মুঠোফোনের স্ক্রিনে এক অমোঘ আকর্ষণের হাতছানি অনলাইন গেম। কিছু ক্ষেত্রে তা নেশায় পরিণত। এমন আকর্ষণীয় বস্তুই তৈরি করেন অসংখ্য গেম ডেভেলপার। এই পেশায় ক্রমশ বাড়ছে মহিলাদের উপস্থিতি। বিষয়টি নিয়ে লিখছেন কমলিনী চক্রবর্তী।
চন্দ্র
পঞ্জিকা বা লুনার ক্যালেন্ডার অনুযায়ী সময়টা ১৩৭২। রাক্ষসের খোঁজে চলেছে একটি চরিত্র। তার দেশ মহামারীতে আক্রান্ত। আর সেই রোগের হাত থেকে দেশকে বাঁচাতে পারে একমাত্র রাক্ষসই। ‘নেভারউইন্টার’ দুর্গে বাস করেন দেশের রানি অ্যারিবেথ। তাঁর নির্দেশেই চরিত্রটি রাক্ষস জোগাড় করার কাজে নেমেছে। প্রচুর খাটাখাটনির পর রাক্ষস জোগাড় করে দেশে ফিরে এল সে। রানির হাতে সমর্পণ করল রাক্ষসদের। তাদের সাহায্যে মহামারী যখন প্রায় নিয়ন্ত্রণের পথে তখনই ঘটল আর এক বিপত্তি। দুর্গ আক্রমণ করল ভিন দেশের দুষ্টু রাজা ডেসথারের সেনা। চরিত্রটি কি পারবে দেশ ও দেশের রানিকে বাঁচাতে?
নাহ্, এ কোনও রূপকথার গল্প নয়। বরং বিখ্যাত অনলাইন গেম ‘নেভারউইন্টার নাইটস’-এর কাহিনি। আর এই খেলার মুখ্য চরিত্র আপনিই। রাক্ষসের খোঁজ থেকে দেশ বাঁচানোর দায়িত্ব আপনারই উপর!
খেলার ছলে
‘খেলার ছলে ষষ্ঠীচরণ হাতি লোফেন যখন তখন...’ অনলাইন গেমিং-এর চিত্রটা খানিকটা তেমনই! স্মার্টফোনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠা এক ভিন্ন জগতের সন্ধান পাবেন এখানে। এমন এক জগৎ যার মোহে মুগ্ধ হয়ে অনেকেরই কেটে যায় দিনের বেশ খানিকটা সময়। সে এক ভিন্ন পৃথিবী। আর এই পৃথিবীর কল্পচিত্র এঁকে বিভিন্ন কোডে যাঁরা খেলাগুলো বানান, তাঁদেরই বলা হয় ‘গেম ডেভেলপার’। সফটওয়্যার নিয়ে এঁদের কারবার।
গেম ডেভেলপিংয়ের পেশায় এতদিন পর্যন্ত পুরুষেরই একচ্ছত্র অধিকার ছিল। কিন্তু দিন পাল্টাচ্ছে, এখন গেমিংও মেয়েদের হাতের নাগালে। ভারতের ‘গেমিং’ দুনিয়ায় প্রথম মহিলা, যিনি নিজে গেম ডেভেলপার হিসেবে নাম করে ফেলেছেন তিনি পূর্ণিমা সীতারামন। আর শুধু নামই করেননি, মহিলা গেম ডেভেলপার হিসেবে একেবারে হল অব ফেম পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছেন।
পূর্ণিমার গল্প
পূর্ণিমা জানালেন, সফটওয়্যার ডেভেলপার হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়ান একটা কোম্পানিতে কাজ নিয়েছিলেন তিনি। সেখানেই তাঁকে প্রথম একটি অনলাইন গেম বানানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। পুরনো ও জনপ্রিয় খেলা নেভারউইন্টার নাইটসের আদলে একটা ভিন্ন স্বাদের অনলাইন গেম বানাতে বলা হয়েছিল। গল্পটা এমনভাবে সাজাতে হবে যাতে খেলাটির প্রতি খেলোয়াড়দের আকর্ষণ বজায় থাকে আগাগোড়া। এমন একটা প্লট যার উত্তেজনায় মজে গিয়ে দর্শক স্ক্রিনে আটকে থাকবেন বহুক্ষণ। নেভারউইন্টার নাইটসের আদল বজায় রাখতে হলে একই সঙ্গে রূপকথা আর বাস্তবের মিলমিশ করা প্রয়োজন। প্লট বানানোর সঙ্গে সঙ্গে তা দৃষ্টিনন্দনও করতে হবে। তার জন্য আবার চাই মনভোলানো গ্রাফিক্স। ফিগার তৈরি, রং বাছাই— সব ক্ষেত্রেই নৈপুণ্য দরকার। এগুলোও মাথায় রাখতে হয়েছিল পূর্ণিমাকে।
