান্ত্রিক।’
কথা এবং চা
কাফে কীভাবে এই সমস্যায় সাহায্য করতে পারে? ‘সমস্যায় জড়িত মানুষকে একটা নন-জাজমেন্টাল প্ল্যাটফর্ম দেওয়ার কথা মনে হয়েছিল। যাঁরা সেখানে কথা বলবেন, তাঁরা নন-জাজমেন্টাল হবেন, যাঁরা শুনবেন তাঁরাও একইভাবে কারও ভালো-মন্দ বিচার করবেন না। আর তার জন্য কাফেতে বসে কথা বলা শুরু ‘টি-টকার্স’-এর। কাফে কারণ, সেখানকার পরিবেশটা একেবারেই ফর্মাল নয়। কাফের চেয়ার টেবিল সরিয়ে বসার জায়গা করে শুরু হয় আদানপ্রদান। টি-টকার্সে যাঁরা আসেন, তাঁদের জন্য শর্ত একটাই। যতক্ষণ আড্ডা চলবে, ততক্ষণ মোবাইলে হাত দেওয়া বারণ। জরুরি পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে এমন আশঙ্কা থাকলে সেদিন তিনি সেশনে আসবেন না। এই শর্ত অবশ্যপালনীয়,’ বললেন সৌভিক। 
তিনি বোঝাতে চাইলেন, ‘এই আড্ডায় যে কেউ আর একজনকে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন, বা কিছু শেয়ার করতে পারেন।’ এখানে তিনি ট্রেনার হিসেবে নন, আড্ডার আর একজন অংশগ্রহণকারীর ভূমিকাই পালন করেন। এভাবে সকলে মিলে তৈরি হয় একটা কমিউনিটি। এক একজন হয়তো এক এক রকম প্রত্যাশা নিয়ে আসছেন। বয়স্করা আসছেন একাকীত্ব ভুলে পুরনো জীবনে ফিরতে, চাইছেন কমবয়সিদের সঙ্গে কথা বলতে। আর অল্পবয়সিরাও তাঁদের ভালো রাখার চেষ্টা করছে আড্ডায়। তাঁর কথায়, ‘যে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে তার প্রক্রিয়াটা একেবারেই সিরিয়াস নয়। অর্থাৎ এটা ঠিক আলোচনা নয়, আড্ডা। এখানে গানবাজনা হয়। সবাই সবার মতো করে কথা বলেন। এই কথায় লুকিয়ে থাকে আর একজনকে অনুপ্রাণিত করার মতো রসদ।’
ফেসবুক গ্রুপ থেকে প্রচার শুরু প্রাথমিকভাবে। এই গ্রুপ থেকে রেজিস্ট্রেশন শুরু করে বেছে নেওয়া হয় ‘আড্ডাবাজদের’। ‘এর জন্য কিছু টাকা দিতে হয়। কারণ একটা কাফেতে গিয়ে আপনি তো টাকা খরচ করেই চা কফি খান,’ বলছিলেন সৌভিক। একটি সেশনে ১৫-১৮ জন বিভিন্ন বয়সের নারী পুরুষ বেছে নেওয়া হয়। 
কী নিয়ে কথা
আড্ডার বিষয় কি ঠিক করা থাকে? ‘এতদিন পূর্বনির্ধারিত বিষয় থাকত না। লকডাউনের মধ্যে ফেসবুকে অডিও লাইভ আড্ডা হতো, কারণ তখন মুখোমুখি আড্ডা সম্ভব ছিল না। বিষয় হিসেবে থাকত, ‘আমার প্রথম প্রেম’ বা ‘আমার কলেজের দিন’ বা ‘একলা ঘরের কোণ’— এইরকম। এই বিষয়গুলোর সঙ্গে প্রতিটি মানুষ কানেক্ট করতে পারবেন। লকডাউনে এক ঘণ্টার আড্ডায় দারুণ সাড়া পেয়েছি। অনেকে বলেছেন সেটা তাঁদের কাছে খোলা হাওয়ার মতো ছিল,’ জানালেন সৌভিক। তাঁর কথায়, ‘আমরা চাই যিনি আসছেন, তিনি ফাঁকা মাথায় আসুন। অর্থাৎ কোনও ব্যাগেজ না নিয়ে। মনযাপনের নতুন অধ্যায় সঙ্গে নিয়ে তারপর ফিরে যান। যেমন একদিন আড্ডা হয়েছে ‘ভাবনা ও লেখা’ নিয়ে। আড্ডা হয়েছে ‘সঙ্গীত ও জীবন’ নিয়ে। এখানে নানা বাদ্যযন্ত্র ছিল। নানারকম মেডিটেশনও হয়েছে। ওই দু’-তিন ঘণ্টায় একটা অন্যরকম মানসিক স্তর তৈরি করার চেষ্টা করি আমরা।’ 
