পুরনো সব শাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে থাকে অনেক আবেগ। তাকে বাঁচিয়ে রাখার নানা পথ নিয়ে লিখেছেন অন্বেষা দত্ত।
মা-ঠাকুরমার শাড়ি— কথাটা বললেই যেন ঘিরে ধরে একটা ওম। কাছের মানুষের ভালোবাসার। নৈকট্যের সেই ভরসা আমাদের সবসময় ঘিরে থাকুক, কে না চায়? আর সেইজন্যই ট্রাঙ্ক থেকে বের হওয়া মা-কাকিমা-মাসিমা-পিসিমা-জেঠিমা কিংবা দিদা-ঠাকুরমার শাড়ি দেখলে এক নিমেষে মন ভালো হয়ে যায়। মনে হয়, একে আপন করে নেওয়া মানে সেই পাশে থাকা মানুষদেরই আঁকড়ে ধরা। তাঁদের কেউ এখনও আছেন, কেউ বা অনেক আগেই চলে গিয়েছেন। কিন্তু তবু তাঁর যাওয়া তো নয় যাওয়া। থেকে যায় সেই স্নেহের পরশ। ট্রাঙ্কবন্দি পুরনো শাড়ি মুক্তি পেলে বলতে পারে এক একটা পুরনো গল্প।
মাসিমণিকে যেমন দেখেছি অপূর্ব জামরঙা কাঞ্জিভরমের সঙ্গে কেবল একটা হালকা খোপা, সিঁদুরের টিপ আর অল্প সোনার গয়নায় সাজতে। লিপস্টিক-কাজলের বালাই-ই নেই। মেকআপ তো দূর অস্ত তখন। শুধু অপার মায়াভরা চোখ। তার আলগা সাজের ছবি মুগ্ধ করে রেখেছিল আশৈশব। বড় হয়ে বারো হাতের জাদু আপন করে নেওয়ার পরে অনেক সময়েই তো মনে হয়, আহা মাসিমণির মতো যদি সাজতে পারতাম। তাঁর সে জামরঙা শাড়ি যদি আমার হতো! কিন্তু শাড়ির যে গিয়াছে সে দিন...। তার বয়স পঁচিশ পেরিয়েছে। অতএব যৌবন অস্তগামী। তবে পাড়টি এখনও বড় উজ্জ্বল। অন্তত সেটুকুও যদি পেতাম। এই সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কথা বলছিলাম একালের ডিজাইনারদের সঙ্গে। তাঁরা যদি সুলুকসন্ধান দিতে পারেন কিছু। আপনারাও যদি এমন স্মৃতিভরা শাড়ি ফিরে পেতে চান, জেনে রাখুন এখন হল ‘রিভাইভাল’-এর যুগ। অর্থাৎ পুরনোকে ফিরে পাওয়া। পুরনোর মতো করেই। এক্ষেত্রে যদিও কেউ কেউ পুরনো শাড়ি থেকে কিছু ‘মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ’ করার সঙ্গে ‘রিভাইভাল’-কে গুলিয়ে ফেলেন। দু’টি বিষয় সম্পূর্ণ আলাদা। কীভাবে, সেটা বুঝিয়ে বলছি। কিন্তু মোদ্দা কথা হচ্ছে যেটা, পুরনোকে কাছে পেতে আয়োজন এখন বহু রকম। ফাস্ট ফ্যাশন নয়, এসময়ের দাবি রিসাইক্লিং। সেক্ষেত্রে এধরনের পদক্ষেপ আরও প্রাসঙ্গিক।
‘ডিজাইনড বাই সুদেষ্ণা’-র তরফে দেবদত্তা হালদার জানালেন, ‘ধরুন আপনার ঠাকুরমার বেনারসি পরার ইচ্ছে। কিন্তু সেটা জায়গায় জায়গায় ফেঁসে গিয়েছে। কীভাবে পরবেন তাহলে? রিভাইভাল বলে, এখনকার প্রযুক্তি মেনে সেই বেনারসির মতো করে নতুন শাড়ি বুনতে হবে। অর্থাৎ ওই অতীতের মোটিফ, বা পাড়ের নকশা সবই নতুন করে বুনে নেওয়া। ধরে নিন ঠাকুরমার সেই পুরনো