বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
আমরা মেয়েরা
 

কাজই  প্রতিষ্ঠা

পুরুষতন্ত্রের বেড়া ডিঙিয়ে অন্য ধরনের কাজে নিজেদের দক্ষ প্রমাণ করেছেন দুই নারী। আসবাবের কারখানা চালান তাঁরা। তাঁদের সঙ্গে কথা বললেন কমলিনী চক্রবর্তী।

কালান্তর-এর ‘নারী’ প্রবন্ধের শুরুতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘মানুষের সৃষ্টিতে নারী পুরাতনী। নরসমাজে নারী শক্তিকে বলা যেতে পারে আদ্যাশক্তি। এই সেই শক্তি যা জীবলোকে প্রাণকে বহন করে।’ তিনি চেয়েছিলেন এহেন গৃহস্থ পুরাতনী নারী আধুনিক জগতে তার আসন প্রতিষ্ঠা করবে। নারীর রূপকে তিনি তার বাইরের শক্তি হিসেবে দেখেছেন। এবং চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্যের সূচনায় লিখেছেন, ‘সুন্দরী যুবতী যদি অনুভব করে যে সে তার যৌবনের মায়া দিয়ে প্রেমিকের হৃদয় ভুলিয়েছে তাহলে সে তার সুরূপকেই আপন সৌভাগ্যের মুখ্য অংশে ভাগ বসাবার অভিযোগে সতিন বলে ধিক্‌কার দিতে পারে। এ যে তার বাইরের জিনিস, ... যদি তার অন্তরের মধ্যে যথার্থ চরিত্রশক্তি থাকে তবে সেই মোহমুক্ত শক্তির দানই তার প্রেমিকের পক্ষে মহৎ লাভ...।’
যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নারীর ভিতরে সেই ‘যথার্থ চরিত্রশক্তি’র উদয় ঘটেছে। মেয়েরা এখন ঘরে বাইরে সমান পারদর্শী। তাদের গুণের কদর চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকী সেইসব ক্ষেত্র যেখানে পুরুষের তথাকথিত আধিপত্য, সেখানেও নারী নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করেছে নিজ যোগ্যতায়। এমনই দু’জন মহিলা আজ আমাদের অতিথি, যাঁরা পুরুষতন্ত্রের ঘেরাটোপে ঢুকে নিজেদের নাম প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন। তাঁরা অনিশা জোহরি ও ঋতু দুগ্গল। কলকাতার এই দুই কন্যা নিজে হাতে আসবাব তৈরি করেন। তাঁরা ফার্নিচারের কারখানা চালান তপসিয়াতে। 

সূচনা পর্ব
পুরুষ আধিপত্য রয়েছে এমন একটা ব্যবসায় আসার কথা ভাবলেন কেন? প্রশ্ন শুনে অনিশা বললেন, মোটামুটি ২৫ বছর ধরে তাঁরা ইন্টিরিয়র ডিজাইনিংয়ের কাজ করছেন। মূলত কর্পোরেট দুনিয়ার অফিস ডিজাইনিংয়ের কাজ করতেন। পরে বিভিন্ন ব্যাঙ্কের অন্দরসজ্জা করেছেন। আর ইন্টিরিয়র ডিজাইনিংয়ের মতো পেশায় বরাবরই মহিলাদের আধিপত্য। ফলে কাজ চলছিল অনায়াসে। কিন্তু একবার একটি ব্যাঙ্কের অন্দরসাজের কাজ করতে গিয়ে দু’জনেই পড়লেন মুশকিলে। অন্দরসজ্জার প্ল্যানমাফিক আসবাব বানানোর বরাত দেওয়া হয়েছিল নাগপুরের একটি আসবাব সংস্থাকে। যথাসময়ে তারা জিনিস ডেলিভারি দিতে না পারায় কাজ আটকে গেল। এদিকে ডেডলাইন এগিয়ে আসছে। সময় ক্রমশ কমছে। শিপমেন্ট হচ্ছে না। ভীষণ টেনশনে পড়ে গেলেন অনিশা ও ঋতু। কোম্পানির সঙ্গে কথার খেলাপ হওয়ার জোগাড়। শেষ পর্যন্ত অবশ্য নির্ধারিত দিনের সামান্য পরেই শিপমেন্ট এসে পড়েছিল। তবু কথার খেলাপ আটকানো যায়নি। এই টেনশন সহ্য করার পর তাঁরা ঠিক করলেন আসবাবের প্ল্যান, মাপ, ডিজাইন, ফিটিং সবই যখন তাঁরা করছেন তখন নিজে হাতে আসবাব বানাতেই বা বাধা কোথায়? সেই থেকেই নিজেদের ওয়ার্কশপ তৈরির পরিকল্পনা ও কাজ শুরু করেন।

