বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
আমরা মেয়েরা
 

মন্দিরে মন্দিরে
দুর্গাপুজো

ভারতের নানা রাজ্যে রয়েছে দেবী দুর্গার মন্দির। কোথাও দেবী নিত্য পুজো পান, কোথাও বা মহা ধুমধাম সহকারে পালিত হয় নবরাত্রি ও দশেরা। মন্দিরের পৌরাণিক গল্প ও পুজোর বিবরণ বর্ণনায় কমলিনী চক্রবর্তী।
 
দুর্গা দুর্গতিনাশিনী রূপে মর্ত্যলোকে আগত প্রায়। অসুর বিনাশিনী তিনি। অশুভের বিরুদ্ধে শুভ শক্তির সঞ্চার হয় তাঁরই পূজার মাধ্যমে। বঙ্গ সমাজেই শুধু নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মায়ের পুজোর মাধ্যমে শুভ শক্তির সঞ্চার ঘটে। দেবী দুর্গার অসুর বিনাস অনুষ্ঠিত হয় পুজোপাঠের মধ্যে দিয়ে। শক্তির প্রতীক রূপে মায়ের মন্দির ছড়িয়ে আছে দেশের নানা রাজ্যে। সেখানে দেবী দুর্গা নিত্য পুজো পান। ভক্ত সমাগম হয় দশমী, নবরাত্রি ইত্যাদি অনুষ্ঠানে। তবে এই সব দুর্গা মন্দির নির্মাণের পিছনে রয়েছে নানা ঘটনা, বিভিন্ন কাহিনি। 

নাটোরের রানির হাতে তৈরি  বেনারসের দুর্গা মন্দির
নাটোরের মহারানি ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তৈরি করেছিলেন বেনারসের দুর্গা মন্দির। তখন বেনারসে বাঙালির সংখ্যা ছিল প্রচুর। তাই দুর্গা মন্দিরটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল খুবই তাড়াতাড়ি। মন্দিরের দেওয়ালের কারুকাজ থেকে দেবী মূর্তি, সবই বেনারসের বাঙালিদের মনে ধরেছিল ভীষণ। আর শুধু বাঙালিই বা বলি কেন? অবাঙালি সমাজেও দুর্গা ভক্তের অভাব নেই। ফলে তাদের মধ্যেও এই দুর্গা মন্দিরটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে অচিরেই। গোটা বছর ধরেই এখানে মা দুর্গা পুজো পান। মন্দিরের মাঝখানে একটা বিশাল কুণ্ড রয়েছে। সেই কুণ্ডের উপরেই দেবী মূর্তির অধিষ্ঠান। ভক্তমহলে বিশ্বাস, এখানে মূর্তি নাকি কোনওকালে গড়া হয়নি। বরং কুণ্ড থেকেই মায়ের মূর্তিটি উঠে এসেছিল ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ। নাটোরের মহারানি ভাবানী দেবী সেই দুর্গা মূর্তিটি দেখতে পান, এবং তা ঘিরেই গড়ে তোলেন বেনারসের দুর্গা মন্দির। শহরের দক্ষিণ প্রান্তে দুর্গা মন্দিরের অবস্থান। লোকের বিশ্বাস মা দুর্গাই নাকি ওই অঞ্চল তথা গোটা বেনারসের রক্ষক। তাঁর আশীর্বাদেই বেনারস শহরের যাবতীয় বাড়বাড়ন্ত। 
দেবী পুরাণেও এই মন্দিরের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেই গল্পটি অবশ্য একটু ভিন্ন। তাতে বর্ণিত আছে, বেনারসের তৎকালীন রাজা তাঁর রাজকন্যা শশীকলার জন্য স্বয়ম্বর সভার আয়োজন করেছিলেন। তিনি জানতেনই না তাঁর কন্যাটি ইতিমধ্যেই এক রাজপুত্রকে মন দিয়েছেন। কথাটা জানাজানি হওয়ার পর রাজা তো কন্যার ইচ্ছে অনুযায়ী তার প্রাণপুরুষ, রাজপুত্র সুদর্শনের সঙ্গে কন্যার বিয়ে দিলেন। কিন্তু বিয়েটা দিলেন গোপনে। তবু রাজকন্যার বিয়ের খবর তো আর চাপা থাকে না। তা রটে যেতে অন্য রাজপুত্র ও রাজারা গেলেন চটে। একজোট হয়ে তাঁরা বেনারসের রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। তখন শ্বশুরকে বাঁচানোর জন্য মা দুর্গার আরাধনায় বসলেন সুদর্শন। ভক্তের প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে সিংহবাহিনী মা দুর্গা এলেন তাঁকে রক্ষা করতে। এবং অন্য রাজাদের সঙ্গে লড়াই করে তাঁদের পরাজিত করলেন। সেই থেকেই বেনারসের রাজা কৃতজ্ঞতাস্বরূপ দেবী কুণ্ডের ওপর মায়ের মূর্তি নির্মাণ করেন এবং সেখানে দুর্গা মন্দির তৈরি হয়। মন্দিরের কারুকাজ ও মায়ের বিগ্রহ সবই লাল রঙের। মন্দিরের দেওয়ালে পাথরে খোদাই করা কারুকাজ দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। দক্ষিণ ভারতের মন্দিরের নকশার সঙ্গে বেনারসের এই দুর্গা মন্দিরের প্রচুর মিল খুঁজে পাওয়া যায়। 

