বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
আমরা মেয়েরা
 

মহাশিবরাত্রির
সেকাল ও একাল

শুচিস্মিতা দেব: ফাল্গুন চতুর্দশীর কৃষ্ণপক্ষের মহানিশিতে মহাদেবের ‘জ্যোতির্লিঙ্গ’ প্রতীকরূপে আবির্ভাবের পবিত্রক্ষণটি পালনে ভারতের ঘরে ঘরে, মন্দিরে মন্দিরে বেজে ওঠে ‘ওঁ নমঃ শিবায়’ মন্ত্র। মহাশিবরাত্রির মহোৎসবে মেতে ওঠে গ্রাম ও শহরের মানুষ। বিশেষত মহিলারা। 
কথিত আছে, পার্বতী মহাদেবের কাছে সহজপথে শিবের উপাসনার পদ্ধতি জানতে চাইলে শিব ব্রতপালনের সহজ উপায় বাতলে দেন। ব্রতের আগের দিন ভক্তরা নিরামিষ খেয়ে রাতে খড় বা কম্বল বিছিয়ে মাটিতে শোবেন। ব্রতের দিন উপবাসী থেকে চারটি শিব গড়ে চার প্রহরে চার বার দুধ, দই, ঘি ও মধু দিয়ে শিবলিঙ্গকে স্নান করাবেন। ব্রতের উপকরণে গঙ্গামাটি, বেলপাতা, অপরাজিতা, আকন্দ, ধুতরোফুল ও নানারকম ফল। সারারাত জেগে পরদিব্রতকথা শুনলেই ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষলাভ। সত্যি! ব্রতপালনে তেমন খরচাপাতি নেই। আড়ম্বর, সাজসজ্জার বাহুল্যও নেই। গরিব-বড়লোক নির্বিশেষে তাই ব্রতপালনে উৎসাহেরও অভাব নেই। হয়তো এই কারণেই পুরাকাল থেকে শিবরাত্রি ব্রত এত জনপ্রিয়। 
শিবঠাকুরের জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ বোধকরি তাঁর ভোলাভালা, ভবঘুরে, আমোদপ্রিয় ভাবমূর্তি। ব্রহ্মা বিষ্ণু ইন্দ্রাদি দেবতাদের মতো দেবসুলভ মনোভাব নেই। বরং কেমন চারটি ছেলেপুলে ও সাধ্বী স্ত্রী নিয়ে সুখের গেরস্থালি তাঁর। ভিক্ষা করে খেতে লজ্জা নেই। শ্মশানচারী, ভস্মাচ্ছাদিত, আত্মভোলা ব্যোমভোলানাথ অথচ ভীষণ পত্নিপ্রেমী। সতীর দেহত্যাগে খেপে প্রলয়তাণ্ডব নাচে স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাললোক ভয়ংকর কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। শিবপুরাণ অনুসারে এই ফাল্গুনী কৃষ্ণচতুর্দশীর রাতেই তাণ্ডবনৃত্য হয়, তাই এটি মহাশিবরাত্রির প্রতীক।
শিব-পার্বতীর প্রণয়-ভালোবাসার রোম্যান্টিক কাহিনিও খুব লোকপ্রিয়। পার্বতীর কঠোর সাধনায় মহাদেব তুষ্ট হয়ে বিয়েতে রাজি হলেন। এবং বিয়ের দিন বাঘছাল পরিহিত, সাপখোপ-ত্রিশূল-ডমরুশোভিত বর ভূতপ্রেত, নন্দী-ভৃঙ্গী সঙ্গীসাথীদের নিয়ে নাচতে নাচতে বিবাহবাসরে হাজির হলেন। পাড়াপড়শির তা দেখে কী হাল হল জানি না, তবে জামাতাকে দেখে হবুশাশুড়ি জ্ঞান হারালেন! পার্বতী প্রমাদ গুনলেন। মাকে শান্ত করতে শিবকে তিনি সুদর্শন মূর্তি ধারণের অনুরোধ করেন। পার্বতীর মনোবাঞ্ছা পূরণ করলেন শিবঠাকুর। এই মহাশিবরাত্রির রাতেই তাঁদের বিবাহ ঘটে। সেই জন্যই হয়তো শিবরাত্রি পারিবারিক সুখ-সমৃদ্ধি, মহাদেবের মতো উদার স্বামীলাভ, দীর্ঘ দাম্পত্যসুখের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। 
