বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
আমরা মেয়েরা
 

নারীর হাতে 
ঢাকের বোল

ঢাকে কাঠি পড়লেই পুজোর আনন্দে মেতে ওঠে মন। কিন্তু এই বোল কি শুধুই পুরুষের হাতে খোলে? মোটেও না। মহিলারাও রয়েছেন এই পেশায়। তাঁদের কথায় কমলিনী চক্রবর্তী।

ঢাকের বাদ্যি শুনলেই মনের মাঝে পুজোর সুর বেজে ওঠে। মাঝে মাত্র কয়েকটা দিন। তারপরেই বাঙালির সেরা উৎসব দুর্গা পুজো। ভোরের আলো চোখে লাগতে না লাগতেই কানে বাজবে ঢাকের তাল। আর সেই তালে হৃদয়ে দোলা লাগবে। মা দুর্গা তাঁর সন্তানদের নিয়ে পুজো মণ্ডপ আলো করে বসবেন। তাঁকে বরণ করে নেব আমরা। শুরু হবে দুর্গোৎসব। 

নতুনত্বের খোঁজ 
পুজো মানেই মন্ত্রের ধ্বনি, পুজো মানেই ঢাকের তাল, পুজো মানেই নতুন পোশাকের গন্ধ। মোট কথা পুজো মানেই হইহই কাণ্ড রইরই ব্যাপার! দুর্গাপুজোর সঙ্গে এমনই কিছু সনাতনী ধারণা গেঁথে রয়েছে আমাদের মনে। ঢাকের বাদ্যিও যে তার একটা সে তো বলাই বাহুল্য। আর ঢাকবাদক হিসেবে আমরা পুরষদেরই কল্পনা করে থাকি। কিন্তু সবকিছুর মতোই এই রীতিতেও বদল এসেছে। পুরুষের পাশাপাশি তাই মহিলাদের কাঁধেও উঠেছে কাশফুলের ছড় লাগানো ঢাক। তাঁরাও ঢাকের কাঠিতে বোল তুলছেন সারাদিন। পুজো প্যাণ্ডেল থেকে অনুষ্ঠান বাড়ি, সর্বত্রই মহিলা ঢাকিদের কদর বাড়ছে। আর প্রথম যিনি মহিলাদের এই ভিন্ন পথে নিয়ে এসেছেন তিনি ঢাকি গোকুল চন্দ্র দাস। এই বিষয়ে গোকুলবাবুকেই প্রশ্ন করলাম, হঠাৎ মহিলাদের দিয়ে ঢাক বাজানোর কথা ভাবলেন কেন? বললেন, ‘মার্কিন দেশে গিয়ে ভাবনাটা প্রথম মাথায় এসেছিল। সেখানে ওস্তাদ জাকির হুসেনের একটি অনুষ্ঠানে দেখেছিলাম এক মার্কিন মহিলাকে। একাধারে ক্ল্যারিয়েন, ড্রাম আর ট্রাম্পেট বাজিয়ে দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করছিলেন তিনি। আমিও ভাবলাম আমেরিকার কন্যা যদি পারে আমাদের ভারতের মেয়েরাই বা পারবে না কেন?’ প্রচেষ্টার সেই শুরু। ইংরেজি প্রবাদ বলে, চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম। বঙ্গসন্তান গোকুল চন্দ্র দাস যে এই প্রবাদটাকে একেবারে অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণ করে ছাড়বেন তা-ই বা কে জানত! মহিলা ঢাকির দল গড়ার কথা যখন ভাবলেন, তখন প্রথম নিজের বাড়ির অন্দরমহল থেকেই খোঁজাটা শুরু করেছিলেন। ভাইঝির কাঁধে ঢাক আর হাতে কাঠি তুলে দিয়ে শুরু করেছিলেন প্রশিক্ষণ। 

দেবীপক্ষের শুরু
ঢাকের বাজনাকে অন্য মাত্রায় তুলে নিয়ে গিয়েছেন গোকুল চন্দ্র দাস। ঢাকবাদক হিসেবে তাই তিনি স্বনামধন্য। দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও ঢাকের তাল পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। বললেন, ‘মহালয়ায় পিতৃপক্ষের অবসান ঘটে, শুরু হয় দেবীপক্ষ। দুর্গাপূ‌জার মাধ্যমে আমরা মাতৃশক্তির আরাধনা করি। তাহলে সমাজের মেয়েদের এত বঞ্চনা কেন? দেবীর আরাধনায় তাঁদেরও তো সমান অধিকার। সেক্ষেত্রে আরাধনার কিছু অংশ মহিলাদের অধরা থাকবে কেন? পুরুষতন্ত্রের প্রভাবে নারীর অধিকারে কিছু ঘাটতি থেকেই যায়। সেটাই দূর করার চেষ্টা করেছি।’

