বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
আমরা মেয়েরা
 

সুরে সুরে কইব কথা

গানেই আছে প্রাণের টান। তা বুঝতে কোনও ভাষা বা সংস্কৃতির মিল দরকার হয় না। সুরের সাধনায় একে অপরের অন্তরকে ছুঁয়ে যাওয়া যায়। বললেন শিল্পী পার্বতী বাউল। তাঁর সাক্ষাৎকারে কমলিনী চক্রবর্তী।

পরিবেশ পরিস্থিতি বড়ই অস্থির। শান্তি খুঁজতে ব্যাকুল হয়েছে মন। সেই শান্তির বাণী সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে তিনি ব্রতী। তাঁর গানের মাধ্যমে মন খুঁজে পায় পরম আশ্রয়। ঈশ্বরের সন্ধান, সেই গানই বয়ে নিয়ে এসেছে তাঁর জীবনে। তিনি পাবর্তী বাউল। বাউল গানের টান প্রতিটি প্রাণে অনুভব করানোর কাজেই নিজেকে সমর্পণ করেছেন। তাঁর সঙ্গীত সাধনা, সঙ্গীতের মাধ্যমে ঈশ্বরের উপলব্ধি বিষয়ে বিস্তারিত জানালেন আমাদের। 
 গানের মাধ্যমে নাকি মানুষের সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরি করা যায়। কথাটা কতটা সত্যি বলে আপনি মনে করেন?
 এই কথাটা একদম ১০০ ভাগ সত্য। বাউল গানের মধ্যে একটা নাদ আছে, আমাদের অন্তরের আওয়াজ। সেই নাদের মাধ্যমেই আমরা একে অপরের মনকে স্পর্শ করতে পারি। তার জন্য ভাষা, সংস্কৃতি কোনও কিছুরই মিল দরকার হয় না। আমরা যে সবাই মানুষ, ঈশ্বরের সন্তান, এই পরিচয়েই একে অপরকে স্পর্শ করি। সত্যি বলতে কী, ভাষা না বুঝে শুধুই সুরের মাধ্যমেও অন্যের হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া সহজ হয়। এই প্রসঙ্গে একটা গল্প বলি। একবার ইতালিতে একটা গ্রাম্য পরিবেশে গান গাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। আসলে ইতালি গিয়েছিলাম একটা থিয়েটারের কাজে। কাজ শেষ হলে আরও কিছুদিন বাড়তি থেকেছিলাম থিয়েটারের পরিচালকের অনুরোধে। এবং তিনিই আমায় ইতালির সেই প্রত্যন্ত গ্রামে নিয়ে যান। গ্রামটায় গিয়েই বুঝেছিলাম ভারি অন্যরকম পরিবেশ সেখানে। সবাই বৃদ্ধ। কেউ কারও পরিবার নয়। সবাই একা। অনেকটা আমাদের বৃদ্ধাশ্রমের মতো। সেই গ্রামে সবাই খুবই ধার্মিক। খুব বয়স্ক লোক— অনেকেই হয়তো কোনও কিছুতে আর রেসপন্ডও করেন না, এতটাই অসুস্থ। সেখানে আমি বাউল গান শোনালাম। ভিন্ন ভাষায়, ভিন্ন সুরে গাওয়া গান শুনে তাঁরা সবাই একটা উপলব্ধিতে পৌঁছেছিলেন। আমার সুর তাঁদের ছুঁয়েছিল। সেটা এতটাই যে একজন মহিলা যিনি সচরাচর রেসপন্ড করেন না, তিনি তাঁর নার্সের হাতের তালুতে চাপ দিয়ে উঠেছিলেন। আর একজন আমার গান শুনে নিজের বাগান থেকে একটাই মাত্র ফোটা গোলাপ তুলে এনে দিয়েছিলেন। তারপর বলেছিলেন, ‘মে জিসাস ব্লেস ইউ।’ তাঁরা তো কেউ বাউল গানের সঙ্গে পরিচিত নন, তবু তাঁরাও আমার গানের মাধ্যমে উজ্জীবিত হন। এটাই গানের ভাষা। এটাই সুরের জাদু। 
 মনকে শান্ত রাখতে সাধনা কতটা সাহায্য করে?