আধিপত্যের পথে
পুরুষ অধ্যুষিত একটা কাজের দুনিয়ায় দু’জন মহিলার কাজ করতে অসুবিধে হয়নি? কখনও অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়তে হয়েছিল কি? অনিশা বললেন, ইন্টিরিয়র ডিজাইনিংয়ের কাজটা যখন শুরু করেছিলেন তখন দেখেছিলেন বহু মহিলা রয়েছেন এই কাজে। কিন্তু হাতেকলমে আসবাব তৈরির কারখানা তাঁদের কারও নেই। সেখানে পুরুষদের রমরমা। এমন একটা ক্ষেত্রে নিজেদের অস্তিত্ব তৈরি করতে গিয়ে অনিশা কিন্তু পুরুষদের কাছ থেকে বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতাই পেয়েছেন। লিঙ্গবৈষম্য তেমন একটা চোখে পড়েনি তাঁর। 
‘মোটেও না। গোলাপি চশমার আড়াল থেকে পরিস্থিতিটা বিচার করলে কিন্তু সত্যটা বেরিয়ে আসবে না,’ বন্ধু তথা বিজনেস পার্টনারের কথার বিরুদ্ধে গিয়ে বললেন ঋতু। 
তাঁর কথায়, ‘পথটা যে সবসময় মসৃণ ছিল তা নয়। গতানুগতিকতা এড়িয়ে পুরুষতান্ত্রিক কাজের জগতে নিজেদের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে প্রচুর কাঁটা বাছতে হয়েছে।’ 
তাঁদের দেখে প্রাথমিকভাবে একটা বিস্ময় অনেকের মধ্যেই কাজ করত। তা সে ক্রেতাই হোক বা প্রতিযোগী। সেই  বিস্ময়টা ক্রমশ কাটিয়ে দিয়ে নিজেদের গুরুত্বটা বুঝিয়ে দেওয়ার কাজটা সবসময় সহজ হয়নি তাঁদের পক্ষে। তবে এই যে বিস্ময়, এর আবার একটা ইতিবাচক দিকও রয়েছে। সেটা কেমন? এই বিস্ময় থেকেই আবার প্রশংসাও কাজ করেছে অনেকের মনে। দু’জন মহিলার পারদর্শিতায় মুগ্ধ হয়ে তাঁদের কাজ দিয়েছেন অনেক মানুষ। 

তবু কেন বৈষম্য
নারীর এত অগ্রগতি ও উন্নতি সত্ত্বেও কেন এই বৈষম্য? কাজের জায়গায় এখনও কেন পুরুষতন্ত্রের রমরমা? ঋতুর কথায়, ‘আসবাব তৈরির কাজটাই একটু মেহনতির। প্রচুর হেভি লিফটিংয়ের দরকার পড়ে। মেয়েদের শক্তিতে কুলিয়ে ওঠে না সবসময়। সেই কারণেই হয়তো এই ক্ষেত্রটা এখনও পুরুষের অধীনে। তবে এই যে পুরুষ আধিপত্যের পেশায় মহিলা হয়ে ব্যবসা করার আবার একটা মজাও রয়েছে। শ্রমিক শ্রেণির কাছ থেকে প্রচুর সম্মান পাওয়া যায়। মহিলাদের মধ্যে একটা চারিত্রিক ‘সিনসিয়ারিটি’ থাকে যেটা এই ধরনের পেশায় আমাদের পক্ষে কাজ করে। আমরা যে মায়া বা ভালোবাসা দিয়ে প্রতিটি কাজ ও কর্মীকে বোঝার চেষ্টা করি সেটাই ওদের কাছে বাড়তি পাওনা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে এটা আমাদের প্লাস পয়েন্ট হয়ে যায়।’ শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন অভিজ্ঞতা হয়েছে তাঁদের। তাঁরা বুঝেছেন বাঙালি শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা অনেক সুবিধেজনক। তাদের যে কোনও কাজ, তা ডিজাইন সংক্রান্ত হোক বা কায়িক পরিশ্রম হোক, বোঝানো অনেক সহজ। ভালো ব্যবহারের কদর করতে তাঁরা জানেন। তাই তাঁদের সঙ্গে কাজ করাও সহজ। 

