বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
আমরা মেয়েরা
 

পা চালিয়ে সুস্বাস্থ্যের
লক্ষ্যে পিঙ্কাথন

ম্যারাথন দৌড় প্রতিযোগিতায় পুরুষদের পাশাপাশি শামিল মহিলারাও। তাঁদের এই ম্যারাথনের নাম পিঙ্কাথন। কেমন সেই দৌড়? কী-ই বা তার উদ্দেশ্য? বিস্তারিত খবরে কমলিনী চক্রবর্তী।
 
স্যার ওয়াল্টার ডিজনির একটি বিখ্যাত উক্তি রয়েছে, ‘কোনও কিছু নিয়ে স্বপ্ন দেখতে পারলে তবেই তা বাস্তবে রূপান্তরিত করা যায়।’ শর্মিলা মুঞ্জ, অপর্ণা ডি’সুজা আর সোনিয়া কুলকার্নি এই উক্তির সারসত্য প্রমাণ করেছিলেন ২০১৪ সালে। মুম্বই থেকে পুনে ম্যারাথন দৌড়ে মোট তিন দিনে প্রায় ১৫২ কিমি পথ পাড়ি দিয়েছিলেন তাঁরা। উদ্দেশ্য ছিল ব্রেস্ট ক্যান্সার বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো এবং মহিলাদের সার্বিক সুস্থতা বিষয়ে অবগত করা। এই তিন মহিলার কেউ-ই শারীরিকভাবে ফিট ছিলেন না। অপর্ণা ফেসিয়াল প্যারালিসিসে আক্রান্ত হন এবং বহু চিকিৎসা ও চেষ্টার পর রোগমুক্ত হন। সোনিয়ার ছিল প্রচণ্ড থাইরয়েডের সমস্যা। আর শর্মিলার ছিল হাইপার অ্যাংজাইটিজনিত নানারকম শারীরিক জটিলতা। অনেক চিকিৎসার পর স্বাস্থ্য উন্নত করতে এবং শরীরকে সচল রাখতে এঁরা তিনজনেই দৌড়নোর অভ্যাস করেন। বছরখানেক পর বুঝতে পারেন শরীরকে সচল রাখতে এটি অনবদ্য। তারপরেই এটিকে সচেতনতার হাতিয়ার করে তুলতে চান তাঁরা এবং মুম্বই-পুনে ম্যারাথন দৌড়ের আয়োজন করেন। 

শুরুর কথা
মহিলাদের ম্যারাথন, যার পোশাকি নাম পিঙ্কাথন, তার শুরুটা কিন্তু হয়েছিল এর অনেক আগে ২০০৪ সালে। মহিলাদের স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতা এবং শারীরিক সুস্থতার লক্ষ্য নিয়েই এই দৌড় প্রতিযোগিতার সূত্রপাত মুম্বই শহরে। ম্যাক্সিমাস মাইস কোম্পানির কর্ণধার রীমা সাংভি এই দৌড় প্রতিযোগিতার মূল হোতা। তাঁর কথায়, ‘মহিলারা মায়ের জাত। নিজেদের আগে সন্তান ও সংসারকে রাখাই তাঁদের স্বভাব। নিজেদের দিকে অনেক সময়ই মন দেন না মহিলারা। প্রচণ্ড অসুস্থ হলে তবে চিকিৎসা করান। এর ফলে অনেক রোগ এমন পর্যায়ে চলে যায়, যার পর আর চিকিৎসা সম্ভব হয় না। এই পরিস্থিতি আটকানোর জন্যই পিঙ্কাথনের মতো দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন। দৌড়ের মতো সার্বিক এক্সারসাইজ খুব কমই হয়। এর জন্য কোনও গ্রুমার বা মেন্টর লাগে না। নিজে থেকেই তা করা যায়। সব মিলিয়ে তাই দৌড় প্রতিযোগিতার কথাই ভাবলাম।’ 
মহিলাদের ম্যারাথনের সেই শুরু। ২০০৪ সালে মুম্বইয়ে যে ম্যারাথনটি শুরু হয় তার অন্যতম উদ্যোক্তা কিন্তু ছিলেন একজন পুরুষ, মিলিন্দ সুমন। মহিলাদের এই ম্যারাথনের প্রচারের জন্য রীমার একটা পরিচিত মুখের প্রয়োজন হয়, আর ঩কাজটি করেন মিলিন্দ। তাঁর কথায়, ‘পিঙ্কাথন এক অসাধারণ প্রয়াস। মহিলারা আজ ঘরে-বাইরে সমান দক্ষ ও সফল। তবু নিজেদের প্রতি অবহেলা যেন তাঁদের জিনগত অভ্যাস। এর প্রতিকার দরকার। আর পিঙ্কাথনের মাধ্যমে যদি মহিলাদের স্বাস্থ্য সচেতন করে তোলা যায় তাহলে এর চেয়ে ভালো আর কী-ই বা হতে পারে?’

পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা
মুম্বইতে শুরু হলেও খুব তাড়াতাড়ি এই দৌড় প্রতিযোগিতা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত এই প্রতিযোগিতা ভারতের সব রাজ্যে ও শহরেই ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে। তিন, পাঁচ, দশ এবং একুশ কিলোমিটারের দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন শুরু হয় বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ, দিল্লি, পুনে, কলকাতা, গুয়াহাটির মতো শহরেও। জনপ্রিয়তার সঙ্গেই বাড়ে পিঙ্কাথনের প্রতিযোগীর সংখ্যা। আপাতত প্রতি বছরই বিভিন্ন শহর থেকে প্রায় পঞ্চাশ হাজার মহিলা এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। 
সোনিয়া কুলকার্নির কথায় আবারও ফেরা যাক। তাঁর বক্তব্য, ‘দৌড়ব বললেই তো আর দৌড়নো যায় না। তার জন্য আগেপিছে অনেক বিষয় ভাবতে হয়। যেমন আমার থাইরয়েডের সমস্যা যখন গুরুতর আকার ধারণ করল তখন আমার ওজন এসে ১০৪ কেজিতে ঠেকেছিল। সেই সময় তো আর চাইলেই ম্যারাথনে নাম লেখাতে পারতাম না। ডাক্তার তো বলেই খালাস ওজন কমাতে হবে। সার্জারি করাব কি না ভাবতে ভাবতে আমার পুত্রের উৎসাহে তার সঙ্গেই ভোররাতে উঠে দৌড়তে শুরু করি। প্রথম দু’-তিনদিন নিজেদের ফ্ল্যাটের চত্বরটুকুও পার করতে পারিনি। তারপর নিজেই নিজের জন্য লক্ষ্য স্থির করলাম। এই সময়ের মধ্যে এত দূর যেতেই হবে। মনের জোরে সেই লক্ষ্যে পৌঁছেও গেলাম। ভীষণ ভালো লাগল। তারপর লক্ষ্যের মাত্রা আরও একটু বাড়ালাম। সেটা অতিক্রম করার পর আর একটু বাড়ল লক্ষ্য। এইভাবে একটু একটু করে নিজের মন ও শরীরকে আয়ত্তে আনতে সক্ষম হয়েছিলাম। প্রথম তিন মাস শুধু লক্ষ্য স্থির ও পূরণ করতেই কেটে গেল। ক্রমশ বুঝতে পারছিলাম আমার শরীর আমার নাগালে এসে যাচ্ছে। তখন ওজন নিয়ে দেখলাম বেশ কিছুটা ওজন কমেছে। উৎসাহ বাড়ল। এইভাবে এগিয়ে আজ আমি পিঙ্কাথনের সদস্য হতে পেরেছি। আর শরীর যত আয়ত্তে এসেছে, রোগও ততই কমেছে। ফলে শরীর ফিট রাখা এবং মন ভালো রাখা— দুটো কাজই সম্ভব হয়েছে এই দৌড়ের মাধ্যমে।’

