বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
চারুপমা
 

হাতে  রইল  পেজলি

অনেকের কাছে নামটি চেনা— পেজলি মোটিফ। অনেকে জানেন আম কলকার নকশা। কীভাবে ঐতিহ্য পেরিয়ে এখনও প্রিয় পেজলি নকশা? লিখেছেন স্বরলিপি ভট্টাচার্য।

চালের গুঁড়ো জলে গুলে তৈরি আলপনার সরঞ্জাম। পুরনো সুতির ছোট্ট কাপড় আঙুলে জড়িয়ে মাঝেমধ্যে বাটিতে ডুবিয়ে নেওয়া। লাল মেঝে ভরে উঠছে সাদা কলকায়। বড় আম আকৃতির কলকার ভিতরে ছোট ছোট হাতের কাজ। ফি বছর লক্ষ্মী বা সরস্বতী পুজোয় বাঙালি বাড়ির দালান, সিঁড়ি, চৌকাঠ সেজে ওঠে শ্বেতশুভ্র সাজে। অনেকটা আমের মতো দেখতে সেই কলকার দেখা পাওয়া যেত আট-নয়ের দশকের বিয়ের কনের সাজেও। কপাল বা গালের চন্দনে থাকত ওই কলকার ছোঁয়া। ঠিক যেন, এক ফোঁটা জল। তার উপরের দিকটা কে যেন বেঁকিয়ে দিয়েছে সামান্য। আকারে বা গঠনে সেই চিরচেনা ভরাট আম কলকার মোটিফেরই পোশাকি নাম পেজলি। যে কোনও ডিজাইনার স্টোরে যার চাহিদা আকাশছোঁয়া।
ইতিহাস বলছে, প্রাচ্যের ব্যাবিলন তথা এখনকার ইরাক পেজলির জন্মস্থান। ২০১৬-এ বিবিসির টিভি সিরিজ ‘সিল্ক রোড’-এ স্যাম উইলস জানিয়েছেন, ইরাকের একটি শহর ইয়াজদ-এ একধরনের ট্র্যাডিশনাল ফ্যাব্রিক তৈরি হতো, যাকে বলা হতো টারমেহ। অর্থাৎ সিল্ক এবং উল দিয়ে তৈরি পোশাক। সেখানে প্রথম শুরু হয় পেজলির ব্যবহার। আর একটি মত ২০০ থেকে ৬৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পারস্যে শুরু হয় পেজলির প্রচলন। 
পারস্যের গাঢ় রঙে বোনা কার্পেট বা রাগ-এ পেজলি ডিজাইনের বহুল ব্যবহার রয়েছে আজও। আবার অনেকে বলেন, প্রাচীন চীনে ধ্যান এবং দর্শনের প্রতীক হিসেবে যে ডিজাইন ব্যবহার করা হতো, পেজলি ডিজাইন তার থেকেই অনুপ্রাণিত। চৈনিক ক্যালিগ্রাফিতেও এই ডিজাইন রয়েছে। আকবরের সময়কালে কাশ্মীরে শালের বুননে পেজলির আধিপত্য চোখে পড়ে। সে সময় পুরুষরাই তা পরতেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে উপনিবেশ গড়ার পর কাশ্মীর থেকে প্রচুর পেজলি শাল ইউরোপে রপ্তানি শুরু করে। সেখানে আবার মহিলাদের এই শাল বেশি পছন্দ হয়। 
ফলত পেজলির ঐতিহ্য দীর্ঘকালের। তা একবাক্যে স্বীকার করে নিলেন মোহর বুটিকের কর্ণধার নন্দিনী বসু। তাঁর কথায়, ‘পেজলির যে মূল ধারা তা থেকে নানাভাবে ভেঙেচুরে ব্যবহার করা হয়েছে নানা জিনিসের উপর। প্রথমত এটা ছিল শুধুমাত্র নানা ধরনের বুননের উপর। বেনারসি শাড়ির যে ঐতিহ্যবাহী আঁচল তার যে কিনার ডিজাইন, অর্থাৎ আঁচলটা যেখানে শেষ হয়ে বডি শুরু হচ্ছে ঠিক তার কর্নারে পেজলি মোটিফগুলো কোনাকুনি বসত। আঁচলেও থাকত পেজলির কাজ। এটা থেকে ভাঙতে ভাঙতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ডিজাইন ব্যবহার করেছেন ডিজাইনাররা। এর জনপ্রিয়তা এখনও অমলিন।’
ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় নন্দিনী দেখেছেন, ভারতকে চিনতে হলে পেজলি মোটিফ দিয়ে চেনেন বিদেশিরা। তিনি বললেন, ‘আমি দেখেছি, বাইরের যে কোনও দেশের লোক ভারতের টেক্সটাইল ডিজাইনে যে নকশার দিকে আগে হাত বাড়ান, তা হল পেজলি। বুনন, প্রিন্ট যাই হোক। একটা মত রয়েছে, পার্সিয়ান কার্পেটের বুনন থেকে কোনও একটা সময় ভারতে ঢুকে পড়ে এই নকশা। দিল্লির রাজদরবারে সেটা এমনভাবে ব্যবহার হয় যে ভারতেরই হয়ে যায় যেন। যদিও এই মত যথার্থ কি না, তা জানি না।’ বাঙালির অন্দরে আলপনা মোটিফে পেজলির ব্যবহারের ইতিহাস শোনালেন নন্দিনী। ‘ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে পেজলির যাত্রা প্রধানত বুননের উপর চলেছে। শান্তিনিকেতনে নন্দলাল বসুর মেয়ে গৌরী ভঞ্জ নানাভাবে পেজলির ব্যবহার করেন আলপনায়। প্রকৃতি থেকেও যেমন নানা জিনিস থাকত তাঁর দেওয়া আলপনায়, তেমনই ঐতিহ্যবাহী পেজলি ডিজাইনের সঙ্গে ফুল, লতাপাতা জুড়েও আলপনার নকশা প্রচলন করেন।’ 
প্যাটার্ন অনুযায়ী আন্তর্জাতিক স্তরে এই ধরনের নির্দিষ্ট কোনও নাম ছিল না। ফ্রান্সে পাল্ম, নেদারল্যান্ডে বোটা, জাপানে পেজুলিয়ান ইত্যাদি নামে ডাকা হতো এই ডিজাইনকে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ১৯৬০ থেকে ফ্যাশন দুনিয়ায় ফের হারানো জায়গা ফিরে পায় পেজলি। দারুণভাবে হয় তার কামব্যাক। যেহেতু বিশ্বের বহু দেশে এর ব্যবহার রয়েছে, তাই এই ডিজাইন যেন বিবিধ সংস্কৃতির ধারক। ২০১০-এর সময়কালে পেজলি নতুন করে সর্বস্তরে জনপ্রিয়তা পেল। শুধু মহিলাদের শাড়ি বা জামা নয়, পুরুষদের শার্ট বা জুতোতেও দেখা গেল এই ডিজাইনের ব্যবহার। ২০২৩-এ ল্যাপটপের ওয়ালপেপার 
বা ফোনের স্ক্রিনসেভারেও এই মোটিফের ব্যবহার দেখা যায়। 
পেজলি আসলে এমন এক ডিজাইন যা বয়স, পেশা বা ব্যক্তিত্বভেদে ভাগ হয়ে যায় না। এই ডিজাইনের সর্বকালীন আবেদন রয়েছে। নন্দিনী বলছিলেন, ‘আমি যখন বাটিক করতাম, পেজলি খুব বেশি করতাম। ব্লক প্রিন্টেও করেছি। জামদানিতেও পেজলির ব্যবহার করেছি। এই তিনটে টেক্সটাইল ডেকরেশন ডিজাইনের মধ্যে পেজলি ব্যবহার করেছি। আসলে ঐতিহ্যকে তুলে ধরার ভাবনায় অধিকাংশ সময়েই নানাভাবে পেজলি উঠে আসে।’ এটাই কি আম বাঙালির চেনা আম কলকার বিস্তৃত রূপ? নন্দিনীর উত্তর, ‘আসলে আম কলকা আমরা বাঙালিরা বলি। তাছাড়া বিভিন্ন আর্টিস্টের হাতে পড়ে পেজলির ফর্মগুলো আলাদা হয়ে গিয়েছে। আম কলকা চালু কথা। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে শাড়ি বিক্রেতাদের কাছে পেজলি কথাটাই শোনা যায়। এখানে কলকা কথাটা শোনা যায় না বেশি। কলকা কথাটা মূলত বাঙালিদের।’
তসর, সুতি, সিল্ক— যে কোনও ফ্যাব্রিকের উপরই আম কলকার ব্যবহার বহুল প্রচলিত। এ নকশায় যেন ধরা পড়ে সেকেলে গন্ধ। বনেদিয়ানার আবহ জুড়ে থাকে সাজের অনুষঙ্গে। যে কোনও চেহারায় তা মানানসই কি? নন্দিনী বুঝিয়ে বললেন, ‘যে কোনও ডিজাইনেরই প্লেসমেন্ট এবং অ্যাপ্লিকেশনের উপর তার ধরন নির্ভর করে। পেজলির একটা লম্বাটে গড়ন হয়। এটি ছোটভাবে বুটির মতো করে ব্যবহার করা হলে সব ধরনের চেহারায় পরতে পারবেন। বড় পেজলি সাধারণত আঁচলে এবং পাড়ে ব্যবহার হতে দেখা যায়। এটা পুরো ট্র্যাডিশনাল নকশা একটা।’ পেজলি নকশা আপনার সংগ্রহে না থাকলে, এবার একটা সংগ্রহে রাখার সময় উপস্থিত। যার ইতিহাস এত সুন্দর, তার বর্তমানকে উপভোগ করুন আপনিও। যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম এই সৌন্দর্যকে রক্ষা করতে শেখে।
শাড়ি: ঐত্রিকা’স উওমেন অ্যাটায়ার
 

8th     July,   2023
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