চুলের যত্নে কেরাটিন ট্রিটমেন্ট কেমন কাজে দেয়? বিশেষজ্ঞের পরামর্শ শুনলেন স্বরলিপি ভট্টাচার্য।
‘কুঁচবরণ কন্যা, তার মেঘবরণ চুল’। রূপকথার সেই মেঘবরণ চুলের কন্যার বাস্তবে দেখা পাওয়া কি অত সহজ? একঢাল চুল থাকলে তার যত্নও একশোরকম। তবে চুল ছোট হলেও যত্ন জরুরি। কিন্তু আধুনিকাদের অত সময় কোথায়? কম সময়ে দীর্ঘস্থায়ী যত্নের সুলুকসন্ধানে থাকেন সকলে। এক্ষেত্রে বন্ধু হতে পারে কেরাটিন ট্রিটমেন্ট।
কেরাটিন কী?
হেয়ার এক্সপার্ট অভিরূপ নন্দী জানালেন, আমাদের চুল প্রোটিন দিয়েই তৈরি। কিন্তু প্রতিদিনের দূষণ, জলে ক্লোরিনের আধিক্য, জীবনশৈলীতে নানা চাপের কারণে চুলের প্রোটিন ধীরে ধীরে নষ্ট হতে থাকে। কেরাটিন হল কৃত্রিম প্রোটিন। যে প্রাকৃতিক প্রোটিন চুল থেকে হারিয়ে গিয়েছে, ক্ষয় হয়ে গিয়েছে, সেটা কেরাটিনের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে ফিরিয়ে আনা হয়। ‘সহজ ভাষায়, কোনও পরিচয়পত্র বা নথি আমরা বাঁধিয়ে রাখি জিনিসটা ভালো থাকবে বলে, এটা হেয়ার ল্যামিনেশনের মতো। অথবা নখে রং দেওয়ার পর শেষে যেমন একটা স্বচ্ছ কোট দেওয়া হয় যা নখের রং রক্ষা করে আবার উজ্জ্বলও করে, কেরাটিনও ঠিক সেটাই। চুল যেখানে যেখানে শুষ্ক, ভঙ্গুর, সেখানে এই কৃত্রিম প্রোটিন ক্ষতিপূরণ করে’, বললেন তিনি।
জনপ্রিয় কেন
অভিরূপ জানালেন, যে কোনও দৈর্ঘ্যের চুলে কেরাটিন ট্রিটমেন্ট করা যায়। এছাড়া একমাত্র অপশন হল স্মুদনিং। কিন্তু কেরাটিনের দিকেই নাকি বেশি ঝুঁকে নন্দিনীরা। কারণ? অভিরূপের যুক্তি, ‘স্মুদনিং করানোর পর স্ট্রেটনিং করালে চুলটা সমান হয়ে যায়। চুল থেকে ঘনত্ব চলে যায়। চুলের ঘনত্ব চলে যাক, কেউই চান না। কেরাটিন এই জন্যই একটা ভালো বিকল্প। চুলের ঘনত্ব না হারিয়ে চুল মোলায়েম এবং উজ্জ্বল করা যায়। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে চুলের সমস্যা সকলেরই কম বেশি থাকে। শুষ্ক, উশকোখুশকো চুলে কেরাটিন খুব ভালোভাবে যত্ন করতে পারে।’
গোপন কথা
ইচ্ছে হলে যে কেউ কেরাটিন করাতে পারেন। কিন্তু এর একটা সিক্রেট আছে। আবার প্রযুক্তিগত ব্যাখ্যাও বলতে পারেন। ‘কেরাটিন সবসময় রাসায়নিক ব্যবহৃত হয়েছে এমন চুলের উপর ভালো কাজ করে। অর্থাৎ চুলে যদি কোনওদিন স্মুদনিং, রং না করিয়ে থাকেন সেক্ষেত্রে কেরাটিন চুলে কাজ করবে ঠিকই, কিন্তু রাসায়নিক ব্যবহার করা চুলে বেশি কাজ করবে’, বললেন অভিরূপ। এর কারণ বুঝিয়ে দিয়ে জানালেন, আমাদের চুলের উপরের যে স্তর তা কাচের মতো স্বচ্ছ। কিউটিকেল। রাসায়নিকের ব্যবহার না হওয়া চুলে এই কিউটিকল শক্ত করে বন্ধ করা থাকে। রাসায়নিক ব্যবহার করা চুলে এই কিউটিকল কিছুটা খোলা থাকে। শ্যাম্পু করলে বা চুল ভেজালে কিউটিকলের স্তর কাচের দরজার মতো খুলে যায় ঠিকই, কিন্তু তা রাসায়নিক ব্যবহারের মতো ফলপ্রদ নয়। কিউটিকল খুললে কেরাটিনের ভিতরে যাওয়া সহজ হয়। সাধারণ চুলে তা একটু কঠিন।
পদ্ধতি
