বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
চারুপমা
 

এল জামদানি দিন

 গরম দিনে আরাম খোঁজার পাঠ শুরু।  বছর জুড়েই যার কদর, বসন্ত পেরিয়ে গ্রীষ্মে তাকে আরও বেশি মনে পড়ে। সেই জামদানির হরেকরকম নিয়ে লিখেছেন অন্বেষা দত্ত। 
মনে পড়ে গত বছর কান চলচ্চিত্র উৎসবের রেড কার্পেটে ঢাকাই জামদানিতে সেজে শোরগোল ফেলে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের অভিনেত্রী আজমেরি হক বাঁধন? কান-এ শাড়ি অতীতেও অনেক অভিনেত্রী পরেছেন। কিন্তু বাঁধনের বেলায় চর্চাটা হয়েছিল ঢাকাই জামদানির জন্যই। ও বাংলা হোক বা এ বাংলা, জামদানি এখন দুই দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্ব জুড়ে। উষ্ণতার পারদ দিনে দিনে জানান দিচ্ছে জামদানি-দিন সমাগত। জামদানি নিয়ে এখন অসংখ্য ডিজাইনার কাজ করছেন। তেমনই তিনজনের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। এ শাড়ির যত্ন নিয়েও জেনে নিলাম বিশেষজ্ঞের কাছে।   

কেন এত জনপ্রিয়
জামদানি শব্দের ব্যাখ্যায় নানা মত। একটি মতে, জামদানি এসেছে ফরাসি শব্দ থেকে। জাম হল পারস্যের একধরনের উৎকৃষ্ট সুতো এবং দানি হচ্ছে পেয়ালা বা বাটি। জাম-কে ধরে রাখে দানি, অর্থাৎ উৎকৃষ্ট সুতো ধারণকারী হল জামদানি।  
শব্দের উদ্ভব না হয় হল। কিন্তু জামদানি, উচ্চারণ একবার শুনলেই যে কোনও শাড়িপ্রিয় নারীর চোখ নেচে ওঠে। সংগ্রহে একখানি জামদানি যার আছে, তার গর্বে মাটিতে পা পড়ে না। আর যার নেই, তার মনে আছে প্ল্যান— অনেক হল, এবার একটা জামদানি না কিনলেই নয়! কি তাই তো? তবে হাত বাড়ালেই জামদানি, এই ট্রেন্ডটা কিন্তু খুব হাল আমলের। হঠাৎ কীভাবে এটা হল?
টেক্সটাইল নিয়ে কাজ করেন জয়িতা সেনগুপ্ত। তিনি বললেন, ‘জামদানি এখন আর শুধু বাঙালির নেই। তার কদর বেড়েছে অবাঙালিদের মধ্যেও। অবাঙালি অভিনেত্রীরাও ফ্লন্ট করছেন বাংলার এই শাড়ি। আমাদের রাজ্যে ফুলিয়াতে জামদানির কাজ কিছু হতো আগে। এখানে লোকে জামদানি বললে দু’-আড়াই হাজার টাকার শাড়িই বোঝে, যেগুলো আসলে মেশিনে তৈরি অথবা সিল্ক মেশানো থাকে। সেই সব শাড়ির ফেঁসে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কটন জামদানি কিন্তু খুব এক্সক্লুসিভ, তার দামও বেশি।’ 
জয়িতা জানালেন, গত দু’বছরে জামদানি আরও দামি হয়েছে। কিন্তু জনপ্রিয়তা কমেনি। বাঙালিদের মধ্যে হয়তো একটি শ্রেণিই বেশি দাম নিয়ে এ শাড়ি কিনতেন আগে। তবে এখন জামদানির জয়যাত্রা সর্বত্র। তাকে শুধু তোলা তোলা করে রাখব কেন? অফিস যাওয়া বা বিয়েবাড়ির পাশাপাশি পার্টির সাজেও জামদানি এখন ভীষণ ইন। ডিজাইনারদের কথাতেই তার প্রমাণ মিলল।  

