বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
আমরা মেয়েরা
 

 দক্ষিণেশ্বরে  
কালী আরাধনা

বাংলার রাজধানী কলকাতার কালী আরাধনায় দু’টি মন্দির অতি প্রসিদ্ধ। কালীঘাট আর দক্ষিণেশ্বর। দুই মন্দিরের মধ্যে চরিত্রগত পার্থক্য হল, কালীঘাট শক্তিপীঠ আর দক্ষিণেশ্বর সিদ্ধপীঠ। কোনও সাধক যখন তার সাধনার মাধ্যমে একটি দেবালয় বা স্থানকে মহিমান্বিত করে তোলেন তখন সেই মন্দির বা দেবালয়কে ‘সিদ্ধপীঠ’ বলা হয়। উনবিংশ শতাব্দীর আধ্যাত্মিক সূর্য শ্রীরামকৃষ্ণ রানি রাসমণি প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণেশ্বরের দেবালয়ে ‘মৃন্ময়ী’ দেবতাকে ‘চিন্ময়ী’ হিসেবে প্রমাণ করেন। এই ঘটনা ঘটে সেই যুগে, যখন বিদেশি শাসকরা হিন্দুর পুতুল পুজো নিয়ে সমগ্র বিশ্বে সমালোচনার ঝড় তুলেছে। প্রতীক পুজোকে পুতুলের আরাধনা বলে নিন্দা করছে। সেই সমালোচনার মধ্যেই শ্রীরামকৃষ্ণ কর্তৃক মাটির প্রতিমাকে সাধনার মাধ্যমে জাগ্রত করা সম্ভব, তা এই মন্দির প্রাঙ্গণে প্রকাশিত হয়েছিল। এদিক দিয়ে দক্ষিণেশ্বর মন্দির আধুনিক যুগে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
রানি রাসমণি মন্দির প্রতিষ্ঠার ক্ষণেই এই মন্দির এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য অর্জন করে। রাসমণির মাধ্যমে সমগ্র জগৎ জেনেছিল, ভক্তের কোনও জাত নেই। এক ব্যক্তি তাঁর ভক্তিতেই অধ্যাত্মক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য স্থান গ্রহণ করতে সক্ষম। রানির মন্দির প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের কথা আমরা জানি। কিন্তু একথা স্পষ্টভাবে বোঝা দরকার, এই সংগ্রামের পথ ধরেই দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের পূজা পদ্ধতি অন্য মন্দিরের থেকে পৃথক ধারায় প্রবাহিত। আচারসর্বস্ব ভাব থেকে মুক্ত হয়ে এই দেবী আরাধনার ধারা জনকল্যাণমুখী রূপে পরিবেশিত হয়েছে। যে স্বকীয়তা আজও বিদ্যমান। 
মন্দিরের স্বকীয়তার সঙ্গে আমাদের এই কথাও মনে রাখতে হবে এই মন্দিরের পূজা পদ্ধতির ধারায় একটি বিবর্তন দেখতে পাওয়া যায়। শ্রীরামকৃষ্ণের পূজা থেকে বর্তমানের পূজা পদ্ধতি, যেন ধাপে ধাপে অগ্রসর হওয়া সুন্দর সোপান শ্রেণি। আমরা আমাদের চারপাশে প্রায় সমস্ত মন্দিরে দেখি সেখানে প্রথাগতভাবে পূজা দেওয়া হয়। যে ব্যক্তির জন্য পূজা দেওয়া হবে বা যিনি পুজো দেবেন তাঁর নাম-গোত্র ইত্যাদি উল্লেখ করা অবশ্যকর্তব্য। কারণ, সেই নাম ও গোত্র অনুযায়ী দেবী সম্মুখে সংকল্প করতে হয়, নইলে পুজো অসম্পূর্ণ। কিন্তু দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে এই পদ্ধতি অবলম্বন করা হয় না। মায়ের সম্মুখে দাঁড়িয়ে প্রত্যেকেই নিজের মতো করে দেবীর কাছে মনস্কামনা করতে পারেন। তাঁর কাছে আনত হতে পারেন, এটি হল মন্দিরের পূজা পদ্ধতির আঙিনায় এক বিরল বৈশিষ্ট্য। কিন্তু ঘোর অমাবস্যায় কালীপূজার বিশেষ ক্ষণে এই দেবীর পূজার আয়োজন কেমন হয়? কোন আচার পালিত হয় বিবিধ প্রশ্ন অনেকের মনেই উঁকি দেয়।
কালীপুজোর একটি বিশেষ পদ্ধতি আছে। কালীপুজোর দিন দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে সেই পদ্ধতিকেই অনুসরণ করা হয়। তবে এই মন্দির আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন হলেও এই দেবী কিন্তু মূলত এক বংশের গৃহদেবী। তাই দেবী কালিকার প্রথাগত রীতি অনুযায়ী পূজা হলেও কিছু ক্ষেত্রে পারিবারিক ঐতিহ্যকে অনুসরণ করা হয়। পূজায় যে ঘটটি স্থাপন করা হয় তা প্রথমেই পাশে প্রবাহিত গঙ্গা থেকে পবিত্র জলে পরিপূর্ণ করে আনা হয়। অন্যান্য দিনে দেবী ভবতারিণী বেনারসি শাড়িই কেবল পরিধান করেন। সঙ্গে থাকে নানা ফুলের গহনা। কিন্তু কালীপুজোর দিন কোনও ফুলের গহনা ব্যবহার করা হয় না। দেবীকে হীরে-জহরতে মুড়ে দেওয়া হয়। পূজারি যখন আরতি করেন তখন সেই আলোর ছটা লেগে দেবীগাত্র ঝকমক করে ওঠে।
