বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
আমরা মেয়েরা
 

দুর্গাপুজোর  মহোৎসবে 
মেয়েরা

প্রায় দু’শো বছর ছুঁই ছুঁই লাহাবাড়ির দুর্গা পুজো। মহাপুজোর প্রস্তুতিতে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে বাড়ির মেয়ে বউরা। পুজোর পুরনো ও নতুন গল্প নিয়ে কলম ধরলেন লাহাবাড়ির কন্যা সুস্মেলী দত্ত।

কথায় কথায় সেদিন দুর্গাপুজোর প্রসঙ্গ উঠতেই, লাহা পরিবারের আদুরে আহ্লাদি গিন্নিমা বছর একশো ছুঁই ছুঁই লীলাবতীর চোখ দুটো কেমন যেন চিকচিক করে উঠল। সে কি কষ্টে না আনন্দে কে জানে! স্মৃতিভারে জর্জরিত এই অশীতিপর বৃদ্ধার দিকে চেয়ে থাকা ওঁর দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের চোখে তখন ফুটে ওঠে হাজারো জিজ্ঞাসা। ‘কেমন ছিল সে সময়ের পুজোর সাজগোজ, প্রসাধন, পোশাকআশাক, উৎসবের প্রস্তুতিপর্ব?’
‘সাধারণ রূপচর্চা হিসেবে বেসন দুধের সর তো ছিলই, তার সঙ্গে ময়লা ত্বক ঝকঝকে হওয়ার জন্য বাদামবাটার পেস্ট, গোলাপ জল, ময়দা, জাফরান— কোনও কিছুই বাদ যেত না। এমনি সময় চুল পরিষ্কার করা হতো রিঠে দিয়ে। কিন্তু দুর্গাপুজোর সাজগোজের প্রস্তুতি হিসেবে স্থানীয় হাকিমি দোকান থেকে আনানো হতো জবাফুল, নারকেল তেল ও বিভিন্ন ভেষজ উপাদানে সমৃদ্ধ ‘মাথাঘষা’-র বিশেষ উপাদান। এভাবেই প্রায় একমাস আগে থেকে চলত পুজোর তোড়জোড়।’
 ‘আচ্ছা ঠাম্মা, স্টাইল ব্যাপারটা সে সময় আদৌ কি ছিল?’ বউমা ভারতীর পর এবার নাতনির প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। লীলাবতী সপ্রতিভভাবে জানালেন, ‘ছিল মানে, অবশ্যই ছিল। না হলে, সিনেমার নায়িকাদের অনুকরণে চুল বাঁধার ছাঁদ, শাড়ি ব্লাউজের রকমফের, গয়নার হরেক ডিজাইন— এইসবের চল থাকত কি? তার জন্য অনেক ধরনের প্রস্তুতিও চলত অবশ্য। বাড়িতে আসত মুসলমান দর্জি। চিকের আড়াল থেকে মেয়ে বউরা ঠিক যেমনটি বলতেন ঠিক সেভাবেই তারা শাড়ি ও ব্লাউজে ফ্রিল, লেস, ঝালর, কুঁচি কখনও বা সোনা বা রুপোর তার দিয়ে সূক্ষ্ম এমব্রয়ডারি করে দিত। তবে হ্যাঁ, সেই সময় কিন্তু এরকম ম্যাচিং ট্যাচিংয়ের বালাই ছিল না।’
