নতুন বছরে পা রাখতেই আসে নতুন চাওয়া-পাওয়া। নতুন বছরে ফ্যাশন দুনিয়াতেও আসবে নানা বদল। কোথাও নতুন রং। কোথাও পরিবেশবান্ধব ফ্যাব্রিক। বেশ কয়েকজন ফ্যাশন ডিজাইনারের সঙ্গে কথা বলে লিখেছেন অন্বেষা দত্ত।
নতুন বছরে সবই নতুন! এ যেমন ঠিক, তেমনই অতীতের ফ্যাশন স্টেটমেন্টও যে কোনও সময় হয়ে উঠতে পারে প্রাসঙ্গিক। এবছর পোশাক জুতো ব্যাগ কোনটা ফ্যাশনে ইন, তা জানতে আমরা কথা বলেছিলাম ফ্যাশন ডিজাইনারদের সঙ্গে। তাঁদের সঙ্গে কথাবার্তায় বোঝা গেল ২০২২-এর ফ্যাশন কোন খাতে বইবে।
টেকসই, আরামদায়ক
অন্যতম ডিজাইনার অভিষেক দত্ত বললেন, ‘২০২২ সাল নিয়ে ভাবনা কিন্তু আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। আমার মনে হয় পোশাক তৈরির ক্ষেত্রে সাসটেনেবিলিটি (টেকসই হওয়া) একটা বড় ভূমিকা পালন করবে। অনেক ডিজাইনার, অনেক ব্র্যান্ডই এখন সাসটেনেবিলিটি নিয়ে ভাবছেন। জোর দিচ্ছেন, হাতে তৈরি বা হাতে বোনা পোশাকের উপরে। এটা বছর জুড়েই থাকবে।’ রঙের ক্ষেত্রে তিনি বেছে নিলেন ‘প্যান্টন’ কালারসকে। মভ থেকে পার্পলের দিকের রং বছর জুড়ে ছেয়ে থাকবে বলে মনে করছেন তিনি। এর সঙ্গে অভিষেক জোর দিলেন উজ্জ্বল রঙের দিকে। অর্থাৎ ব্রাইট মাস্টার্ড বা অ্যাকুয়া শেড ছুঁয়ে যাবে নানা ধরনের পোশাক। ডিজাইনের ক্ষেত্রে তিনি এগিয়ে রাখছেন অফ শোল্ডার টপ বা কোল্ড শোল্ডার টপস, ট্রিপি স্কার্ট যার নীচটা ফ্লেয়ারড আর উপরের দিকটা তাঁবুর আকৃতির। ‘এই ধরনের ড্রেস এবার ইন,’ বললেন তিনি। পাশাপাশি তিনি প্রাধান্য দিলেন আরামদায়ক পোশাককে যাকে ‘রিল্যাক্সড ক্লোদিং’ বলা হচ্ছে এখন। সময়ের দাবি মেনেই এই ধরনের পোশাক মানুষ বেছে নিয়েছেন। জাম্পস্যুট, ড্রেন পাইপ প্যান্টস অর্থাৎ নীচের দিকে অনেকটা ওয়াইড— এধরনের পোশাক খুঁজছেন মানুষ। কারণ ঘর ছেড়ে বাইরে বেরনোর পালা বাড়লেও আরামের দিকে পাল্লা ভারী এ সব পোশাক কিন্তু বাজারে থাকতেই এসেছে। এর সঙ্গে অনেকের পোশাকের পছন্দ-তালিকায় থাকছে অ্যাসিমেট্রিকাল হেম লাইন বা স্লিভ বা টপ, বললেন অভিষেক। তিনি জানালেন, এমব্রয়ডারির তুলনায় টেক্সচার ও প্রিন্টের ঝোঁক আবার বাড়ছে। অর্থাৎ স্টাইলিশ পোশাক চাই, কিন্ত ভরা এমব্রয়ডারির কাজ নয়।
তৃতীয় ঢেউ খুব চোখ না রাঙালে ফ্যাশন দুনিয়া আবার ছন্দে ফিরে যাবে বলে মনে করছেন তিনি। গত বছরের শেষ থেকেই একটু একটু করে গতি পাচ্ছে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি। ‘গত দেড়-দু’বছর সব বন্ধ থাকায় মানুষ বেরতে পারেননি, সাজগোজ করে সেই যে দেখানোর আনন্দ, সেটাই যেন ভুলতে বসেছিলেন অনেকে। তাই এবার সব ভুলে আবার কেনাকাটায় মন দিতে চাইছেন সবাই। তবে ট্রেন্ড অবশ্যই বদলাচ্ছে। মানুষ এখন ভিন্ন ধরনের পোশাক খুঁজছেন। উজ্জ্বল রং চাইছেন। সঙ্গে নজর দিচ্ছেন অ্যাক্সেসরিজের দিকে।’ মানুষ আশা খুঁজছেন। মনমেজাজ এক নিমেষে উজ্জ্বল করে তুলতে পারে একটা দারুণ ঝকঝকে ব্যাগ। গত দু’বছর বন্দি থেকে মানুষ এখন বাঁধনছাড়া। যে করে হোক, বেরিয়ে পড়তেই হবে, এ ভাবনা তাকে তাড়িয়ে মারছে। সেই সূত্রেই অভিষেক বললেন, ‘টোট বা স্লিং ব্যাগ ভীষণ চলছে। লেদার কাম প্রিন্টিং ব্যাগেরও খুব চাহিদা। এক্ষেত্রেও বোল্ড প্রিন্টের সঙ্গে উজ্জ্বল রং চাইছেন সবাই। আর শ্যু-এর ক্ষেত্রেও হিল নয়, আরাম চাই। তাই স্পোর্টি লেজার শ্যুর বেশি চাহিদা। প্রিন্টেড ফ্যান্সি লোফারসও ইন। এছাড়া চলছে হাই অ্যাঙ্কল বুটস।’
এথনিক শাড়ি ব্লাউজ
‘পরমা’ ব্র্যান্ডের পরমা ঘোষের কথায় জানা গেল, আগের বছর থেকেই নতুন বছরের ট্রেন্ড ধীরে ধীরে তৈরি হয়। এবছরটাও তার ব্যতিক্রম নয়। তাঁর কথায়, ‘একটা পরিবর্তন অবশ্যই আছে। সেটা হল মানুষ কিন্তু এখন ভেবেচিন্তে কেনাকাটা করছেন। যেটা সত্যি দরকার, সেটাই কিনব— এই ভাবনাটা এসেছে। বাইরে বেরনো কমে যাওয়ায় সেটা আরও হয়েছে। বাড়িতে বসে থাকায় আরামকে প্রাধান্য দেওয়ার ভাবনাটা এসেছে।’ এই প্রসঙ্গেই পরমা বললেন, তাঁর কাফতান ব্লাউজের কথা। কাফতান এমনিতে ঢিলেঢালা আরামদায়ক ঠিকই, কিন্তু ব্লাউজের ক্ষেত্রে সেটা লোকে নেবেন কি না, তা নিয়ে সন্দিহান ছিলেন তিনি। কিন্তু সেটাই পছন্দ করেছেন ক্রেতা। তাঁর কথায়, ‘ওই গায়ে চেপে বসে থাকা, ফিটিং ব্যাপারটা অনেকেই চাইছেন না আর। কেউ চাইছেন পাফড স্লিভস। অর্থাৎ একটু ঢিলে ফিটিং চাইছেন। কাফতান ব্লাউজের ক্ষেত্রে সেটাই ফ্যাক্টর হয়েছে। এই ট্রেন্ড ২০২২-এ থাকবে বলেই আমার মনে হয়। মানুষ আরাম খুঁজছেন। আমার জামদানি ব্লাউজেরও বিক্রি বেড়েছে এই জন্যই।’ এর পাশাপাশি ব্লাউজের ক্ষেত্রে লাইনিং দেওয়ার ফর্মুলা পাল্টে ফেলেছেন, জানালেন তিনি। পরমা বললেন, ‘ব্লক প্রিন্ট কাপড় দিয়ে লাইনিং করা হচ্ছে আমাদের ব্লাউজে। এতে সেটা টেকসই হচ্ছে অনেক বেশি। এত ভালো ফ্যাব্রিকে লাইনিং দেওয়া হলে সিল্কের ব্লাউজের ক্ষেত্রেও আরামের জন্য আপস করতে হয় না। মানুষ সন্তুষ্ট হয়েই কিনছেন।’ শাড়ির ক্ষেত্রে তিনি বলছেন, ‘শাড়ি ঘিরে একটা গল্প খোঁজেন অনেকে। এই গল্পটা খুঁজে পেলে বংশ পরম্পরায় সে শাড়ি যত্ন করে রেখে দেওয়ার ভাবনাটাও আসে। আর সেই ভাবনা থেকেই শাড়ি কেনার ঝোঁকটা বাড়ে।’ শান্তিপুরী শাড়িতে কবিতা উইভ করিয়ে তিনি এইজন্যই সাড়া পেয়েছিলেন বলে মত তাঁর। পরমা-র গরদের মাড় ছাড়া উজ্জ্বল রঙের শাড়িও এ প্রজন্মের মেয়েদের পছন্দ হয়েছে। তার পিছনেও রয়েছে আরামের প্রাধান্য। কারণ গরদ বেশিরভাগ সময় খরমর করে, পরতে অসুবিধা— এই ধারণাটাই কাজ করে সকলের মধ্যে। আরামকে গুরুত্ব দিয়ে সেটাই পাল্টেছেন পরমা। তাই তিনি মনে করেন, ২০২১-এর শেষ বেলার এই ট্রেন্ড এ বছরও থাকবে। সারা বছর বাড়িতে থেকে সকলে এখন এইজন্যই ভেবেচিন্তে কেনাকাটা করতে চাইছেন।
গুরুত্ব পরিবেশে