খরা থেকে মুক্তি পেতে তৈরি হল শ্রীদুর্গা পরমেশ্বরী মন্দির
সে বহু যুগ আগের কথা, কর্নাটকের কাতিল অঞ্চলে একবার প্রচণ্ড খরা হয়েছিল। বহু বছর বৃষ্টির নামগন্ধ নেই। শুকিয়ে কাঠ গাছপালা, মাটি সব। তৃণভোজের উপায় নেই। ব্রাহ্মণেরাও আমিষ খেতে বাধ্য। এমন সময় সেখানে এক ঋষি তাঁর জ্ঞানচক্ষু প্রদান করে দেখলেন দেবী দুর্গার কৃপা দৃষ্টি ছাড়া ওই অঞ্চলে বৃষ্টি অসম্ভব। তখন তিনি একটি যজ্ঞের আয়োজন করলেন। সেই যজ্ঞে দেবীর আরাধনা করে ঋষি মাকে মর্তে আহ্বান করলেন। চার দিন টানা পুজোর পর দেবী দুর্গা প্রকট হলেন এবং তাঁর কৃপা দৃষ্টি বর্ষণ করলেন। সেই কৃপায় কর্নাটকের কাতিল জেলায় বৃষ্টি নামল। এবং সেখানকার মানুষ দুর্দশা মুক্ত হল। এরপর ভক্তিভরে সেই অঞ্চলে শুরু হল দেবীর পুজো। কর্নাটকের কাতিল জেলায় রয়েছে এক বিশাল হ্রদ। আর তারই মাঝে মা দুর্গার বড় একটি মন্দির। ভারি সুন্দর নিস্বর্গে ঘেরা এই মন্দির। মন্দিরের সবচেয়ে বড় দ্রষ্টব্য এক বিরাট গেট বা গোপুরম। ১০৮ ফুট উঁচু এই গোপুরমটি দেখতেই সারা ভারত থেকে লোকে জড়ো হয় এই মন্দিরে। মন্দিরে দেবী দুর্গা নবরূপে পূজিতা। তাঁর বিভিন্ন রূপের মূর্তি মন্দিরের বিভিন্ন স্থানে অধিষ্ঠিত। প্রতি বছর তাই এই মন্দিরে ধুমধাম সহ নবরাত্রি পালিত হয়। তাছাড়াও দেবী দুর্গা নিত্য পুজো পান। আর ভক্তরা পায় রোজকার প্রসাদ। সন্ধ্যাবেলা আরতির পর ভোগপ্রসাদ বিতরণ করা হয় ভক্তজনের মাঝে। জনশ্রুতি অনুযায়ী এই মন্দিরের দেবী দুর্গা নাকি নাচ গানের ভক্ত। সেই কারণে এখানে প্রতি সন্ধ্যায় নৃত্য ও সঙ্গীতের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন পূজারীরা। নবরাত্রি জুড়ে চলে বিভিন্ন পৌরাণিক পালা গানের অনুষ্ঠান। মন্দিরের সম্মুখে বড় চাতালে এই ধরনের অনুষ্ঠান করা হয়। ভক্তরাও সেই অনুষ্ঠান দেখতে পান। বিশেষ বিশেষ দিনে এই মন্দিরে বেদের কিছু অংশ পাঠ করা হয়। এছাড়াও নানাবিধ দানমূলক অনুষ্ঠানেও এই মন্দির কমিটি যুক্ত থেকে অঞ্চল ও সমাজসেবার কাজ করে।

