বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
আমরা মেয়েরা
 

বেঁচে থাকার ভরসা

স্বরলিপি ভট্টাচার্য: দুই তরুণী। কন্যা, স্ত্রী, মা, বন্ধু...। জীবনের চড়াই-উতরাইয়ে নানা দায়িত্ব পালন করে     চলেছেন। বিবিধ সত্তার মধ্যে উজ্জ্বল তাঁদের     
পারফর্মারের পরিচয়। নাচ রয়েছে প্রাণে। সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স দেখলে মনে হবে না একজনের জন্ম ১৯৪২-এ। আর একজন বছর কয়েকের জুনিয়র। ১৯৫০। ৮০-র পূর্ণিমা ঘোষ এবং ৭২-এর দীপালি চক্রবর্তী বয়সকে কয়েক গোল দিয়ে নৃত্যবিভঙ্গে আজও তরুণীই বটে!
মা হিসেবে তাঁদের আলাদা পরিচয় রয়েছে। পূর্ণিমাদেবীর ছোট মেয়ে চান্দ্রেয়ী ঘোষ অভিনয় জগতে সুপরিচিত। আবার দুই প্রখ্যাত অভিনেত্রী বিদীপ্তা এবং সুদীপ্তা চক্রবর্তীর মা হিসেবে দীপালিদেবী পরিচিত। মেয়েদের কাছে মা যেন আত্মবিশ্বাসের আর এক নাম। পাশাপাশি বহু শিল্পীর কাছে এই মায়েরা অনুপ্রেরণাও।  
নিয়মে বাঁধা জীবন
চান্দ্রেয়ী মনে করেন নিয়মানুবর্তিতাই তাঁর মাকে ৮০ বছর বয়সেও তরতাজা রেখেছে। তিনি বললেন, ‘মায়ের যে ডিসিপ্লিন আছে, সেটা যদি একটুও শিখতে পারতাম! এখনও সকালে উঠে এক ঘণ্টা যোগাসন, প্রাণায়াম করেন। সঠিক সময়ে খাওয়া। বেশিরভাগ বাড়ির খাবার। সময় মতো ঘুম। আর হল পজিটিভিটি। জীবনে নেতিবাচক কিছু এলেও মা কোনওদিন তাতে দমে যাননি। নিজের এবং পরিবারের উপর প্রভাব পড়তে দেননি।’ ট্র্যাডিশনাল ডান্স ফর্ম বজায় রেখে পূর্ণিমাদেবী কাজ করতে পছন্দ করেন, জানালেন মেয়ে। তাঁর কথায়, ‘মায়ের নাচের স্পেশালিটি হল ক্যান্ডি ডান্স ফর্ম। সেটা এখানে হয়তো খুব কম মানুষই জানেন। মা বিভিন্ন ডান্স ড্রামায় সেটা ব্যবহার করেন। এটা জাভার একটা ট্র্যাডিশনাল ফর্ম।’ 
সংসার সীমান্তে
দীপালিদেবীর ক্ষেত্রে বিষয়টা অনেকটাই আলাদা। সুদীপ্তার কথায়, ‘মা নিজের নাচ কোনওদিন সিরিয়াসলি নেননি। আজন্ম দেখছি, ক্যালকাটা কয়্যারের সঙ্গে যুক্ত। নাচ নিয়ে সিরিয়াস হলে অনেক দূর যেতেন। সংসার, সন্তান সামলে যেটুকু করা যায়, সেটুকু করেছেন। প্রায়োরিটি দেননি। দু’বেলার রান্না করে শো-এ যাচ্ছেন। আবার শো থেকে ফিরে রাতের রুটি বানাচ্ছেন, এটাই দেখেছি। ছোট থেকে সাঁতার ভালোবাসেন। ফলে ফিটনেস আছে। কিন্তু মা এখন ভালো করে হাঁটতে পারেন না। হাঁটু ক্ষয়ে গিয়েছে। এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যেতে কষ্ট হয়।’ সদ্য সুদীপ্তার অভিনয় প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের বাৎসরিক অনুষ্ঠানে দীপালিদেবীর নাচ দেখে তাঁর পায়ের সমস্যার কথা প্রায় কেউই বোঝেননি। সে প্রসঙ্গে সুদীপ্তা বললেন, ‘সেদিন প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে নেচেছেন। প্রথমে রাজি হননি। পরে মা বললেন, ‘তোরা বুঝিসনি, আমি চুরি করে করে নেচেছি। বাঁ পায়ে জোর দিতেই পারি না, তাই সব স্টেপ ডানদিকেই করেছি। যাতে বাঁ পায়ে জোর না দিতে হয়।’ কিন্তু শরীরে যে ছন্দ আছে, সেটা তো আর চলে যাওয়ার নয়।’ 
গোড়ার কথা
