বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
আমরা মেয়েরা
 

টেবিল কাঁপানো  মেয়ে

টেবিলে তাঁর সুনাম শ্যেনদৃষ্টির জন্য। দৌড়ঝাঁপ নয়, বিপক্ষকে বিপাকে ফেলতে নিজের টেকনিক আর স্কিলকেই কাজে লাগাতেন। তিনি বাংলা টেবিল টেনিসের অন্যতম অহংকার মৌমা দাস। সদ্য পদ্মশ্রী খেতাব মিলেছে। পছন্দ-অপছন্দ ও খেলোয়াড় জীবনের নানা কথা মৌমা ভাগ করে নিলেন ‘চতুষ্পর্ণী’-র সঙ্গে। শুনলেন মনীষা মুখোপাধ্যায়।

• বাংলার টেবিল টেনিস তো মৌমাকে খুব মিস করছে!
 বলছেন? আমিও টেবিলকে খুব মিস করছি। তবে লকডাউনের মধ্যেই মা হয়েছি। তাই শারীরিক কারণেই খেলা থেকে দূরে থাকতে হয়েছিল। প্রায় দু’বছর হতে চলল আমি টেবিলে যাইনি। এবার খেলার জন্য মনখারাপ হচ্ছে। 
• সেই মনখারাপ কাটানোর দাওয়াই?
 আবার খেলাটা শুরু করা। প্রায় দু’ সপ্তাহ হতে চলল আমি ফের প্র্যাকটিস শুরু করেছি। এত দীর্ঘ দিন টেবিলের বাইরে, তার ওপর মা হওয়ার কারণে শরীরেও কিছু পরিবর্তন আসে। সব মিলিয়ে ফিটনেস প্রায় তলানিতে ঠেকেছিল। তবে প্র্যাকটিস শুরু করে খুব চনমনে লাগছে। অনেকটা ঝরেও গিয়েছি। লকডাউনে মা হওয়ার কারণে ভ্যাকসিন আর চিকিৎসার প্রয়োজন ছাড়া আমি আর বেরইনি। এখন আবার পুরনো টেবিল, পুরনো শরীরচর্চা করে পুরনো আত্মবিশ্বাস ফিরে আসছে।
• অনেকে বলেন, মৌমা দাস যদি নারকেলডাঙা দাস বাড়ির মেয়ে না হতো, তাহলে এই কেরিয়ার তাঁর হতোই না!
 কথাটা খুব ভুল নয়। আমার বাবা ফুটবল খেলতেন। কাকা দিলীপ কুমার দাস টেবিল টেনিস খেলোয়াড় ছিলেন। আমার বাড়িতে সবসময়ই একটা খেলার পরিবেশ ছিল। তাই বোধহয় ছোটবেলায় আমি খুব দুরন্ত ছিলাম বলে আমাকে শান্ত করতে ওরা ক্লাবে পাঠিয়ে দিয়েছিল, যাতে অন্তত খেলা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় দুষ্টুমি করার সময় না পাই! তাতে দুষ্টুমি কমেছিল কি না জানি না (হাসি)।
• খেলায় মন বসেছিল প্রথম থেকেই? অত ছোটবেলায় ভালো লাগত খেলাটা?
 সত্যি বলতে কি, প্রথম প্রথম ভালো লাগত না। তবে কাকা সে সময় খুব উৎসাহ দিত। মা-বাবাও। মানে বাড়ির সকলেই। তারপর আস্তে আস্তে দেখলাম আমার বয়সি অনেকেই খেলছে, সেই থেকে নিজেরও একটা টান তৈরি হল। তখন আমার ন’বছর হবে।
• আর কোচ জয়ন্ত পুশিলাল?
 ও বাবা, তিনি তো ততদিনে আমার জীবনে আশীর্বাদ হয়ে চলেই এসেছেন। আমার কাকারও কোচ ছিলেন তিনি। ওঁর অধীনেই অনুশীলন শুরু হয় আমার। খেলাটা ভালোবাসতে শুরু করি আমার কোচের উৎসাহেই। আজ যেটুকু করতে পেরেছি, তার নেপথ্যে আমার দুই পরিবার ও আমার কোচের অবদান সবচেয়ে বেশি।
• প্রথম বড় টুর্নামেন্ট কী?
