বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
আমরা মেয়েরা
 

গণেশ জননী

১৪ বছর বয়স থেকে হাতি ধরতে ওস্তাদ। আজও হাতির সঙ্গেই কাটে অধিকাংশ সময়। ‘ওয়ার্ল্ড এলিফ্যান্ট ডে’-র আগে জঙ্গুলে জীবনের দীর্ঘ কাহিনি ভাগ করে নিলেন পার্বতী বড়ুয়া। লিখেছেন স্বরলিপি ভট্টাচার্য।  

আপনিই দেশের একমাত্র মহিলা মাহুত? ‘ফান্দি, আমি ফান্দি’, উত্তর দিলেন বছর ৬৮-র প্রৌঢ়া। কত বয়স, জানতে চাইলে ওই সংখ্যাটাই বলেন। সাধারণ হিসেবে প্রৌঢ়াই বটে। এই বয়সে কেউ অবসরের আরামে গা সেঁকেন, কেউ বা বার্ধক্যের খতিয়ান জমা করেন কালের গর্ভে। কিন্তু আজও তাঁর বেশিরভাগ সময়ই কাটে জঙ্গলে। কাটে হাতিদের মাঝে। সেখানেই তো তাঁর কাজ! শক্ত চেহারা। দেখেই বোঝা যাবে রোদ, ঝড়, বৃষ্টি মাথায় নিয়েই জীবন কাটে। আদতে জঙ্গলেই কেটেছে জীবনের অনেকটা সময়। এখনও ডাক আসলেই হাজির হয়ে যান হাসিমুখে। যান হাতিদের কাছে। হাতিরা তাঁর কথা শোনে। তিনিও বোঝেন হাতির মন। তিনি অর্থাৎ মহিলা মাহুত,  থুরি ‘ফান্দি’— পার্বতী বড়ুয়া। পুরুষ আধিপত্যের এই পেশায় হইহই করে নিজের জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। ভালোবাসা এবং দীর্ঘ অভিজ্ঞতার মিশেলে জঙ্গুলে জীবনের পরতে পরতে পার্বতীর অবদানের গুরুত্ব বোঝেন সরকারের পদস্থ আধিকারিকরাও।   

বহু সাধনার ফল
‘ফান্দি’ কী? গুয়াহাটির বাড়ি থেকে ফোনে পার্বতী বললেন, ‘যে ফাঁস দিয়ে হাতি ধরে সে ফান্দি। ফাঁদ পেতে নয়। ফাঁস ছুড়ে। ১৪ বছর বয়সে আমি প্রথম হাতি ধরি। হাতি ধরার ক্যাম্প হতো আমাদের। যে বয়সে মানুষ কিছু বুঝতে শেখে না, ধরে নিন তখন থেকে আমি হাতি দেখছি। ওই পরিবেশেই আমি বড় হয়েছি। এসবে অনেক কৃচ্ছ্রসাধন করতে হয়। সাধনা করতে হয়। যথেষ্ট কষ্টকর এই পথ। একদিনে ফান্দি হওয়া যায় না। আগে ঘাসি হবে তারপর মাহুত, তারপর ফান্দি। কাজ শিখতে শিখতে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়। এটা তো বই পড়া শিক্ষা নয়।’ 

রাজকন্যা
পার্বতীর শরীরে বইছে রাজরক্ত। তাঁর বাবা প্রকৃতিশ চন্দ্র বড়ুয়া ওরফে লালজিই তাঁর গুরু। অসমের গৌরীপুরের রাজপরিবারে রাজা হিসেবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সর্বশেষ সদস্য প্রয়াত প্রকৃতিশ চন্দ্র বড়ুয়া। হাতি তাঁর কাছে ছিল নিজের সন্তানের মতো। বাবার কাছ থেকেই হাতির নেশা, হাতির প্রতি ভালোবাসা জন্মায় পার্বতীর মনে। ‘আমি ছোট থেকে হাতি চড়ি। আমার প্রফেশন তো মাহুত বা ফান্দি নয়। আমাদের ফান্দি, মাহুতরা ছিল। আমি ওদের সঙ্গে যেতাম। বাবার সঙ্গে যেতাম। আমার ভালো লাগত। মনে হতো, ওরা যদি করতে পারে, আমি করতে পারব না? নিশ্চয়ই করতে পারব। বাবাকে বললাম। বাবা বলল, ‘হ্যাঁ, শিখতে কী অসুবিধে?’ সেই শেখার শুরু। আমি ছোটবেলা থেকেই জঙ্গলে যাই। মাত্র ১৪ বছরের মেয়ে ফাঁস দিয়ে বুনো হাতি ধরেছে দেখে খুশি হয়েছিলেন লালজি। বহু বছর আগের বাবার সেই হাসিমুখ আজও স্পষ্ট পার্বতীর স্মৃতিতে। বললেন, ‘বাবা আমাকে বলেছিলেন, ‘শাবাস বেটি’। আসলে হাতি ধরা শারীরিক শক্তির বিষয় নয়। এটা বেশিরভাগটাই মন আর কিছুটা ভাগ্যের ব্যাপার।’ 