পূর্ণিমার কথায়, ‘অনলাইন গেমিং বিষয়ে একটা ধারণা আমার ছিল। খেলতেও ভালোই লাগত। কিন্তু তা তৈরি করতে ঠিক কতটা শিল্পগুণ লাগে, তা জানতাম না। তবে এমন একটা খেলার বিষয়ে জানতাম যাকে অনলাইন গেমিংয়ের ‘বাইবেল’ বলা হয়। খেলাটির নাম ‘ডানজিয়নস অ্যান্ড ড্রাগনস’। হাতেকলমে গেম তৈরি করার আগে ওটাই বারবার দেখতে লাগলাম। খেলার ভিস্যুয়ালস কেমন, স্পিড কত, ভাষা কীভাবে সাজানো হয়েছে, গল্পের প্লট কীভাবে এগিয়েছে, খেলার নেপথ্য কাহিনি কোথায় কেমনভাবে সাজানো হয়েছে (প্লেসিং অব দ্য রিটেন ভিস্যুয়াল)— এই সবই খুব খুঁটিয়ে খেয়াল করলাম। বেশ কয়েকবার খেলেও নিলাম নিজেই। একটা পর্যায়ে পৌঁছে আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল। বুঝলাম আমি তৈরি।’
গেমিংয়ের সাফল্য
অনলাইন গেমিং-এর ক্ষেত্রে ‘প্লেসিং অব দ্য রিটেন ভিস্যুয়াল’ ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। খেলার গল্প, চরিত্র এবং নিয়ম সবই লেখা থাকে ওর মধ্যে। জরুরি এই তথ্যগুলো স্ক্রিনে এমনভাবে রাখতে হবে যাতে দর্শক তা দেখতে পায়, বুঝতে পারে, অথচ তা যেন খেলার দৃশ্যগুলোকে নষ্ট না করে। খেলার সিন বা দৃশ্যগুলোই কিন্তু অনলাইন গেমিংয়ের প্রাণশক্তি। তাই বলে শুধুই যদি চিত্র সাজানো থাকে তাহলে তো লোকে খেলাটা সম্বন্ধে ধারণাই করতে পারবে না, খেলবে কী করে? ফলে গল্পটা সাজাতে হবে, তা দর্শককে দিয়ে পড়াতেও হবে কিন্তু তার প্রাধান্য যেন কোনওভাবে দৃশ্যাবলিকে ছাপিয়ে না যায়। এরপর রয়েছে মিউজিক। একটু মৃদু আবার উত্তেজনায় পূর্ণ একটা মিউজিক ট্র্যাক ভরতে হবে। তা চলবে খেলার তালে তালে। এই টুকরো টুকরো বিষয়গুলোর উপরেই গেমিংয়ের সাফল্য নির্ভর করে।
অধিকার বিস্তার
তবে এই ধরনের নানা প্রযুক্তিগত বিষয় ছাপিয়ে পূর্ণিমার কাছে যেটা সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং ছিল সেটা হল, পুরুষতন্ত্রের বেড়া ডিঙিয়ে মহিলা হিসেবে গেম ডেভেলপিংয়ের দুনিয়ায় নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা। তিনি বললেন, ‘আমাদের সমাজের ছত্রে ছত্রে পুরুষতন্ত্রের দাপট চলছে। সেটা ভাঙা নেহাত সহজ কাজ তো নয়। আর এই পুরুষতন্ত্রের বিস্তার দেশে-বিদেশে সব জায়গায়। বিদেশের গেমিং ওয়ার্ল্ডেও একই চিত্র। ফলে ভারতীয় বলে আমি অসুবিধায় পড়েছি, একথা ঠিক নয়। সমস্যা শুধু মহিলা বলে! তাই বলে কি আর হার মানলে চলে? কাজ যখন পেয়েছি তখন তার আগাপাশতলা দেখে তবে না ছাড়ব!’ পূর্ণিমার তৈরি প্রথম খেলাটির নাম ‘পটবিংসু’। এটি কোরিয়ান মার্কেটের জন্য তৈরি করেছিলেন তিনি। এরপর মার্কিন গেম তৈরির কোম্পানি জিংগায় লিড গেম ডিজাইনার হিসেবে যোগদান করেন। বললেন, ‘মেয়েরা যত নিজেদের অধিকার বিস্তার করবে পুরুষতন্ত্র ততই তাদের জায়গা দিতে বাধ্য হবে। আমার ক্ষেত্রেও তেমনটাই হয়েছিল। প্রথম দিকে গেমিংয়ের দুনিয়ায় একা মহিলা হিসেবে আমাকে দেখে যাঁরা তাচ্ছিল্য করতেন, তাঁরাই একদিন আমার আধিপত্য মেনে নিলেন। আর আমি জিংগা ইঙ্ক-এর লিড গেম ডিজাইনার হয়ে উঠলাম।’