শাড়ি সামনে রেখে আপনার কাজটা শুরু হবে। ওই শাড়িটা ব্যবহারের যোগ্য নেই বলেই সেটাকে নতুন বুনটে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা। যাতে তাঁর স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে পারি। আর যেসব শাড়ি ভালো অবস্থায় রয়েছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে ওই শাড়ির সুতোটাকে বা জরিকে বুননে ব্যবহার করে নতুন ফ্যাব্রিকে পুরনো মোটিফ ফিরিয়ে আনা যেতে পারে। সেটাকেও বলা হয় রিভাইভাল। বা বলা ভালো রিক্রিয়েশন— পুনর্নির্মাণ।’
দেবদত্তার মতে, ‘রিভাইভাল নিয়ে একটা ভ্রান্ত ধারণাও কাজ করে। যেমন ঠাকুরমার বেনারসি শাড়ি ছিঁড়ে বা ফেঁসে গিয়েছে। সেই শাড়ির পাড়টা বিষ্ণপুরী কাতান সিল্কে বসানোর ব্যবস্থা করলাম। সেটা কিন্তু রিভাইভাল নয়। সেটা অন্য পথে রিইউজ বা পুনর্ব্যবহার হল।’
রিভাইভাল চাইলেই যে কেউ করাতে পারবেন, এমনটা নয়। কেন? বুঝিয়ে বললেন দেবদত্তা। তাঁর কথায়, ‘এই যে শাড়ি নতুন করে বোনা হচ্ছে, বা পুরনো শাড়ির সুতো ব্যবহার হচ্ছে নতুন শাড়িতে, তা নিয়ে তাঁতি যখন লুম-এ বুনছেন, তখন মাত্র একটাই শাড়ি বোনা কিন্তু শক্ত কাজ। অন্তত দুটো বা পাঁচ-দশটা শাড়ি করতে হয়। লুম-এ ফেলে এভাবে একটা মাত্র শাড়ি বের করাই যায় না। এটা বেশ বড়সড় এবং বিস্তৃত প্রক্রিয়া। আর খরচসাপেক্ষও বটে। এছাড়া সব তাঁতি হয়তো সেই পুরনো নকশা ফুটিয়ে তোলার মতো দক্ষও নন। এমন নানা শর্ত ঘিরে থাকে রিভাইভাল-এর ক্ষেত্রে। তবে কাজটা হচ্ছে। আজকাল খুব চলছে রিভাইভাল বালুচরি। দুটো থ্রেডের মিশেলে দু’রকমের রং এল। তাঁতিরা ফিরিয়ে আনছেন পুরনো নকশাটা। আমরা যেমন বালুচরি শাড়ি বলতেই বুঝি একটা গল্প। বা একটা চরিত্র, যাকে বর্ণনা করা হচ্ছে শাড়ি জুড়ে। সে মহাভারত হোক, রামায়ণ হোক। এবার সেখান থেকে সরে আসি যদি, আরও অতীতে নবাবি আমলে চল ছিল শুধু মোটিফেই নজর, কোনও গল্প বর্ণনা উদ্দেশ্য নয়। ফেলে আসা সেই পেসলি মোটিফে কলকা, ফুল ইত্যাদি সুন্দর নকশার অনুপ্রেরণায় এখনকার বালুচরি হচ্ছে। কোনও গল্প বা মহাকাব্যিক বা পৌরাণিক চরিত্র থাকছে না। তবে এধরনের শাড়ি অনেকটাই দামি। পুরনো দিনে ফেরার তীব্র ইচ্ছে থাকলে তবেই এ শাড়িতে মন দিন। তা না হলে পুরনো শাড়ির আঁচল থেকে ওড়না কিংবা ড্রেস, সালোয়ার, কোট বা জ্যাকেট তৈরি করে নেওয়া— এটা অনেক সহজ পন্থা।’ বলা ভালো, এখন বাণিজ্যিকভাবেও রিভাইভাল-এর কাজ হচ্ছে। তাই শাড়ির দোকানে গিয়ে চাইলে আপনি ফিরিয়ে আনতে পারেন তেমন স্মৃতি। এক্সক্লুসিভ এমন কিছু পেতে পকেটে একটু টান পড়লেই বা ক্ষতি কী!
