বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
চারুপমা
 

গৃহসজ্জায় নতুন রূপ

ফেলে দেওয়া জিনিসকেই একটু অদলবদল করে সুন্দরভাবে সাজানো যায় গৃহকোণ? এখন বহু ইন্টিরিয়র ডিজাইনার তেমনই কাজ করছেন। কেউ আবার গৃহসজ্জায় নতুনত্ব আনছেন অভিনব ধারণা কাজে লাগিয়ে। তেমনই দু’জন মহিলা ইন্টিরিয়র ডিজাইনারের খোঁজ দিলেন কমলিনী চক্রবর্তী।
 
‘পুকুর, মরাই, সবজি-বাগান, জংলা ডুরে শাড়ি,
তার মানেই তো বাড়ি।
তার মানেই তো প্রাণের মধ্যে প্রাণ,
নিকিয়ে-নেওয়া উঠোনখানি রোদ্দুরে টান্‌-টান্‌।’ 

কই না তো। অন্দরসজ্জার এমন চিত্র কোথাও তো চোখে পড়ে না। আসলে যুগটাই বদলে গিয়েছে। তাই বুঝি কবির কল্পনা ফিকে হয়েছে। এখন আর পুকুর-উঠোন সহ বাড়ি কই যে সামান্য এক চিলতে রোদের হাসি তার শোভা বাড়িয়ে তুলবে। এখন বাড়ি মানেই বর্গফুট মাপা ফ্ল্যাট। তার প্রতিটি ঘরও মাপমতো। একচিলতে ফাঁক নেই সেখানে। তবু তারই ম঩ধ্যে সাজ সরঞ্জাম চাই তো। না হলে গৃহকোণের চেহারা খুলবে কী করে? সেই গৃহসজ্জা নিয়েই কথা হচ্ছিল বিশিষ্ট ইন্টিরিয়র ডিজাইনার ও শিক্ষিকা বীণা সহজওয়াল্লার সঙ্গে। মুম্বইয়ের এই ডিজাইনার সবসময়ই নতুনত্বের সন্ধান করেন। বললেন, গৃহকোণের সাজসজ্জার মাধ্যমেই গৃহিণীর ব্যক্তিত্ব ফুটে ওঠে। 