পার্বতীর মতো স্বামী পাওয়ার বাসনায় ভারতবর্ষের মহিলাকুল এরপর নীলকণ্ঠ শিবের মাথায় জল ঢালার ব্যাপারটা নিজেদের এক্তিয়ারে নিয়ে নেওয়ায় শিবরাত্রির উপর কালেকালে যেন মেয়েদের একচেটিয়া অধিকার— এমন ধারণাই চলে এসেছে।
হিন্দুধর্ম পাঁচ হাজার বছরের দীর্ঘপথ পরিক্রমার পর আজকের ইলেকট্রনিক সমৃদ্ধির যুগে এসে পৌঁছেছে। একবিংশ শতাব্দীতে তাই শিবরাত্রি পালনে কিছু কিছু পরিবর্তন নজরে পড়ে। আমাদের জীবনে ধর্মের অনুশাসন কমেছে। ধর্মের আফিং খেয়ে মন্দকে ভালো বলার মানসিক জড়তা অনেক মেয়েই কাটিয়ে উঠেছেন। একালের নারী তাঁর আর্থসামাজিক অধিকার নিয়ে সচেতন। শিবমাহাত্ম্যে সে নারীর পুরোপুরি আস্থা রাখা সম্ভব এখনও? নাকি গ্রামের বা ‘স্বল্পশিক্ষিত’ মেয়েদের মধ্যেই যুগ যুগ ধরে চাপিয়ে দেওয়া এই ব্রত এখন সীমিত? চাকুরিরতা মহিলাদের ব্যস্তজীবনে ব্রত উদ্‌যাপনের অনুকূল অবসর বা ইচ্ছা কি কমছে? এখন ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলি অনেকাংশেই উৎসবমুখর হয়ে উঠেছে। নিছক আমোদ-আহ্লাদের উপকরণসমৃদ্ধ অভ্যাসেও পরিণত হচ্ছে। চটুল নাচগান, সাজসজ্জা, থিমসর্বস্ব, মাইকের দৌরাত্ম্য আমাদের ধর্মীয় বাতাবরণের সুষমা কেড়ে নিচ্ছে। শিবরাত্রির ক্ষেত্রেও সারা রাত সিনেমা দেখার বা নাচাগানা করার, সাজসজ্জা ও আড়ম্বরের অনুপ্রবেশ ঘটে যাচ্ছে। পুজোআচ্চার নামে আমরা বিশ্বাস আর অভ্যাসের দাসত্ব করে চলেছি কি না— সেই দোলাচলটা যুক্তিনির্ভর বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজের মনে জাগছে কি? মনে হয় না। কারণ  শিবরাত্রি অনেক ঘরেই সমারোহে পালিত হচ্ছে। কিছুটা হাজার হাজার বছরের ভক্তি ও অন্ধবিশ্বাসে, কিছুটা অভ্যাসে আর কিছুটা হয়তো উৎসবপ্রিয়তায়। 
তবে এটাও ঠিক, ত্রিনয়নে আত্মদর্শনের মগ্নতা এবং অসীমকে প্রত্যক্ষ করার দুর্বার রহস্যময়তা শহরের আধুনিকমনস্ক মহিলাদেরও শিবরাত্রির মাহাত্ম্যের দিকে হয়তো কিছুটা আকৃষ্ট করছে। এজন্য শিবঠাকুরকেই আমরা বিশেষ ক্রেডিট দেব কারণ তিনি একাধারে লৌকিক এবং বৈদিক দেবতা। 
