একজন জনপ্রিয় বাংলা চ্যানেলের বিজনেস হেড। আর একজন কলকাতার জনপ্রিয় কাফের অন্যতম কর্ণধার। সাফল্যের স্বাদ দু’জনেই পেয়েছেন। তাঁদের চলার পথটা ঠিক কেমন? জি বাংলার নবনীতা চক্রবর্তী ও হোয়াটস আপ কাফে-র অনামিকা সেনগুপ্তর সঙ্গে কথায় অন্বেষা দত্ত।
নিজের সেরাটা দিতে হবে
তুমুল ব্যস্ততা থাকলেও পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে ভালোবাসেন। ছবি দেখা, বেড়াতে যাওয়া এসব তো আছেই। আছে গল্পের বইয়ের সঙ্গও। বাঙালি খাবারও পছন্দ জি বাংলার বিজনেস হেড নবনীতা চক্রবর্তীর।
আলোচনার শুরুতেই তাঁর কাছে প্রশ্ন ছিল, সাফল্যে পৌঁছনোর রাস্তাটা কীরকম? ‘নিজের কাজের প্রতি নিষ্ঠা বজায় রাখা এবং অবিচলিত থাকা খুব প্রয়োজন। চলার পথে যে ধরনের চ্যালেঞ্জই আসুক, নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। আমি বরাবর সেটা করে এসেছি।’ কাজের চাপ সামলে নিজের বাকি জীবনে ভারসাম্য বজায় রাখার কাজটাও নবনীতা করেছেন নিপুণভাবে। তাঁর কথায়, ‘নারীদের মধ্যে এই ব্যালান্স করার ক্ষমতাটা যেন সহজাত। আমরা সবাই তো দশভূজা। আমরা জানি বাড়ির আর কাজের জায়গার মধ্যে কীভাবে ভারসাম্য রেখে চলতে হয়। কেরিয়ারের একটা সময় গিয়েছে, যখন অফিসকে অনেকটা বেশি সময় দিতে হয়েছে। ধীরে ধীরে পরিণত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি আর অফিস ম্যানেজ করার কৌশলটাও যেন রপ্ত হয়ে গিয়েছে। তার জন্য অবশ্যই বাড়ির সমর্থন খুব জরুরি। কাছের মানুষজন পাশে থাকলে কোনও কাজই দুঃসাধ্য নয়।’
নবনীতার বিয়ে হয়েছে কিছু দিন আগে। শ্বশুরবাড়ি-বাপেরবাড়ি সবরকম দায়িত্ব সামলে কাজের জায়গায় কখনও যদি কেউ পুরোটা দিতে না পারে? তিনি বলেন, ‘মনে রাখতে হবে, পরিবার আমাদের জন্য অনেক কিছু করে। মা-বাবা-স্বামী সকলেই নানা দিক থেকে নিজেদের সমর্থন বোঝাতে থাকেন। আমাদেরও সেইমতো একটা বোঝাপড়া করেই এগতে হয়। আমার পারিবারিক সমর্থন পেতে কোনও অসুবিধে হয়নি। কাজে বাইরে চলে গিয়েছি বলে ঘর সামলাতে কোনও সমস্যা হয়েছে, এমনটা একেবারেই নয়। উল্টে আমার নিজেরই মনে হয়েছে, পরিবারকে আর একটু সময় যদি দিতে পারতাম, ভালো হতো। কিন্তু যাঁদের সমস্যা হয় বা যাঁরা সমর্থনটা ঠিকমতো পান না, তাঁদের একটাই কথা বলব, ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে যেতে হবে। সাফল্য ধীরে ধীরে আসবেই। নিজের কাজটা ঠিকঠাক করে যেতে হবে। লেগে থাকতে হবে। ধৈর্য হারিয়ে মাঝপথে ছেড়ে দিলে চলবে না।’
