একাধারে তিনি বলিউড শাহেনশার নাতনি। এ বাংলার জনপ্রিয় অভিনেত্রী তাঁর প্রিয় ‘নানি’। তিনি অমিতাভ ও জয়া বচ্চনের কন্যা শ্বেতার মেয়ে, নভ্যা নভেলি নন্দা। মাথা ঘামান নারীকল্যাণের মতো সিরিয়াস বিষয়ে। অনলাইনে তাঁর সঙ্গে অকপট আড্ডায় অন্বেষা দত্ত।
দাদু অমিতাভ বচ্চন। দিদা জয়া বচ্চন। মামা অভিষেক বচ্চন। মামী ঐশ্বর্যা রাই বচ্চন। অভিনয়ের দাপট এ পরিবারে শেষ কথা! নতুন প্রজন্মের ব্রিগেডে অমিতাভের নাতি অর্থাৎ শ্বেতার পুত্র, অগস্ত্য নন্দা বলিউডে নাম লিখিয়েছেন সদ্য। নভ্যা নভেলি নন্দার বাবা, নিখিল নন্দার দাদু ছিলেন বলিউডের আর এক স্তম্ভ, রাজ কাপুর। সেদিক থেকে কাপুরদের খানদানি রক্তও নভ্যার শরীরে। গ্ল্যামার দুনিয়ায় প্রবেশের এতরকম পথ খোলা থাকলেও সে ঝলকানি থেকে দূরে থাকতেই আগ্রহী এই তরুণী। উল্টে তিনি নিজের নামের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছেন ‘অন্ত্রপ্রোনারি’-র (অন্ত্রপ্রোনার বা উদ্যোগপতি থেকে উদ্ভূত!) মতো শব্দ। লন্ডনে স্কুলের পড়াশোনা এবং নিউ ইয়র্কে স্নাতক স্তরের পড়াশোনার পরে ২০১৯ সালে স্বেচ্ছাসেবার কাজে তৈরি করেন ‘প্রোজেক্ট নভেলি’ নামে এক সংস্থা। এরপরে হাত দেন আর একটি সংগঠনের কাজে যার নাম ‘আরা হেলথ’। এখানে আছে ১০০-র বেশি স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ এবং কিছু প্রতিষ্ঠান।
কোভিডের সময় থেকে সামাজিক পরিস্থিতি ক্রমশ নেতিবাচক খাতে বইছে দেখে নভ্যা সমাজকল্যাণের কাজে সক্রিয়তা বাড়িয়েছেন দিন দিন। অবসর সময়ে পিয়ানো ছোঁয় তাঁর আঙুল। দাদু অমিতাভ তো বটেই, তাঁর গুণে মুগ্ধ গোটা পরিবার। আর সেটাই তাঁর সবচেয়ে বড় শক্তি, মনে করেন নভ্যা। ২০২১ সালে উত্তরাখন্ডের মুখ্যমন্ত্রী তিরথ সিং রাওয়াতকে এক হাত নিয়ে সংবাদ শিরোনামে এসেছিলেন তিনি। তিরথ দেরাদুনের একটি অনুষ্ঠানে মন্তব্য করেছিলেন— ‘ছেঁড়া (রিপড) জিনস পরা ভারতীয় মহিলারা সমাজ এবং শিশুদের জন্য নেতিবাচক বার্তা বহন করে।’ ওই মন্তব্যের কয়েক ঘণ্টা পরেই রিপড জিনস পরিহিত নিজের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় দিয়ে নভ্যা লেখেন, ‘আমাদের পোশাক বদলে দেওয়ার আগে আপনার মানসিকতা বদলান। এই ধরনের মন্তব্য সমাজে যে বার্তা পৌঁছয়, সেটা বেশি মারাত্মক।’
অভিনয় মন না টানলেও সম্প্রতি দিদা জয়া বচ্চন এবং মা শ্বেতার সঙ্গে এক পডকাস্ট সিরিজে যোগ দিয়েছিলেন নভ্যা। যার নাম, ‘হোয়াট দ্য হেল নভ্যা!’একটি বিশেষ অ্যাপ-এ সম্প্রচারিত সেই পডকাস্টে তিন প্রজন্মের গলায় শোনা গিয়েছিল প্রজন্মান্তরের নানা ভাবনা। ছিল মেয়েদের নিজস্ব বন্ধুতার কথা, বাড়িতে কাটানো মুহূর্তের কথা, বেড়ানোর কথা, তিন নারীর পারস্পরিক নির্ভরতার কথা...। বর্তমানের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বোঝা গেল ২৫-এর তরুণী নভ্যা কতটা পরিণতমনস্ক এবং নিজের লক্ষ্যে কতটা স্থির!