মোটিফের সেকাল একাল
জামদানি নিয়ে অনেক পরীক্ষা চলছে। সেই ধারার ডিজাইনার সায়ন্তী ঘোষ বললেন, ‘জামদানির সঙ্গে জ্যামিতিক নকশা বা বুটির যোগ বরাবরই ছিল, যা দেখে বড় হয়েছি আমরা। কিন্তু অন্য কিছু করার কথা মনে হয়েছিল। নানারকম ফুল বোনা বা পুরাণ থেকে গল্প তুলে বোনার মাধ্যমে নতুনত্ব আনার চেষ্টা করেছি। জামদানি মানেই অনেকের ধারণা রয়েছে যে এটা সকালে পরার শাড়ি। তা কেন হবে? সকাল বা রাতের যে কোনও অনুষ্ঠানে জামদানি আলো করে থাকতে পারে। গরমকালে যেমন কটন জামদানি, তেমনই শীতে তসরে জামদানিই বা হবে না কেন? পার্টিতে মসলিনের জামদানিও দিব্য লাগে।’ নকশায় ফুলের মধ্যে কৃষ্ণচূড়া, ছোট চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া, নয়নতারা, শিউলি  জামদানিতে এনেছে ‘সায়ন্তী ঘোষ ডিজাইনার স্টুডিও’। ব্লাউজেও জামদানির কাজ করেছেন তিনি। জামদানি শাড়ি ব্লাউজ সেট হয়ে যায় সেক্ষেত্রে। 
‘আসমানি’ ব্র্যান্ডের অরুন্ধতী মৈত্র কটন বা খাদিতে জামদানির কাজ করেন। গরমের দেশে কটনই সবচেয়ে আরামদায়ক বলে সকলে মানবেন। ডিজাইনের দিক থেকে ঐতিহ্যবাহী নকশা অনুসরণ করে ‘আসমানি’। অরুন্ধতী জানালেন, নিজের মায়ের ঢাকাই জামদানি শাড়ির সম্ভার দেখেই এই কাজে উৎসাহ তৈরি হয়েছিল। তাই ঐতিহ্যের অনুসারী তিনি। তাঁর মতে, ‘ঐতিহ্যবাহী মোটিফ সময়ের বাঁধন মানে না।  নিমফুল, জুঁইফুল, বেলকুঁড়ি, কাঁকড়া বুটি ইত্যাদি নকশার আবেদন সবসময়। পাড়ে থাকে আঙুরলতা নকশা, তেরচি বা করাত যা খুবই প্রচলিত। এগুলোতেও তো প্রকৃতিরই ছাপ।’ তাছাড়া প্রকৃতি থেকে অন্য অনুপ্রেরণা খোঁজেন অরুন্ধতী। যেমন মৌমাছি, প্রজাপতি, মাছ, ফুল— এগুলোও আসে তাঁদের জামদানিতে। সঙ্গে থাকে কলকা, আঁচলে জাল মোটিফ ইত্যাদি।   
‘রাতুল দত্ত কলকাতা’— আর একটি ব্র্যান্ড যারা জামদানি নিয়ে কাজ করছে। রাতুলও জানালেন, ‘মোটিফের ক্ষেত্রে জামদানির কিছু নকশা চোখে বসে গিয়েছে। কিন্তু এখন ব্লক, স্ক্রিন প্রিন্ট করে তার ডুপ্লিকেটে ছেয়ে গিয়েছে বাজার।’ তাই জামদানি বোনার সাধারণ প্রযুক্তি এবং তার নিজস্ব মূলগত স্টাইল অটুট রেখে তাঁরা কাজটা করেন। তাঁর মতে, ‘সময়ের দাবি মেনে ঐতিহ্য থেকে কিছুটা সরতে পারি। কিন্তু মোটিফ কখনও এতটা বদলে ফেলব না, যাতে বোঝাই যাবে না যে সেটা জামদানির কাজ।’ 
জয়িতা সেনগুপ্ত বলছেন, ‘নতুন মোটিফ এলেও পুরাতনের কদর কমেনি। পুরনো মোটিফ দিয়েও কাজ হচ্ছে। এক এক প্রজন্মের মাধ্যমে এক এক ভাবে মোটিফ তৈরি হচ্ছে।’ 

