বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
আমরা মেয়েরা
 

‘আমি স্লেজিংকে ভয় পাই না’

মেয়েটিকে নেটে বল করতে দেখে ঝুলন গোস্বামী অবাক হয়েছিলেন। নির্বাচকদের বলেছিলেন, ‘এর প্রতি নজর রাখুন’। তিনি যে জহর চিনতে ভুল করেননি, তার প্রমাণ দিয়েছেন মেয়েটা। খাস মফস্সলের মেয়ে তিতাস সাধু। ভারতীয় জুনিয়র দল যাঁর কাঁধে ভর দিয়ে বিশ্বকাপ জয়ী হল। তাঁর সঙ্গে কথা বললেন মনীষা মুখোপাধ্যায়।

প্রথমে বাবার পথ ধরেই অ্যাথলেটিক্স। তারপর দম বাড়াতে সাঁতার। মাঝে ফুটবলে লাথিও মেরেছ। অবশেষে ক্রিকেটে এসে থামলে?
হ্যাঁ, আসলে ছোটবেলা থেকেই মাঠে যাওয়ার একটা প্রবণতা ছিল। চুঁচুড়ায় আমাদেরই পরিবারের একটা ক্লাব আছে, রাজেন্দ্র স্মৃতি সংঘ। সেখানে ছোট থেকেই যেতাম। যতরকম খেলা হতো প্রায় সবেতেই অংশ নিতাম। ছোটরা যেমন ব্যাট করতে ভালোবাসে, আমিও তেমনই ছিলাম। তবে ওই সময় থেকেই বেশ জোরে বল করতে পারতাম। এক সময় বলটা জায়গায় পড়তে শুরু করল। বাবা যেহেতু নিজেই খেলোয়াড়, বুঝেছিলেন, খেলাটা আমার হবে। আমারও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ বাড়ল। তখন এই জোরে বল করতে পারার ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়েই অনুশীলন শুরু করলাম। আরও কী করে গতি আনা যায়, সেই পাঠ নেওয়া শুরু হল। 

কার কাছে শুরু করলে? প্রথম কোচ কে? 
একদম প্রথম থেকেই আমি দেবদুলাল রায়চৌধুরীর কাছে শিখছি। এরপর আমি প্রিয়ঙ্কর মুখোপাধ্যায়ের অধীনে এখন অনুশীলন করছি। এখনও আমি রাজেন্দ্র স্মৃতি সংঘের হয়েই খেলি।

ছোট থেকেই পারিবারিক ক্লাবে ছেলেদের সঙ্গে খেলে বড় হয়েছ। এটাই কি তোমার প্লাস পয়েন্ট?
হ্যাঁ, সেটা কাজে লেগেছে তো বটেই। ছেলেদের শক্তি ও ক্ষমতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খেলতে হয়েছে বলে গতি বাড়াতে অনেকটা সুবিধা হয়েছে। শক্তিও অনেকটা বাড়ানোর প্রয়োজন পড়েছে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে সুবিধা তো হয়েছেই।

মেয়েদের ক্রিকেটের গ্রাফ এখন অনেক উন্নত। তবে এখনও বুনিয়াদি স্তরে নানা খামতি আছে। একজন মহিলা ক্রিকেটার হয়ে এই পরিকাঠামো নিয়ে কী বলবে?
দেখুন, আমার মনে হয় না প্রতিভা থাকলে পরিকাঠামো খুব একটা সমস্যার। আমাদের অনেককেই ছেলেদের সঙ্গে একসঙ্গে প্র্যাকটিস করতে হয়েছে। অনেকেই হয়তো চেঞ্জিং রুম আলাদা করে পান না। মেয়েদের আলাদা জিম থাকে না সব জায়গায়। তবে এতকিছু সত্ত্বেও আমার মনে হয়, চেষ্টা থাকলে, পরিশ্রম থাকলে আর খেলার ইচ্ছে থাকলে এগুলো কোনও বাধা নয়। ছোটবেলা থেকে যারা ক্রিকেটে আসছে, অনেক সময়ই দেখা যায় একই ড্রেসিং রুম ছেলেদের সঙ্গে শেয়ার করতে হচ্ছে। আজকাল একটা ঘর হলেও ছেলে ও মেয়েদের আলাদা ব্যবস্থা সেখানে থাকে। একটু বড় হয়ে গেলে ছেলেমেয়েরা আলাদা ব্যবস্থাই পায়। বেসিক চেঞ্জিং রুম হিসেবে কিন্তু একটা টয়লেটকেও ব্যবহার করা যায়। সামনে কাউকে দাঁড় করিয়েও যাওয়া যায়। আমাদের মতো দেশে যেখানে অনেকেই নিম্নমধ্যবিত্ত, সেখানে খেলাটাই কিন্তু আসল। সেটুকুর ট্রেনিং ভালো করে হলে বাকি সব পরিকাঠামো অত বাধা দিতে পারে না। মিনিমালিস্টিক একটা ব্যবস্থা থাকলেও খেলাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়।

