বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
আমরা মেয়েরা
 

দেশে বিদেশে জামাই-র বাহারি কদর

কথায় বলে, জন জামাই ভাগনা, তিন নয় আপনা। তবু জামাইষষ্ঠী মানেই শ্বশুরবাড়িতে হইহই কাণ্ড রইরই ব্যাপার! রসিকতায় ভরা দিনটির দেশি ও বিদেশি মেজাজের রম্যরচনায় সন্দীপন বিশ্বাস ও শুভঙ্কর মুখোপাধ্যায়।


প্যাকেজে শ্বশুর শাশুড়ি শ্যালিকা
জামাইষষ্ঠীর আগের দিন বাপেরবাড়ি যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে ইষ্টিকুটুম। ঘাড়ে পাউডার ঘষছে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে ধবলকান্তি বলল, ‘মনে করে ব্যাগে হজমের ওষুধটা নিয়ে নিও। হোমিওপ্যাথি, অ্যালোপ্যাথি দুটোই।’ 
ইষ্টিকুটুম ঘাড় বেঁকিয়ে ঝাঁজিয়ে বলল, ‘একেবারে বাচ্চাদের মতো হয়ে গেছ। বাইরে বেরলে বাচ্চাদের জন্য যেমন বেবিফুড, ফিডিং বটল, হাগিস নিয়ে যেতে হয়, তোমারও সেইরকম অম্বল, বুক জ্বালা, চোঁয়া ঢেকুর, গ্যাস, লুজ মোশান সবকিছুর ওষুধ নিয়ে বেরতে হয়। ভাল্লাগে না আমার!’
ধবল বলল, ‘আফটার অল জামাইষষ্ঠীটা হল বছরে একবার আইপিএলের টি-২০ ম্যাচের মতো। মানে অল্প সময়ের মধ্যে ব্যাট চালাও স্যাটাস্যাট। তোমার ভগ্নিপতি কৃষ্ণবান্ধব অবশ্য কোনওদিন আমার স্ট্যান্ডার্ডের প্লেয়ার নয়।’
ধবলকে থামিয়ে ইষ্টি বলল, ‘ঠিকই, তবে তোমার মতো পেটরোগাও নয়।’ 
ধবল বলল, ‘ও তো ডাক্তার। ও খেতে জানে? নাড়ি টিপে মানুষের পকেট কাটতেই ব্যস্ত!’ 
ইষ্টি শাড়ির আঁচলে পিন করতে করতে বলল, ‘তুমিও তো সরকারি কর্মী। হাত পেতে উপরি আয় করা ছাড়া আর কোনও কাজ জানো না। যাক গে, আমি চললাম। কাল সকাল সকাল চলে যেও। আর মিষ্টি, আম কিনে নিয়ে যেও।’ ধবল হাত পেতে বলল, ‘তাহলে ৫০০ টাকা দিয়ে যাও।’
ইষ্টি চোখ বড় করে বলল, ‘আবার শুরু হয়ে গেল হাতপাতা রোগ। চিপকুস কোথাকার!’
‘শোনো, কাল সকাল সকাল যাব। কিন্তু ওই কচুরি, রাধাবল্লভী, অমিত্তি, টক আম, লিচু খাইয়ে সকাল থেকেই আমার চাক্কা জ্যাম করার চেষ্টা করবে না।’  
‘বেশ, তাহলে মাকে বলল, তোমাকে জলমুড়ি দিতে। জামাইয়ের চোঁয়া ঢেকুর প্রতিষেধক মেনু।’ 
পরদিন শ্বশুরবাড়ি পৌঁছে ধবল জেনে নিল মেনু কী। ওসব ভাজাভুজি, ডাল, চচ্চড়িকে সে খাদ্য বলেই মনে করে না। ওগুলো শাশুড়ির সৌজন্য পদ। মেন কোর্সে কী থাকছে, তা জানার সোর্স একমাত্র শ্যালিকা মিষ্টিকুসুম। সকালের মেনুতে ভাত, চিংড়ি-পোলাও, পাঁচ রকম ভাজা, শুক্তো, ডাল, ভেটকির পাতুরি, তেল ইলিশের ভাপা, পাঁঠার মাংস, আনারসের চাটনি, ক্ষীর-দই, চার রকমের মিষ্টি। আর রাতে ফিশ ফ্রাই, মাটন বিরিয়ানি, চিকেন কষা। মেনু শোনার পর জিভের ডগা থেকে খাদ্যনালীর প্রতিটি অংশ শিরশির করে উঠল। ধবলের মন বলে উঠল, ‘প্রতি খাদ্য লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।’
ধবল বলল, ‘তোমার বরটি তো এসব খাবে না, তার কি স্বাস্থ্যকর মেনু বলো তো?’ 
মিষ্টি বলল, ‘হ্যাঁ, বলেছিল খাবে না। আমি বলেছি, বছরে একটা দিন খাবে না কেন? কিচ্ছু হবে না।’ 
‘আচ্ছা দেখো, কৃষ্ণ হল সুগারের পেশেন্ট, আর তার বউয়ের নাম কি না মিষ্টিকুসুম।’ জামাইবাবুর কথায় হা হা করে হেসে উঠল শ্যালিকা।
খেতে বসে একে একে শুক্তো, বেগুনভাজাকে ডাক করল ধবল। ‘ওঁ নমঃ স্বাহা’ বলে জিভে ছোঁয়াল মাত্র। উল্টোদিকের চেয়ারে বসে শ্বশুর। বললেন, ‘বাবা, ভালো করে খাও। এখনকার জামাইরা খেতেই পারে না। আমাদের সময় জামাইদের খাইয়ে শ্বশুর-শাশুড়িরা খুব আনন্দ পেত। জামাই বসেছে খেতে। চারিদিকে বাটি সাজানো পদ্মফুলের মতো। কম করে ৩০-৩২টা বাটি থাকত। শাশুড়ি পরিবেশন করত। আর শ্যালিকার কাজ ছিল দূরের বাটিগুলো জামাইবাবুর কোলের দিকে এগিয়ে দেওয়া। জামাইরা খেয়ে যদি ১২ ঘণ্টা বোয়াল মাছের মতো কাত হয়ে শুয়েই না থাকে, তবে আর কী খাওয়া হল!’ 
ধবল হেঁ হেঁ করে সবে পাতুরির পাতা ছাড়িয়ে পিঞ্চ হিটারের ভূমিকায় নামতে চলেছে, সেই সময় ছোট জামাই কৃষ্ণ দিল তার মেজাজটা শুক্তো করে। কৃষ্ণ বলল, ‘আমি একটা প্ল্যান করেছি। একটা প্যাকেজ বলা যায়। আজ জামাই ষষ্ঠী তো হচ্ছেই, কাল আমরা পালন করব শ্বশুর সপ্তমী, পরশু শাশুড়ি অষ্টমী, আর তার পরদিন শ্যালিকা নবমী। 
ইষ্টিকুটুম বলল, ‘ওমা কী দারুণ আইডিয়া তোমার কৃষ্ণ। জামাইষষ্ঠীটা পুরো দুর্গাপুজোর মতো হয়ে গেল তো।’
কৃষ্ণ বলল, নবমীটা ক্রিসক্রস হবে। সেদিন রেস্তরাঁয় নিয়ে গিয়ে দিদি আপনাকে খাওয়াব আমি। আর ধবলদা আপনি এই মিষ্টিকে নিয়ে গিয়ে খাওয়াবেন। শ্যালিকা নবমীর নতুন থিম।’ 
মিষ্টি বলল, ‘দারুণ আইডিয়া। চলুন জামাইবাবু, একসঙ্গে আপনি আর আমি হারিয়ে যাই।’ 
সামনে এতগুলি পদ সাজানো। ভালো করে খেতেই পারছে না ধবল। খাওয়া ভুলে সে মনে মনে হিসেব কষতে লাগল। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমীর ঝক্কিটা টাকার মূল্যে কত হতে পারে। শ্বশুরমশাই বললেন, ‘ও ধবল বসে রইলে কেন, তুমি তো খুব ভালোই ব্যাট চালাও।’ ধবল যেন কিছুরই স্বাদ পাচ্ছে না। গলদায় গলদ। পাতুরি, ইলিশ ভাপা যেন পেঁপে সেদ্ধ। ইষ্টি বুঝতে পারল, তার কৃপণ বরের সমস্যাটা কোথায়। কিন্তু কিছু তো বলা যায় না। সে বিষয়টিকে চাপা দেওয়ার জন্য বলল, ‘পরে বিকেলে, এ নিয়ে কথা হবে কৃষ্ণ। এখন তোমরা খেয়ে নাও। কৃষ্ণ, তোমায় আর একটা চিংড়ি দেব। তুমিও একটা নাও।’ ব্যাড প্যাচের ঘোর কাটিয়ে আবার খাওয়ার মধ্যে ডুবে যায় ধবল। ম্যাচে বল নষ্ট করা চলবে না। স্টেপ আউট করে ছয় মারার ঢংয়ে সে বলল, ‘দারুণ হয়েছে চিংড়িটা, আমায় দুটো দাও।’  
ভাপা ইলিশের কাঁটা বাছতে বাছতে ধবল ভাবল, কৃষ্ণটা একেবারে গাম্বাট জামাই। জামাইষষ্ঠী নিয়ে আবার প্যাকেজ করছে। তবুও টেনশন কাটিয়ে সে মাটনের বড় বাটিটার দিকে হাত বাড়াল। 
দিদি নাকি শাশুড়ি!