রংবেরং, ফ্যাব্রিক
‘আসমানি’ কাজ করে বিভিন্ন রং নিয়ে। তবে একটি জামদানি শাড়ি বা স্টোলে অনেক রঙের সুতোর কাজ অরুন্ধতী করেন না। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর মনে হয় দু’-তিনটির বেশি রঙের কাজ একসঙ্গে ভালো লাগে না। তিনি অফ হোয়াইটে প্রচুর কাজ করেন যা গরমে আরামদায়ক। আছে ন্যাচারাল ইন্ডিগো যা থেকে ব্র্যান্ড-নাম ‘আসমানি’। ব্যবহার করেন সব প্রাকৃতিক ডাই যেমন, মঞ্জিষ্ঠা গাছ থেকে হালকা পিচ রং। রং বেছে নেন হরিতকী, বেদানা, চা থেকেও। চা দেয় সুন্দর বেজ রং। ‘আসমানি’ পুরোটাই প্রাকৃতিক ডাই ও ফাইবারে বিশ্বাসী। তাই শাড়িতে রং কিছুটা কম উজ্জ্বল লাগে, তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ধরে রাখে। ঋতু অনুযায়ী তাদের কাজে পার্পল বা হলুদ আসে, যেমন এখন বসন্তে। শীতে আরও উজ্জ্বল রং। গরমে হালকা। ফাইবারের ক্ষেত্রে তাঁরা তসর, মটকা ও রেশমেও জামদানি কাজ করেন। রয়েছে কালা কটন ও ব্রাউন কটন যা আসলে অর্গ্যানিক কটন, তাতেও জামদানি কাজ তাঁরা করেন। এটা খুব সাম্প্রতিক ট্রেন্ড, বললেন অরুন্ধতী।
জামদানির রঙের ক্ষেত্রে উৎসবের মরশুমে রাতুল দত্ত রাখেন উজ্জ্বল রং বা চিরকালীন লাল-সাদা। গ্রীষ্মে নরম রঙেই জামদানি হয় তাদের। সাদা, হালকা বেজ, হালকা হলুদ, ধূসর— এগুলো মরশুমি গরমকে ঠান্ডা করার রং। শীতে কালো, খয়েরি, ডিপ গ্রে আসে। রাতুল বলছিলেন, ‘জামদানি খুব দামি, সূক্ষ্ম কাজের শাড়ি— এই ধারণায় চললে বছরে এক বা দু’বারের বেশি সেটা পরা যায় না। আমরা চাই জামদানিও রেগুলার ওয়্যার হোক। নিত্য পরুন, আরাম পান। রংগুলোও তাই এমন হবে যে অফিসে বা বন্ধুদের গেট টুগেদারে মানিয়ে যাবে।’ ফ্যাব্রিকে খাদি জামদানি রোজ পরলেও চিন্তা নেই। হাতে কাচায় বাধা নেই। ঢাকাই জামদানি নিয়েও কাজ করেন তাঁরা। বাংলাদেশের তাঁতিদের সঙ্গে। বিরাট যত্ন লাগে সেই শাড়িতে। এটা যেন আলমারিতে রাখা একটা বিশেষ ভালোলাগার মতো।

যত্নে রাখা 
জয়িতা পরামর্শ দিলেন জামদানির যত্ন নিয়ে। তাঁর কথায়, ‘একটা ভালো কটন জামদানি সারা জীবনের সঙ্গী। ঠিকমতো রাখতে হবে তাকে। কাটা ওয়াশ বলে তাঁতিরা একটা ওয়াশ করেন, সেটা করাতে পারলে এই শাড়ি ভালো থাকে। তবে সকলে এই খোঁজ নাও পেতে পারেন। সেক্ষেত্রে ভালো ড্রাই ক্লিন শপ থেকে পরিষ্কার করানো যায় শাড়ি। একটু পুরনো হলে কখনও ঠান্ডা জলে লিকুইড ডিটারজেন্ট দিয়ে হাতে আলতো কেচে নেওয়া যায়। ছায়ায় শুকিয়ে বাড়িতে সাবধানে ইস্ত্রি করে নিলে ভালো থাকে। এ শাড়ির যত্ন বেশি লাগে, তাই আদরে রাখুন, প্রতিদিন পরুন জামদানি।’ 

5th     March,   2022
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