বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
আমরা মেয়েরা
 

টক ঝাল
নোনতায় রোজগার

ফুচকা স্টলে বিক্রেতার আসনে মহিলাদের দেখা যায় প্রায়ই। রান্নায় তাঁদের হাতের ম্যাজিক প্রিয় স্ট্রিট ফুডের মহিমা যেন বাড়িয়ে তোলে। কলকাতার দুই মহিলা ফুচকাবিক্রেতার কথায় কমলিনী চক্রবর্তী।
 

রুপোলি পর্দায় অনুষ্কা শর্মা আর শাহরুখ খানের ফুচকা খাওয়ার কম্পিটিশন হয়েছিল ‘রব নে বানা দি জোড়ি’ ছবিতে। কিন্তু ফুচকা খাওয়ার লড়াই শুধু যে রুপোলি পর্দায় সীমাবদ্ধ, তা তো নয়। রাস্তাঘাটে ছেলেমেয়েদের অনেক সময়ই দেখা যায় এই প্রতিযোগিতায় নামতে। কেউ বা কোনও লড়াইয়ের বালাই ছাড়াই ফুচকা খেয়ে যায় একের পর এক। স্ট্রিট ফুড হিসেবে ফুচকা বরাবরই জনপ্রিয়তার শীর্ষে।  ফুচকা বিক্রেতার নারী পুরুষে ভেদ হয় না ঠিকই। তবে যতই বলুন, পাড়ার দিদি-বৌদিরা ফুচকায় যে ম্যাজিক দেখাতে পারেন, তার কোনও তুলনা হয় না! ফুচকাবিক্রেতার আসনে মেয়েদের দেখলে ভরসা একটু বাড়ে বইকি।   

হাসিমুখের দেবকুমারী
দেবকুমারী মণ্ডলের বাড়ি বাইপাসের ধারে। কসবার রামলাল বাজার অটোস্ট্যান্ডে তিনি এক পরিচিত মুখ। সদা হাস্যময়ী এই মহিলাকে সবাই ‘ফুচকা দিদি’ বলেই চেনে। ফাল্গুনের এক সন্ধ্যায় সেখানে গিয়ে দেখি হাসিমুখই তাঁর ট্রেডমার্ক। এতরকম কাজ থাকতে হঠাৎ ফুচকা বেচার কথা ভাবলেন কেন? প্রশ্ন শুনে একগাল হেসে পাল্টা প্রশ্ন করলেন আমায়, ‘কেন এই কাজে ছেলেদের বেশি দেখা যায় বলে আমাকে দেখে অবাক লাগছে?’ তারপর বললেন, ‘আজ তিরিশ বছর হল ফুচকা বিক্রি করছি। আগে অল্প বয়স ছিল ফুচকার স্ট্যান্ড, ঝুড়ি, বয়াম ইত্যাদি টেনে আনতে অসুবিধে হতো না। কিন্তু এখন একটু সমস্যা হয়।’ 
ওঁর স্বামীও ফুচকাই বিক্রি করতেন। স্বামী মারা যাওয়ার আগে পর্যন্ত বাড়ি থেকে স্বামীর ব্যবসায় সাহায্য করতেন। তাই কাজটা তাঁর জানাই ছিল। এরপর স্বামী যখন মারা গেলেন তখন সংসার চালাতে নিজেকেই এই কাজে নামতে হল। একমাত্র ছেলেটা মানসিক ভারসাম্যহীন। তার ওষুধের খরচ আছে, ডাক্তার আছে। তার উপর সংসারের উনকোটি চৌষট্টি খরচ। কাজ না করলে হিমশিম অবস্থায় পড়বেন দেবকুমারী। তাই যে কাজটা জানতেন সেটাই শুরু করলেন। 
এই বয়সে এত দায়িত্ব নিতে কষ্ট হয় না? দেবকুমারীর সরল উত্তর, ‘হয় তো।  কিন্তু নিজের কথা ভাবলেই তো আর চলে না, সংসারের মুখ চেয়েও তো কাজ করতে হয়। সেই কথা ভেবেই কষ্ট সহ্য করে নিচ্ছি।’  