সিরিয়াস সব বিষয় নিয়ে আপনার কাজ। ফ্যাশন বা স্টাইলিং নিয়ে মাথা ঘামান কখনও?
-খুব একটা না। আমাকে দেখলেই সেটা বুঝবেন। সারাদিন ধরে আমায় কাজ করতে হয়। তাই আরামদায়ক কিছু পরতেই পছন্দ করি। ফ্যাশন নিয়ে তেমন ভাবি না। দিনের বেলায় একটা সাদা টিশার্ট, জিনস, স্নিকার্স ব্যস। এমনিতেও খুব সাধারণ সাজগোজই আমার পছন্দ। কী পরব, তা নিয়ে বেশিক্ষণ ভাবার লোক নই আমি! আর কোনও বিশেষ উৎসব থাকলে, যেমন দীপাবলি..., তখন সবাই একটু সাজতে ভালোবাসে। বড় উৎসব। তাই তখন আমারও ভারতীয় সাজ পছন্দ। তখন সবার সঙ্গে মিলে আনন্দ করা, সাজগোজ এসব ভালোই লাগে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? তারকা পরিবারে বড় হওয়ার সুবাদে ফিল্মে মুখ দেখানোর ইচ্ছে হয় না কখনও?
-আমি কিন্তু দিল্লিতে বড় হয়েছি। মুম্বইয়ে নয়। ১৩ বছর দিল্লিতে কেটেছে আমার। জানি না অনেকেরই কীভাবে এই ধারণাটা আছে যে আমি গ্ল্যামার দুনিয়ায় বড় হয়েছি! আমার বাবার দিকের পরিবারের অধিকাংশই ব্যবসায় সফল, কেউ বা আমার মতোই অন্ত্রপ্রোনার। তাই গ্ল্যামার দুনিয়া থেকে অনেক দূরেই থাকতাম আমি। প্রতি গ্রীষ্মের ছুটিতে মুম্বই আসতাম ঠিকই। সেটা আলাদা। কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে আমি বাবার মতোই এগতে চেয়েছি। আমি যেভাবে বড় হয়েছি তাতে এটাই আমাকে উৎসাহ দিয়েছে। এখন বাবার সঙ্গে পারিবারিক ব্যবসার কাজও দেখি। ফলে বিনোদন জগতের তুলনায় এগুলোই আমার কাছে আকর্ষণীয়। এটাই ভালো পারি বলে আমার মনে হয়। অভিনয় বা বিনোদন ঠিক আমার জন্য নয়! এর জন্য আমার কোনও প্যাশন আছে এটা কখনও মনেই হয়নি। আর সেটাই করা উচিত যেটা নিয়ে আমি ১০০ শতাংশ প্যাশনেট। তাই অভিনয়ের কোনও প্ল্যান নেই।
ফিল্ম দেখতে ভালোবাসেন? পরিবারে কে সবচেয়ে প্রিয় অভিনেতা?
-আমার মনে হয় সবাই ফিল্ম দেখতে ভালোবাসে। আমিও বাসি। খুব ভালো লাগে সিনেমা হল-এ যেতে। কখনও বন্ধুদের সঙ্গে, কখনও বা পরিবারের সবার সঙ্গে। আর পরিবারের কাউকে যদি বাছতে হয়, আমি বলব আমার ভাইয়ের (অগস্ত্য) কথা। ওর অভিনয় এখনও কেউ দেখেননি। এবছরেই নেটফ্লিক্সে মুক্তি পাবে জোয়া আখতারের ‘দ্য আর্চিজ’। ওখানেই আপনারা দেখবেন অগস্ত্যকে।
কলকাতায় কবে আসবেন? দাদু-দিদার শহর দেখার ইচ্ছে হয় না?
-খুবই ইচ্ছে। আশা করি কোনও না কোনও দিন সুযোগ হবে নিশ্চয়ই। দিদার দিক থেকে ধরলে আমি তো ওয়ান ফোর্থ বাঙালি! তাই আসব অবশ্যই। বাঙালি মিষ্টি খুব প্রিয়— সন্দেশ। জানি, ওই ভালো মিষ্টিটা কলকাতা এলেই পাওয়া যায়। দাদু-দিদার কাছে তো শুনেছি এ শহরের কথা। আমি চাই এ শহরে আমারও কিছু সুন্দর মুহূর্ত তৈরি হোক। বাঙালি শিকড়টা ঝালিয়ে নিতে চাই তখন!
