বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
চারুপমা
 

বনস্পতির ছায়ায়

বুড়িয়ে যাওয়া মানে কি ফুরিয়ে যাওয়া? ষাটের আশপাশেও কীভাবে প্রাণবন্ত থাকেন ওঁরা? লিখছেন স্বরলিপি ভট্টাচার্য । 

‘তিনি বৃদ্ধ হলেন, বনস্পতির ছায়া দিলেন সারাজীবন’— কবীর সুমনের লেখা শব্দগুলো যখন দৈনন্দিন বেঁচে থাকার অংশ হয়ে ওঠে, তখনও বনস্পতির সুঠাম ডালে নতুন দিনের গন্ধ। কিন্তু তিনি কি বৃদ্ধ? কতটা পথ পেরলে তাঁকে বৃদ্ধ বলা যায়? আনুষ্ঠানিক অবসরের বয়স ৬০। সেই প্যাভেলিয়নে পৌঁছে গেলেই কি বৃদ্ধ বলা যাবে? ৬০-এর দিকে দ্রুত এগিয়ে চলেছেন যেসব বনস্পতি তাঁরা কী ভাবেন? বুড়িয়ে যাওয়া, ফুরিয়ে যাওয়ার বেলা কি তবে সমাগত প্রায়? নাকি এ বয়সে মন, মগজকে নতুন করে সাজিয়ে নেওয়ার উৎসব চলে?
৬০ থেকে বছর দুয়েক পিছিয়ে থাকা পরিচালক অরিন্দম শীল এখনও টানা ১৬-১৭ ঘণ্টা কাজ করেন। তিনি বললেন, ‘৬০ কোনও বয়সই নয়। যেটা ভালোবাসেন সেটা করুন। আমি টপ ফর্মে থেকে চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলাম। ৪৮ বছর বয়সে প্রথম ছবি পরিচালনা করি। অভিনয় থেকে সরে যখন পরিচালক হিসেবে কাজ করা শুরু করি, সেটা আমাকে একটা নতুন জীবন দেয়। এই মুহূর্তে অদম্য এনার্জি আমার। মনে হয়, যতদিন বাঁচব কাজ করতে হবে। কোথাও একটা অ্যাগ্রেসন এসেছে। বারবার মনে হয় আমার প্রতিযোগিতা আমার থেকে বয়সে অনেক ছোটদের সঙ্গে। সৃজিত (মুখোপাধ্যায়), কৌশিক (গঙ্গোপাধ্যায়)— যাদের নাম পরিচালক হিসেবে একসঙ্গে করা হয়, তাদের বয়স আমার থেকে অনেক কম। কিন্তু কাজের জায়গা থেকে মনে হয় আমার বয়স ২৫-৩০।’
অরিন্দমের মতোই বেশি বয়সে এসে ছবিতে মিউজিক করতে শুরু করেছেন বিক্রম ঘোষ। হেসে বললেন, ‘আমার ৫৬ বছর বয়স। সবে শুরু করলাম। কত নতুন কাজ করছি। অবসর বলে কিছু হয় না। ফিট, হেলদি থাকতে হবে। আনন্দে থাকতে হবে।’ এই আনন্দে থাকার রসদ খুঁজে নিতে পারেন আপনিই। তার জন্য দরকার সঠিক পরিকল্পনা। সেকথা মনে করিয়ে দিলেন সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায়। পেশাদার জগতে তাঁর অনেকগুলো পরিচয় থাকলেও তিনি এখনও আপামর বাঙালির কাছে আদরের ‘তোপসে’। 
