অন্বেষা দত্ত: সংসার, বাচ্চা, অফিসের কাজ... তালিকাটা শেষ হওয়ার নয়। কিন্তু সব সামলে মায়েরা নিজেদের দিকে তাকাবেন কখন? তবে এযুগের নতুন মায়েরা অনেকেই সেই মিথ ভেঙে দিচ্ছেন। বাচ্চা সামলে তাঁরা নিজের ত্বক থেকে চুল, বলা ভালো গোটা শরীরের সার্বিক যত্ন নিতে ভুলে যাচ্ছেন না। পাশাপাশি মনের মধ্যে কোনও অপরাধবোধকেও চেপে বসতে দিচ্ছেন না। কীভাবে? মাদার’স ডে-র প্রাক্কালে এ ব্যাপারে কথা হচ্ছিল ‘নিউ এজ মাদার’ তথা অভিনেত্রী কোয়েল মল্লিকের সঙ্গে। সেদিন ছিল ছোট্ট কবীরের দু’বছরের জন্মদিন। শত ব্যস্ততার মধ্যেও চতুষ্পর্ণীর জন্য সময় বের করে কথা বললেন কোয়েল। ব্যস্ত মা কীভাবে সামলে দেন সব কিছু, যেন তখনই স্পষ্ট হয়ে গেল কিছুটা।
মায়ের সঙ্গে ছেলেদের টান আর মেয়েরা ড্যাডি’জ গার্ল— এমনটাই সাধারণত ভেবে থাকি আমরা। কোয়েল বললেন, ‘আমিও সেটার ব্যতিক্রম ছিলাম না। কিন্তু বাবার সঙ্গে যতই জড়িয়ে থাকি না কেন, জানতাম যে কিছু কিছু জায়গায় মা ছাড়া চলে না। এভাবেই মা যে কখন বন্ধু হয়ে গেলেন, নিজেও জানি না।’ যৌথ পরিবারে বড় হওয়ার সুবাদে ঠাকুরমা, দিদা সবার সঙ্গই পেয়েছেন তিনি। প্রত্যেকের মনের উদারতা, আধুনিকতা যেমন দেখেছেন, একইসঙ্গে দেখেছেন নারীর বহুধা বিস্তৃত ভূমিকাও। মায়ের মধ্যেও সেই ছায়াই খুঁজে পেয়েছেন তিনি। কোয়েল বলছিলেন, তাঁর স্কুলশিক্ষিকা মা স্কুলের কাজের পাশাপাশি তাঁকে যেমন পড়াতেন, তেমনই সংসার, শ্বশুর-শাশুড়ির দেখভাল, তাঁর বাবার সঙ্গে কাজ নিয়ে আলোচনা, সবই সামলেছেন। একজন মহিলার যে অসংখ্য ভূমিকা থাকতে পারে, ঠাকুরমা-দিদিমা-মাকে দেখে ছোটবেলাতেই বুঝে গিয়েছিলেন তিনি।
মা মানে তাঁর কাছে আস্থা আর আশ্বাস। কিন্তু যে মা এত কিছু সামলে দেন, তাঁর কথা আমরা কি ভাবি? মাদার’স ডে-র হইচই ছাড়া মায়ের খবর কতটা রাখতে পারি? কোয়েলের স্বীকারোক্তি, ‘একটা বয়স পর্যন্ত সত্যি বুঝতে পারা যায় না। কিছুটা ম্যাচিওরিটির পর সেই ভাবনা আসে। মা কেন সবার খাবার বেড়ে তারপর খেতে বসবেন? পরিণতমনস্ক হওয়ার পরেই এই প্রশ্নগুলো জাগে। মায়েরা এইরকম আত্মত্যাগ করবেন, সেটাই ধরে নেওয়া হয়। তার জন্য তাঁর শরীরে কতটা ক্ষতি হচ্ছে, না তিনি ভাবেন, না বাকিরা। একইসঙ্গে আমার মনে হয়, মহিলাদের ভিতরেও একটা শক্তি থাকে। তাঁরা সব কিছুকে আত্মত্যাগ মনে করেন না, মনে করেন দায়িত্ব। তাই তাঁদের আক্ষেপ তৈরি হয় না। কিন্তু সন্তানের যখন বোঝার মতো বুদ্ধি হয়, তখন সে যেন এটা বলার মতো জায়গায় পৌঁছয়, যে ‘মা সবার শেষে নয়, তুমিও আমাদের সঙ্গেই খেতে বসো।’ সে যেন ভুলে না যায়, মা তাকে কতটা সময় দিয়েছেন। মায়ের মনখারাপ হলে পাশে বসে দুটো কথা বলা, এমন ছোট ছোট অনেক কিছু খেয়াল করতে হয়। মা সারাজীবন আমায় দেখে যাবে, আমি মাকে দেখব না, বুঝব না— এটা যেন কখনও না হয়।’