 পৃথিবীর সব বড় টুর্নামেন্টেই আমি অংশ নিয়েছি। ১৯৯৭-এ প্রথমবারের জন্য ওয়ার্ল্ড টেবিল টেনিস চ্যাম্পিয়নশিপ খেলতে যাই ম্যাঞ্চেস্টারে। এর পর থেকে পৃথিবীর নানা প্রান্তেই প্রায় ৭৫টা দেশ জুড়ে ৪০০-রও ওপর ম্যাচে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছি। ২০০০ সালে চিলড্রেন অব এশিয়া ইন্টারন্যাশনাল স্পোর্টস গেমসে সোনা জয়ের মাধ্যমেই প্রথম আন্তর্জাতিক পদক জয় শুরু। বড় সাফল্যগুলোর মধ্যে ২০১৫-র কমনওয়েলথে রুপো তো থাকবেই, সে বছরই আমি ভারতীয় মহিলা টেবিল টেনিস খেলোয়াড় হিসেবে সবচেয়ে বেশি পদকজয়ীর রেকর্ড করি। ২০১৬-র রিও অলিম্পিকে আমার ফল খুব ভালো না হলেও সেখান থেকে আমি অনেক অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরেছি। খেলার জার্নিতে সেটাও কম নয় আমার কাছে। এছাড়া আইটিটিএফ (ইন্টারন্যাশনাল টেবিল টেনিস ফেডারেশন)-এর নানা প্রতিযোগিতায় বহুবার সোনা জয় ও নানা রেকর্ড তৈরি তো আছেই। ২০১৮-র কমনওয়েলথে আমাদের টিম সোনা পেয়েছিল, সেই দলে থাকতে পারায় আমি আনন্দিত।
• সেই খেলায় মধুরিকা পাটকরের সঙ্গে জুটি বেঁধে আপনি ভারতকে অনেক সুবিধাজনক জায়গায় পৌঁছে দিয়েছিলেন...।
 হ্যাঁ, এবং সেই খেলার রেশ ধরেই ভারত সে বছর ইংল্যান্ডের মতো শক্তিশালী দলকে হারিয়েছিল! সেই ম্যাচটা নিয়ে নানা জায়গায় আজও চর্চা হয়। আমি আর মধুরিকা দু’জনেই খুব ভালো ফর্মে ছিলাম তখন।
• আপনার রেকর্ডের দিকে তাকালে তো বাংলার যে কোনও উঠতি টেবল টেনিস খেলোয়াড়ের হয় ঈর্ষা হবে নয়তো সে আপনার মতো হতে চাইবে।
 এভাবে ভেবে দেখিনি কখনও। তবে হ্যাঁ, খেলার সময় বেশ কিছু রেকর্ড গড়ি। যেমন, আন্তর্জাতিক ম্যাচগুলোয় এশিয়ার মধ্যে আমিই সবচেয়ে বেশিবার অংশ নেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করি। সিনিয়র ন্যাশনালে আমারই সবচেয়ে বেশি সোনা জেতার হ্যাট-ট্রিক আছে। সিঙ্গলসে সাউথ এশিয়ান গেমসে সোনা জেতার হ্যাট-ট্রিক রয়েছে। কমনওয়েলথে আমি সাতবার ফাইনাল খেলেছি, সেটাও ভারতীয় মেয়েদের মধ্যে রেকর্ড। সম্প্রতি একটা হিসেবে দেখছিলাম, এ যাবৎ একশোটারও বেশি ম্যাচে সোনা পেয়েছি, খবর পেলাম, সেটাও রেকর্ড। এগুলো খুব খেটে অর্জন করা, তাই ভাবলে তৃপ্তি হয়। তবে আমার রেকর্ড কাউকে উৎসাহিত করলে আমার খুব ভালো লাগবে।
• আপনার তো র‌্যাঙ্কিংও বেশ ভালো ছিল, কোচিংয়ে কখনও পাব?