 যাঁরা সাধনা করেন বা সাধনার জন্য নিজেকে আত্মস্থ করেন তাঁদের মন আপনা থেকেই শান্ত হয়ে যায়। কারণ সাধনা করলে একটা নিয়মের মধ্যে থাকতে হয়। এবং সেই সাধনা যতই গাঢ় হয়, মন ততই সেই সাধনায় লিপ্ত হতে থাকে। তখন আর সে বাইরে যেতে চায় না। বরং সাধনার মধ্যেই মন আশ্রয় খুঁজে পায়। সাধনা যতই গভীর হয়, ততই ঈশ্বর চিন্তা নিবিড় হয়ে ওঠে। তখন তিনি নিজেও ঈশ্বরের মধ্যেই আশ্রয় খুঁজে নেন। কোনও মানুষ যদি খুব মন দিয়ে ঈশ্বর চিন্তা করেন, তাহলে তাঁর সামনে গেলে আমরাও সেই চিন্তার প্রতি আকৃষ্ট হব এবং মন একাগ্র হয়ে যাবে। 
 মনকে একাগ্র করার প্রচেষ্টাই কি ঈশ্বরের কাছাকাছি পৌঁছতে সাহায্য করে?
 অনেকটাই তা‌ই। মন যখন একাগ্র হয়ে যায় তখন মানুষ খুব সাধারণ জিনিস, খুব ছোটখাট ঘটনার মধ্যেও আনন্দ খুঁজে পায়। তখন দ্বিধা, বিক্ষিপ্ত চিন্তা, সন্দেহ ইত্যাদি মন থেকে সরে যায়। মন একটা অন্য ধরনের সৌন্দর্য দেখতে পায়। আর সেই যে সৌন্দর্যের সন্ধান, তা অন্যদেরও আকর্ষণ করে। তাঁরা তখন একাগ্র মনের কাছে নিজেদের সমর্পণ করতে চান এবং এই সমর্পণের মাধ্যমে একটা শান্তি অনুভব করেন। তাই ঈশ্বর সাধনা যদি সৎ মনে ও নিষ্ঠা সহকারে করা যায় তাহলে শুধু যে নিজের মনই শান্ত হয় তা-ই নয়, অন্যকে শান্তির খোঁজ দিতেও তা সমর্থ হয়। 
 আপনার মধ্যে এই যে গানের মাধ্যমে ঈশ্বরকে সাধনা করার ইচ্ছা, তা জাগল কেন?
 পারিবারিক একটা ধারা আমাদের বরাবরই ছিল। ঈশ্বরের প্রতি টান সেই ধারা থেকেই প্রথম অনুভব করেছি। আমার মা স্বামী ভূতেষানন্দজি মহারাজের শিষ্য ছিলেন। রোজ কথামৃত পাঠ শুনতাম মায়ের মুখে। ফলে ছোটবেলা থেকেই একটা নিবিড় টান ছিল। সেই টানটাই বেড়ে গিয়েছিল শান্তিনিকেতন এসে। ভিস্যুয়াল আর্ট নিয়ে পড়তে গিয়েছিলাম শান্তিনিকেতনে। বাউলের সঙ্গে যোগাযোগ সেখানেই প্রথম ঘটে। আর সেই টানেই আমি বাউল গানের প্রতি আকৃষ্ট হই। বাউল গানের মাধ্যমে খুব সহজে গভীর তত্ত্ব বোঝানো হয়েছে। এই গানের মাধ্যমেই আমি আমার জীবনের অর্থ নতুন করে খুঁজে পেয়েছি। 
 গানের মাধ্যমে ঈশ্বরের সাধনা করা বা মনকে ঈশ্বরের সামনে মেলে ধরা কীভাবে সম্ভব বলে আপনার মনে হয়?