একটি ইন্টিরিয়র ফ্যাশন শো-এ তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল। অন্দরসজ্জা তখনও বড়লোকি কনসেপ্ট। কিন্তু সহজওয়াল্লা তাঁর ডিজাইনের মাধ্যমে সেই পুরনো ধারণাটাই ভাঙার চেষ্টা করছিলেন। ড্রয়িং রুম থেকে কিচেন বা বেডরুম থেকে স্টাডি-ই শুধু নয়। বাড়ির প্রতিটি কোণ সাজিয়ে তোলার মধ্যেও যে একটা সৃষ্টিশীল ভাবনা লুকিয়ে রয়েছে, সেটাই তিনি বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু টানাটানির বাজারে পকেটসই গৃহসজ্জা কি সত্যিই সম্ভব? সহজওয়াল্লার কথায়, পুরনো পোশাক দিয়েও ঘর সাজানো সম্ভব। ফেলে দেওয়া জিনিসকেও সুন্দর করে নতুন মোড়কে মুড়ে নেওয়া যায়। এবং এই যে পুরনোকে নতুন রূপ দেওয়া এই আইডিয়া নাকি বহু আগে থেকেই বিদেশে প্রচলিত। ওদের ‘ডু ইট ইয়রসেল্ফ’ বা ‘ডিআইওয়াই কোর্স’-এও এই ধরনের অন্দরসাজের কথা বলা হয়। তবে সহজওয়াল্লা এই ধরনের কাজের প্রতি আকৃষ্ট হন ইউরোপিয়ান ইন্টিরিয়র ডিজাইনার এমা এলিজাবেথকে দেখে। বললেন একটা ভেলভেট পার্টি গাউনকে কেটে তা থেকে বিভিন্ন সাইজের থ্রো কুশন বানিয়ে তার সঙ্গে সামান্য গোল্ডেন লাইনিং ও ট্রিমের কাজ করেছিলেন এমা। গোটা বসার ঘরের ভোল বদলে গিয়েছিল এমার এই অন্দরসজ্জার ফলে। আর সেটা দেখেই প্রথম এই ধরনের ‘রিসাইকেলড ইন্টিরিয়র’-এর কথা মাথায় আসে সহজওয়াল্লার। তিনি একটা পুরনো রাজস্থানি ঘাগড়া থেকে ওয়াল হ্যাঙ্গিং আর সিলিং ল্যাম্প বানিয়ে ফেললেন। ঘরে একটা এথনিক লুক এল। বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠল ডিজাইন। তারপর এইভাবেই আরও বিভিন্ন ধরনের সাজে সাজিয়েছেন বাড়ি। যেমন একটা ঘরের রঙের সঙ্গে কনট্রাস্ট করে কাপড় কেটে তার ভেতর পাইপ ঢুকিয়ে বইয়ের তাক বানানো। পুরনো জামা থেকে ফ্রিল বা লেসের নকশা এমনকী সুন্দর বোতাম ইত্যাদি কেটে তা ল্যাডারে লাগিয়ে তার সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছেন বিভিন্ন সময়। এমন নানা ধরনের অন্দরসজ্জার নকশা এঁকেছেন যা মধ্যবিত্তের সাধ্যের মধ্যে। 
সহজওয়াল্লার কথায়, ‘বিদেশে ওয়েস্ট একটা বড় সমস্যা। সব জিনিসই যেখানে ইউজ অ্যান্ড থ্রো, সেখানে নতুনের পুরনো হতেও সময় লাগে না। কিন্তু এত জিনিস ফেলবে কোথায়। এদিকে ইয়ার্ড সেল আর ইউজ অ্যান্ড থ্রোয়ের ঠেলায় ডাম্পইয়ার্ডগুলোও উপচে যাওয়ার জোগাড়। আর তখনই অগতির গতি হিসেবে রিসাইক্লিং-এর ভাবনা চিন্তার সূত্রপাত।’ অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের গোটা ডিআইওয়াই ইন্টিরিয়র কনসেপ্টই নাকি রিসাইক্লিংয়ের ভিত্তিতে চলে জানালেন সহজওয়াল্লা। এই বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে এক মজার গল্পও বললেন তিনি। একটা সময় মার্কিন দেশে রিসাইক্লিংয়ের ঝোঁক এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে অনেক কোম্পানি পুরনো জিনিস রীতিমতো চড়া দামে বিক্রিও করতে শুরু করে। এবং অন্দরসজ্জার সমঝদাররা নাকি সেই জিনিসগুলো কিনে নিয়ে নিজেদের ঘর সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন।