সিদ্ধার্থর পরামর্শ, ‘৬০-এ অবসর নিয়ে, প্রথমে অনেকে দিশাহারা হয়ে যান, সারাদিনটা কাটাব কীভাবে? তার আদর্শ প্ল্যানিং অবসরের আগে সম্ভবত হয় না। সেটাই করে ফেলতে হবে। কর্মজীবন হঠাৎ করেই এক সকালে শেষ হয়ে যায়। কিন্তু ৬০-এর পরেও শ্রম করার ক্ষমতা থাকে মানুষের। ৬০-এ পৌঁছে বড় অভিজ্ঞতা হয়। সেটার মূল্য সাংঘাতিক। যে ভাবতে পারবেন, আমি কোন ব্যাপারে ভালো, আর অবসরের পর কী করা উচিত, তিনি ভালো থাকবেন। এখন ডিজিটাল জগতের সুবাদে অনেক সুযোগ এসে গিয়েছে। আমি বহু মানুষকে জানি, যাঁরা ষাটোর্ধ্ব চিকিৎসক বা উকিলদের উপর ভরসা করেন অভিজ্ঞতার জন্য।’ 
আসলে যত বেশি অভিজ্ঞতা হয়, জীবনে তত বেশি সদর্থক চিন্তাভাবনার পরিসরও তৈরি হয়। বিক্রমের কথায়, ‘আমাকে সকলে বলে আমার থেকে ৩০ বছরের ছোট যে তার থেকেও বেশি এনার্জি আমার। প্রতিদিন জিম করি, হাঁটি। আমার বয়সি অনেক পরিচিতর থেকে আমি অনেক বেশি পজিটিভ ভাবনার লোক। আমার তবলার কেরিয়ার অনেক কম বয়সে শুরু হয়েছিল। কিন্তু সিনেমার কেরিয়ার তো ৪৫-এ শুরু হল।’ ইতিবাচক ভাবনা থাকলে মনের বয়স তরুণ রাখা কোনও সমস্যার নয়। অরিন্দমের অভিজ্ঞতা, ‘নারী, পুরুষ নির্বিশেষ সব বয়সের মানুষ আমাকে ভালোবাসেন। তার কারণ আমার মনে হয় জীবনের প্রতি আমার অ্যাটিটিউড। সবই মনের ব্যাপার। নিজে নিজেকে অনুপ্রাণিত করা যায়। নিজেকে তরুণ ভাবতে হবে। এমন মানুষ দেখেছি বেশি বয়সে গিয়ে পৃথিবী ওলটপালট করে দিয়েছে। সে তুলনায় তো আমার বয়স অনেকটাই কম।’
৬০-এর ট্র্যাকে যাঁরা দৌড়চ্ছেন, নিজেদের যত্ন নেওয়াটা প্রাথমিক কর্তব্য বলেই তাঁদের মনে করতে হবে। অরিন্দম হেসে বললেন, ‘রুদ্রনীল (ঘোষ, অভিনেতা) আমার নাম দিয়েছে যত্নশীল। আমার সিনেমা তো বটেই, সব কিছুর মধ্যেই যত্ন রয়েছে। আমি কম বয়স থেকেই শৌখিন। এখন একটু টাক পড়েছে, চুল কমে গিয়েছে। সেজন্য কয়েকদিন আগে একটা অনুষ্ঠানে বিবিদির (রাসেল, ডিজাইনার) পোশাক পরার আগে ওঁকে বলে পাঠিয়েছিলাম, একটা হেড গিয়ার পরব (হাসি)। আমার শ্যুটিং ফ্লোরও খুব গোছানো। বাড়িতে লোক আসছে বলে গোছাতে হবে তা নয়। জায়গার জিনিস জায়গায় থাকে।’  
চিরকালই ফ্যাশনেবল বিক্রম। জানালেন, পোশাক পরার ক্ষেত্রে আরামকে প্রাধান্য দেন। পোশাকের সঙ্গে যাতে ব্যক্তিত্বের সংঘাত না ঘটে, সেটাও মাথায় রাখেন। ‘আমি মানুষ হিসেবে খুব ক্যাজুয়াল। সেটা আমার জামাকাপড় দেখলেও বোঝা যায়। ডেনিম পরে কার্যত সারা জীবন কাটাচ্ছি। ডেনিমের সঙ্গে ভালো কটন শার্ট বা টি শার্ট পরি। মূলত ফুলস্লিভ শার্ট ফোল্ড করে পরি। হাতের অ্যাক্সেসরিজ চিরকাল পরি। একসময় যেটা ভারতে একেবারে নতুন ছিল। যে ধরনের ব্রেসলেট বা ব্যাঙ্গেল পরি কোনওটা আফ্রিকা, কোনওটা আমেরিকা বা জাপানের। গত ৩০ বছর ধরে আমার চুলের স্টাইল একইরকম। আমি জুতো-অ্যাডিক্ট। পাজামা পাঞ্জাবি পরি পুজো এবং কনসার্টে।’ 