সাইকোলজির ভূমিকা
এই আদানপ্রদানে সাইকোলজি বা কোনও মেডিক্যাল দিকের সম্পর্ক রয়েছে? সৌভিকের দাবি, ‘আমরা কোনও সাইকোলজিক্যাল টুল ব্যবহার করি না। সাইকোলজিস্ট যা করেন, আমরা তা করতে পারি না। আমরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নই। কর্পোরেট ট্রেনিংয়ে আমরা সাইকোলজিক্যাল টুলস ব্যবহার করতাম, কিন্তু সেটা ছিল নন-মেডিক্যাল। যেমন পার্সোনালিটি অ্যাসেসমেন্ট। এই ধরনের টুলস ব্যবহার করার সময়ও আমরা সাইকোলজি বা সেই সংক্রান্ত কোনও শব্দ বলি না। কারণ তাতে সচেতন হয়ে কেউ শেয়ার করতে দ্বিধাবোধ করতে পারেন। আমরা বলি, আড্ডা দিতে এসো। মেডিটেশন এবং ব্রিদিং টেকনিক ব্যবহার করি। এগুলোও বিজ্ঞানসম্মত। এর মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ডিটক্সিফাই হয়। সঙ্গে অবশ্যই থাকে মিউজিক।’
আড্ডা থেকে উঠে আসে অনেক কিছু। অনেকেই ভাবেন, আড্ডায় ফেলে আসব নিজের নেতিবাচক ভাবনাচিন্তা। বা কোনও পিছুটান যা কষ্টদায়ক। ‘এভাবে অনেকের বাঁধভাঙা কষ্ট হয়তো বেরিয়ে আসে। কেউ ভেঙে পড়েন। হয়তো প্রিয়জনকে হারানোর দুঃখ বা খুব সংবেদনশীল কোনও বিষয়, যেটা কোথাও বলতে পারেননি, আড্ডায় বেরিয়ে এসেছে। সেটা সামলাতে হয় খুব সাবধানে। শেয়ার করার পরে আড্ডায় আবার অনেকেই ফিরে আসেন। কারণ সেই ভরসার জায়গাটা পান। ধরে নিন একটা সেশনের ৫০ শতাংশ মানুষ ফিরে আসেন। বাকি ৫০ শতাংশ থাকেন নতুন,’ বললেন সৌভিক।
ঝুঁকি এড়ানো
কিন্তু এই আড্ডায় এসে কি সিরিয়াস মানসিক সমস্যার সমাধান সম্ভব? সৌভিক বলেন, ‘সিরিয়াস সমস্যা আমরা ফেস করিনি তা কিন্তু নয়। এমন কাউকেও আমরা পেয়েছি যিনি আত্মহত্যাপ্রবণ ছিলেন। সেটা ২০১৮-র কথা। তার মধ্যে দু’বার অ্যাটেম্পট করে ফেলেছেন তিনি। তারপর আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ। এখনও তাঁর সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা দিই। বলতে গর্ব হয়, তিনি মূলস্রোতে ফিরে আসতে পেরেছেন। মেডিক্যাল কাউন্সেলিং ছাড়াই। এর দুটো কারণ। উনি একাকীত্বে ভুগছিলেন, আমাদের কাছে এসে একটা সোশ্যাল লাইফ পান। সঙ্গে মেডিটেশন টেকনিক দিয়ে তাঁর হরমোনে সেরাটোনিন এবং ডোপামাইন রিলিজ করাতে পেরেছিলাম আমরা। তাতে কাজ দিয়েছিল। এবার সবসময় প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই সেটা সম্ভব হবে, এটা হয়তো বলা যায় না। যাঁর কাউন্সেলিং আশু প্রয়োজন তাঁকেও আমরা আশ্বাস দিয়ে বলতে পারি, চলো আমরাও যাব তোমার সঙ্গে। একবার কথা বলেই দেখো মনোবিদের সঙ্গে।’   
মা পুলিশে চাকরি করতেন। তাই সৌভিক জানেন, এই পেশার মানুষ কতটা স্ট্রেস সামলান। এরকম নানা পেশায় মানুষজন প্রয়োজনে যাতে একটু স্বস্তি পান তার জন্য তাঁরা ছোট ছোট কমিউনিটি পাড়ায় পাড়ায় তৈরি করে ভরসা দিতে চান।সুতরাং চায়ে আড্ডা জমুক, জমুক বন্ধুত্বও। 

18th     June,   2022
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