কিন্তু পরিকাঠামো মানে তো শুধু চেঞ্জিং রুম নয়। ছেলেদের ক্রিকেট যে উচ্চকিতভাবে স্বীকৃত ও যে গগনচুম্বী আবেগ ও আগ্রহে ভরপুর, মেয়েদের বেলায় সেটা কই?
আমি বিষয়টাকে অন্যভাবে দেখি। ছেলেদের ক্রিকেট লোকে বেশি দেখে কারণ ছেলেদের ক্রিকেটে সাফল্যের হার অনেক বেশি। এতদিন ছেলেরা ভালো খেলেছে, তাই এই খেলায় জনপ্রিয়তা এসেছে। একটা সময় তো বাঙালি ছেলেমেয়ে খেলা বলতে বেশিরভাগই ফুটবল বুঝত। তারপর ক্রিকেটে সাফল্য এসেছে দেশের। সাফল্যের হাত ধরে স্পনসরশিপ বলুন, বিনোদন বলুন সবই এসেছে। তাই ছেলেদের ক্রিকেট নিয়ে মাতামাতিও বেশি হয়েছে। আমাদের বাংলায় মেয়েদের হয়ে এই জায়গাটা অনেকটা তৈরি করে দিয়েছেন ঝুলনদি। ঝুলন গোস্বামীর সাফল্যের পর অনেক পরিবারই মেয়েদের ক্রিকেট খেলতে পঠায়। মেয়েদের ক্রিকেট খেলে কিছু হবে না, এই ধারণা বদলেছে। এবার আমরাও যদি ঝুলনদির দেখানো পথে আরও সাফল্য আনতে পারি, তাহলে মেয়েদের ক্রিকেট নিয়েও মাতামাতি হবে।

লোকে তো এখনই তোমাকে ঝুলন গোস্বামীর সঙ্গে তুলনা করছে। আরও করছে কারণ ঝুলন নদীয়া চাকদহের মেয়ে। তুমিও জন্মের পর কিছুটা সময় কৃষ্ণনগরে মামার বাড়িতেই কাটিয়েছে। তুমি নিজে কার মতো হতে চাও?
ঝুলনদির সঙ্গে তুলনাটা একেবারেই ঠিক নয়। আমি সবে শুরু করেছি। আর ঝুলনদি অনেক সিনিয়র। ওঁর কাছ থেকেও অনেক কিছু শিখি। আমি এখন এতটাই ছোট যে এই দিকপাল খেলোয়াড়দের সঙ্গে তুলনার জায়গাতেই নেই। সবে আমার শুরু...। আমি যে নদীয়ায় থেকেছি, সেই নদীয়ার মেয়েই ঝুলনদি, এই ভাবনায় বরং আমারই খুব আনন্দ হয়। আর আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব পছন্দ করি হার্দিক পাণ্ডিয়া আর প্যাট কামিন্সের খেলা। আমি ওঁদের মতো খেলতে চাই। 

ওদের কিন্তু খুব স্লেজিং সামলাতে হয়!
এখনও মারাত্মক কিছুর মুখোমুখি হইনি। তবে এটা খেলারই অংশ। আমি ওসব নিয়ে মাথা ঘামাই না। খেলা দিয়েই জবাব দিতে হয়। যা হয়ে গিয়েছে, তা নিয়ে ভেবে লাভ নেই। যা হবে তা ভালো করতে হবে, আমি এটাই মাথায় রাখি। স্লেজিংকে ভয় পাই না। 

বিশ্বকাপ জয়ের পর জগৎটা কতটা পাল্টাল? যেদিন ফিরলে আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী সকলে তো আনন্দে ফেটে পড়েছিল পুরো! 
বাড়িতে অনেকেই এসেছিলেন। আমিও ক্লাবে গিয়ে সকলের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। আর জেতার পর তো বাড়িতে কথা হয়েছে অনেকবার। তাই বাড়ির লোকজনের ভালোলাগাটা অনেকটাই সয়ে গিয়েছিল। তবে আমার জগৎ খুব একটা পাল্টায়নি। আমিও চাই না পাল্টাক। ফেম বলুন বা মাতামাতি— এসবে এখনই ভেসে যেতে চাই না। সামনে ডব্লুপিএল (উওম্যান’স প্রিমিয়ার লিগ) আছে। ওটাকেই এখন পাখির চোখ করেছি।

জগৎ পাল্টায়নি? এখনও সকলের সঙ্গে দাঁড়িয়ে স্ট্রিট ফুড খেতে পারো? লোকজন জড়ো হয়ে যায় না?
 এই এলাকায় ছোট থেকে বড় হয়েছি। সবাই আমাকে চেনে। আলাদা করে মবড একেবোরেই হই না। তবে যাঁরা মেয়েদের ক্রিকেট নিয়ে অত কিছু খবর রাখতেন না, তাঁরাও এগিয়ে এসে কথা বলছেন, খোঁজখবর নিচ্ছেন খেলার— এটা ভালো লাগে। বন্ধুদের সঙ্গে আমার কোনও সমীকরণ পাল্টায়নি।

স্কুলের বন্ধুরা ফোন করল?
হ্যাঁ, স্কুলের বেশ কয়েকজন ফোন করেছে। আমি যখন বাইরে থাকি, ওদের সঙ্গে আমার ফোনে যোগাযোগ থাকে। আবার যখন বাড়িতে থাকি, তখন পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা হয় কিন্তু ক্রিকেট ক্যাম্পের বন্ধুদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ থাকে। আমার বন্ধুত্বে ফোন তাই একটা গুরুতর ভূমিকা পালন করে আরকি (হাসি)!