লক্ষ্য যেথা স্থির 
পিঙ্কাথন কিন্তু শুধুই মহিলাদের দৌড় প্রতিযোগিতা নয়। তার বিভিন্ন দিক রয়েছে। মূল লক্ষ্য অবশ্যই মহিলাদের ফিজিকাল ফিটনেস, কিন্তু এছাড়াও ব্রেস্ট ক্যানসারের বিরুদ্ধে সচেতনতা বাড়ানো, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, সন্তানসম্ভবা অবস্থায় সুস্থ থাকা ইত্যাদি নানাবিধ কর্মশালা নিয়ে এই প্রতিযোগিতাটি এগয়। মহিলাদের মানসিক দৃঢ়তা বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়েও এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। পরিবার ছাড়াও যে তাঁদের নিজেদের পৃথক অস্তিত্ব রয়েছে এবং নিজেদের ভালো রাখার মাধ্যমেই যে পরিবারকে ভালো রাখা সম্ভব— এই বিষয়গুলো পিঙ্কাথনের কর্মশালার অন্যতম অঙ্গ। রীমা বলেন, দিনে অন্তত দশ মিনিট মহিলাদের শরীরচর্চার জন্য রাখা উচিত। তিনি আরও বলেন, পিঙ্কাথনের দৌড়ের মধ্যে দুটো স্তর সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছে ভারতে। প্রথমটি দশ কিলোমিটার ‘ফিটনেস রান’ আর দ্বিতীয়টি ব্রেস্ট ক্যান্সারের বিরুদ্ধে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য ৩ কিলোমিটার ‘সারভাইভার রান’।

সাহায্যের হাত
রীমা বলেন, মেয়েরা একে অপরকে সাহায্য করার জন্য মুখিয়ে থাকে। নিজের সমস্যার সমাধানের সূত্র ধরে যদি অন্যের সমস্যা লাঘব করা যায়, তাহলে সেই কাজে সবার আগে মহিলাদের পাবেন। আর পিঙ্কাথনের সারভাইভার রানও এমনই একটা সাহায্যের পথ। এই দৌড়ে এমন মহিলারাই নাম লেখান যাঁরা ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ হয়েছেন। নিজেদের চিকিৎসাগত অভিজ্ঞতার কথা জানানো, জীবনযাপনের বদল বিষয়ে অন্যকে ওয়াকিবহাল করা ইত্যাদির মাধ্যমে তাঁরা এই রোগে আক্রান্ত মহিলাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে চান। আর এই দৌড়টা একটা প্রতীক। মারণ রোগ অতিক্রম করে সুস্থ হওয়ার এবং সুস্থ থাকার অঙ্গীকারও বলতে পারেন। এতে অন্যকে সচেতন করা যায়, উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব হয়। সব মিলিয়ে পিঙ্কাথনের এই স্তরটি খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এবং এই দৌড়ে প্রতিযোগীর বয়সও বিভিন্ন। ১৭-১৮ বছরের খুদে সদস্য থেকে ৭০ বছরের বৃদ্ধা, সকলেই অন্তর্ভুক্ত। ক্যান্সার সারভাইভার রানের শেষে মহিলারা ম্যামোগ্রাফি করার সুযোগও পান। বিভিন্ন ক্যান্সার হসপিটাল থেকে এই কর্মশালার আয়োজন করা হয়।        