দিগন্ত বিস্তার
হাতেকলমে আসবাব তৈরি করতে শুরু করার পর অনিশা ও ঋতু দেখলেন তাঁদের কাজের দিগন্ত বিস্তার হয়েছে। গ্রাহকের সংখ্যাও বেড়েছে। ব্যাঙ্ক বা অন্যান্য কর্পোরেটে ক্লায়েন্টের পাশাপাশি ভবানীপুর এডুকেশন সোসাইটির অন্দরসজ্জার কাজও তাঁরা নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। আসলে নিজেদের ভাবনা অন্যকে বুঝিয়ে যখন কাজে রূপান্তরিত করা হতো তখন কোথাও হয়তো সেই ভাবনা বোঝানো এবং বোঝার মধ্যে একটা ফাঁক থেকে যেত। কিন্তু নিজের ভাবনার রূপদান যখন নিজেরই উপর থাকে তখন আর সেই সমস্যা হয় না। ঠিক যেমন ভেবেছেন তেমনই জিনিস তৈরি করে ফেলা যায়। কথাটা অনিশা আর ঋতুর ক্ষেত্রেও খাটে। িনজেরা হাতেকলমে আসবাব তৈরির কাজ করতে গিয়ে তাঁরা দেখেছেন যে কাজে অনেক বৈচিত্র্য আনতে পারছেন।

নকশার নানা রূপ
অফিস ফার্নিচার বা কর্পোরেট ফার্নিচার বানানোর কায়দা একরকম। সেটাতেই মোটামুটি অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন অনিশা ও ঋতু। কিন্তু মহামারী ও লকডাউন চলাকালীন তাঁরা দেখলেন আসবাবের এক নতুন চাহিদা তৈরি হয়েছে বাজারে। বাড়িতেই অফিস ইউজ–এর মতো আসবাব চাইছেন সবাই। ক্রমশ ওয়ার্ক ফ্রম হোম যত বাড়তে লাগল ততই এই ধরনের আসবাবের চাহিদাও বেড়ে যেতে শুরু করল। গত দু’বছরে আসবাবের ধরন নিয়ে আরও বিস্তারিত পড়াশোনা শুরু করলেন তাঁরা। ঘরের কোণে বসানোর মতো অফিস টেবিল, তার সঙ্গে লাগোয়া ড্রয়ার এবং কি বোর্ড ইউনিট, চাকা দেওয়া চেয়ার, দেওয়ালে লাগানো ছোট ফাইল ক্যা঩বিনেট, সাইড টেবিল, স্টোরেজ ইউনিট— অর্থাৎ অফিসের ব্যবহার করা হয় এমন আসবাবের চাহিদা বেড়ে যেতে শুরু করল। কিন্তু সবই ছোট মাপের। ঘরের মাপ অনুযায়ী সেই ধরনের আসবাব বানাতে শুরু করলেন তাঁরা। পাশাপাশি ঘরোয়া আসবাব বানানোর জন্যও অর্ডার পেতে লাগলেন। অনেকেই কোভিডের সময় বাইরে থেকে মিস্ত্রি ঢোকাতে চাইতেন না বাড়িতে। ফলে অনিশাদের অর্ডার দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতেন। তাঁরা মাপ নিয়ে নিজেদের কারখানায় আসবাব তৈরি করে ডেলিভারি দিয়ে দিতেন। ফলে বাইরের লোক ঢোকানোর ঝামেলা নেই। 