বাড়িতে এসে মায়ের কাছে কী খেতে চাইলে?
আমার খাওয়া নিয়ে অত বাছবিচার নেই। যা পাই, তা-ই খাই। বাইরে গেলেও এত খাওয়ার ফ্যাসিনেশন রাখলে চলেও না। বাড়িতে এসেও সবাই যা খেয়েছে আমিও তা-ই খেয়েছি। আলাদা করে খেতে আমি যে খুব ভালোবাসি এমন নয়।

তোমার তো গত বছর সিবিএসই দ্বাদশের পরীক্ষা ছিল...।
হ্যাঁ, আমি টেকনো ইন্ডিয়া গ্রুপ অব পাবলিক স্কুলে পড়ি। ক্লাস টেনের বোর্ডে ৯২ শতাংশ নম্বর পেয়েছিলাম। কিন্তু ২০২২-এ আমি টুয়েলভের ফাইনাল বোর্ড দিতে পারিনি। কারণ ওই সময় আমার বিশ্বকাপের প্রস্তুতি চলছিল। আর যেহেতু খেলাই আমার কেরিয়ার, তাই খেলাকেই বেছে নিতে হয়েছিল। আমার অভিভাবক-কোচ সকলে মিলেই আমরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তবে আমার টুয়েলভের ফাইনাল বোর্ডটা দেওয়ার ইচ্ছে আছে। খেলার ফাঁকে ফাঁকেই আমি প্রিপারেশন নেব বলে ভেবেছি। এবার দেখা যাক!

একটু আগেই বলছিলে, তোমার জগৎ পাল্টায়নি। তিতাসের জগতে কী কী আছে এখন?
সামনেই ডব্লুপিএল। তাই এখন সকাল ৭টা নাগাদ প্র্যাকটিস শুরু করি। ফিজিক্যাল ট্রেনিং ও প্র্যাকটিস নিয়ে প্রায় আড়াই ঘণ্টা মাঠে থাকি। এরপর বাড়ি এসে একটু বিশ্রাম নিয়ে স্নান খাওয়া সেরে ফের মাঠে চলে যাই ১২.৩০-১টার মধ্যে। একটানা পাঁচ ঘণ্টা টানা প্র্যাকটিস চলে তখন। এরপর সন্ধের সময় হয় রিকভারি সেশন চলে, কোনও কোনও দিন জিম চলে। তারপর বাড়ি ফেরা। বলতে পারেন ক্রিকেট নিয়েই আমার সারা দিন কেটে যায়। 

এত টাইট রুটিন, তারপরেও যেটুকু অবসর পাও, কী করতে ভালো লাগে?
আমি খেলা দেখি খুব। পুরনো খেলা, পছন্দের খেলোয়াড়দের খেলা সব খুঁজে খুঁজে দেখি। ডাউনলোডও করা থাকে। চুঁচুড়া মাঠে অন্যদের খেলা থাকলে তা দেখতে চলে যাই। খেলার বাইরে ওটিটি-তে ওয়েব সিরিজ দেখি। এখন যেমন ‘মডার্ন ফ্যামিলি’ দেখছি।

এই জায়গায় পৌঁছনোর জন্য বাবাকে তুমি অনেকটা ক্রেডিট দিয়েছ। মায়ের ভূমিকাটা?
মা সবসময় আমাকে ফ্রি থাকতে দিয়েছেন। খেলতেই হবে এমন যেমন বলেননি, তেমন পড়তেই হবে এমন কিছুও চাপিয়ে দেননি। এটাই আমাকে আরও সফল করে তুলেছে। শুধু বলেছেন, যা করছ সেটা মন ঢেলে করো। তাতে সাফল্য আসবেই। আমি শুধু মায়ের কথায় আস্থা রেখে সেটাই করে গিয়েছি।

খুব গতে বাঁধা একটা প্রশ্ন, ভবিষ্যতে নিজেকে কোথায় দেখতে চাও? 
অবশ্যই ভবিষ্যতে ভারতীয় সিনিয়র মহিলা দলের কোর টিমে খেলতে চাই। আপাতত ডব্লুপিএল মিটলেই আবার হয়তো দলীয় অনুশীলন শুরু হয়ে যাবে। 

25th     February,   2023
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