দেবকুমারীর রান্নার হাত খাসা। ফুচকাগুলো প্রতিটাই দারুণ ফুলকো হয়। আর যেগুলো ফোলে না সেগুলোকে চুরমুর মাখার জন্য স঩রিয়ে রাখেন। ফুচকা ফোলানোর কোনও বিশেষ পদ্ধতি আছে কি না জিজ্ঞেস করলে দেবকুমারী বললেন, তেমন কিছু নয়। সবটাই হাতের আন্দাজ। একটু বড় করে বেলেন তিনি ফুচকাগুলো। তাতে নাকি পাতলা হয়, আর ফোলেও বেশি। তবে ফুচকা ফোলার চেয়েও বেশি জরুরি আলুর পুরের স্বাদ সঠিক রাখা। টক, ঝাল, নুন একেবারে সঠিক মাপে না দিলে পুরের স্বাদ ওঠে না। একই সঙ্গে মাথায় রাখতে হয় টক জল দিয়ে খাওয়া হবে। ফলে পুরে তেঁতুলের পরিমাণ বেশি হলে খেতে খারাপ হবে, এগুলোই ফুচকা বিক্রেতার বিশেষত্ব। 
আজকাল তো ফুচকার অনেক ধরন হয়ে গিয়েছে। কেউ টক জলের সঙ্গে মিষ্টি জলেরও ব্যবস্থা রাখেন। কেউ আবার পুরে মিষ্টির পরিমাণ বেশি দেন। কিন্তু দেবকুমারী সে রসে বঞ্চিত। বললেন, ‘সব খাবারেরই একটা 
নিজস্ব ধরন আছে। সেই ধরনটা রক্ষা করার জন্যও তো কাউকে দরকার। আমি সেটা রক্ষা করতেই আছি।’
সকাল থেকে ফুচকা গড়ে বেলে ভাজার কাজে লেগে পড়েন দেবকুমারী। তারপর বিকেল চারটের মধ্যে সাজসরঞ্জাম গুছিয়ে বেরিয়ে পড়েন। পাঁচটায় রামলাল বাজার অটো স্ট্যান্ডে দেবকুমারীর ফুচকার স্টল রেডি। একটানা দাঁড়িয়ে বিক্রি করতে এখন কষ্ট হয়। তাই বসার জন্য টুলও রেখেছেন একটা। ফুচকা আর চুরমুর ছাড়াও আলুকাবলি মেখে দিতে বললেও দেন তিনি। ক্রেতার স্বাদ অনুযায়ী আলুর পুরে কখনও টক জল, কখনও বা বিটনুন, আবার কখনও লঙ্কা কুচি মেশান। প্রতিদিনের ফুচকা বিক্রিই তাঁর কাছে এক নতুন অভিজ্ঞতা। কত লোকের সঙ্গে আলাপ হয় রোজ। কেউ হয়তো ফুচকা খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে গল্প করে। কেউ বা কম কথার মানুষ। কারও আবার আবদারি ভাব। অল্পবয়সিরা নিজের পছন্দ মতো নানারকম দাবি তোলে। কেউ ফাউ চায়, কেউ টক জল দিতে বলে। দেবকুমারীর মজা লাগে দেখতে। বন্ধু জুটিয়ে টিউশন যাওয়ার বা ফেরার পথে কত ছেলেমেয়ে ভিড় করে তাঁর দোকানে। কত গল্প তাদের একে অপরের সঙ্গে। স্কুলের মজা, বন্ধুত্বের খুনসুটি, টিউশন ক্লাসের কম্পিটিশন— সব মিলিয়ে দেবকুমারীর ফুচকার স্টল বিকেল থেকে সন্ধে জমজমাট। তারপর আবার আর এক ধরনের ক্রেতা আসেন। তাঁরা মূলত মহিলা। অফিস ফেরতা ফুচকা খেয়ে বাড়ির পথ ধরেন। অনেক সময় বাড়ির গিন্নিরাও সারাদিনের কাজ সেরে সন্ধেবেলা দল বেঁধে ফুচকা খেয়ে যান।  বাচ্চাদের টিউশন ক্লাসে জমা দিয়ে মায়েদের আড্ডা জমে দেবকুমারীর ফুচকার স্টলে। তারা আবার খেয়ে বাচ্চাদের জন্য আলুকাবলি বা চুরমুর নিয়ে যায়। এইভাবেই দিব্য চলছে দেবকুমারীর ব্যস্ত জীবন। রোদে ঝড়ে জলে ফুচকার ঝুড়ি আর খদ্দেরদের মুখগুলোই তাঁর আশা ভরসা। প্রকৃতির খামখেয়ালি ঝড় বৃষ্টিতে বিরক্ত হন তিনি। ঝড়ের মধ্যে তাড়াহুড়ো করে সব গুটিয়ে তুলতে পারেন না। কতবার ফুচকা নষ্ট হয়েছে এইভাবে। তাই দেবকুমারীর প্রিয় ঋতু গ্রীষ্ম। বললেন, দিনের আলো থাকে অনেকক্ষণ। ভোরও হয় তাড়াতাড়ি। সকালে উঠে কাজ গোছানো থেকে রাতে বাড়ি যাওয়া কোনও কিছুতেই অসুবিধে হয় না গরমকালে। 