শুধু যে বাড়ির অন্দরমহল সাজানোর জন্যই এই ধরনের রিসাইক্লিং করা হয় তা কিন্তু নয়। অনেকে বাড়ির বাইরের দিকেও পুরনো জিনিস রংচং করে টাঙিয়ে ফেলেন। এবং রিসাইক্লিং-এর এই ধারা ক্রমশ আমাদের দেশেও খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তবে তার জন্য একটা শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন। এই বিষয়েই কথা হচ্ছিল কলকাতার কন্যা বিদিশা বসুর সঙ্গে। বরাবরই ঘর সাজানোর প্রতি ভীষণ আগ্রহ ছিল তাঁর। কত কম খরচে কীভাবে নিজের ঘরের চেহারা বদলে ফেলা যায় তাই নিয়েই চিন্তাভাবনায় মগ্ন থাকতেন তিনি। তাঁর শিল্পীর চোখ সব কিছুর মধ্যেই সৌন্দর্য সন্ধান করতে চায়। আর সেই কারণেই সাইকেলের চাকা, ফেলে দেওয়া তোয়ালে সবই তাঁর হাতের ছোঁয়ায় হয়ে ওঠে ঘরসাজানোর টুকিটাকি। ভাবছেন তো কীভাবে? বিদিশা জানালেন, যে কোনও জিনিস ফেলার আগে তা একটু ভালো করে দেখলেই বুঝবেন তার মধ্যে সৌন্দর্য কোথায় লুকিয়ে রয়েছে। আর সেই সৌন্দর্যের সন্ধান একটিবার পেয়ে গেলেই ব্যস, তখন তাকে অন্দরসজ্জায় কাজে লাগানো তো বাঁ হাতের খেলা। কেমন সেই সৌন্দর্য সন্ধান? বিদিশা বললেন, ‘ধরুন একটা কালো, সবুজ বা সাদা ওয়াইন বটল। সাধারণভাবে আমরা ওয়াইন খেয়ে বোতলটা ফেলে দিই। কিন্তু তা না করে যদি একটু ভাবনাটাকে কাজে লাগাই তাহলেই দেখব এই বোতলগুলো বারান্দা থেকে ঝুলিয়ে তাতে ইন্ডোর বা আউটডোর গাছ লাগানো যায়। যদি আর একটু সময় দিতে পারেন তাহলে এই বোতলে একটু রং করে নিন অথবা টোনসুতো বা একটু মোটা থ্রেড দিয়ে ডিজাইন করুন। দেখবেন তারপর তাতে গাছ লাগিয়ে তা ব্যালকনি বা বড় জানালা থেকে ঝোলালে বাড়ির চেহারাই বদলে যাবে। অথবা বাথরুমের জানালার এক কোণে রেখে দিন। সাদা কাচের বোতলে একটু রঙিন পাথর ভরে তাতে মানি প্ল্যান্ট লাগান। উফ, বাথরুমের লুকটাই ভিন্ন হবে।  শুধু ওয়াইনের বোতলই বা কেন? ফেলে দেওয়া রঙের টিনকেও ঘরসজ্জার কাজে লাগিয়েছেন বিদিশা। রঙের টিনের সাইজ ও শেপ অনুযায়ী তাকে কখনও ফুলদানিতে রূপান্তরিত করেছেন কখনও বা তাই দিয়ে ঘরের কোণে আলোর বক্স বানিয়েছেন। পুরনো ট্রাঙ্ক দিয়ে সেন্টার টেবল, শাড়ি কেটে জুড়ে পর্দা, এমনকী ফেলে দেওয়া কার্ডবোর্ড কার্টন রং করে তাকে টয়লেটারি বক্সও বানিয়ে ফেলেছেন বিদিশা। পুরনো জলের বোতল বাতিল না করে বরং তাতে আলো ভরে ঘরকে উজ্জ্বল করে তুলেছেন।           
কিন্তু এই ধরনের ধারণা তাঁর হল কী করে? অনেক অল্প বয়স থেকেই পুরনো জিনিস জমাতেন বিদিশা। এই জমানোর অভ্যাস হয়েছিল নিজের মাকে দেখে। তারপর ক্রমশ ইন্টিরিয়র নিয়ে কাজ করার সময় সেই জমানো জিনিস থেকেই কখনও ফুলদানি, কখনও আলো কখনও বা শোপিস বানিয়ে ফেলেছেন। বললেন, পুরনো টার্কিশ টাওয়েল থাকলে তা সিমেন্টে সেট করে বড় আউটডোর প্লান্টার্স বানিয়ে নেওয়া যায়। সিমেন্ট দিয়ে টাওয়েলে শেপ এনে তা বিভিন্ন রঙে রাঙিয়ে তুললে একেবারে অভিজাত ফুলের টবের মতো লাগে। আবার সাইকেলের চাকা খুলে তার থেকে টায়ার বাদ দিয়ে লোহার স্ট্রাকচারটা রং করে বাড়ির বাইরের দিকের দেওয়ালে বা বারান্দার দেওয়ালে ফিক্স করে নিলে তা-ই হয়ে ওঠে বাড়ির সাজ। কনট্রাস্ট করে কাপড় কেটে জুড়ে শোওয়ার ঘর থেকে ব্যালকনি— যে কোনও দরজার পর্দা হিসেবে কাজে লাগানো যায়। অনেকে আবার একটানা লিভিং রুমে ড্রয়িং এবং ডাইনিংয়ের ভাগ করার জন্যও এই ধরনের পর্দার কারুকাজ করেন। সেক্ষেত্রে একটু ঘরের দেওয়ালের রঙের দিকে খেয়াল রাখা জরুরি। পর্দা আর দেওয়ালের রং যেন মোটামুটি মানানসই হয় সে দিকে একটু নজর দিতে হবে বইকি।