পূর্ণিমা দেবী জানালেন, তাঁর বাবা শ্রীযুক্ত ব্রজবাসী সিংহ মণিপুরি ডান্স ফর্ম কলকাতায় প্রথম নিয়ে আসেন। বাবার কাছেই তাঁর প্রথম নাচ শেখা। উদয়শঙ্কর আলমোড়াতে একটা ডান্স অ্যাকাডেমি করেছিলেন। সেখানে মণিপুরী নাচ শেখানোর জন্য ব্রজবাসীকে আহ্বান করেন। কিন্তু তাঁর হাঁপানির সমস্যা দেখা দেওয়ায় আলমোড়া যেতে পারেননি। সেই তাঁর প্রথম কলকাতায় আসা। সারা জীবন নাচ নিয়ে সাধনা করা পূর্ণিমা বললেন, ‘আমি কলেজে পড়িনি। স্কুল শেষ করেছি। নাচ ছিল আমার ধ্যানজ্ঞান। বাবা বলেছিলেন, যদি নৃত্যশিল্পী হতে চাও তাহলে তার উপর অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে। বাড়িতে গুরু রেখে কত্থক, ভরতনাট্যম, ওড়িশি- এসব ক্লাসিক্যাল নাচ শিখেছি। শুধু কথাকলি শিখিনি। ওটা মূলত মেল ডান্স ফর্ম। কারণ এমন স্টেপ থাকে, সেটা মেয়েদের পক্ষে করা অসুবিধে।’ শুধু নাচ নয়। তিনি বললেন, ‘মণিপুরী খোলকে বলে পুং। কাঠের তৈরি। চামড়া দিয়ে গাঁথা। অনেকটা মৃদঙ্গের মতো। বাজানো কঠিন। হাতের আঙুল ফেটে যায়। কিন্তু আমি শিখেছিলাম। খোল, তবলাও বাজাতে পারি।’ রবীন্দ্রনৃত্য তাঁর কেরিয়ারের এক বিশেষ অধ্যায়। ‘শৈলজারঞ্জন মজুমদার ছিলেন সঙ্গীতভবনের অধ্যক্ষ। রবীন্দ্রনাথের সময় উনি রসায়ন পড়াতে শান্তিনিকেতন গিয়েছিলেন। আমি ওঁকে পেয়েছি, জীবনের ঈশ্বর পাওয়ার মতো। ওঁর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর আমার নাচের ধারণা পাল্টে গেল। আমি শান্তিনিকেতনে পড়িনি। কিন্তু সে সময় কীভাবে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ নাচের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, সেটা জানি। এভাবে আত্মস্থ করতে পেরেছি। সেটা এখনও ধরে রেখেছি এবং সকলকে শেখাই’, বললেন বর্ষীয়ান শিল্পী।
দীপালিদেবীর জীবনেও নাচ প্রাণের আরাম। কিন্তু মাঝে কিছু বছর সংসার, সন্তান সামলাতে গিয়ে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। তিনি বললেন, ‘আমার কাছে নাচটাই সবকিছু ছিল। নাচের জগতে প্রতিষ্ঠিত হব, এটা বিয়ের আগে ভাবতাম। কিন্তু বিয়ের পর দেখলাম সেটা সম্ভব নয়। তখন থেকে মনে চাপা কষ্ট ছিল। হাওড়া গার্লস কলেজের ছাত্রী ছিলাম। কলেজের তিন বছর যে কোনও অনুষ্ঠানে নাচের দায়িত্ব আমারই ছিল। ১৯৭২-এ বিয়ের পর নাচটা আর হয়ে ওঠেনি। আট, ন’বছর বন্ধ ছিল।’
পারিবারিক সমর্থন
স্বামী বিপ্লবকেতন চক্রবর্তীর হাত ধরেই দীপালিদেবী ফের নাচের জগতে ফেরেন। কীভাবে সম্ভব হয়েছিল? ‘১৯৮০ সালে অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস-এ একটা অনুষ্ঠান দেখে খুব কষ্ট হয়েছিল। বাড়ি ফিরে কান্নাকাটি করেছিলাম। মনে হয়েছিল, যদি বিয়ে না করতাম, তাহলে হয়তো ওই জায়গায় যেতে পারতাম। সেদিনের কষ্টটা আমার স্বামী বুঝতে পেরেছিলেন। আমাকে বললেন, ‘তুমি নাচ করতে চাও?’ পরিবারের অনুমতির দরকার ছিল। গুরুজনরা বলেছিলেন, ‘সংসার সামলে যদি করতে পারো, কোনও আপত্তি নেই।’ অনুমতি পাওয়ার পর উনি বললেন, ‘আমার সঙ্গে একজনের আলাপ হয়েছে, কল্যাণ সেন বরাট। ওঁর একটা দল আছে। ওটা খানিকটা পরিবারেরই মতো। তোমার অসুবিধে হবে না।’ উনিই নিয়ে যান ক্যালকাটা কয়্যারে। তখন থেকে এখনও পর্যন্ত আমি সদস্য’ বললেন তিনি। চলার পথে মেয়েদের সমর্থনের কথা আলাদা করে উল্লেখ করলেন। একই দিনে বাবার নাটকের শো, মায়েরও নাচের শো পরেছে বহুবার। ছোট ছোট তিন মেয়ে মানিয়ে নিয়েছিল সবটাই।  