বিদ্যুতের ঝিলিক
গোকুলবাবুর ভাইঝি প্রমিলা জানালেন তাঁর ঢাক বাজানোর অভিজ্ঞতার কথা। ‘ঢাকের কাঠি হাতে নিলেই সারা শরীরে একটা বিদ্যুতের ঝিলিক খেলে যায়। একটা অদ্ভুত মাদকতা আসে মনের মধ্যে। ঢাকের তালে আমাদের হৃদয়ে দোলা লাগে। মনটা আনন্দে ভরে ওঠে। ছোটবেলা থেকেই কাকার সুবাদে তাল আর বোলের মধ্যে আমার বড় হওয়া। ঢাক মানেই উৎসবের আনন্দ। সেই আনন্দ যে আমার মাধ্যমে সকলের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারব তা কোনও দিন কল্পনাও করিনি। তাই কাকার কাছে ঢাক শেখার কথা শুনে প্রথমটা নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।’ 
ঢাক বাজানোর বিভিন্ন অভিজ্ঞতার মধ্যে তাঁর স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে দিল্লির বাঙালি পাড়ার পুজোয় ঢাক বাজানোর কথা। পুজোর মধ্যে বাড়ি ছেড়ে শহর ছেড়ে অত দূর দিল্লি যেতে মনখারাপই লেগেছিল। কিন্তু কথা দিয়েছেন দিল্লির একটি পুজো কমিটিকে। সেখানে ঢাক বাজাবেন তিনি ও আরও কয়েকজন মহিলা বাদক। গোকুলবাবুরই হাতে গড়া ঩সেই দল। কথা মতো দুর্গাষষ্ঠীতেই পৌঁছে গেলেন দিল্লির পুজো মণ্ডপে। সেখানে গিয়ে দেখেন গোটা পুজোটাই মহিলা পরিচালিত। একসঙ্গে এত মহিলাকে পুজোর নানা কাজে ব্যস্ত দেখে প্রমিলার মনে ভরসা জাগল। শুরু করলেন ঢাকের বাদন। বাজাতে বাজাতে এমনই মাদকতা ছেয়ে গেল গোটা মণ্ডপে যে শিশু থেকে বয়স্ক সকলের শরীরী বিভঙ্গেই সেই বাজনার প্রভাব পড়ল। মনে এক অন্যরকম চাঞ্চল্য ঩দেখা দিল, ঢাকের তালে কোমর দুলে উঠল। মায়ের পুজোয় মেয়ের হাতে ঢাকের বোল যেন অন্য মাত্রায় পৌঁছে গেল। বাজনা একসময় শেষ হল। সকলে প্রশংসায় পঞ্চমুখ। শুধু তাই নয়, এক অসম্ভব প্রশান্তি সকলের চোখে মুখে। প্রমিলার মনে হয়েছিল সত্যিই বুঝি দুর্গা মণ্ডপে পুজোর আমেজ নিয়ে আসতে তিনি সক্ষম হয়েছেন। মায়ের কাজে সাফল্য পাওয়ার মতো এমন অনুভূতি তাঁর এর আগে কখনও হয়নি। 

সীমার মাঝে অসীম 
প্রথা ভেঙে নতুন কিছু করতে গেলেই বাধা আসে। সেটাই স্বাভাবিক, জানালেন গোকুল চন্দ্র দাস। জানালেন, সম্পূর্ণ মহিলাকেন্দ্রিক একটি ঢাকির দল গড়ে তোলাও তাঁর পক্ষে সহজ হয়নি। প্রথমদিকে পুরুষতন্ত্রের চোখরাঙানি ছিল, কটু কথা ছিল। কিন্তু ভালো কাজ কখনও চাপা থাকে না। ‘কষ্ট’ করলে ‘কেষ্ট’ ঠিকই পাওয়া যায়। গোকুলবাবুর ঢাকের দলের ক্ষেত্রেও তেমনটাই হয়েছিল। প্রথম বাধা পেরিয়ে মন শক্ত করে টিকে থাকার লড়াইটা তাঁর মেয়েরা জিতে গিয়েছে। ক্রমশ মেয়েদের প্রশিক্ষণ এতটাই উন্নত মাত্রায় তিনি নিয়ে গেলেন যে তাঁদের হাতে ঢাকের কাঠি পড়লে ঢাক যেন কথা বলে উঠতে শুরু করত। আর সেই শ্রুতির মধু গুঞ্জরণে শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে যেতেন। ক্রমশ শ্রোতাদের মুগ্ধতা সমাজে আলোড়ন ফেলল। মহিলাদের হাতেও খুলতে শুরু করল ঢাকের বোল। ‘এখন তো পুরুষতন্ত্র মহিলাদের বিভিন্ন পেশায় দেখেই অভ্যস্ত। যত দিন যাবে, যুগ বদলাবে, ততই মহিলারা স্বমহিমায় বিরাজ করবেন সমাজে। এ আর নতুন কথা কী?’ বললেন গোকুল চন্দ্র দাস। 