আগেই বললাম সঙ্গীত আমাদের অন্তরের নাদ। আমাদের এই যে শরীর, এই জন্ম সবই তো পঞ্চভূত থেকে সৃষ্টি হয়েছে। আবার সেই পঞ্চভূতেই আমরা বিলীন হব। সঙ্গীতের মাধ্যমেই আমাদের মনে একটা অন্য ধরনের চৈতন্যের উদয় হয় বলে আমি মনে করি। কিন্তু জাগতিক একটা আচ্ছাদনের মধ্যে আমরা লিপ্ত থাকি বলে সেই চৈতন্য আমাদের মনে সবসময় উপলব্ধি হয় না। কিন্তু গানের মধ্য দিয়ে সেই উপলব্ধি সম্ভব। হৃদয় খুলে যদি গান করা যায়, তাহলে সেই গানের মধ্যে আমাদের অন্তরের যে নাদ বা আওয়াজ তা স্পষ্ট হয়। আর সেই নাদের মাধ্যমেই আমাদের শরীর ও মন জুড়ে ঈশ্বরের উপস্থিতি অনুভূত হয়। এই যে নাদ তা আমাদের মধ্যে একটা ভাইব্রেশন ঘটায় এবং এই ভাইব্রেশন বা অনুরণন আমাদের মনের সঙ্গে বিশ্বচরাচরের যোগাযোগ ঘটায়। বিশ্বশক্তির সঙ্গে তখন মানুষের মনের শক্তির মিলন ঘটে। এবং তার মাধ্যমেই একটা আধ্যাত্মিক চৈতন্য প্রকাশ পায়। ভারতের সব পরম্পরা খুঁজলে বোঝা যায় সমস্ত উচ্চারণের মধ্যেই একটা সুর বা গানের অস্তিত্ব রয়েছে। বেদ মন্ত্রও সুরে পাঠ করা হতো। এই সুরের প্রাচুর্য কেন? শুধু শ্রুতিমাধুর্যই এর কারণ? না, তা নয়। সুরের মধ্যে দিয়ে আমাদের অন্তরের যে নাদ প্রকাশ পায় তার কারণেই সঙ্গীতের এই বিশেষ স্থান। তার মধ্যে দিয়েই আমরা নিজেদের মনের স্পিরিচুয়ালিটি বা আধ্যাত্মিক বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হই। ফলে অবশ্যই গানের মাধ্যমে ঈশ্বরের কাছে পৌঁছনো যায়। গানের আর একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে। তা সবাইকে এক মন্ত্রে গেঁথে নিতে পারে। তাই তো সব ধর্মে সঙ্গীতের উপস্থিতি অনস্বীকার্য। বলা হয় ঈশ্বরের সবচেয়ে কাছে পৌঁছনোর উপায় সঙ্গীত। 
তাই সঙ্গীতের মাধ্যমেই সাধনা চূড়ান্ত হয়। 
 আপনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় এই সত্যটা কীভাবে অনুভব করেছেন?
 ব্যক্তিগতভাবে আমি দেখেছি গান একের সঙ্গে অন্যের মিলন ঘটায়। কেউ যখন নিজেকে গানের টানে বইয়ে দেয় তখন ধর্ম, বর্ণ, ভাষা বা সংস্কৃতির বিভেদ হারিয়ে যায়। গান নিজের মধ্যে সব বিভেদ আত্মস্থ করে সবাইকে একই সুরে গেঁথে 
ফেলে। তাই তো গানের মাধ্যমে আমরা শান্তি খুঁজে পাই। এখনকার অস্থির সময়েও দেখবেন মন গানের মাধ্যমেই শান্তি খোঁজে, শান্তি পায়। আমি নিজেও এই সত্যটা উপলব্ধি করেছি। বাউল মহাজন পদাবলি আমি দেশে দেশান্তরে মানুষকে শুনিয়ে এই সত্যটা উপলব্ধি করেছি। এতে যত সহজ ভঙ্গি ও সুরে ঈশ্বর চেতনার কথা বলা হয়, তা বুঝতে কিন্তু      আলাদা করে অন্য ভাষায় বোঝাতে হয় না। সুর নিজেই নিজস্ব ভাষা তৈরি করে নেয়।  

24th     July,   2021
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