আপনার কাজের দিকে ফেরা যাক। মহিলাদের স্বাস্থ্য, ক্ষমতায়ন ইত্যাদি বিষয়ে কাজের ভাবনার শুরু কখন?
-বেশ শক্ত প্রশ্ন! কাজ শুরুর ক্ষেত্রে কোনও নির্দিষ্ট মুহূর্ত আমার মনে পড়ছে না। তবে একটা কথা ঠিক, ভারতে বড় হয়ে ওঠা যে কোনও মেয়েই জানে, কী ধরনের বাস্তবের সঙ্গে লড়াই করে প্রতিদিন চলতে হয় তাদের। মানুষজনের কথাবার্তা শুনে এবং তাদের সঙ্গে কথা বলে ক্রমশ আমার মনে হয়েছে অনেক কিছু। আমি কলেজের পড়া শেষ করে মহামারীর সময় যখন এদেশে ফিরলাম, সেই বাস্তবটা চোখের সামনে আরও বেশি প্রকট হয়ে উঠল। মহিলাদের সার্বিক স্বাস্থ্য, ঋতুকালীন সুস্থতা বজায় রাখা ইত্যাদি নিয়ে সাধারণভাবে একটা উদাসীনতা কাজ করে অনেকের মধ্যে। ভারতের অর্ধেক জায়গায় মহিলারা স্যানিটারি ন্যাপকিন পান না, এটা আজও ভয়ংকর বাস্তব। মহামারীর সময় গার্হস্থ্য হিংসাও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। এই খবরগুলো দেখতাম কাগজে। এভাবেই কবে জানি না মনে হল বিষয়গুলো নিয়ে দ্রুত সক্রিয়ভাবে কিছু করা দরকার। কোভিডের সময়েই শুরু আমার স্টার্টআপ ‘আরা হেলথ’ এবং ‘প্রোজেক্ট নভেলি’। দু’টিই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা।
দাদু-দিদা, মামা-মামি সবাই তারকা। এমন পরিবার থেকে এসে ব্যতিক্রমী কাজে নিজেকে সঁপে দেওয়ায় সমস্যা হয়েছে?
-না, সেরকম কিছু হয়নি। বরং যে ধরনের সুযোগ সুবিধা আমি কাজের ক্ষেত্রে পেয়েছি, তার জন্য আমি পরিবারের কাছে কৃতজ্ঞ। ওঁদের সমর্থন, ওঁদের উৎসাহ ছাড়া আমি এগতেই পারতাম না। যে ধরনেরই কাজ করি না কেন, ওঁদের ভরসার হাত আমার মাথায় আছে— এটা আমি সবসময় জানি। আর সেটা প্রকৃতপক্ষে কাজে এগিয়ে যেতেই সাহায্য করে। ওঁরা আমায় এতটাই অনুপ্রেরণা দেন, যে মনে হয় হ্যাঁ, ওঁদের গর্বিত করার মতোই কাজ করছি। এটা আমার মোটিভেশন। মনে হয় ওঁদের জন্যই করছি। আমি নতুন কিছু করছি জেনেও ওঁরা সবসময় পাশে আছেন।
তবে অন্য যে ধরনের সমস্যা হয়, সেটার কথা একটু বলি। আমার বয়স এখন ২৫। আমার সংস্থা যখন খুলি, তখন আমি ২২-এর তরুণী। এইরকম বয়সে নতুন কোনও কাজে কেউ ঝাঁপিয়ে পড়লে যেটা হয়, অনেকেই আপনার লক্ষ্য সম্পর্কে সন্দিহান হবেন। তাঁরা নানা প্রশ্ন তুলতে পারেন। যেহেতু আপনার বয়স কম, তাই অভিজ্ঞতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। এই সমস্যাটার মুখে কিন্তু আমিও পড়েছি। অর্থাৎ বলতে চাইছি শুধু আমি নয়, আমার মতো আরও যারা খুব কম বয়সে নিজ উদ্যোগে কোনও সংস্থা খুলতে চায়, তখনই অসংখ্য প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় তাদের। এই সমস্যাটা এখনও ফেস করছি। আমার মনে হয় এর একটাই সমাধান— নিজের কাজটা ঠিকমতো করে যাওয়া এবং যে কাজটা করছি, তাতে বিশ্বাস রাখা। সেটাই আপনার জবাব হবে।