ভালোবাসার উত্তরাধিকার
হাতিদের খাওয়ানো, তাদের সঙ্গে কথা বলা, নদীতে স্নান করানো এমনকী তাদের জন্য গানও করেন পার্বতী। জন্মের সময়ই হয়তো বিধাতা ভাগ্যনির্ধারণ করেছিলেন। কিছু না ভেবেই তাঁর নাম ‘পার্বতী’ রাখেন লালজি। পুরাণ মতে যিনি গণেশের মা। যে ঠাকুরের মাথা হাতির মতো। ‘আমি তখন কোলের শিশু। বাবা শিলং থেকে গৌরীপুর যাওয়ার পথে একটি এলিফ্যান্ট ক্যাম্পে হল্ট নিয়েছিল। তখন থেকে হাতির সঙ্গে যোগাযোগ’, সোনালি সে দিনের মুহূর্ত আজও জীবন্ত পার্বতীর কাছে। জানালেন, ছোটবেলায় লালজি বছরে অন্তত সাত-আট মাস ছেলেমেয়েদের ক্যাম্পে রাখতেন। সেই ক্যাম্পে প্রায় ৭০ জন পরিচারক থাকত। তার মধ্যে পাচক, নাপিত, দর্জি, চিকিৎসক, একজন শিক্ষকও থাকতেন, যাতে সন্তানদের পড়াশোনার ঘাটতি না হয়। যে হাতিদের ভালো ট্রেনিং হতো, তাদের কুনকি হাতি বলতেন পার্বতীরা। নিজের থেকেও হাতিদের বেশি ভালোবাসতেন লালজি। সেই ভালোবাসার উত্তরাধিকার বয়ে নিয়ে চলেছেন পার্বতীও। দিনভর ক্যাম্পের কাজ খুঁটিয়ে দেখতেন। বিকেলে বাবার সঙ্গে বসতেন। মাহুতরাও থাকতেন সে সময়। ক্যাম্পের কাজ নিয়ে আলোচনা হতো মূলত। হাতি নিয়ে অনেক ঘটনাও শুনতে পেতেন পার্বতী।
এখন পার্বতী ঠিক কী কাজ করেন? আজও বছরের অনেকটা সময়ে জঙ্গলেই কাটান কেন? ‘আমি এখন এলিফ্যান্ট ম্যানেজমেন্ট পলিসি কন্ট্রোলার, মাহুতদের ট্রেনার। কখনও জংলি হাতি উৎপাত করলে কীভাবে সেখান থেকে বেরনো যাবে, সে ব্যাপারে পরামর্শ দিই। অসম আর পশ্চিমবঙ্গে মূলত কাজ আমার। উত্তরবঙ্গে বেশি কাজ হয়। দক্ষিণবঙ্গে আমি যাইনি এমন নয়, সেখানেও গিয়েছি আটের দশকের শেষে, হাতি তাড়ানোর জন্য। চাকরি করি না। আমাকে যে সরকারই ডাকুক, সাধ্যমতো তাদের সাহায্য করার চেষ্টা করি। হাতি ভালোবাসি। হাতির সঙ্গে জড়িত যাঁরা, তাঁদেরও ভালোবাসি। তাঁদের উন্নতির জন্য চেষ্টা করি। যতটুকু আমার ক্ষমতা।’ স্পষ্ট বললেন পার্বতী। 

হাতির ট্রেনিং
গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক পার্বতীর পছন্দের পোশাক মেখলা চাদর। শাড়ি পরতেও ভালোবাসেন। আর জঙ্গলে গেলে ফেডেড জিনস, জ্যাকেট, টুপি, সানগ্লাস। হাতি ধরা এক রকমের অভিজ্ঞতা। হাতি তাড়ানোর অভিজ্ঞতা আবার অন্য রকম। বুনো হাতি ধরে ঠিক কী কাজে লাগানো হতো? পার্বতীর কথায়, ‘১৪ বছর বয়সে আমি প্রথম হাতি ধরি। তারপর সেই বিদ্যে ঝালিয়ে রাখার জন্য আরও হাতি ধরেছি। বুনো হাতি ধরে ট্রেনিং করানো হতো। অর্থাৎ পোষ মানানো। পেট্রোলিংয়ে, ট্যুরিজিমে ব্যবহার করা হতো তাদের। হাতির মালিকরা যাতে বেঁচে থাকেন, তার জন্য সরকার হাতিগুলিকে কাজে লাগায়। নাহলে হাতি পোষা তো সোজা কথা নয়। খরচ থাকেই। আগে যেমন হাতি ধরে সরকার রাজস্ব দিয়ে সে হাতি বিক্রি করত। আমাদের ঘরে হাতির বাচ্চা হয়েছে, দেখেছি। ওদেরও ট্রেনিং হয়েছে। মানুষের যেমন স্কুল থাকে, মানুষের বাচ্চা যেমন স্কুলে পড়ে, তেমন ধাপে ধাপে ট্রেনিং হয়। ওয়ান, টু, থ্রি, ফোর— এভাবে। হাতি ধরা, মারা এখন বন্ধ। এখন ধরুন, ওষুধ দেওয়া, দুষ্টু হাতি কীভাবে দমন করতে হবে, এসব কাজে ডাকে।’