অভিরূপ জানালেন, প্রথমে চুল কেমন, তার কী কী সমস্যা রয়েছে, সেটা দেখে নেওয়া হয়। এরপর শ্যাম্পু। এটা চুলের কিউটিকলগুলোকে খুলে দেয় যাতে কেরাটিন ভিতরে যেতে পারে। এটাকে সাধারণত পিএইচ শ্যাম্পু বলা হয়। এতে চুলের পিএইচ স্তর বাড়ানো হয় যাতে কিউটিকলগুলো দ্রুত খুলে যায়। এই শ্যাম্পুটা সাধারণত দু’বার করা হয়। তিন চার মিনিট চুলে শ্যাম্পু রাখা হয়। এরপর ধুয়ে কেরাটিন অ্যাপ্লিকেশন শুরু হয়। চুলের গোড়া থেকে আধ ইঞ্চি ছেড়ে দিয়ে কেরাটিন চুলে লাগানো হয়। ‘কেউ যদি ভাবেন বেশি কেরাটিন লাগালে ফল ভালো হবে, ব্যাপারটা সেরকম নয়। চুল অনুযায়ী লাগাতে হবে। ব্রাশ একবার ডুবিয়ে যতটা প্রোডাক্ট আসছে, সেটাই চুলে লাগাচ্ছি’, বললেন তিনি। এরপর মাসাজ। তারপর সেলোফেনের মতো পরিষ্কার র্যাপ দিয়ে চুল বেঁধে আধ ঘণ্টা রেখে তা খুলে ব্রাশ ড্রাই করা হয়। এরপর ব্রাশ আর ড্রায়ার দিয়ে স্মুদ ব্লো ড্রাই হবে। এসময় অনেক ধোঁয়া বেরতে দেখা যায়। কেন ধোঁয়া? অভিরূপের জবাব, ‘চুল যতটা কেরাটিন নেওয়ার নিয়েছে। বাকি যেটা নিতে পারছে না সেটা বাষ্প হয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে।’ এরপর চুলের পাতলা পাতলা অংশ নিয়ে আয়রন করা হয়। ২০০-২৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকবে তাপমাত্রা।
প্রথম দিনের কাজ শেষ। কেরাটিন করা হয়ে গেলে চুল ফ্ল্যাট এবং স্ট্রেট দেখতে লাগবে। অনেকে ভাবেন, চুলটা কি এরকমই হয়ে গেল? তা নয়। ‘২৪ ঘণ্টা পর ওয়াশ করা হয়। চুলের উপর কেরাটিন বসার জন্য একদিন সময় দেওয়া হয়। এর মধ্যে চুল খুলে রাখতে হবে। ক্লিপ বা হেয়ার ব্যান্ড লাগানো যাবে না। কানের পিছনে চুল দেওয়ার অভ্যেস থাকে অনেকের। এই একদিন সেটাও এড়িয়ে চলতে বলি’, বললেন বিশেষজ্ঞ।
দৈনন্দিনের যত্ন
কেরাটিন চুলে তিন চার মাস পর্যন্ত স্থায়ী হয়। তবে প্রতিদিন কেমন যত্ন করছেন তার উপর এটা নির্ভর করবে। কেরাটিন ট্রিটমেন্টের পর সালফেট এবং প্যারাবেন মুক্ত শ্যাম্পু ব্যবহার করতে হবে। সাধারণ শ্যাম্পু ব্যবহার করলে ফলাফল বেশিদিন ধরে রাখা যাবে না। কন্ডিশনার অথবা হেয়ার মাস্কও জরুরি। এছাড়া ফ্রিজ কন্ট্রোল সেরাম ব্যবহার করতে হবে। শ্যাম্পুর পর চুল টাওয়েল ড্রাই করে মাস্ক লাগাতে হবে। কয়েক মিনিট রেখে সাধারণ জলে ধুয়ে আবার টাওয়েল ড্রাই করে সেরাম লাগাতে হবে। সেরাম চুলের নীচের দিকে লাগানোর নিয়ম। অর্থাৎ মাঝামাঝি থেকে শেষ পর্যন্ত। গোড়ায় নয়। গোড়ায় সেরাম লাগালে তা তৈলাক্ত হয়ে খুসকি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এরপর ড্রায়ার দিয়ে শুকিয়ে নিন। অনেকে চুল ভিজে অবস্থায় বাইরে বেরিয়ে যান, তখনই ধুলো বেশিমাত্রায় চুলে আটকে যায়। তাই সেরাম লাগানোর পর ড্রায়ারের হাওয়ায় হাত দিয়ে ব্রাশ করে নিন।
টোটকা
অভিরূপের মতে, যেদিন চুলে রং করছেন, হাতে সময় থাকলে সেদিনই কেরাটিন করিয়ে নিন। তাতে উজ্জ্বলতা আরও ভালো থাকবে। রং করার কিছুদিন পর কেরাটিন করালে তার মধ্যে যতবার চুল ধোয়া হয়েছে রং কিছুটা করে হালকা হয়েছে। তখন কেরাটিন করালে উজ্জ্বলতার সঙ্গে কোথাও না কোথাও আপস করা হয়। ১০-১২ বছর বয়সের পর থেকে যে কেউ কেরাটিন করতে পারেন। এর কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। তবে সন্তানসম্ভবাদের এটা এড়িয়ে চলাই ভালো। তিন চার মাস পর ফের কেরাটিন না করালে চুল খারাপ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই।
কেশই বেশ। এ কথা নিজের জীবনেও সত্যি করতে চাইলে একবার কেরাটিন ট্রিটমেন্ট করিয়ে দেখবেন নাকি?