সাফল্যের স্বাদটা কেমন? নবনীতার বক্তব্য, ‘একা আমি সফল হয়েছি, এটা কখনওই মনে করি না। আমার সঙ্গে ভীষণ ভালো একটা টিম আছে। সবাই মিলে কাজটা করেছি বলেই সাফল্য এসেছে। টিম হিসেবেই আমরা চ্যানেলকে উপস্থাপিত করি। সেটাই এই যাত্রাপথে সবচেয়ে আনন্দদায়ক অনুভূতি। লিডার আমি হতে পারি, তবে সকলের অবদান মাথায় রাখা দরকার। এটা অনেকটা ফুটবল ম্যাচ জেতার মতো। সেখানে কেউ একা দলকে হারিয়ে বা জিতিয়ে দিতে পারে না। গোটা টিমের ভূমিকা থাকে। সেই উত্তেজনাটাই আমাদের এগিয়ে যেতে সাহায্য করে।’
বাংলা বিনোদন চ্যানেলের ভাবনাচিন্তা বা মতাদর্শ একালে অনেকটাই বদলেছে। দর্শকদের মনোভাব বুঝে এগিয়ে চলা কতটা কঠিন? বোঝাতে গিয়ে নবনীতা বলেন, ‘চারপাশটা খুব দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। এটা মনে রাখতেই হয়। পাঁচ বছরের তফাতে জীবনধারা একেবারে অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। কোভিড পরবর্তী জীবনে এটা বড় বাস্তব। সেটা আমাদের ভেবে এগতে হয়। দর্শক কী ভাবতে পারেন, এটা আমাদের সবসময় আগে ভাবতে হয়।’ সিরিয়াল বা বিনোদনের অন্য মাধ্যমে নারীকেন্দ্রিক ভাবনা কি এজন্য ক্রমশ বেড়েছে? ‘টেলিভিশন মেয়েদের বিনোদনের জায়গা হিসেবে বরাবরই পরিচিত। সঙ্গে তার পরিবারও জুড়ে যায়। মেয়েদের কথা, জীবন, সংগ্রাম, আশা-আকাঙ্ক্ষা এগুলো আমাদের সবসময় নজরে থাকে। সুন্দরবনে একজন সাধারণ মহিলা তাঁর জীবন কীভাবে নির্বাহ করছেন, মধু সংগ্রহ করছেন জঙ্গলে গিয়ে...তাঁর একরকম সংগ্রাম। আর শহরের বুকে বসে অফিস করা মেয়েদের আর একধরনের লড়াই। মেয়েদের ক্ষমতায়ন নিয়ে যাত্রাপথটা যেমনই হোক, সেটা আমরা সাধ্যমতো তুলে ধরার চেষ্টা করি সবসময়।’
ক্ষমতায়নের কথাই যখন উঠল তখন জানতে চাই নারীর টিভি-নির্ভরতা আগের মতোই রয়েছে, এমনটা কি বলা যায়? ‘দশ বছর আগেও মেয়েদের জীবনটা এরকম ছিল না। আর্থিক স্বাধীনতা অর্জন করে মেয়েরা এখন অনেক বেশি সচেতন। নিজেদের কথা বলতে তাঁরা আগ্রহী। শহর হোক বা মফস্সল, প্রত্যেকেই নিজে কিছু করে এগতে চাইছেন। তার জন্য নানা কমিউনিটি তৈরি হচ্ছে। একইসঙ্গে বলব, তাঁরা নিজেদের মতো করে একটা জায়গা খুঁজছেন যেখানে নিজেদের তুলে ধরা যায়, নিজের কথা বলা যায়। স্বামী এখন তাঁর অভিভাবক নয়, বরং বন্ধু। পরস্পরকে সমর্থন করে দম্পতি এগতে চাইছে। তাছাড়া এখন মোবাইল ওটিটি-র যুগে সবই খুব ক্ষণস্থায়ী। তাই লম্বা সময় ধরে আগে যেমন সিরিয়াল চলতেই থাকত, সেখানে বদল এসেছে। এখন আট মাস বা এক বছর চলে। আর চরিত্রের মধ্যেও মহিলারা আশপাশে যেমন চরিত্র দেখতে পান, তেমন কাউকেই খুঁজে পাচ্ছেন। সেই একাত্মতাটা কিন্তু রয়েছে।’
যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে
কর্পোরেটে স্বস্তির চাকরি ছেড়ে পার্টনারশিপে কাফে ব্যবসায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন একদিন। ঝুঁকি ছিল, তার সঙ্গে ছিল অনেকটা স্বপ্ন আর চ্যালেঞ্জ নেওয়ার মানসিকতা। ছোটবেলা থেকে খেতে ভালোবাসেন, রান্না করে খাওয়াতে আরও বেশি! মনে মনে সুপ্ত বাসনা ছিল, একদিন নিজের ‘চেন অব রেস্টুরেন্টস’ হবে। সেই স্বপ্ন যে সফল হবেই, সেটা তখনও জানতেন না। কাফে খোলার সময়েও সংশয় ছিল মনে। কিন্তু সাফল্য ক্রমশ আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে।
এই শহরের হোয়াটস আপ কাফের অন্যতম কর্ণধার অনামিকা সেনগুপ্ত সাফল্যের পথে হাঁটার রাস্তাটা ফিরে দেখলেন ঝলকে। তিনি বললেন, ‘গতানুগতিকভাবে ব্যবসাটা করতে চাইনি। এই কাফে খোলার পিছনে কাজ করেছিল একটাই ভাবনা। সেটা হল ক্রেতাকে সবসময় নতুন কিছু দেব। তা না হলে ক্রেতার কাছে সবটাই দ্রুত একঘেয়ে হয়ে যায়। আমাদের কাফে-তে জাকুজিতে পা ডুবিয়ে খাবার বা ড্রিঙ্ক উপভোগ করা— এটা একেবারে ব্যতিক্রমী ব্যাপার। যেটা আমাদের জনপ্রিয় করেছে। এছাড়াও প্রতি ছ’মাস অন্তরই কিছু না কিছু নতুন করার চেষ্টায় থাকি। খাবারের স্বাদ বা কাফের আবহ, সব নিয়েই ভাবনা চলে।’ নানা দেশীয় খাবার ঘুরেফিরে আসে। মানের ব্যাপারে কোনও আপস করি না। এর সঙ্গে ৯৯ কাফে (যে কোনও পদ ৯৯ টাকায়) চালু করেও খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছি। ক্রেতা আমাদের কাছে বারবার ফিরে আসবেন, লক্ষ্য থাকে এটাই। বলতে পারেন আমাদের ৭০ শতাংশই পুরনো ক্রেতা, যাঁরা বারবার আসেন। আট বছরে ৭০ আসনের কাফে থেকে ৩০০+ আসনে যেতে পেরেছি এভাবেই। আমাদের মোট কর্মীর সংখ্যা একশো জন। গর্বের সঙ্গে বলতে পারি তাঁদের কেউ ছেড়ে যাননি আমাদের। তাঁরা আমাদের পরিবারের মতো। সবাই মিলে কাজটা করি,’ জানালেন তিনি।
এখন আমেরিকায় অনামিকা আর দুই বাঙালি মিলে ফরাসি রেস্তরাঁ খুলেছেন। সাফল্যের পরিধি বাড়ছে এভাবেই? চল্লিশ ছোঁয়া তরুণীর কথায়, ‘আমরা যেটাই করব, ১০০ শতাংশ দিয়ে করব। এটাই মাথায় থাকে শুধু। বিদেশের মাটিতে এভাবে রেস্তরাঁ খোলার সাহসটা তাই দেখাতে পেরেছি।’ মহিলা হিসেবে এত কিছু সামলাতে আলাদা করে কিছু প্রয়োজন হয়? ‘ছোটবেলা থেকেই শুনেছি যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে। আর দশভূজার মতো সবটা সামলাতে পারে মেয়েরা। এ যুগে ছেলেরাও পারে। আমি নিজে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবেতেই অভ্যস্ত। এই যুগে সবটাই পারতে হয়। সবাইকেই।’