সহজ পথে কাছের মানুষের প্রিয় শাড়ি আরও প্রিয় করতে তাহলে উপায়? বেনারসি, কাঞ্জিভরম বা ঢাকাই— পুরনো যে ধরনের শাড়ি আপনার কাছে রয়েছে, সেই অনুযায়ী পথ বেছে নিতে পারেন। ‘যেমন কাতান সিল্কের উপর বেনারসির পাড় বা আঁচল বসানো যায় সহজেই। এভাবে মিক্স অ্যান্ড ম্যাচে ধরে নিতে হবে, পুরনো অংশটা অনেকটা অ্যাপ্লিকের কাজের মতো দেখতে লাগবে। সুন্দরভাবে মেশাতে পারলে দেখতে খারাপ লাগে না। তবে বুনন আর কেটে বসানোর মূলগত পার্থক্য থেকেই যাবে। সেটা মেনে নিয়ে এগনই ভালো,’ পরামর্শ ডিজাইনারের। ‘বেনারসির পাড় কেটে তসরেও বসানো যায়, এমন তসর বেনারসি অনেকেই পছন্দ করেন। সিল্কেও তা করা যায়। ঢাকাই শাড়ির ক্ষেত্রে পুনর্ব্যবহার একটু মুশকিল। কারণ এত সূক্ষ্ম সুতো, সমস্যা হতে পারে। সেক্ষেত্রে শাড়ি থেকে শার্ট বা ওড়না বা ড্রেস আলাদাভাবে বানিয়ে নেওয়া শ্রেয়। বা ঢাকাইয়ের পাড়টা অন্যত্র ব্যবহার করা যেতে পারে। কাঞ্জিভরমের ক্ষেত্রেও পুরনো হলে সিল্কটা মূলত নষ্ট হয়, পাড়টা ঠিকঠাক থাকে। ওই পাড়টাই সিল্কে বা তসরে বসানো যায়। অনেকে লিনেনেও ট্রাই করতে পারেন। ফিউশন লুক দেবে,’ জানালেন দেবদত্তা।
‘সেরিনিটি বাই সৈকত’-ব্র্যান্ডের সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘মা-ঠাকুরমার শাড়ি চাইলে নানাভাবে ফিরিয়ে আনতে পারি। পুরনো টাঙ্গাইল বা ধনেখালিকে নতুন করে উইভারদের দিয়ে বানাচ্ছি। ডিজাইনটা একইরকম। তবে একমাত্র উইভারদের পক্ষেই সম্ভব এধরনের শাড়ি সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরা।’
আর একটি উপায় হতে পারে। মায়ের বেনারসি ফেলতে চাই না। স্মৃতিটা রাখতে চাই। তাহলে কী করণীয়? সৈকত জানালেন তিনি ডিজাইনার হিসেবে নিজের মায়ের বউভাতের বেনারসিটাই অন্যভাবে ব্যবহার করার মতো তৈরি করেছেন। ‘হলদে আমরঙা জমিতে বটলগ্রিন পাড়ের শাড়ি সেটি। সঙ্গে ছিল পিওর সিলভার জরির কাজ। সেকালের বেনারসি এমনিতেই একটু ভারী হতো। পাড় ও জমি সংলগ্ন জায়গাটা থেকে শাড়ি ফেঁসে যেতে শুরু করত। জমি হয়তো ভালো আছে। আমার মায়েরটাতেও তেমন হয়েছিল। মনে রাখতে হবে একটা বিষয়। যে শাড়ি রিভাইভ কিংবা রিসাইকেল করতে চাইছি, তার