বোলগুলো কথা বলে
প্রমিলার মতোই জ্যোৎস্না, লক্ষ্মী সকলেই ঢাক বাজানোকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন। লক্ষ্মীর কথায়, ‘ঢাকের কাঠিতে হাত পড়লেই মনে হয় বোলগুলো যেন আমার সঙ্গে কথা বলছে। আমি নিজের অন্য ধরনের একটা পরিচিতি তৈরি করতে পেরেছি ঢাকে বোল তুলে। ঢাকের বাজনা তাই আমার কাছে স্বাধীনতার আর এক নাম। আমার স্বামীও ঢাক বাজান। ফলে ঢাকের বাজনার সঙ্গে ভালোলাগার মুহূর্তগুলো জুড়ে গিয়েছিল বিয়ের পর থেকেই। কিন্তু নিজে যবে থেকে ঢাক কাঁধে তুললাম তখন থেকেই ঢাক আমার জীবনের অস্তিত্ব হয়ে উঠল। জীবনের একটা নতুন মানে খুঁজে পেলাম। আর সেটা যে শুধুই নিজস্ব রোজগারের কারণে তাও কিন্তু নয়। একেবারে স্বতন্ত্র এক অনুভূতি। নিজেকে অন্যভাবে খুঁজে পাওয়ার কিছু মুহূর্ত, যা অনুভব করা যায়। ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।’

নতুন করে আবিষ্কার
জ্যোৎস্নার মুখেও একই সুর। এতদিন নানা ধরনের খুচরো কাজে রোজগার করতেন তিনি। কিন্তু ঢাক বাজানোর পেশায় এসে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেছেন। এই অনুভূতি তিনি ঢাকের তালের সঙ্গে টের পান। ভালোলাগা, আনন্দ, হৃদস্পন্দন সব ছাপিয়ে একটা বিহ্বল ভাব, যা মনকে আচ্ছন্ন করে। শরতের আকাশে সাদা মেঘ ভেসে বেড়াতে শুরু করলেই তাঁরাও সবাই তৈরি হতে থাকেন। মনে এক আলাদা উন্মাদনা পেয়ে বসে। হাতের আঙুলগুলো এমনিই চঞ্চল হতে শুরু করে। ঢাকের বোলের তরঙ্গ ওঠে মনে। একটা ছন্দে বাঁধা পড়ে শরীর। ঢাকের ভৈরব হরষ প্রাণে লাগে, শুরু হয়ে যায় পুজোর প্রস্তুতি। 

সাধনা আর ইচ্ছা
ঢাক কাঁধে তুললাম, কাঠি হাতে নিলাম আর বাজাতে শুরু করলাম, এমন সহজ কাজ কিন্তু এটা নয়, জানালেন জ্যোৎস্না। সাধনা আর প্রচেষ্টার মিলিত একটা ফল বলা যেতে পারে এই ঢাক বাজানো। প্রথমত এই পেশায় যে এতদিন পর্যন্ত পুরুষদের আধিপত্য ছিল এবং এখনও অনেকাংশে তা-ই, তার একটা বড় কারণ ঢাক বাজাতে গায়ের জোর লাগে। অনেক মেয়ের পক্ষেই সেটা সম্ভব হয় না। ঢাকের ওজন কাঁধে তুলে হাত ও পা সমান তালে সঞ্চালন অনেক মহিলার পক্ষেই সম্ভব হয় না। আর সেই কারণেই ঢাক বাজানো একটা সাধনা। গোকুলবাবুর নেতৃত্বে মহিলা ঢাকির দল রীতিমতো শারীরিক কসরত করেন রোজ। যোগাসন, ব্রিদিং এক্সারসাইজ ইত্যাদি করে তবেই ঢাক বাজানোর দম পান তাঁরা। এছাড়া তীব্র ইচ্ছা তো আছেই। ‘মায়ের পুজোর অনবদ্য অংশ হল ঢাকের তাল। সেই তাল নিজেরা তৈরি করতে পারলে মনে হয় পুজোর কাজে আমরাও নেহাত ফেলনা নই, বরং প্রয়োজনীয়’, বললেন প্রমিলা। 
মা দুর্গার আগমনে প্রাণ যখন ব্যাকুল হয়ে ওঠে আপামর বাঙালির, তখনই ঢাকের বোলের সঙ্গে নিজেদের নতুনরূপে আবিষ্কার করেন মহিলা ঢাকির এই দল। ঢাক বাজানো তখন আর শুধুই পেশার পর্যায়ে থাকে না। বরং জীবন্ত দশভুজা হয়ে তাঁরা পুজোর আসরে নামেন। পিতৃপক্ষের অবসান ও দেবীপক্ষের সূচনার ঘোষণা হয় তাঁদের হাতে, ঢাকের তালে। আবার বিজয়া দশমীতে তাঁদের ঢাকের বোলেই মা পাড়ি দেন শ্বশুরবাড়ি।
 

17th     September,   2022
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