প্রাক-ইতিহাস কাল থেকেই পশুপতি শিবের অস্তিত্ব প্রমাণিত। হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর শীলে নানা প্রাণিবেষ্টিত যোগাসনে আসীন পশুপতির মূর্তিটিকে ইতিহাসবিদ জন মার্শাল আদি পশুপতি শিবের প্রতীক বলে মানেন। বৈদিক পরবর্তী যুগে লিঙ্গপূজার প্রচলন বাড়ে। শিবের অনন্যতা তাঁর দ্বৈত সত্তায়। তাই তিনি ‘মিসটিক’ বা রহস্যময়। তিনি কখনও কোমল, কখনও উগ্র, কখনও শ্মশানবাসী সন্ন্যাসী, আবার তিনি সুখী গৃহস্থ। তিনি কখনও প্রণয়ী, কখনও বৈরাগী। কখনও সংহারক আবার কখনও সৃষ্টি-স্থিতির আহ্বায়ক। তাঁর আদি-অন্ত নেই। তাঁর এই ‘একই অঙ্গে এত রূপ’ সত্যিই বিস্ময়কর। এবং এই রহস্যময় ভাবই তাঁকে মহিলাদের কাছে জনপ্রিয় করে তুলেছে বলেও অনেকের মত। আধুনিকাদের বক্তব্য অনুযায়ী, শিব ঠাকুরের একটা ‘ঘরোয়া ইমেজ’ আছে যা তাঁকে অন্যান্য দেবতাদের থেকে একটু কাছের করে তুলেছে। এছাড়া বাঙালি তাঁকে ঘিরে যে সংসারী রূপ সৃষ্টি করেছে, প্রতি দুর্গাপুজোয় যার প্রতিফলন দেখা যায়, সেটাই মহিলামহলে শিবঠাকুরের ‘ইউএসপি’ বলা চলে।  
  ত্রিকালজ্ঞ, সর্বশক্তির আধার মহাদেবের এই আত্মমগ্ন, ধ্যানগম্ভীর আদিযোগীর রূপ হল তাঁর অন্তস্থিত সত্তা। তিনি এই কারণেই ব্রাহ্মণেরও পূজনীয়। শৈবদের কাছে তিনিই একাধারে স্রষ্টা, পালক ও সংহারক। 
তবে যুগ যত এগিয়েছে আদিযোগী শিবের আবেদন ততই সমগ্ররূপ পেয়েছে। এখন আর শুধু নারীদের মধ্যেই এই জনপ্রিয়তা সীমাবদ্ধ থাকছে না। বরং ইদানীং পুরুষদের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে শিবপূজায় অংশ নেওয়ার হিড়িক। শিবের ব্রতকথাতেই তো পুরুষের শিববন্দনার গল্প বলা হয়েছে। তবু যে কেন একে মেয়েদের ব্রত বলে দাগিয়ে দিল সমাজ! সেই গল্পটা বলি। বারাণসীর কাছে এক হিংস্র, নিষ্ঠুর ব্যাধ থাকত। একদিন পরিবারের জন্য খাবার জোগাড়ের উদ্দেশ্যে বনে বনে ঘুরে দিনশেষে ক্লান্ত উপবাসী ব্যাধ ঘরে ফেরা অসম্ভব বুঝে একটি বেলগাছের নীচে ঘুমিয়ে পড়ল। রাতে তার গায়ের ধাক্কায় শিশিরসিক্ত একটি বেলপাতা গাছের নীচে শিবলিঙ্গের মাথায় পড়ে। সকালে ঘরে ফিরে সে স্নান করলে এক অতিথি এসে উপস্থিত হল। উপবাসী ব্যাধ অতিথিকে খেতে দিয়ে পরে নিজে খায়। ব্যস, স্বল্পে সন্তুষ্ট শিবঠাকুরের ব্রত ব্যাধটি অজান্তেই পালন করে ফেলে। ব্যাধের জীবনাবসান হলে শিবঠাকুরের দূতরা যমরাজের দূতদের ব্যাধের আত্মাকে নিতে বাধা দেয় এবং শেষমেশ যমরাজকে মেনে নিতেই হয় যে শিবরাত্রির ব্রতপালনের সুফলের কারণে ব্যাধের জীবনের উপরে তাঁর আর অধিকার নেই। অতএব শিবরাত্রির ব্রত মহিলারা শুধু নন, পুরুষরাও করতে পারেন। 
সমাজের চোখে মহিলাদের ব্রতপালনের এই রীতি শাঁখা-সিঁদুরের মতোই স্বামীর প্রতি আনুগত্য দেখানোর আরও একটি বেড়ির সমান। আজকের যুগে নারী-পুরুষের যখন সমাজ-সংসারে সমানাধিকার নিয়ে সর্বত্র ভাবনা চলছে, সেখানে ব্রতপালনেও স্বামী-স্ত্রীর হাত ধরাধরিই তো কাম্য। একজন আনুগত্য প্রকাশে ব্রত রাখবেন, আর একজনের কোনও দায়িত্বই নেই?