স্ট্রেন্থ কীরকম, সেটা স্পষ্ট বুঝে নিতে হবে। সেটা যদি ভালো থাকে, তাহলে যে কোনও ফ্যাব্রিকে ওটা মানানসইভাবে ব্যবহার করতে পারি। আর ভালো না থাকলে খুব জোরজার করে না করাই ভালো। মায়ের শাড়িটির পাড় ও আঁচল কেটে একটা অফ হোয়াইট কোটা শাড়িতে বসিয়েছিলাম। কোটা শাড়িকে তার আগে টোন অন টোন হালকা সবুজের মিশেল দিয়েছিলাম। বেনারসি পাড় আঁচল বসিয়ে তার সঙ্গে জমিতে একটু কাঁথা আর মিরর ওয়ার্ক করে দিয়েছিলাম। দিব্যি লাগছিল। কোটা শাড়িতে করেছিলাম, কারণ মায়ের শাড়ির পাড়টা খুব ভালো ছিল না। না হলে আরও ভালো শাড়িতে বা তসরে হয়তো করা যেত।’ সৈকতের মতে, ‘অনেকেই চাইলে বালুচরি শাড়িতেও এটা করতে পারেন। তার পাড় আর আঁচল হয়তো ভালো আছে। কোনও সিল্কের থান কিনে সেই পাড়-আঁচল তাতে বসাতে পারেন। সেটার সঙ্গে মানিয়ে যায় এমন রঙে ডাইও করে নিতে পারেন। অথবা ব্লক প্রিন্ট
করাতে পারেন। সারা শাড়িতে মোটিফ করালেন ছোট ছোট। একদম অন্যরকম লুক আসবে। অথচ পুরনোর ছোঁয়াও রইল। কাঞ্জিভরমের হয়তো রংটা ফেড হয়েছে ধোয়াকাচায়। বা দাগ হয়েছে, এমন শাড়ি ফিরিয়ে আনতে কাঁথাকাজে ভরসা রাখতে পারেন। কাঞ্জিভরম বেনারসির মতো হবে। খুব হেভি কাঁথার কাজ রইল। কিংবা ধরা যাক নিজের পুরনো বেনারসি কেউ পরতে পরতে
ক্লান্ত, তার জন্য সেটাকে নবরূপে হাজির করা যেতে পারে। একটা মালবেরি সিল্কে ওই শাড়ির পাড়টা বসিয়ে দেওয়া যায়। তাতে বড় বড় মিরর ওয়ার্ক এবং কাঁথার কাজ করা যায়। পাড়-আঁচল ব্যবহার করলাম বলে বাকি ফেলে দিলাম, তা নয়। অনেক শাড়ির জমি ভালো, পাড় আঁচল নষ্ট হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে সেই জমিতেই কাজ করা যায়। একটা কোনও তসরে লাল-কালো ডাই করে পাড়ে হেভি এমব্রয়ডারি করে দেওয়া যায়। এমন নানা পথ আছে। যে যাঁর পছন্দমতো খুঁজে বেছে নিতে পারেন।’
পুরনোর সঙ্গে নতুন হাত মেলাতে পারে এভাবেই। এমন আদরেই অতীত বেঁচে থাক।
কাহিনি নয়, দুই বালুচরি শাড়িতে রয়েছে অতীতের মোটিফ
মডেল: উদিতা দাস, মেকআপ: সুরজিৎ বারিক
হেয়ার: তনুশ্রী দাস, জুয়েলারি: গয়না বাই সুরজিৎ
শাড়ি: ডিজাইনড বাই সুদেষ্ণা, যোগাযোগ: ৯৯২০৯১০০৮১
ছবি: চারকোল মার্কস (রাজ)