বিপদ পথ
জঙ্গলে গেলে তাঁবুতে বিছানার পাশে সবসময় বাবার যুবক বয়সের একটি ছবি রাখেন পার্বতী। পশুআরোহীর পা-দানি, দড়ি, খুখরি (ধারালো ছুরি) তাঁর অস্ত্র। সেসবও থাকে মাথার পাশে। যুদ্ধের সিনেমা দেখতে ভালোবাসেন। বাস্তবে জঙ্গলে যাওয়া মানেই যুদ্ধ। জঙ্গলে কাজ মানেই প্রতি মুহূর্তে বিপদ। সেসব কথা খুব বেশি ফলাও করে বলতে চান না পার্বতী। পুতুল খেলা নয়, ছোট থেকেই খেলার সঙ্গী হিসেবে যিনি হাতি, ঘোড়াদের বেছে নিয়েছিলেন, তাঁর কাছে এ বিপদ তো চেনা। তবুও...। হেসে বললেন, ‘বিপদেরই কাজ তো আমার। আমরা যখন হাতি ধরতে যাই, জঙ্গলে ঢুকি, সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যাই। ফিরে আসব কি না জানি না। প্রতি মুহূর্তে বিপদ। বিপদে পড়লে পালিয়ে আসতে হয়েছে বহুবার। কখনও কখনও হাতি আমাদের তাড়া করেছে, আমরা পালিয়ে এসেছি। জীবন নিয়ে পালিয়ে আসা। আবার কখনও হাতির সঙ্গে টক্করও দিয়েছি। আমাদের তাড়ালে, আমরাও তাড়াব। কখনও ওরা পালিয়েছে, কখনও আমরা পালিয়েছি।’ 
বয়সের হিসেবে পার্বতীর এখন অবসরের সময়, বিশ্রামের দিন। ঠিক যেমন অবসর হয় হাতিরও। সেই অভিজ্ঞতা ভাগ করতে গিয়ে বললেন, ‘সরকারি হাতি হলে অবসরের পর পেনশন পায়। ৬০ বছর বয়স হওয়ার পর যেমন মানুষের চাকরি শেষ হয়ে যায়। সে সিনিয়র সিটিজেন হয়ে যায়, তেমনই। অবসরের টাকার অঙ্ক বলতে পারব না। কারণ তা বিভাগ অনুযায়ী বদলে যায়। তবে অসমে অন্তত হাতি আর্থিক মূল্যে কিছু পায় না। কিন্তু তার কোনও কাজের ভারও থাকে না। শুধু বসে বসে ঘাস খায়। পশ্চিমবঙ্গে কী হয় আমার জানা নেই।’ 

আদরের নাম লক্ষ্মীমালা
রাজপরিবারে একসময় অনেক হাতি ছিল। বইতে পড়া ‘হাতিশালে হাতি’ দেখেই বড় হয়েছেন পার্বতী। কিন্তু আজ তাঁর পোষ্য হাতির সংখ্যা এক। তার নাম লক্ষ্মীমালা। সন্তানস্নেহে তাকে পালন করেন পার্বতী। সেই মেয়ের কথা বলতে গিয়ে খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল তাঁর মুখ, ‘বাবার সময় একবারে ৮০-৯০টা হাতিও ছিল। আমি অত দেখিনি। আমার দেখা বাবার হাতির সংখ্যা ধরুন ৪৫। এখন আমি একটাই হাতি রেখেছি, লক্ষ্মীমালা। কারণ বেশি হাতি রাখলে ‘মানুষ’ করা যায় না। আর অযত্ন আমার পছন্দ হয় না। ওদের অযত্ন হলে আমি খুব কষ্ট পাই। লক্ষ্মীমালা মেয়ে হাতি। আমার ধরা হাতি। শেখানো হাতি। ওর বয়স ৪৫ বছর তো হবেই। ওর কোনও ইস্যু হয়নি। অনেকদিন ওকে না দেখতে পেলে আমার সত্যিই মনখারাপ লাগে।’
হাতির মৃত্যুসংবাদ পার্বতীর কাছে আত্মীয় বিয়োগের মতো। ‘যে কোনও হাতির মৃত্যুসংবাদ আমার জন্য কষ্টকর। সে আমার হাতি হোক বা অন্য কারও। আর যদি দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু হয় বা কোনও কারণে কেউ মারে, তাহলে ভীষণ কষ্ট হয়। সব হাতিই আমার কাছে সমান। বৃদ্ধ হয়ে মরলেও কষ্ট হয়। তবু মেনে নিতে হয়’, বললেন ‘রাজকন্যা’। 
হাতির জন্য গোটা জীবন বাঁচা পার্বতী স্পষ্ট বললেন, ‘হাতি আমার সবচেয়ে ভালোবাসার জিনিস। সবচেয়ে বড় বন্ধুও বলতে পারেন। ...সবকিছু।’

6th     August,   2022
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