প্রথম থেকেই পরিবারের সমর্থন পেয়েছিলেন পূর্ণিমা দেবীও। ছোটবেলার প্রেম, পরে বিয়েতে পরিণতি পায়। সেই কাহিনি বললেন, ‘আমার স্বামী মিহির ঘোষ, আর্কিটেক্ট। বাবার কাছে নাচ শিখতে গিয়েছিল। আমি তখন ১৩। কত পাকা ছিলাম! প্রেমে পড়লাম (হাসি)। ২১ বছরে বিয়ে হল। কর্তা এবং শ্বশুরবাড়ির খুব সাপোর্ট পেয়েছি। এটা বিরাট পাওয়া। অনেক বছর আগের কথা বলছি তো। তখন কিন্তু নাক চ্যাপ্টা, চোখ ছোট হলেই বলা হতো, ও বাবা! চীনে বউ বাড়িতে এসেছে (হাসি)! মণিপুরী কী, তখন কিন্তু অনেকেই জানতেন না।’ 
আক্ষেপ
নাচ তাঁর পরবর্তী প্রজন্ম বহন করছে না, এই আক্ষেপ রয়েছে পূর্ণিমাদেবীর। তিনি বললেন, ‘নাচ আমার দুই মেয়ে সিরিয়াসলি করেনি। চান্দ্রেয়ী তো ছোট থেকে বলতো, ‘নাচ শিখব না। সবাই তোমার সঙ্গে তুলনা করবে। বলবে, মায়ের মতো হল না। ওটা আমি শুনতে চাই না।’ আমার মেয়েদের শেখাতে পারলাম না। এটা আমার আফসোস। সেজন্য ছাত্রীদের বলি, দেখ, ওদের তো করাতে পারলাম না, তোরা কর। আজকালকার মেয়েদের অতটা গভীরতা নেই। আমি বলি, আমার পারিশ্রমিক চাই না। শুধু আমার জিনিসটা শিখে রাখ।’ আরও একটা আক্ষেপ রয়েছে তাঁর। ‘আমার অল্প বয়সে প্রযুক্তি এত উন্নত ছিল না। এত পারফর্ম করেছি, কিন্তু ভিডিও করে তা ধরে রাখা গেল না। এখন কত সুযোগ। এখনও আমি আছি। কিন্তু এখন আর করার ক্ষমতা নেই। এই আফসোস থেকে গেল,’ বললেন শিল্পী। 
হাওড়ার বাড়িতে ছাত্রীদের নাচ শেখাতেন মা। তা দেখে দেখেই তিন বোনের নাচের তালিম হতো, জানালেন সুদীপ্তা। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা নাট্য অ্যাকাডেমি তৈরির পর প্রথম প্রোডাকশন ছিল ‘চৈতালি রাতের স্বপ্ন’। উৎপল দত্তর অনুবাদ করা সেই নাটকে ডান্স কোরিওগ্রাফি করেছিলেন দীপালিদেবী। সুদীপ্তার কথায়, ‘আমার মনে হয়, বাবা বেশি বিখ্যাত বলে মা ওভারশ্যাডোড হয়েছিলেন। মা নিজে এত ভাবেনই না। বিপ্লবকেতনের স্ত্রী, পরবর্তী কালে বিদীপ্তা, বিদিশা, সুদীপ্তার মা বলেই চিনেছেন সকলে।’ সত্যিই কি এ নিয়ে ভাবেন না? দীপালিদেবী হেসে বললেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে দীপালি চক্রবর্তী হয়ে উঠতে পারিনি। এই আফসোস ছিল। বিপ্লবকেতনের স্ত্রী হিসেবে প্রচুর সম্মান পেয়েছি। মেয়েদের নাম হওয়ার পর আমি খুবই খুশি। স্ত্রী ও মা এই পরিচয় নিয়ে বাঁচতে আমি গর্ব অনুভব করি। আইডেনটিটি ক্রাইসিস ছিল। সেটা ধীরে ধীরে চলে গিয়েছে। চার নাতনি, তিন মেয়েকে নিয়ে ভালো আছি।’ নাচের মধ্যেই ভালো থাকার রসদ খুঁজে নিয়েছেন দুই প্রবীণা। সে কারণেই আজও তাঁরা নতুন প্রাণের দূত। ঘরে, বাইরে সব দায়িত্ব পালন করেও ভালোবাসার হাত ছাড়েননি।

7th     May,   2022
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