স্তরের নানারকম
পিঙ্কাথন যদিও মহিলাদের ম্যারাথন, আর ম্যারাথন শব্দটার সঙ্গে দৌড়নো বিশেষভাবে যুক্ত, তবু এই প্রতিযোগিতায় হাঁটারও একটি বিভাগ রয়েছে। এই বিভাগটি খুবই সুন্দর। এতে মহিলারা একে অপরের পরিপূর্ণতায় সাহায্য করে। এই বিভাগটিতে হাঁটার জন্য বিভিন্ন ধরনের স্তর রয়েছে। ৫, ১০, ২১ কিমির স্তরে হাঁটার সুযোগ পান মহিলারা। এই বিভাগটিতে মহিলাদের কর্মদক্ষতা ও সামাজিক সাফল্য উদ্‌যাপন করা হয়। পোশাকি ভাষায় বিভাগটিকে বলা হয় ‘সেলিব্রেটিং উওম্যানহুড’।      
আরও যে স্তরগুলি উল্লেখযোগ্য তার মধ্যে প্রথমটির নাম ‘ভিসুয়ালি ইমপেয়ারড’। এই বিভাগে এমন মহিলারা অংশগ্রহণ করার সুযোগ পান, যাঁরা চোখে দেখেন না। ৩, ৫ এবং ১০কিমি দৌড়ের আয়োজন করা হয় এই বিভাগের জন্য। এবং তার আগে মহিলাদের নানারকম প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।  চোখের পরীক্ষা ও সঠিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মহিলাদের উন্নততর জীবনের হদিশ দেওয়া হয়।  প্রশিক্ষকরা প্রথমে মহিলাদের পরীক্ষা করেন। নানারকম আধুনিক পদ্ধতিতে চোখের পরীক্ষা হয়। তারপর তাঁদের মনের জোর বাড়ানোর জন্য থাকে মেন্টাল গ্রুমিং সেশন। ম্যারাথনের মাস দুয়েক আগে থেকেই তাঁদের তৈরি করা হয়। মানসিক সাহসের উপর ভর দিয়ে মহিলারা অন্ধকার থেকে আলোর জগতে পা বাড়ান। রীমা বললেন, ‘এই ধরনের মহিলাদের মুখের হাসি আমার এই প্রয়াসকে সার্থক করে তোলে।’ বিজয়ীর জন্য থাকে একটি ব্রেল মেডেল। তাতে লেখা থাকে, ‘দৌড়ের মাধ্যমে আমি অন্যকে উৎসাহ দিই।’  

মাতৃত্বের উদ্‌যাপন
সন্তান সম্ভাবনার সময় মহিলারা একটু জবুথবু হয়ে যান। বিশেষত আমাদের দেশে এই সময়কালে মেয়েদের অনেক সময় বিশেষ কিছু বাধা-নিষেধের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। অথচ সন্তান সম্ভাবনা মহিলাদের জীবনে এক অনন্য অনুভূতি। খুশির সময়। সেই সময়টাকে উদ্‌যাপন করার জন্যই রয়েছে পিঙ্কাথনের প্রেগন্যান্সি রান। এই বিভাগটি ২০১৫ সালে শুরু হয়েছিল। মাতৃত্ব উদ্‌যাপনের মাধ্যমে মায়ের সঙ্গে সন্তানের বন্ধন আরও নিবিড় হয় বলেই পিঙ্কাথন প্রতিযোগীদের দাবি।  মহিলাদের যে এই সময় ঘরের চার দেওয়ালে বন্দি রাখা উচিত নয়, বরং মাতৃত্বের স্বাদ নিতে দিকে দিগন্তরে তাঁদের বেরনোর সুযোগ দেওয়া দরকার, পিঙ্কাথন প্রেগন্যান্সি রান সে কথাই প্রচার করতে চায়। 

স্বয়ংসম্পূর্ণ মেয়েরা
এই দৌড়ের মাধ্যমে আসলে মহিলারা নিজেদের মতো করে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে সক্ষম হয়। পরিবার, সন্তান, সংসার ও সমাজের বাইরেও যে তাঁরা নিজেরাই স্বয়ংসম্পূর্ণ এটাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মহিলারা নিজেদের জীবন এবং একে অন্যকে সেলিব্রেট করতে শেখেন। নিজেকে প্রাধান্য দিলে যে অন্যকে ছোট করা হয় না, এই সারসত্যাটা নিজেরাই মনে মনে উপলব্ধি করেন এবং ডানা মেলে খুশির জোয়ারে ভাসার অনুভূতি উপভোগ করেন। মহিলারা অনেক ক্ষেত্রেই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে সমাজে ও সংসারে প্রতিষ্ঠিত। সেই ধারণা ভেঙে দেওয়ার সময় এসেছে। মহিলাদের এই টুকরো টুকরো প্রয়াসের মাধ্যমেই তাঁরা উন্নততর জীবনের স্বাদ পাবেন বলে আশা রীমা ও পিঙ্কাথনের অন্য সদস্যদের।

20th     May,   2023
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