 ব্রেকিং নিউজটা পেলাম বিকেলবেলা। বউ সুতপা ‘দিওয়ার’-এর শশী কাপুরের স্টাইলে বললো, ‘মেরে পাস মা হ্যাঁয়’! 
গতবারের গপ্প। জামাইষষ্ঠীর মাত্র কয়েকদিন আগে বউকে ‘মা’ খুঁজতে পাঠালাম। সে জানতে চাইল, ‘তোমার কেমন পছন্দ’? বললাম, ‘পাকা রাঁধুনি এবং সুন্দরী কন্যার জননী হতে হবে’। তা সুতপার কালচার আবার বুদ্ধবাবুর মতো, ‘ডু ইট নাও’! কয়েকদিনের মধ্যে সে সেই ‘মিছিমিছি মা’ এনে হাজির করল। বউয়ের আসল মা তো কলকাতায়। বিশ্বস্ত সূত্রে জেনেছি, তিনি নাকি ফি বছর জামাইষষ্ঠীর দিন ‘নিমাই সন্ন্যাস’ পালার শচীমাতার মতো ‘আমার জামাই নাই’ গাইতে গাইতে রুদালি হয়ে যান! তাঁকে বোঝানোই যায় না যে, তাঁর জামাই মার্কিন মুলুকে বাবাজীবনটি হয়ে দিব্য আছে। তার লাগি করিও না শোক। প্রবাসে সেই জামাই পঞ্জিকার মতো বছর বছর শাশুড়ি বদলায়। যদিও সেসব হল শর্টটাইম শাশুড়ি! 
তবে গতবছর জামাইরা সব জাঁতাকলে পড়ে গিয়েছিল। কারণ, কেস করোনা! শাশুড়ি শর্ট! ‘সিক্স ফিট’ দূরত্ব ঘুচিয়ে যে ক’জন ‘হলেও হতে পারত’ শাশুড়ি নাকমুখ ঢেকে বাজারে নেমেছিল, তারাও ‘আগে এলে আগে পাবে’ নীতি চালু করেছিল। অগত্যা আমি তৎকাল প্রকল্পে বউকে অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছিলাম, ‘মা খোঁজো! তুমি মা না পেলে আমার জামাইষষ্ঠী ভোগে’। এখন প্রশ্ন, বেচারি ‘মা’ কোথায় পাবে? পরবাসের মাতৃতুল্যা বাঙালিনীদের দিদি বা বড়জোর বৌদি বলে না ডেকে, তাদের মাসিমা কাকিমা জেঠিমা বলে ডাকলে, তারা ‘একঘরে’ করে দেবে। একেবারে ধোপা নাপিত বন্ধ। অবশ্য তার মধ্যে হাতে গোনা কয়েকজন স্বল্পমেয়াদি হলেও রূপান্তরকামিনী, তবে কেস টু কেস। যারা ভাইফোঁটার দিন দিদি, জামাইষষ্ঠীর দিন তারাই আবার শাশুড়ি। আমরা আদর করে এই জনরাটার নাম দিয়েছি ‘দিদি-মা’! একই অঙ্গে এত রূপ দেখিনি তো আগে! তা হোক, পলিটিক্সে যদি দলবদল হয়, তাহলে পরিবারে সম্পর্ক বদল হবে না কেন! 
