তুলির আঁচড়ে মেয়েদের যাপন আঁকেন অরুণিমা চৌধুরী। কেমন সেই পথ চলা? লিখেছেন স্বরলিপি ভট্টাচার্য।
‘সারা জীবন মেয়েদের অনেক সহ্য করতে হয়। ছোটবেলায় দেখেছি মাকে খুব যন্ত্রণা দিতেন বাবা। অথচ মা নিজের মনে থাকা একটা মানুষ ছিলেন। আমরা যদি পড়াশোনা না করতাম, সব দোষ হতো মায়ের। তখন থেকেই মেয়েদের উপর আমার দুর্বলতা। বাবা কিন্তু মাকে ভালোও বাসতেন। মা খুব ভালো রান্না করতেন। তার প্রশংসা করতেন সকলের কাছে। কিন্তু মায়ের কষ্টও দেখেছি। ফলে নারী আর প্রকৃতি, বারবার এই বিষয়ই ফিরে এসছে আমার আঁকায়,’ বলছিলেন ৭১-এর ‘তরুণী’ অরুণিমা চৌধুরী।
মা মাধুরী ভট্টাচার্য। বাবা অচিন্ত্য ভট্টাচার্য। মায়ের কষ্ট দেখে শৈশবেই নারীর প্রতি এক অন্য ভালোলাগা তৈরি হয়েছিল অরুণিমার। আঁকতে শুরু করার পর থেকে রঙে, রেখায় সেই শিল্পভাবনা ফুটিয়ে চলেছেন আজও। ‘কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটি’-তে গত ১৯ জুন থেকে শুরু হয়েছে তাঁর প্রদর্শনী ‘দ্য ডার্ক এজ অব গ্রিন’। চলবে ২০ আগস্ট পর্যন্ত।
মেয়েবেলা
উত্তরবঙ্গের মেয়ে অরুণিমা। বাবার বদলির চাকরিসূত্রে নানা জায়গায় ঘুরেছেন। কলেজে পড়তে কলকাতায় পা রেখেছিলেন। ‘মামারা পূর্ব পাকিস্তান থেকে সদ্য এসেছে তখন। মামাদের কাছেই থাকতে শুরু করি। আমার মামা অরুণকুমার সান্যাল মৌলানা আজাদ কলেজের অঙ্কের অধ্যাপক ছিলেন। উনিই আমার মেন্টর,’ বললেন শিল্পী। রঙের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছোট থেকেই। কীভাবে শুরু এই ভালোবাসার? মেয়েবেলার স্মৃতি হাতড়ে বললেন, ‘বাবার এক বন্ধু ছিলেন মিউনিসিপ্যালিটির ড্রাফটসম্যান। আমাদের বাড়িতে একটা বড় কাচের টেবিলে একদিকে লাল, একদিকে নীল পেন্সিল দিয়ে কাজ করতেন। আমার খুব ইচ্ছে করত ওই পেন্সিল দিয়ে কাজ করি। উনি বোধহয় সেটা বুঝতে পারতেন। পেন্সিলটা ছোট হয়ে গেলে আমাকে দিয়ে দিতেন। আর আমি ওই দুটো রং দিয়ে যে কত ছবি আঁকতাম...।’
প্রথাগত শিক্ষা
আঁকা নিয়ে প্রথাগত শিক্ষার শুরু ১৯৬৯-এ। সে বছর ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজে ভর্তি হন। ‘বিকাশ ভট্টাচার্য আমার ভর্তির পরীক্ষা নিয়েছিলেন। কয়েকটা ছবি এঁকে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেটা দেখে বলেছিলেন, ‘এগুলো তো যামিনী রায়ের অনুকরণ।’ আমি বলেছিলাম, অনুকরণ কেন, অনুসরণও তো হতে পারে। উনি বলেছিলেন, ‘না এটা অনুকরণ।’ ওই ইন্টারভিউয়ের পর মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। পাঁচ বছর টানা ওঁর কাছেই আঁকা শিখেছি। উনি আমাদের জন্য অসম্ভব পরিশ্রম করতেন। ১৯৭৪-এ পাশ করে বেরলাম। বিকাশবাবুকে নকল করতে গিয়ে দেখলাম, ওটা আমার নয়। আমার নিজের ভাষা তৈরি করতে হবে। নিজে ছবি আঁকতে গিয়ে দেখলাম অয়েলে ছবি আঁকতে ভালো লাগছে না। অনেক সময় লাগছে,’ বললেন অরুণিমা। সেই থেকে তাঁর রং নিয়ে পরীক্ষা শুরু হল।
কেমন সেই পরীক্ষা? বিকাশবাবুরই ছাত্র শিল্পী গৌতম চৌধুরী সম্পর্কে অরুণিমার স্বামী। তাঁরা দু’জন মিলে সে সময় নৈহাটিতে ‘বিহান’ নামে একটি আঁকার স্কুল তৈরি করেন। সেখানে শুরু করেন অন্য রঙের ব্যবহার। অরুণিমার কথায়, ‘আর্ট কালার দিয়ে ছেলেমেয়েদের ছবি আঁকাতাম। গদের আঠা, বাবলা গাছের আঠা, রঞ্জক আঠা মিশিয়ে ওদের রং দিতাম। ওদের পাশাপাশি আমিও আঁকতাম। তখন দেখলাম আর্ট রঙে ছবি আঁকতে ভালো লাগছে। তখন থেকে আর্ট রঙে আঁকা শুরু।’
ভেষজ রং তৈরি
অরুণিমার কাজের বড় অংশ জুড়ে রয়েছে ভেষজ রং। এই রং নিজে তৈরিও করেন শিল্পী। নানা জিনিস থেকে নানা রং তৈরি হয়। তার সন্ধান করে বহু রং নিজেই তৈরি করেছেন। কীভাবে হয় সেই কাজ? অরুণিমা জানালেন, হরীতকী হলুদ রং দেয়। হরীতকীর মধ্যে ফেরাস সালফেট, লোহার গুঁড়ো মেশালে বা লোহার পাত্রে হরীতকী ফোটালে কুচকুচে কালো রং পাওয়া যাবে। মঞ্জিষ্ঠা থেকে লাল রং বের হয়। চুনের মধ্যে গদের আঠা মিশিয়ে সাদা রং তৈরি করেন। আবার খড়িমাটির সঙ্গে আঠা মিশিয়েও তৈরি করেন সাদা। ‘একদিন মঞ্জিষ্ঠার মধ্যে চুন মেশালাম, উজ্জ্বল ভায়োলেট তৈরি হল। হরীতকী হলুদের সঙ্গে মেশালে একটা সবুজও পাই। টকটকে লাল জবা, লাল গোলাপ ফোটালে ভাবলাম লাল পাব। কিন্তু জবা থেকে বেরল নীল রং। গোলাপ থেকে পেলাম মভ রং। এই সব রঙের সঙ্গে ফটকিরি মেশালে রং উজ্জ্বলও হয়। বাইন্ডার হিসেবেও ভালো কাজ করে। ২০০৫-২০০৬ সাল থেকে রং তৈরি করছি। গ্যাসে ফুটিয়ে এক্সট্র্যাক্ট ছেঁকে নিয়ে তার মধ্যে ফটকিরি বা অ্যালাম মিশিয়ে ব্যবহার করি। এই রং তৈরি করে বেশিদিন ফেলে রাখা যায় না। কাঁচা বা পাকা হলুদ থেকে হলুদ রং পাওয়া যায়। ডালিমের খোসা থেকেও হলুদ বেরয়। আগে হ্যান্ডমেড পেপারে করেছি। পরে কাপড়ে এই রঙে কাজ করেছি,’ বললেন তিনি।
পেশার কানাগলি