এ পর্যন্ত এক নিঃশ্বাসে বলে এবার লীলাবতী একটু দম নিলেন। ‘ঠাম্মা শুনেছি, পুজোয় নাকি লাহাবাড়ির বউ মেয়েরা সেলাই করা জামাকাপড় পরতেন না?’প্রশ্ন করল নাতনি।  ‘ঠিক শুনেছিস ভাই, আমার বিয়ে হয়েছিল ন’বছর বয়সে। বিয়েতে লাল টুকটুকে একটা চেলি গায়ে জড়িয়েছিলাম আর শরীরের ওপরে একটা উড়নি ছিল মাত্র। সেটাই নিয়মমাফিক আমার বিয়ের পর প্রথম দুগ্‌গাপুজোয় আবার একদিন পরেছিলুম। সঙ্গে গায়ে চড়িয়েছিলুম প্রচুর গয়না। সাতনরী হার, মুক্তোর কলার, সোনার চিক, জড়োয়ার নেকলেস, বিছে হার, গিনি-গাঁথা হার, আর্মলেট, রিস্টলেট, খোঁপার বাগান, নথ, ঝাড়ঝুমকো, রুপোর মল, পায়েজোর... আরও কত কী! আর পুজোর অন্যান্য দিন পরেছিলুম বেনারসি। তবে অষ্টমীর দিন আমাদের শাশুড়ি মায়ের পুরনো বেনারসি পরতেই হতো। সঙ্গে থাকত হীরের গয়না।’
 ‘মা গো, মনে আছে নতুন বউ হয়ে এ বাড়িতে আসার পরে, তোমার হাত ধরে গুটি গুটি পায়ে রোজ পুজোবাড়ি যেতুম আর হাঁ করে চেয়ে দেখতুম— তোমাদের চুলগুলো— কতরকম খোঁপার ডিজাইন সব! শাশুড়ি হয়ে গেছ বলে সাদা খোলের কাপড় আটপৌরে করে পরতে বটে, কিন্তু চুল বাঁধতে নানারকম করে’। বউমার কথা শুনে ফোকলা দাঁতে ফিক ফিক হেসে ঠাম্মা বলে উঠলেন, ‘কাননদেবী, অনুভাদেবী, পদ্মাদেবীর মতো ইস্টাইল করতাম গো। সে যুগে বাংলা ছবির নায়িকাদের আদলে আমরা খোঁপা বাঁধতুম। এলোখোঁপা, বিনুনিখোঁপা এরকম কত শত যে খোঁপার রকমফের ছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। পুজোর প্রায় মাসখানেক আগে থেকে প্রতিদিন বিকেলে বসত বউ-ঝিদের চুলবাঁধার রিহার্সাল। অপেক্ষাকৃত ছোট ছোট নববধূরা ছিল এই কাজে বলির পাঁঠা। শাশুড়ি, ননদ, জা, পিসিশাশুড়ি মাসিশাশুড়িদের আবদারে মাথাভর্তি চুল নিয়ে বেচারিদের তখন যেন নাভিশ্বাস অবস্থা। এক এক দিন এক একরকম চুল বেঁধে আসন্ন পুজোর জন্য এই ছাঁদটা কতটা কীভাবে কার জন্য উপযুক্ত, তা বিচার করা হতো। আসলে সে যুগে তো এমন সব ফ্যাশন প্যারেড ট্যারেডের বালাই ছিল না, টেলিভিশন, মোবাইলও ছিল না— যা ছিল তা হল, পুজোবাড়ি উপলক্ষে একসঙ্গে হওয়ার ছুতোয় কীভাবে সমাজের কাছে পরিচিত হওয়া যায় তারই উপায় ঠিক করা। তমুক বাড়ির বউ দেখেছ কী সুন্দর চুল বেঁধেছিল, অমুক কী ভালো ডিজাইনের গয়না পরেছে— এভাবে আর কি।’
লীলাবতীর কথার রেশ টেনে এবার তৃতীয় প্রজন্ম ঝরঝর করে বলে উঠল, ‘বুঝেছি তোমাদের লাহাবাড়ির মধ্যে এভাবেই এক বাড়ির সঙ্গে অন্যবাড়ির একটা প্রচ্ছন্ন প্রতিযোগিতা চলত। আর যে জিতত, সেই-ই পেত শারদসুন্দরীর শিরোপা। তাই না?’ 
ফোকলা হাসি হেসে ঠাম্মা নাতনির কথায় সায় দিলেন।
‘এ তো গেল চুল বাঁধার স্টাইল আর পোশাকআশাকের কথা— তোমাদের প্রসাধন কেমন হতো ঠাম্মা?’