কাজ করতে গিয়ে কোনও স্মরণীয় অভিজ্ঞতা? মহারাষ্ট্রের গড়চিরৌলির সেই গ্রামটির কথা শুনতে চাই যেটি নিয়ে আপনি দাদুর শো ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’-তে কথা বলেছিলেন...।
-আমার কাছে প্রতিটি দিনই স্মরণীয়। প্রতিদিন নতুন মানুষজনের সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয়। স্বেচ্ছাসেবার মাধ্যমে কতটা প্রভাব ফেলতে পারছি আমরা, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমার কী মনে হয় জানেন? প্রতিদিন যদি অন্তত একজনের জন্যও কিছু করতে পারি, সেটাই অনেক। আমার সংস্থা ঠিক সেই কাজটাই করে। সেটাই আমার কাছে স্মরণীয়।
মহারাষ্ট্রের গড়চিরৌলিতে একটি উপজাতি অধ্যুষিত গ্রামে ছিল আমাদের প্রথম দিককার প্রোজেক্ট। ওখানে দীর্ঘদিন ধরে একটা প্রথা রয়েছে। ঋতুকালীন সময়ে গ্রামের মেয়েদের নিজেদের বাড়িতে থাকা নিষেধ। তাই প্রতি মাসে ওই ক’টা দিন মেয়েরা খোলা মাঠে অস্বাস্থ্যকর জায়গায় থাকতে বাধ্য হন। তাঁদের জন্য না থাকে শুদ্ধ জল, না স্যানিটারি প্যাড। ঠিকমতো খাওয়াদাওয়াও জোটে না। আমাদের সঙ্গে মাঠে নেমে ওই প্রোজেক্টে কাজ করেছিল ‘মুকুল মাধব ফাউন্ডেশন।’ ওরাই আমায় বিষয়টা নিয়ে প্রথম জানিয়েছিল। ধারণাই ছিল না, এখনও এমনটা কোথাও হয়! প্রোজেক্টের নাম ছিল ‘পিরিয়ড পজিটিভ হোমস।’ ওই গ্রামের বাইরে আমরা ছ’সাতটা বাড়ির ব্যবস্থা করেছিলাম। যেখানে ওই সময়টা মহিলারা সুস্বাস্থ্য মেনে ঠিকমতো থাকতে পারেন। কোভিডের সময় থেকেই কাজটা শুরু করেছিলাম। আমি জানি এই ধরনের ‘কুপ্রথা’ শেষ করাই আসল কাজ। কিন্তু প্রাথমিকভাবে আমাদের মনে হয়েছিল, মেয়েদের স্বাস্থ্যরক্ষার দিকে আগে নজর দেওয়া উচিত। কারণ এত পুরনো প্রথা ভাঙতে সময় লেগে যায়। রাতারাতি কারও মানসিকতা বদলে যায় না। ফলে ততদিন পর্যন্ত মেয়েরা এই অসুবিধে সঙ্গে নিয়ে চলবে, এটা কোনও কাজের কথা নয়। এরপর আমাদের লক্ষ্য, গ্রামের বাকিদের বোঝানো যে কেন ওই প্রথা মেয়েদের স্বাস্থ্যের জন্য ঠিক নয়। এটা বারবার করে যেতে হবে।
নিজের প্রজন্মের জন্য কোনও বার্তা? বিশেষ করে মেয়েদের জন্য?
-আগেই কিছুটা এ বিষয়ে বললাম। তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের কেউ কেউ সিরিয়াস না-ও ভাবতে পারেন। কিন্তু আমাদের নিজের কাজের উপর বিশ্বাস রাখতে হবে। অনভিজ্ঞতার জন্য আমরা কখনও থমকে যেতে পারি। কিন্তু আগামীতে ২০-৩০ বছর দেশের জন্য কাজটা আমরাই করব। সেই দায়িত্বটা আমাদের নিতে হবে। কেউ কিছু বলল বলেই আমরা থেমে যাব না। প্রচুর তরুণ তরুণী অসম্ভব ভালো কাজ করছে নিজেদের মতো করে। সেটা করে যেতে হবে। উদ্যোগটা যেন চলতে থাকে। বয়স সেখানে কোনও বাধা যেন না হয়।