অতীতে অবশ্য বহু সামাজিক ও ধর্মীয় রীতির মতো নারীদের শিবব্রতপালন বাধ্যতামূলক ছিল। মধ্যযুগের অশিক্ষিত, আর্থিকভাবে পরনির্ভর মহিলাদের স্বামীই ছিল সুখস্বাচ্ছন্দ্যের একমাত্র উৎস। একটি ভালো বর ও শ্বশুরঘর লাভই ছিল তাঁদের জীবনের লক্ষ্য। স্বামীর দীর্ঘজীবনের প্রার্থনায় ব্রত উদ্‌যাপনের মূল কারণ ছিল বৈধব্যজীবনের অসহায়তা থেকে দূরে থাকতে চাওয়ার বাসনা। এখন স্বামীর মৃত্যুর পর মেয়েদের রঙিন শাড়ি পরা বা আমিষাহার নিয়ে আগেকার মতো প্রশ্ন ওঠে না। অন্তত শহরে! স্বামী বেঁচে না থাকলে পুনর্বিবাহেও অতীতের সেই সামাজিক চোখরাঙানি নেই। অতএব নারীদের জীবনে আগের নিরাপত্তাহীনতা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। তাই সচেতন নারীর শিবরাত্রি পালনের উৎসাহে ভাটা পড়া খুবই স্বাভাবিক সামাজিক বিবর্তনের ছবি। তা ছাড়া সুউপায়ী আত্মনির্ভর মেয়েদের অনেকেই এখন বিয়ের টানাপোড়েনে বাঁধা পড়তে চান না। 
বিয়ে ছাড়াও সমাজে নারীপুরুষের একসঙ্গে বসবাসে (লিভ ইন) সমাজের অনুমোদন পাওয়ায় বিয়ের গুরুত্বও কমেছে। বিয়েও এখন আগের মতো চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নয়। মেয়েরা শ্বশুরবাড়িতে অন্যায়-অত্যাচার মেনে নেয় না। স্বামী-স্ত্রীর বনিবনার অভাবে বিবাহবিচ্ছেদ এখন খুবই স্বাভাবিক। স্বনির্ভর মেয়েদের জীবনে নানাভাবেই পুরুষনির্ভরতা কমে গিয়েছে। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে শিবের মতো আলুথালু অগোছালো, ভুঁড়িওয়ালা পুরুষের চেয়ে ঝকঝকে বলিয়েকইয়ে পুরুষই হয়তো মেয়েদের এখন বেশি পছন্দ! এমনকী স্বামীর মাত্রাছাড়া ধূমপান বা সুরাপান, মাদকসেবন শরীরসচেতন জিমপ্রিয় মহিলাদের ভালো লাগার কথা নয়। শিবের মতো বদমেজাজি, যত্রতত্রগামী ইয়ারদোস্ত সহযোগে ফূর্তি করে বেড়ানো অসংসারী পুরুষের ঘর সামলানো সহজ নয়! মর্তের মহিলাদের তো আর মা দুর্গার মতো দশটি হাত নেই! শুধু ঘর সামলানো সেকেলে মেয়েদের মধ্যে উদাসীন শিব জনপ্রিয় হলেও আজকের স্বয়ংসম্পূর্ণা নারীর কাছে তাই তাঁর টিআরপি খানিক পড়তির দিকেই!  

18th     February,   2023
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