সিদ্ধার্থও রঙিন মানুষ। পোশাকে রং তাঁর চিরকালের পছন্দ। ৬০ বছর বয়স অতিক্রম করার পর সাঁতার কাটছেন নিয়মিত। গান শোনার ইচ্ছে বেড়েছে। না পড়া বই কিনছেন এবং পড়ছেন নিয়মিত। সপ্তাহে একটা দিন সিনেমাহলে গিয়ে সিনেমা দেখাটাও তাঁর নতুন অভ্যেস। ‘আগের থেকে কাজের পরিধি বেড়েছে। আগে বেশি দৌড়োদৌড়ি করে কাজ করতাম। এখন মগজাস্ত্র ব্যবহার করে কাজটা করি (হাসি)! আমি অনেক বছর ধরে পড়াই। যখন বয়স ৪৫ ছিল কাকতালীয়ভাবে ‘ভজহরি মান্না’-র মাধ্যমে খাবারের ব্যবসা শুরু করেছিলাম। সময় যত এগিয়েছে ব্যবসাটা ভালো বুঝতে শিখেছি’, বলছিলেন সিদ্ধার্থ। ভবানীপুরের ছেলে হওয়ার কারণে এখনও মাঝেমধ্যে শ্রীহরিতে পৌঁছে যান কচুরি আর ছোলার ডালের স্বাদ নিতে। কখনও বা গঙ্গার পাড়ে গিয়ে একা একা ডালের বড়া খাওয়া তাঁর অন্যতম বিনোদন। অথবা প্রাণের আরাম খুঁজে নেন কফি হাউসের ইনফিউশন এবং ভেজিটেবল পকোড়ায়। ‘মজা করে জীবন কাটাতে হবে। জীবনের সময়সীমা মোটামুটি নির্দিষ্ট। একটা বয়স পর্যন্ত জীবন চলবে। সেদিন আমার এক বন্ধুকে হাসপাতালে দেখে ফেরার পথে আলিপুর চিড়িয়াখানা দেখে মনে হল, অনেকদিন তো যাইনি। প্ল্যান করেছি, বন্ধুদের জোগাড় করলাম। বউদের ছাড়া নিজেরা যাব। টিফিন কেরিয়ারে খাবার নিয়ে যাব। একটু যদি ছোটবেলাটা ফিরিয়ে আনা যায়’, নিজের দৈনন্দিন রুটিন নিয়ে গল্প করছিলেন সিদ্ধার্থ। আরও এক অভ্যেস তাঁকে আনন্দে রেখেছে। কী সেটা? ‘কলকাতার বিভিন্ন পাইস হোটেলে ঘুরে ঘুরে খেতে ভালোবাসি। ব্যবসায় আমার প্রতিযোগীরা, যাদের দেখে ‘ভজহরি মান্না’ খুলেছিলাম, তারা কী করছে, সেটা দেখি। আর এই খাবারগুলো এখনও আমার ভালো লাগে।’ 
১৫-২০ বছর আগেও জীবনের প্রতি বাঙালির যেমন দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, তা আজও অনেকটাই ফিকে। নতুন করে ভাবতে শিখেছে এই জাতি। এমনটাই মনে করেন বিক্রম। তাঁর কথায়, ‘৬০ তো এখন নতুন ৪০। আর ৪০ হল নতুন ২০। অমিতাভ বচ্চনকে দেখুন। ৮২ বছরেও দারুণ ফিট, চুটিয়ে কাজ করছেন। অনিল কাপুরকে দেখলে কেউ বলবেই না ৬৭ বছর বয়স। মানুষের মধ্যে আশা তৈরি হয়েছে অনেক বেশি। আগে যেমন ছিল, আর কী আছে, সব তো হয়ে গেল, নাতি নাতনি নিয়ে এবার থাকব— এধরনের ভাবনা আর নেই।’ 
সবুজে মোড়া জীবনবোধ ৬০-এর ঘোড়াদের। দৌড় চলুক। ওঁদের দেখেই ব্যাটন বয়ে চলার এনার্জি সঞ্চয় করুক আগামী। 

15th     July,   2023
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