এই মন্দিরের প্রথম পূজারি ছিলেন রামকুমার চট্টোপাধ্যায়। তিনি অতি শুদ্ধ মতে দেবী পূজা সম্পন্ন করেছিলেন। শাস্ত্রজ্ঞ রামকুমারের দেবী আরাধনায় মা ভবতারিণী অন্নভোগ গ্রহণ করেন। সেই শাস্ত্র অনুসারী রীতির সঙ্গে অপূর্ব মাত্রা সংযোজিত হয়েছিল রামকুমারের পরবর্তী পূজক শ্রীরামকৃষ্ণের পূজা পদ্ধতিতে। সেই বাউল প্রেমিক অনায়াস সাধক শ্রীরামকৃষ্ণের পুজো ছিল ভক্ত ও ভগবানের একান্ত আলাপচারিতা। তাঁকে রাসমণির জামাতা মথুরবাবু যখন দেবীর বেশকারী রূপে নিযুক্ত করতে চেয়েছিলেন, তখন কিশোর গদাধর স্পষ্ট সত্য উচ্চারণ করেছিলেন, ‘তোমাদের দেবীর গায়ে অনেক গহনা, আমি সেগুলির ভার নিতে পারব না।’ দেবী যে অর্থের মাধ্যমে, ধনের আতিশয্যে প্রাপ্ত নন— এই কথা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। সেখান থেকেই দেবী আরাধনার ধারা নতুন পথে পথে প্রবাহিত হল। শ্রীশ্রীদুর্গামাতার আরাধনায় আমরা ভাবপুষ্পের কথা পাই। সেই পুষ্পগুলি হল, জ্ঞান পুষ্প, বৈরাগ্য পুষ্প, ভক্তি পুষ্প ইত্যাদি। শ্রীরামকৃষ্ণও দেবীর কাছে চেয়েছিলেন জ্ঞান, ভক্তি, বৈরাগ্য। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে দেবী ভবতারিণীর প্রধান উপচার হল ভাব। তিনি শ্রীরামকৃষ্ণ কর্তৃক ভাবের মাধ্যমে পূজিত হয়েছিলেন। যদিও শ্রীরামকৃষ্ণ বিধিমতো তন্ত্রসাধনা করেছিলেন। তবু তিনি ভবতারিণীকে কোনও দিন সেই আচারে পূজা করেননি। শ্রীরামকৃষ্ণ মঠের পুজোও ভাবের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের পুজো অন্য মন্দিরের পুজোর থেকে এখানেই একটু পৃথক ধারার অনুসারী। যদিও মানুষের কাছে এই দেবীপূজাই অনেক বেশী আকর্ষণীয়। কারণ, এই দেবীর কাছে চাইলেই কামনা সিদ্ধ হয়— এই বিশ্বাস শ্রীরামকৃষ্ণ প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তাঁর বার্তাবাহক, সহচর নরেন্দ্রনাথ সাংসারিক অসুবিধার মধ্যে প্রায় হাবুডুবু খেতে খেতে উপস্থিত হয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ সন্নিকটে। যদিও তিনি দেবীরূপের আরাধনায় বিশ্বাসী ছিলেন না। তবু একথা বিশ্বাস করতেন যে শ্রীরামকৃষ্ণের কথা দেবী শোনেন। শ্রীরামকৃষ্ণ কিন্তু তাঁর আদরের মায়ের কাছে নরেনের হয়ে সুপারিশ করতে চাননি। তিনি নরেন্দ্রনাথকে বলেছিলেন, ‘আমি বললে মা মানবেন কেন? তুই তো মাকে মানিস না। নিজে গিয়ে বল।’ নরেন্দ্রনাথ এই প্রস্তাবে সম্মত হয়েছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, তাহলে শনি বা মঙ্গলবারে আয়। দেবীবার, তিনি জাগ্রত থাকেন।’ 
নরেন্দ্রনাথের জীবনে দেবী সন্নিধান কী প্রভাব ফেলেছিল তা আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়। আমরা কেবল জানি, দেবী জাগ্রতা। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর নাকে তুলো ধরে দেখেছিলেন, দেবীর শ্বাসে তুলো নড়ছে। দেবী কখনও মন্দিরের উপরে উঠে গঙ্গা দর্শনও করেছেন। 
দেবীর এই লীলাখেলা মন্দিরের সর্বত্র এখনও জড়িয়ে আছে। সেই একই বিগ্রহ আমরা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। আর জেনেছি এই দেবীর কাছে আবেদন নিবেদনের ফল অমোঘ। তাই দুঃখ-দ্বন্দ্বে পরিপূর্ণ জীবনে শান্তি পেতে আমরা ছুটে যাই সেই দেবীর পদপ্রান্তে। দেবীর নাম ভবতারিণী। পুজো পদ্ধতি নয়, পুজোর আকুতিই আমাদের মনে ধরা দেয় বেশি। 

22nd     October,   2022
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