কাজের ক্ষেত্রে শিল্পী কে জি সুব্রমণিয়ামের উৎসাহও তাঁর পাথেয় বলে জানালেন অরুণিমা। এই প্রদর্শনীতে ১৯৯৫ থেকে ২০২২ পর্যন্ত তাঁর বিভিন্ন কাজ ধরা রয়েছে। দর্শক এসে ঘুরে ঘুরে দেখছেন। কখনও তাঁদের মাঝে গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন। চলনে তারুণ্যের মেজাজ। কখনও বা একলা বসে দেখছেন তাঁদের। মুখে তখন অনাবিল প্রশান্তির ছায়া। তাঁর কাজ দেখতে আসা উৎসুক দর্শকের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এত দিন পরে এসে আমার এমন প্রদর্শনী হচ্ছে, এর পিছনে আমার কত যে চোখের জল আছে...। আমি এতদিনে একটা এমন প্রদর্শনী পাচ্ছি। বিভিন্ন গ্যালারিতে ঘুরে ঘুরে কাজ দেখিয়েছি, সব জায়গা থেকে প্রত্যাখ্যান পেয়েছি। কোনও সুপারিশ ছিল না তো...।’ পেশার কানাগলিতে ঘুরতে থাকা রাজনীতি, অসহযোগিতার ইঙ্গিত দিলেন শিল্পী।
স্বপ্নের কারখানা
আঁকা যে তাঁর পেশা হবে, তুলির আঁচড়ে যে ভালো থাকার রসদ খুঁজে পাবেন— মেয়ের এই সিদ্ধান্তে খুশি হননি তাঁর বাবা। ‘আমার জামাইবাবু ছিলেন সিদ্ধার্থশংকর রায়। মায়াদি আমার জ্যাঠতুতো দিদি। বাবা চেয়েছিলেন আমি ব্যারিস্টারি পড়ব। তারপর সিদ্ধার্থশংকর রায়ের অধীনে ওকালতি করব। আমি আঁকব, সেটা বাবার পছন্দ ছিল না। কিন্তু ওটাই আমার ভালো লেগে গেল। বাবাকে যখন জানালাম, আইন পড়ব না, ছবি আঁকব। বাবা কথা বলা বন্ধ করে দিলেন। মানসিক চাপ তৈরি করলেন। আঁকা ছাড়তে বলেননি। কিন্তু আইন পড়তেই হবে। এখনও আঁকা পেশা হবে, এটা যেন ভাবতেই পারেন না অনেকে। ছেলেমেয়েরা আঁকবে বললে বাবা, মা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। আমাদের কত ছাত্রছাত্রী ভালো রেজাল্ট করেছে। কিন্তু শিক্ষকদেরই বলতে শুনেছি, এত ভালো রেজাল্ট করেছে, আঁকা নিয়ে পড়বে কেন? ছবি এঁকে চাকরি পাবে? এসব সত্ত্বেও আমি বলব, স্বপ্ন ছাড়া উচিত নয়।’
স্বপ্নের রং পাল্টায়। ১৭-র তরুণী যে স্বপ্ন দেখতেন, ৭১-এ এসে সে স্বপ্নের রঙে সেপিয়া টোনের ছোঁয়া। নেশা এবং পেশা একাকার হয়ে যাওয়া শীত, গ্রীষ্ম, বসন্তে হাল ছাড়েননি অরুণিমা। যে বীজ বপন হয়েছিল আকৈশোর, সে চারাগাছরা আজ মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। প্রদর্শনীর মধ্যেখানে বটবৃক্ষের মতো দাঁড়িয়ে থাকেন শিল্পী। যাঁর ছায়ায় মাথা নাড়ছে তরুণ প্রজন্মের আঁকিয়েরা। যাঁরা ভবিষ্যতে পিদিম জ্বালবে এই ঘরানায়।