মেয়েদের কাজের সুযোগ
নিজেদের এই ব্যবসায় মহিলাদের কাজের কতটা সুযোগ দিতে পারেন তাঁরা? প্রশ্ন করলে অনিশা এবং ঋতু দু’জনেই বলেন, ‘ইচ্ছে থাকলেও তেমন সুযোগ খুব একটা দেওয়া যায় না। কিছু ক্ল্যারিকাল কাজে মহিলাদের নেওয়া হয়েছে ঠিকই কিন্তু আসবাবের জন্য কাঠের বোর্ড কাটা, মাপমতো কেটে তাতে শেপ দেওয়া, ভারী বোর্ড তুলে একটার সঙ্গে আর একটা জোড়া লাগানো ইত্যাদি কাজ কখনওই মহিলারা একা করতে পারে না। ফলে সেই যদি পুরুষের সাহায্যই নিতে হয় তাহলে আর সেখানে মহিলাদের গুরুত্ব কীভাবে বজায় থাকবে?’ আর সেই কারণেই হার্ড লেবারের যেসব কাজ তাতে মহিলাদের খুব একটা নিতে পারেননি তাঁরা। তবু মেয়েদের যেটুকু কাজের সুযোগ দেওয়া সম্ভব সেটুকু তাঁরা দিয়েছেন বটেই। যেমন অফিস অ্যাডমিনের কাজে মহিলা নিয়োগ করেছেন, আসবাব তৈরির পর যখন তা কারখানা থেকে শোরুমে যায় তার আগে তা পরিষ্কার করা হয়। সেই পরিষ্কারের কাজটাও মহিলাদের দিয়েই করানো হয় তাঁদের সংস্থায়। এছাড়া প্যাকেজিংয়ের কাজেও যতটা সম্ভব মহিলা নিয়োগ করার চেষ্টা করেন। এইভাবে সুযোগসুবিধে মতো মেয়েদের কাজে লাগান তাঁরা। 

সবে মিলে করি কাজ
পুরুষের আধিপত্যের মাঝে নিজেদের অস্তিত্ব তৈরির কাজটা যে সহজ নয় তা আর আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। তবু ঋতু ও অনিশা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই কাজ করেন। তাঁদের কথায়, ‘সবাই যে সহযোগিতা করবে এমন ভাবনাই ভুল। কিন্তু এই যে পুরুষালি ক্ষেত্রে আমরা নিজেদের একটা নাম করতে পেরেছি তার পিছনে পুরুষদের কিছুটা সহযোগিতা যে আছে সেটা অস্বীকার করা উচিত হবে না। আমরা কয়েকজন আছি যারা একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নয়, বরং একে অপরের পরিপূরক হয়ে কাজ করি। আমাদের কোনও ডেডলাইন কাছাকাছি চলে এলে তাঁরাও আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন। একইভাবে তাঁদের প্রয়োজনেও আমরা নিজেদের প্রোডাকশন বন্ধ রেখে তাঁদের কাজ তুলে দিই। এইভাবে একে অপরের সঙ্গে মিলিত হয়ে কাজ করি।’ কাজ করতে করতে অনেকেই একটা জিনিস বুঝেছেন, প্রতিযোগিতা আছে এবং থাকবে কিন্তু বন্ধুত্বের কোনও বিকল্প নেই। কারও জন্য ভাবলে, তাঁকে সাহায্য করলে নিজের পরিধি সংকীর্ণ হয় না, বরং বেড়ে যায়। এই চেতনা সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ুক সেই আশাই রাখেন এই দুই নারী, যাঁরা অন্য ধারার পেশায় সাফল্য পেয়েছেন। 
(যোগাযোগ: decorage_2000@yahoo.com)

30th     April,   2022
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