বিদিশা বললেন, ‘মহামারীতে আমার এই রিসাইকেলড হোম ডেকর আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। লোকে দেখছেন এতে খরচ কম অথচ তা দেখতে সুন্দর। আর সবচেয়ে বড় কথা একটু সাহায্য এবং সঠিক পরামর্শ সহ নিজেই এই ধরনের ডিজাইনিং করে ফেলা যায়। ফলে লোকের অন্দরসজ্জার এই ধরনটি বেশ মনে ধরেছে।’ বিদিশাকে দিয়ে রিসাইকেলড হোম ডেকর করাতে চাইলে খরচ মোটামুটি ৩০ হাজার টাকা থেকে শুরু। তবে ফ্ল্যাটের মাপের উপর এবং অন্দরসজ্জার ধরনের উপর খরচ অনেকটাই নির্ভর করে।    
বিদিশার মতোই অল্প বয়স থেকে ঘর সাজাতে ভালোবাসতেন পূজা বিহানী। কলকাতার এই কন্যাটি অবশ্য রিসাইকেলড হোম ডেকর করেন না। বরং অতি সাধারণ স্ট্রাকচারের মধ্যেও অসাধারণ লুক দেওয়াই তাঁর বিশেষত্ব। কলকাতা থেকেই কাজ শুরু করেছেন। তবে এখন তিনি মুম্বই, বেঙ্গালুরুর মতো শহরেও বিভিন্ন বাড়ি ঢেলে সাজানোর কনট্র্যাক্ট নেন। তাই বলে নিজের শিকড়টা ভোলেননি পূজা। বললেন, ‘কলকাতা আমার কাজের অনুপ্রেরণা। এখানে রাস্তাঘাটে, অলিগলিতে আমি আমার কাজের রসদ খুঁজে পাই। কলকাতার মধ্যে এক অন্য ধরনের সংস্কৃতি রয়েছে। আর সেই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলই আমার কাজকে সমৃদ্ধ করে।’ সম্প্রতি বেলেঘাটায় একটা পুরনো বাড়ির ভোল বদলে তা গেস্ট হাউজে রূপান্তরিত করেছেন পূজা। ‘গৃহসজ্জার জন্য একটা দেখার চোখ লাগে। কোথায় কেমন সাজ মানাবে সেই বিষয়ে ধারণা তৈরি করতে হয়,’ বললেন পূজা। সম্প্রতি তিনি একটা দুপ্লে কমপ্লেক্সের অন্দরসজ্জার কাজ করেছেন। তাতে কপারটোন ব্যবহার করেছেন বাড়ির আউটার ওয়ালে। এই তামাটে রঙের ব্যবহারে বাড়িগুলোয় অন্য ধরনের একটা চরিত্র এসেছে। পূজা বললেন, ‘কপার সাধারণত অফিশিয়াল বিল্ডিংয়ে ব্যবহার করা হয়। এবং এই রংটা আমরা কংক্রিটের সঙ্গে একেবারেই ব্যবহার করি না। কিন্তু বাড়ির স্ট্রাকচার দেখে আমার মনে হয়েছিল এতে তামাটে রং মানাবে। এবং হয়েছেও তাই। এই যে কোথায় কেমন রং মানাবে বা কোন দেওয়ালে কেমন সাজসরঞ্জাম ব্যবহার করলে তা চেয়ে থাকবে না — এগুলোই অভিজ্ঞতা। তার সঙ্গে শৈল্পিক চোখ তো আছেই।’  ২০০৬ সাল থেকে নিজের ইন্টিরিয়র ডেকরেশন সংস্থা খুলেছেন পূজা। তার আগে বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে কাজ করতেন। চাকরি ছেড়ে নিজের ব্যবসার কথা ভাবলেন কেন? পূজা বলেন, ‘চাকরিতে সঠিক স্বাধীনতা পাচ্ছিলাম না। নিজের সম্পূর্ণ প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পারছিলেন না। তাই নিজের মতো করে কাজ শুরু করি।’
অন্দরসজ্জার কাজে মেয়েদের ভূমিকা বরাবরই বেশি। বাড়ি সাজিয়ে গুছিয়ে রাখার জন্য যে নৈপুণ্য ও ক্রিয়েটিভ মন প্রয়োজন তা ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের বেশি। কিন্তু আগে শুধু‌ই ঩নিজের গৃহকোণটুকু সাজাতেন মেয়েরা। এখন তাঁরাই দশভূজা হয়ে অন্যের ঘরও সাজিয়ে তুলছেন। শুধু ঘরই বা বলি কেন? বিভিন্ন অফিস স্পেস, শপিং মল বা হোটেলের অন্দরসজ্জাতেও মেয়েদের হাতের ছোঁয়া লক্ষ করা যায় এখন। এই বিষয়ে বিদিশা এবং পূজা দু’জনেই বললেন, অফিস হোক বা বাড়ি, ঘর সাজানো থাকলে মন ভালো থাকে। আর অন্দরসজ্জার মাধ্যমে সেই  মন ভালো রাখার কাজটাই করছেন তাঁরা।       

11th     December,   2021
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