কিন্তু চলার পথে ঝুঁকি আর বাধা তো অনেক? ‘নিশ্চিন্ত চাকরি জীবন ছেড়ে যখন ব্যবসায় আসি, সেটাই ছিল সবচেয়ে বড় ঝুঁকি। কীভাবে চলবে, তখন কিছুই জানি না। তা ছাড়া এমন একটা ক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়েছি, যা সম্পর্কে সম্যক ধারণাও নেই তখন। সেটাও ঝুঁকি। ৯৯ কাফে খোলার সময়েও অনেকে ভেবেছিল ওটায় ক্ষতি হবে। এমন হতে হতেই একদিন আমেরিকা তিন বাঙালি মিলে ব্যবসা শুরু করে দিলাম। ওখানে লোকাল পার্টনার বা ফান্ড ছাড়া এভাবে কোনও বাঙালি ব্যবসা করেনি। গত দশ বছরে অনেক ঝুঁকি এসেছে, আরও হয়তো আসবে। সেগুলো কাটিয়ে এগিয়ে যেতে পারব বলেই বিশ্বাস,’ আত্মবিশ্বাসী অনামিকা স্পষ্ট বলেন কথাগুলো।
ব্যবসায় সঙ্কটের সময় এলে মাথা ঠান্ডা রাখা খুব প্রয়োজনীয় বলে জানালেন তিনি। ‘ঠান্ডা মাথায় বুদ্ধি খাটানো সহজ। আর সবকিছু খেয়াল করতে হয় ভালো করে। যে কোনও পরিস্থিতি বা যে কোনও মানুষকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা উচিত। এগুলো থেকে শেখা যায় অনেক কিছু।’
মহিলারা উদ্যোগপতি হলে কি সমস্যা একটু বেশি হয়? একুট আক্ষেপ ঝরে পড়ে অনামিকার গলায়। তিনি বলেন, ‘জানেন, সমাজের দেখার ধরনটা খুব অদ্ভুত। মহিলা উদ্যোগপতি শুনতে খুব ভালো। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যায়, তাঁর পুরুষ সঙ্গীই সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। এটা কেন হবে? এটা শুধু ভারতে নয়, সারা পৃথিবীতেই দেখি। কোনও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত মানেই সেখানে স্বামী বা পুরুষ সঙ্গী জড়িয়ে যাবে। মহিলারা যেন ট্রফি ওয়াইফের মতো! খুবই বিরক্তিকর। আমাকেও এই সমস্যার মুখে পড়তে হয়েছে। কোনও জরুরি কথার সময়ে দেখেছি, মহিলা বলে একটু যেন কম গুরুত্ব দেওয়াই স্বাভাবিক। আমার দুই পুরুষ পার্টনারের কিন্তু এ সমস্যা হয় না। সৌভাগ্যবশত আমার পার্টনারদের মানসিকতা একেবারেই এমন নয় বলে কাজে অসুবিধা হয় না। কিন্তু দেখার ধরনটা এখনও এই রকমই। এই মানসিকতা কবে পাল্টাবে জানি না।’
মহিলাদের স্বাবলম্বী হওয়ার বিষয়ে কী ভাবনা অনামিকার? ‘দেখুন প্রত্যেকেরই নিজের পায়ে দাঁড়ানো উচিত। সে পুরুষ হোক বা মহিলা। যে কাজ করতে ভালো লাগে, সেটাই করতে হবে। আর লোকে কী ভাবল, এসব নিয়ে মাথা ঘামালে চলবে না।’
অবসরে নিজেকে সময় দেওয়া তাঁর কাছে খুব জরুরি। ‘কাজ তো থাকবেই, কিন্তু নিজেকে সময় দেওয়া দরকার। একা ঘুরতে চলে যাই যখন-তখন। ফেলুদার ছবি দেখতে, গান শুনতে, রান্না করতে ভালোবাসি। এগুলো আমাকে চাঙ্গা রাখে,’ বলেন তিনি।