নিজের পছন্দ
অনলাইন গেমার হিসেবে পূর্ণিমা যাত্রা শুরু করেছিলেন বছর পনেরো আগে। দীর্ঘ এই সময় জুড়ে নানারকম চরিত্র বানিয়েছেন তিনি। গল্পের জাল বুনেছেন সেইসব চরিত্র ঘিরে। এত কাজের মধ্যে সবার সেরা কোনটা? তাঁর মতে, ‘বায়োশক থ্রিডি’ মোবাইল গেমটি । এই খেলাটি বানাতে তাঁকে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে বলে জানিয়েছেন পূর্ণিমা। তাঁর বক্তব্য, এই খেলাটার ব্যাপ্তি ছিল বিরাট। সেখান থেকে তাকে মোবাইল ফোনের ছোট ফ্রেমে নিয়ে আসা নেহাত সহজ কাজ নয়। তাছাড়া এমনভাবে তা করতে হবে যাতে খেলার বৈশিষ্ট্যগুলো নষ্ট না হয়। কাজটা তাঁকে এবং তাঁর টিমকে অসম্ভব তৃপ্তি দিয়েছে। এত যে খেলা তৈরি করেন, পূর্ণিমার নিজের পছন্দের গেম কী? বললেন, ‘একটা নয়, দুটো খেলার প্রতি আমার পক্ষপাত একটু বেশি। প্রথমটি ‘এজ অব এম্পায়ার টু’ এবং দ্বিতীয়টি ‘উইচক্রাফট থ্রি’। এই খেলা দু’টি বহু পুরনো এবং জনপ্রিয়। এগুলোর মাধ্যমেই অনলাইন গেমিংয়ের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল পূর্ণিমার। তাই এদের প্রতি ভালোলাগা থাকাই স্বাভাবিক। নিজের তৈরি কোন খেলাটি সবচেয়ে প্রিয়? বললেন, ‘এখনও সেটা তৈরি করে উঠতে পারিনি। তবে নাম ভেবে ফেলেছি, ‘মধুরম’। তাতে ক্লাসিকাল মিউজিক থাকবে, আর সেই টানেই কাহিনির মোড় ঘুড়বে।’
গেম স্ট্রিমারদের কথা
গেম ডেভেলপার ছাড়াও ভারতে প্রচুর গেম স্ট্রিমারও রয়েছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম মুম্বই নিবাসী কাশভি হীরানন্দানি। পঁচিশ বছরের এই তরুণীটি ইউটিউবের মাধ্যমে ভিডিও গেম স্ট্রিম করেন। অর্থাৎ নিজের ইউটিউব চ্যানেলে তিনি অন্যের তৈরি করা অনলাইন গেম ছাড়েন। এমন গেম যা হয়তো ভারতীয় মার্কেটে আদৌ পাওয়াই যেত না। এই গেমগুলো শুধু বিদেশি দর্শকদের হাতের কাছে ছিল। অথবা এমন কিছু গেম যা অনেক বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয় বলে অনেকেই সেটা ছুঁতে পারে না। এই ধরনের খেলা নির্বাচন করে তা নিজের ইউটিউব চ্যানেলে বিনামূল্যে অথবা নামমাত্র দামে ছাড়েন কাশভি। বললেন, ‘প্রথমে এই ধরনের স্ট্রিমিং বিষয়ে লোকে সচেতন ছিল না। কিন্তু ক্রমশ স্ট্রিমিং গেমের দর্শক বেড়েছে। এখন তো গেম স্ট্রিমারদের এতটাই চাহিদা যে এটাকেই অনেকে পেশা করে ফেলছে।’ দিল্লির মেয়ে সাক্ষী সুদের বয়স বাইশ। তিনি একাধারে গেম কনটেন্ট লেখেন এবং গেম স্ট্রিম করেন। বললেন লকডাউনে বাড়িতে বন্দি থাকার সময় প্রথম অনলাইন গেমিংয়ের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং ক্রমশ এই গেমের নেপথ্য গল্প লেখার ভাবনা মাথায় আসে। লকডাউনের সময় প্রথম যে খেলাটি তিনি স্ট্রিম করেছিলেন, তার নাম জিটিএ ফাইভ। এরপর বিজিএমআই খেলাটিও তিনি স্ট্রিম করেন। এই খেলাটি প্রচণ্ড জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, এক বছরে এক মিলিয়ন ফলোয়ার পান সাক্ষী। তিনি নিজের ফেসবুক পেজে খেলাগুলো স্ট্রিম করেন। বিজিএমআই (ব্যাটেলগ্রাউন্ডস মোবাইল ইন্ডিয়া) খেলার টুর্নামেন্টে তিনি খেলতেও গিয়েছিলেন সম্প্রতি। সাক্ষী অবশ্য পুরোপুরি গেম কনটেন্ট লেখেন না। অন্যান্য নানারকম কনটেন্ট রাইটিংয়ের কাজের সঙ্গেই এই কাজটাও করেন তিনি। কিন্তু এমন অনেক ভারতীয় মহিলাই রয়েছেন যাঁরা গেম কনটেন্ট রাইটিংকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন। আর সেই কারণেই অনলাইন গেমিংয়ের দুনিয়ায় মহিলাদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে।
দর্শকের মধ্যেও মহিলাবৃদ্ধি
শুধু অনলাইন গেম বানালে বা স্ট্রিমিং করলেই তো আর চলবে না। তা খেলার লোকও চাই। আর সেই ক্ষেত্রটায় মহিলাদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। ভারতীয় অনলাইন গেম ডেভেলপিং এজেন্সির মত অনুযায়ী, আমাদের দেশে অনলাইন গেমিং প্রায় পুরোপুরিই স্মার্টফোনের ব্যবহারের উপর নির্ভর করে। স্মার্টফোনের প্রযুক্তি যত সমৃদ্ধ হচ্ছে ততই লোকের মধ্যে গেমিংয়ের প্রবণতাও বাড়ছে। গেমার অর্থাৎ যাঁরা গেমগুলো খেলেন তাঁদের মধ্যে এখন অন্তত ৪৩ শতাংশ মহিলা।
অনেক মহিলা এমনও রয়েছেন যাঁরা নিজেদের ছোট্ট গণ্ডিতে গেমার হয়ে থেমে থাকেননি। বরং আন্তর্জাতিক স্তরেও গেমার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তবে তাঁরা নিজেদের নামে খেলেন না, ‘স্ক্রিন নেম’ নিয়ে খেলেন। সেই নামেই তাঁরা পরিচিত। যেমন সগুফতা শিয়া ইকবাল, মনিকা শার্লক জেফ, সালোনি পানওয়ার, পূজা ক্ষেত্রী প্রমুখ। এঁদের মধ্যে সালোনি আবার ইন্টারন্যাশনাল গেমিং টুর্নামেন্টে অংশ নিতে থাইল্যান্ডও গিয়েছিলেন। তিনি মহিলা হিসেবে আন্তর্জাতিক স্তর পর্যন্ত পৌঁছে দারুণ খুশি। বললেন, ‘নতুন আর পুরনো মিলিয়ে মিশিয়ে নানারকম খেলা নিয়ে তৈরি হয়েছে টুর্নামেন্ট। খেলোয়াড় এসেছেন সব দেশ থেকে। পুরুষের সংখ্যাই বেশি। কিন্তু মহিলাও রয়েছে। আগে এই মহিলা খেলোয়াড়দের উইংয়ে সবাই ছিলেন বিদেশি। এই প্রথম ভারতও সেই উইংয়ে স্থান পেল এবং একমাত্র ভারতীয় মহিলা গেমার হিসেবে উপস্থিত থাকা বড় ব্যাপার বলে মনে হয়েছে আমার।’ গেম ডেভেলপিং সংস্থাগুলো মনে করে, মহিলারা যত বেশি এ খেলায় আকৃষ্ট হবেন ততই তা সমৃদ্ধ হবে। গেমারদের বয়সের সীমায় বেঁধে রাখলেও চলবে না। সব বয়সের মহিলার কাছে তা আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে। সেটি ঘটলে তবেই গেমিং ইন্ডাস্ট্রি সাফল্যের শিখর ছুঁতে পারবে।