 ‘দূর তোদের মতো ওসব মুখে রংটঙের বালাই ছিল না বাপু। পায়ে আলতা পরতাম, সেটাই নীচেকার ঠোঁটে আলতো বুলিয়ে নিতাম। তার সঙ্গে পরতাম ঘরে পাতা কাজল আর কপালে একটা সিঁদুরের টিপ বা কাঁচপোকার টিপ— ব্যস।’
ভারতীদেবী মাঝখান থেকে ফুট কেটে বলে উঠলেন, ‘আমাদের সময়ে কিন্তু বিলিতি ম্যাক্সফ্যাক্টর ঠোঁট রং, লাল আর কমলা রঙে পাওয়া যেত। তার সঙ্গে মাখতাম বিলিতি পমেটম, ঘরে পাতা কাজল আর লাল ভেলভেটের টিপ। তোদের মতো আইব্রাও, মাস্কারা, আইলাইনার, রুজ— ওসবের মোটেও চল ছিল না। আর তাছাড়া সে যুগে বিলিতি ভালো কোম্পানির সেরা শ্যাম্পু, সাবান, পাউডার এসবও পাওয়া যেত। যেগুলো মাখলে এমনিই সুন্দর থাকতাম আমরা।’
দুর্গা পুজোর আর মোটেও দেরি নেই। নীচে লাহাবাড়ির ঠাকুরদালান থেকে মাঝেমধ্যে ভেসে আসছে ঢাকের মৃদুমন্দ আওয়াজ। ঠাকুরে রং লেগে গিয়েছে এক কোট। শরতের পুজো পুজো গন্ধে চারিদিক মাতোয়ারা। কথা বলতে বলতে মনটা কেমন যেন হঠাৎ উদাসীন হয়ে গেল অনিন্দিতার। অনেক বেলা হয়ে গিয়েছে, এবার বাড়ি ফিরতে হবে।
ঠাম্মা আর মায়ের কথাগুলো শুনতে শুনতে এতক্ষণ ধরে সে যেন ডুব দিয়েছিল পুরনো প্রস্তর যুগে— এখন আবার বুঝি ফিরতে হবে ঘোর কলিতে। ভাবতে না  ভাবতেই ভ্যানিটি ব্যাগের ভিতর চতুর্থ প্রজন্মের বায়বীয় ডাক।
 ‘মা, তোমাকে একটা হোয়াটসঅ্যাপে ছবি পাঠিয়েছি, এক্ষুনি দেখে বলো তো কেমন লাগছে? ভাবছি এ বছর অষ্টমীতে এভাবেই সাজব।’
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলেই ঝপ করে ফোনটা রেখে দিল পুপু।
হোয়াটসঅ্যাপটা খুলতেই চোখ দুটো ঝিলমিলিয়ে উঠল মেয়ের সাজ দেখে। এ বছর ওর মামার বাড়িতে দুর্গাপুজোর পালা পড়েছে। তাই সদ্য ইতিহাসে মাস্টার্স করা পুপুর উৎসাহের অন্ত নেই। ওর অষ্টমীর রিহার্সাল সাজে ধরা পড়েছে যেন আভিজাত্য আর বনেদিয়ানার এক অনবদ্য মেলবন্ধন। সাদা খোলের লাল পাড় কাতান বেনারসির সঙ্গে ও পরেছে ফ্রিল দেওয়া সাবেক জ্যাকেট প্যাটার্নের ব্রোকেড কনট্রাস্ট ব্লাউজ আর তার সঙ্গে মানানসই ভারী সোনার গয়না। কী সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে, আহা নজর না লেগে যায়!
কে বলে, এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা তাদের চিরন্তন সাজপোশাক আর সাবেকিয়ানাকে ভুলে গিয়েছে? কে বলে, তারা উদ্ধত, অশালীন?
পুপুর পাঠানো ছবির নীচে একটা ছোট্ট ভালোবাসার চিহ্ন এঁকে মোবাইলটা বন্ধ করল অনিন্দিতা। দক্ষিণ কলকাতায় থাকে অনিন্দিতা, কিন্তু বাপের বাড়িতে দুর্গাপুজোর পালা পড়লে, ক’দিনের জন্য তার ঠিকানা বদলে যায় বেচু চ্যাটার্জি স্ট্রিট লাহাবাড়িতে। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হবে না। বাপের বাড়িতে এসে থাকার তোড়জোড় ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ মায়ের সেই বেনার঩সি, যেটা ঠাম্মা মাকে দিয়েছিলেন বিয়ের গায়ে হলুদের তত্ত্বে, সেটার কথা মনে পড়ল। এবারে লাহাবাড়ির পুজোয় অষ্টমীর দিন অনিন্দিতা সেটাই পরবে ঠিক করল।
তবে বাড়ি যাওয়ার আগে অন্তত একবার প্রতিমা দর্শন না করলেই নয়। দেখা গেল, নীচে ঠাকুরদালানে তখন চলছে মায়ের সাজগোজের প্রস্তুতি। কুমোরের তুলির আঁচড়ে মা দুগ্‌গা কীভাবে যেন জীবন্ত হয়ে উঠছেন ক্রমশ। কী অপূর্ব মায়ের এই রূপ!
কাকে দেখছেন মা, মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা অনিন্দিতাকে, নাকি বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডকে? কে জানে! পা দুটো যেন ক্রমশ অবশ হয়ে আসছে। বুক থেকে একটা ভারী দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। কেন জানি না, প্রায় দু’শো বছর আগেকার এই ঐতিহ্যমণ্ডিত ঠাকুর মণ্ডপে দাঁড়িয়ে থাকার শিহরণ যেন আজ এই এতদিন পরে অনুভব করল সে।
মাকে ছেড়ে যেতে এখন মন চাইছে না— কিন্তু তবু গন্তব্যে তো যেতেই হবে। ‘জয় মা দুর্গা’ মনে মনে জপতে জপতে অনিন্দিতা পাড়ি দিল শ্বশুরবাড়ির দিকে।

18th     September,   2021
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