এযুগে মাতৃত্ব কতটা আলাদা? মা হওয়ার আগে-পরে যে যে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, তার জন্য এখনকার মায়েদের কি আফসোস অথবা হতাশা তৈরি হয়? চেহারাগত দিক বা অন্য শারীরিক জটিলতায় অনেকেরই নানারকম সমস্যা হয়। ‘নিউ এজ মাদার’ হিসেবে কোয়েল কী মনে করেন? তাঁর কথায়, ‘হতাশা তৈরি হতে দেব কেন? বাচ্চাকে পাওয়ার আনন্দের কাছে সব তুচ্ছ। মা হওয়ার আগে বাচ্চার শরীর এবং মায়ের শরীর বুঝে চিকিৎসকই বলে দেবেন কতটা ওজন বাড়লে আপনি ঠিক থাকবেন। আমিও চিকিৎসকদের পরামর্শ মেনে প্রেগন্যান্সির সময় নিয়মিত যোগাসন, মেডিটেশন করতাম। এগুলো মায়েদের জন্য খুবই উপযোগী। আগেকার দিনে হবু মায়েদের বলা হতো শুধু মন খুশি রাখো, তাহলেই বাচ্চা আর নিজেকে ভালো রাখতে পারবে। এখনও সেটা প্রযোজ্য। ভালো বই পড়া, গান শোনা, সিনেমা দেখা সবই জরুরি। কোনও নেতিবাচক প্রভাব নিজের উপর পড়তে না দেওয়ার জন্য যা যা করা সম্ভব, করতে হবে। এতে মা ভালো থাকবেন, বাচ্চারও ভালো হবে।’
কিন্তু মা হওয়ার পরে নিজেকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জায়গাটা কি খুব সহজ? কোয়েল বলছেন, ‘নিজের কথা বলতে পারি। যতদিন ফিডিং মাদার ছিলাম, ততদিন আমি ডায়েট, এক্সারসাইজ-এর কথা ভাবিনি। কারণ প্রায়োরিটি ছিল কবীর। বাচ্চার জন্য যা যা প্রাথমিকভাবে করা উচিত, সব কমপ্লিট করার পরে চিকিৎসকদের পরামর্শ নিয়ে মা হওয়ার সাত মাস পর থেকে ব্যালান্সড ডায়েটে ফিরেছিলাম। তার আগে এসব ভাবিইনি। আমি যে পেশায় আছি, তাতে এটুকু করতেই হতো। তবে ফিটনেস সবারই দরকার। পোস্ট ডেলিভারি ডিপ্রেশন কাটানোর ক্ষেত্রে এটা খুব কাজ দেয়। আমার ডিপ্রেশন হয়নি, কিন্তু জানি যোগাসন, জুম্বা বা কোনও ডান্স থেরাপি এইসময় সাহায্য করে। এগুলোর মাধ্যমেই নিজেকে মোটিভেট করেছিলাম। একেবারেই সহজ রাস্তা নয়। উপর উপর দেখে হয়তো মনে হয়, ও চট করে কী রোগা হয়ে গেল। তা কিন্তু নয়।’ অর্থাৎ নিজেকে ভালো রাখার জন্য এই সময়টা নিজেকে দিতে হবে? তিনি বলছেন, ‘একেবারেই। এটা একেবারেই সংশ্লিষ্ট মহিলার উপর নির্ভর করে। কীভাবে নিজেকে ঠিক রাখব, সেটা সমাজে পাঁচজন কী বলে দিচ্ছে সেটা ভেবে করব না। অনেকেই বলবে ‘এত মোটা হয়ে গেছিস...’, এগুলো পাত্তা দিলে চলবে না। তিনি তখন বাচ্চাকে দেখবেন না এক্সারসাইজ করবেন? এটা একদম সেই মহিলার চয়েস। এগুলো নিজে ঠিক না করতে পারলেই মানসিক চাপ তৈরি হয়। মনে রাখতে হবে, মা ভালো থাকলেই কিন্তু সন্তান ভালো থাকে।’
এখনকার মায়েরা বেশিরভাগই কর্মরতা। কাজে গিয়ে বাচ্চাকে সময় দিতে পারছি না, এমন অপরাধবোধও তাঁদের হয়। তার সঙ্গে কীভাবে লড়াই করবেন? কোয়েলের মতে, ‘শুধু বাচ্চা কেন, কাউকে নিয়েই অপরাধবোধ থাকা উচিত নয়। বাবার মতো মা-ও কাজ করতে যাবেন, এটা তো স্বাভাবিক ব্যাপার। বাবাদের কি অপরাধবোধ হয়? তাহলে মায়ের কেন হবে? প্রত্যেকেই পরিবারকে ভালো রাখার জন্য, নিজেকে ভালো রাখার জন্য উপার্জন করেন। আর একটা বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে আমার মনে হয়। চাকরি ছেড়ে সারাদিন বাড়ি বসে বাচ্চাকে সময় দিলাম, অথচ কাজ করতে পারছি না বলে হতাশায় ভুগলাম। এতে কারওরই ভালো হল না। কাজ করেও বাচ্চাকে কোয়ালিটি টাইম দেওয়া সম্ভব, এটা বুঝতে হবে।’