যাকগে সে সব। টি টোয়েন্টি ম্যাচের শেষাংশের মতো রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনার পর, সুতপা ওরকম একটা ‘বহুরূপী মা’ জোগাড় করছিল। তবে সেটা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার নন প্রফিট সার্ভিস নয়। জামাই যাবে শ্বশুরবাড়ি, সঙ্গে যাবে কে, ঘরে ছিল বউরানি, কোমর বেঁধেছে! কষ্টেসৃষ্টে একটা অস্থায়ী শাশুড়ি জোগাড় করতে পারলে পুরো ফ্যামিলি রিজার্ভেশন। একটাই সমস্যা, এই সব ‘পাতানো’ শাশুড়ি হল অঞ্জন চৌধুরীর সিনেমার সেই ‘ভাগের মা’। তারা ডে নাইট ম্যাচ খেলে, দুপুরে এক জামাই তো রাতে আর এক জামাই। আসলে প্রবাসে এই জামাইষষ্ঠীটা হল একটা পাবলিক রিলেশনস প্রোজেক্ট! নো জামাই লেফট বিহাইন্ড! 
অবশ্য আমার তাতে কী! গান্ধারী যদি শতপুত্রের জননী হতে পারেন, তাহলে আমাদের ‘দিদি-মা’ কেন শত জামাইয়ের শাশুড়ি হতে পারবেন না! আমি এই সব ব্যাপারে মুক্তমনা। তাছাড়া জামাইষষ্ঠী তো প্রেমের মতোই, দেশ-কালের ঊর্ধ্বে! কাজেই আমি সুতপার সংগৃহীত ‘নকল মা’-কে জানিয়ে দিলাম, জামাইশিপ কনফার্মড। অপশন ছিল, মধ্যাহ্নভোজ না নৈশভোজ। আমি নিশাচরে টিক মারলাম। তার অবশ্য কারণ আছে। অভিজ্ঞতায় দেখেছি, প্রতিবারই খাওয়াদাওয়া শেষে হতে হতে বেশি রাত হয়ে যায়। তারপর ‘প্রচুর খেয়ে নিয়েছি, নড়তেই পারছি না’ বলে খানিক জিরোতে যাব যেই, সুন্দরী শ্যালিকা এসে বলবে, ‘রজনী এখনও বাকি, আরও কিছু দিতে বাকি’। বলেই সে আমার হাতে একটা মিঠাপাতার পান গুঁজে দেবে। তখন আমার এক রাতের শাশুড়ি এসে বলবে, ‘আরে রাতে থেকে যাও না, কাল সকালে যাবে’! আমি সঙ্গে সঙ্গে রাজি। কারণ, এই রাতে থাকার সোশিও-ইকোনমিক দিকটা হল, পরের দিন প্রাতঃরাশ ফ্রি! কাজেই নাইট শোয়ের জামাইষষ্ঠী মানেই ‘কম্বো অফার’। 
নৈশকালীন জামাইষষ্ঠীর প্যাকেজে যেমন ফুডিং লজিং আছে, তেমনই শাশুড়ির সাথে শ্যালিকা ফ্রি! আমি শ্যালিকা ছাড়া শাশুড়ির সঙ্গে কন্ট্রাক্টে যাইনি। আর জামাইষষ্ঠীর খাওয়াদাওয়ার পোশাকি নাম ‘খাইবার পাস’! উরি বাবা রে, সে সব গেলা তো দূরের কথা, চোখে দেখলেই পেট ফুলে গ্যাসবেলুন! আমি সেজন্য শুধু সুতপা আর মেয়ে লগ্নজিতাকে নিয়ে জামাইষষ্ঠী করতে যাই না। সঙ্গে কিছু হজমের বড়িও নিয়ে যাই। ভূরিভোজের পরে আমি সেগুলো টফির মতো টুকটাক খেতে থাকি। আর শেষ হইয়াও হইল না শেষ। জামাইয়ের জন্য হরেক রকমের উপহার এমন তত্ত্বের মতো সাজানো থাকে যে, দেখলেই মনে হয়, আবার বিয়ে করছি! 
আমি তাই সবাইকে বলি কি, দিদি ধরুন। কালের নিয়মে আপনিই তারা শাশুড়ি বনে যাবে। চিৎপুরের জন্য সম্প্রতি আমি একটা যাত্রাপালা লিখেছি, ‘দিদি কেন শাশুড়ি’! সত্বর বায়না করুন! 

4th     June,   2022
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