 সেটা আমি এখনই ভেবে দেখিনি। আমি নিজে এখনও অনেক দিন খেলতে চাই।  যেহেতু নতুন করে শুরু করছি, তাই একেবারে বুনিয়াদি স্তর থেকে আমাকে আবার খেলে যোগ্যতা অর্জন করে আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছতে হবে। এখন আমার পাখির চোখ এই ঘরোয়া টুর্নামেন্টগুলোয় খুব ভালো ফল করা। তবে কোনও জুনিয়র যদি আমার থেকে খেলার কোনও টিপস বা সাহায্য চান, আমি খেলতে খেলতেই তাঁকে সেসব বলে দেব। সেদিক থেকে কোনও বাধা নেই।
• ‘অর্জুন’ পেয়েছেন ২০১৩ সালে। আর তার আট বছর পরেই মিলল ‘পদ্মশ্রী’। দায়িত্বও তো বাড়ল অনেক?
 তা তো বাড়লই। আর এখন তো আমার ঘরে-বাইরে দায়িত্ব। খেলার পাশে মেয়েকেও অনেকটা সময় দিতে হয়। মাতৃত্বও আমি খুব উপভোগ করছি। মা-কাকিমা-শাশুড়ি মা সকলের থেকেই শিখছি কী করে একজনকে বড় করে তুলতে হয়। মেয়ে হওয়ার পরেই আমি পদ্মশ্রী পাই। তাই এটা ওকেই উৎসর্গ করেছি। এমনিতেও আমার সব সাফল্যের নেপথ্যে আমার দুই পরিবারের লোকজন রয়েছেন। বাপের বাড়ি তো বটেই, আমার শ্বশুরবাড়িও খুব সাপোর্টিভ। নইলে এ জায়গায় পৌঁছনো সত্যিই সম্ভব হতো না। 
• কিন্তু অনেক মেয়ে তো সেই সাপোর্ট পায় না, তাঁরা কী করবেন?
 দেখুন খেলতে গেলে মানসিকতা ঠিক রাখতেই হবে। টেনশন, অশান্তি এগুলো খেলা নষ্ট করে। যিনি খেলবেন, তাঁকে প্রথমেই বুঝে নিতে হবে চারপাশের মানুষজনের সমর্থন আছে কি না। সেটা না পেলে তাঁদের বুঝিয়েসুঝিয়ে, নিজের যোগ্যতা ও জেদ সম্বল করেই এগতে হবে। তার সঙ্গে কাছের লোকজনের সমর্থন আদায়ের চেষ্টাতেও কসুর করলে চলবে না। তাতে সেও ভালো থাকবে আর বাড়ির লোকজনও।
•  কিন্তু অনেক বাড়িতেই তো পারিবারিক সেই সমর্থন মেলে না মেয়েদের...। 
 হ্যাঁ, সেটা হলে খুব মুশকিল। পরিবারকেও মনে রাখতে হবে আজকাল মেয়েরা কী না করছে! 
• আচ্ছা একটা অভিযোগ আছে। মাঠের   বাইরে মৌমা নাকি একেবারে ডায়েট করেন না!
 হা হা হা। ঠিকই শুনেছেন। আমি রীতিমতো ভেতো। ভাতের পাতে বিউলির ডাল, আলুপোস্ত আর মাছ হলে আমার আর কিছু চাই না। তবে বড় টুর্নামেন্টের আগে ধরেবেঁধে মা-কাকিমারা আমাকে ডায়েট করায়। আমিও বাধ্য হয়েই তখন সব সেদ্ধ খাই। 
• টেবিল টেনিসে যাঁরা নতুন উঠে আসছেন, তাঁদের কী বলবেন?
 অভ্যাসের কোনও বিকল্প নেই, আর সাফল্যের কোনও শর্টকাট নেই। এত প্র্যাকটিস করো, যাতে তোমার ভুলগুলোও তোমাকে ভয় পায়। খেলাটার প্রতি ভালোবাসা, নিষ্ঠা তো থাকতেই হবে। নিজের পরিশ্রমের প্রতিও সৎ থাকতে হবে। এটুকু হলেই আকাশ ছোঁয়া সম্ভব। 
 

13th     March,   2021
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