পাহাড় চূড়ায় কনকদুর্গা মন্দিরে দেবীর অধিষ্ঠান
এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠার পিছনে দু’-দু’খানা গল্প রয়েছে। মহাভারতের যুদ্ধ যখন মধ্যগগনে তখন অর্জুন এসেছিলেন ইন্দ্রকীলাদ্রি পর্বতে। পাহাড় চূড়ায় বসে তিনি দেবী দুর্গা ও শিবের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন যুদ্ধ জেতার বর চেয়ে। শেষে বরপ্রাপ্ত হয়ে অর্জুন যখন আবারও কুরুক্ষেত্রে ফিরলেন তখন যুদ্ধ প্রায় শেষ পর্যায়। বহু বীরের মৃত্যু হয়েছে ইতিমধ্যেই। অর্জুন তখন প্রশান্ত মনে আবারও যুদ্ধক্ষেত্রে ফেরেন এবং কৌরবদের হারিয়ে হস্তিনাপুর জয় করেন। পঞ্চপাণ্ডবের জয়ের কেতন উড়েছিল বলে সেই অঞ্চলের নামকরণ হয় বিজয়ওয়াড়া। এবং শিব ও দুর্গার বরে অর্জুনের জয় হয়েছিল বলে এখানে কনকদুর্গার মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। আর তার পাশেই এক পাথরে শিবের অবস্থান বলে মনে করা হয়। 
এই গল্পটি ছাড়াও রয়েছে আরও একটি গল্প। পৌরাণিক সেই গল্প অনুযায়ী মর্তে তখন অসুরদের বড্ড বাড়াবাড়ি চলছে। এমন সময় দেবী পার্বতী বিভিন্ন রূপ ধারণ করে মর্তে আসেন অসুর বধ করার উদ্দেশ্যে। কখনও তিনি কৌশিকী রূপ ধারণ করে শুম্ভ নিশুম্ভকে বধ করেন, কখনও বা মহিষাসুরমর্দিনী রূপে মহিষাসুরকে বধ করতে উদ্যত হন। আবার কখনও দেবী দুর্গা রূপে দুর্গমাসুরকে বধ করেন। মায়ের এইসব রূপের কাছে স্বর্গের সব দেবতাই শ্রদ্ধায় মাথা নত করেন। ব্রহ্মা দেবী দুর্গাকে জিজ্ঞেস করেন কীভাবে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা অর্পণ করলে তিনি খুশি হবেন? তখন দেবী বলেন তাঁর নামে একটি পাহাড়ের গায়ে একটা মন্দির তৈরি করতে হবে। আর সেই পাহাড়েই তাঁর পাশে মহাদেবেরও আসন পাতা থাকবে। ভক্তদের বিশ্বাস সেই থেকেই অন্ধ্রপ্রদেশের বিজয়ওয়াড়ায় ইন্দ্রকীলাদ্রি পাহাড়ের চূড়ায় কনকদুর্গার মন্দির গড়ে ওঠে। ভক্তদের অনেকেই বিশ্বাস করেন অর্জুন শিবের কাছে যুদ্ধ জেতার বর পেয়ে এই মন্দির নির্মাণ করেন। কৃষ্ণা নদীর তীরে ইন্দ্রকীলাদ্রি পাহাড়। আর সেই পাহাড়ের চূড়ায় মন্দিরের অবস্থান। মন্দিরে মায়ের মূর্তিটি ৪ ফুট উঁচু। তিনি বিভিন্ন ধরনের গয়নায় সুসজ্জিতা। তাঁর উল্লেখ কালিকা পুরাণে পাওয়া যায়। সেখানে তিনি স্বয়ম্ভু রূপে বর্ণিত। এই মন্দিরে প্রতিবছর দশমীর দিন বিরাট পুজোর আয়োজন করা হয়। অশুভ শক্তির পরাজয় এবং শুভ শক্তির জয়ের বর্ণনায় এই পুজো অনুষ্ঠিত হয়। দশমীর সকাল থেকে ভক্ত সমাগম হয় মন্দির চত্বরে। 
দুর্গা পুজোয় প্রতি বছরের মতোই এবছরও সেজে উঠবে ভারতের বিভিন্ন মন্দির। ভক্ত মনে ভক্তিরসের সঞ্চার ঘটিয়ে মা দুর্গার মর্তে আগমন ঘটবে। মঙ্গল হবে  জগৎ সংসারে।           

2nd     October,   2021
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