ডিজাইনার দেবারুণ মুখোপাধ্যায় বলছিলেন, ‘ক্যাজুয়ালসে বলতে পারি নটি স্টাইল ফিরছে। ২০০০ সালের গোড়ার দিকে এটা এসেছিল। সেই নটি স্টাইল এবার ফিরছে। লো ওয়েস্ট জিনস, ব্যাগি, মিনি স্কার্ট এগুলোও আবার ফিরছে। লুজ প্যান্টও ফিরছে। নয়ের দশকের শেষ দিকে যেমনটা ছিল।’ তিনিও বললেন, ‘প্রিন্ট নিয়ে এবার মানুষের উৎসাহ বেশি। প্রকৃতি নির্ভর প্রিন্ট লোকে পছন্দ করছেন। আর ফ্যাব্রিকের ক্ষেত্রেও পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই জিনিস সকলে চাইছেন।’ পরিবেশ থেকে দূরে সরে যাওয়া মানুষ এখন পরিবেশে গুরুত্ব দিতে আগ্রহী। তাই তাঁরা খুঁজছেন প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি ফ্যাব্রিক।
এছাড়া উজ্জ্বল রং ফিরে আসার কথা বললেন তিনিও। ব্রাইডাল ওয়্যারের ক্ষেত্রেও এমনটা হচ্ছে বলে জানালেন তিনি। পুরুষদের শেরওয়ানি বা নেহরু জ্যাকেটেও উজ্জ্বল রং এখন।
সাধারণ ট্রেন্ড
যে ধরনের পোশাক নিয়ে এবার ফ্যাশন ট্রেন্ড তৈরি হচ্ছে, তার একটা ধারণা দেওয়া যাক। পুরুষদের ক্ষেত্রে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে কুর্তা শার্ট। শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক স্তরেও নামী ব্র্যান্ডের কাছে এই ধরনের শার্ট গত বছরের শেষ দিক থেকেই বাজার মাতাচ্ছে। আর এই শার্টে ম্যান্ডারিন কলার খুবই স্টাইলিশ। তার সঙ্গে উঠে এসেছে সাঙ্গানেরি প্রিন্ট। রাজস্থানের রাজধানী জয়পুরের দক্ষিণ প্রান্তের গ্রাম সাঙ্গানের। এখানকার হ্যান্ড ব্লক প্রিন্টকেই বলা হয় সাঙ্গানেরি প্রিন্ট। পাঁচ শতাব্দী পুরনো এই প্রিন্ট এখনও তাঁতিদের কাছে প্রিয়।
এখনও ক্রেতার মন ছুঁয়ে আছে ডিজিটাল প্রিন্ট। তা সে শার্টে হোক বা ড্রেস, শাড়ি, কাফতান, জাম্পস্যুট সবেতেই এই প্রিন্ট বেশ নজরকাড়া এখনও। এর পাশাপাশি মান বজায় রেখেছে স্ট্রাইপস। ১৫ বছর আগে যে স্ট্রাইপস সাড়া ফেলেছিল, তা যেন আবার এসেছে ফিরিয়া। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন মানুষের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছে স্ট্রাইপস।
সুদিং কালার, ফ্লোয়িং ফ্যাব্রিক এবং রিল্যাক্সড ফিট-এর পোশাক গত বছর থেকেই ঘোর বাস্তব। এখনও পর্যন্ত সেটাই ফ্যাশনিস্তাদের চাহিদা। আর এই রিল্যাক্সড ফিটের দোসর হয়েছে সলিড কালারস। ওয়ার্কওয়্যার বলুন বা সামাজিক অনুষ্ঠান, সব জায়গায় বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে সলিড কালারস। কেউ সুন্দর দুপাট্টা নিয়ে রঙের সঙ্গে স্টাইলিং করছেন, কেউ আবার পরে নিচ্ছেন একটু ভিন স্টাইলের জুতো। সলিড কালারস-এ কম্বিনেশন ঠিকঠাক হলে তার জবাব নেই।
মাইক্রো জ্যাকেট আর ছোট স্কার্টও চলছে ভালো। যদি ফিরতে চান নয়ের দশকের স্টাইলে, কোমরে বেঁধে নিতেই পারেন চেন বেল্ট বা বেলি চেন। কথায় বলে পুরনো চাল ভাতে বাড়ে। পুরনো ফ্যাশনও ফেলনা নয়! তবে পরিবেশবান্ধব আর টেকসই পোশাকের টানেই মাতবে ২০২২।