রাত করে বাড়ি ফিরতে ভয় করে না? প্রশ্ন শুনে দেবকুমারীর উত্তর, ‘রাত কোথায় মা? মাত্র তো দশটা। তাছাড়া এ পথে সবাই আমায় চেনে। ফুচকা দিদির সাহায্যে তাই বাজারের দোকানি থেকে অটোর চালক সকলেই একপায়ে খাড়া।’

পরিচ্ছন্নতার খেয়াল রাখেন অঞ্জলি 
গড়িয়া বাসস্ট্যান্ডের কাছে ফুচকার স্টল দিয়েছেন অঞ্জলি মণ্ডল। এই পেশায় এলেন কেন? বললেন, ‘পেশার আবার পুরুষ নারী ভাগ হয় নাকি? রোজগার তো সবার কাছেই জরুরি। যে যেমন কাজ জানবে সে তেমন রোজগার করবে। এর মধ্যে আবার ছেলেমেয়ের বিভেদ কেন?’ অঞ্জলির এই ফুচকার ব্যবসাটা অবশ্য পারিবারিক। প্রায় ৭০ বছরের পুরনো ব্যবসা শুরু করেছিলেন অঞ্জলির বাবা। তাঁর মৃত্যুর পর থেকেই সেই ব্যবসাই চালানোর ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন অঞ্জলি। ওঁরা দুই বোন। তবু অঞ্জলিই কেন বাবার ব্যবসা রক্ষার দায়িত্ব নিলেন? তাঁর কথায়, ‘ছোট থেকেই আমি বাবার সঙ্গে ফুচকা তৈরির কাজ করতাম। তাই কাজের ধরনগুলো সবই আমার জানা ছিল। ব্যবসার সাতসতেরো সম্বন্ধেও বাবা আমায় শিখিয়েছিলেন। বাবা যখন অসুস্থ হয়ে পড়লেন, তখন তাঁর কাজ আমিই কাঁধে তুলে নিলাম। আমার অন্য বোনের দোকান আছে।’ 
অঞ্জলি যেমন রান্নাবান্নার কাজে পারদর্শী অন্য বোনটি আবার একটু বারমুখী। বাজার দোকান করা তঁার পছন্দের। তাই সে দোকান খুলেছে। আর রান্নার সাজসরঞ্জাম গুছিয়ে বাবার ফুচকার স্টল সামলাচ্ছেন অঞ্জলি। তাঁর কথায়, ‘আমি যখন খুবই ছোট তখন থেকেই বাবার সঙ্গে ফুচকার কাজ করতাম। সুজি আর আটা কতটা মাপে মেশাতে হবে। কীভাবে মাখতে হবে এইসবই ছিল আমার নখদর্পণে। বাবা হাতে ধরে আমায় এই কাজগুলো শিখিয়েছিলেন। ছোট মেয়েরা যখন পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে দল বেঁধে মাঠে খেলে তখন থেকেই বিকেল হলে উনুনে আঁচ দিতাম আমি। তারপর শুরু হতো বাবার হাতে হাতে ফুচকার ভাজার কাজ। আলু সেদ্ধ করা, মশলা তৈরি, তেঁতুল গোলা। গন্ধরাজ লেবু দিয়ে টক জল বানানো। ধনেপাতার ডাঁটি থেকে পাতা ছাড়ানো। লঙ্কা আলাদা করে কুচিয়ে রাখা। এই ছোটখাট কাজগুলো আমার দায়িত্বে ছিল। বাবার কাছেই শিখেছি ফুচকা তৈরি করার কাজে দক্ষতা কতটা প্রয়োজন। এমনিতেই হাতে করে মাখা হয়। হাতে মাখা জিনিস আমি লোককে খাওয়াচ্ছি। ফলে পরিচ্ছন্নতা এখানে ভীষণ দরকার। খদ্দেরের যেন কখনওই দেখে খারাপ না লাগে। বরং ফুচকার ফুলো চেহারা আর গন্ধরাজ লেবু ও ধনেপাতার গন্ধে যেন তাঁদের জিভে জল আসে। তবেই না ফুচকা বিক্রি হবে। এই পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা যে এই ব্যবসায় ভীষণ জরুরি তা বাবা থাকতে বুঝিনি। বুঝলাম লকডাউনের পর যখন আবার সব কাজকর্ম শুরু হল তখন। সবার মনে মহামারীর আতঙ্ক। কারও হাতের ছোঁয়াই লোকে মুখে তুলতে চাইছে না। সেখানে আমাদের হাতে মাখা আলুর পুর— তাও যে ব্যবসাটা টিকিয়ে রাখতে পেরেছি তার মূলেই কিন্তু ওই পরিচ্ছন্নতার শিক্ষা। হাতে প্লাস্টিকের গ্লাভস লাগিয়ে আলু মেখেছি। ক্রেতার হাতে অল্প পুর দিয়ে টেস্ট করাতাম। তাঁরাই আমায় নুন, ঝালের মাপ বলে দিতেন। গ্লাভস পরা হাতে সবসময় সঠিক আন্দাজ পাওয়া যেত না। এছাড়া টক জলের জন্য তো আলাদা হাতা আমার বরাবরই ছিল। সেই হাতা দিয়েই জল গোলা হতো। একটা আলাদা মোছার কাপড় রাখতাম জায়গাটাকে পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য। বিক্রি যে প্রচুর হতো তা নয়। তবে একজনও যাতে ফেরত না যায় সেদিকটা মাথায় থাকত। ক্রমশ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে। আমার ফুচকার ব্যবসাও আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। 
এই ব্যবসাটা আমার সন্তানের মতো। এক অসম্ভব টান আমার এটার প্রতি। শীত হোক বা গ্রীষ্ম, আমি কিন্তু নিয়ম করে উঠে পড়ি সকাল পাঁচটায়। তাপর স্নান করে পরিষ্কার কাপড় পরে শুরু হয় ফুচকা তৈরির কাজ। সকাল সাড়ে ছ’টার মধ্যে ফুচকার লেচি মাখা শুরু করে দিই। লেচি মেখে একটুক্ষণ রাখতে হয়। তারপর বেলা, ভাজা ‌ইত্যাদি। যেটুকু সময় ফুচকার লেচিটা মেখে রাখা থাকে তারই মধ্যে  আলুগুলো সেদ্ধ বসাই। 
পাশাপাশি চলতে থাকে বাড়ির রান্নার কাজ। চাল ধোয়া, তরকারি কাটা সবই একহাতে সামলাই। কোনটার পর কোনটা করব, এর একটা রুটিন তৈরি করেছি। সেই মতোই কাজ করি। অসুবিধে হয় না।’ 
ফুচকা বিক্রির কাজে একঘেয়েমি নেই। বরং রয়েছে অগাধ ভালোবাসা। রোজ বিকেল তিনটে থেকে সাড়ে তিনটের মধ্যে গড়িয়া বাসস্ট্যান্ডের কাছে ঝুড়ি পেতে বসেন অঞ্জলি মণ্ডল। প্রতিদিনের এক এক রকম অভিজ্ঞতা। কত বন্ধুত্ব প্রেমে পরিণত হতে দেখেছেন। কত প্রেম আবার ভেঙে গিয়েছে তাঁরই ফুচকার স্ট্যান্ডে। স্কুলপড়ুয়াদের বন্ধুত্ব পরিণতি পেতেও দেখেছেন। প্রতিদিনই জীবন তাঁর কাছে নতুন কিছু নিয়ে হাজির হয়। ফুচকা বিক্রির মাধ্যমেই নিত্য কলকাতার নবরূপ দর্শন করেন অঞ্জলি। 

11th     March,   2023
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