বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
চারুপমা
 

ফ্যাশনে স্মরণ
সত্যজিৎ রায়

বরেণ্য চলচ্চিত্র পরিচালক, লেখক হওয়ার পাশাপাশি তাঁর প্রতিভা বহুমুখী। বাঙালির গর্বের আর এক নাম, সত্যজিৎ রায়। তাঁর জন্মশতবার্ষিকীতে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে ফ্যাশন দুনিয়াও। সাজপোশাকে কীভাবে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন এই স্রষ্টা, লিখেছেন অন্বেষা দত্ত।

কলকাতার তিনজন ডিজাইনার তাঁদের সৃষ্টির মাধ্যমে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন জনপ্রিয় স্রষ্টাকে— পরমা ঘোষ, গৌরী সাহা এবং অগ্নিক ঘোষ। তাঁরা অনুপ্রেরণা খুঁজে পেয়েছেন সত্যজিৎ রায়ে বিখ্যাত ছবির কোনও মুহূর্ত, বা পোস্টার বা কোনও একটি বিশেষ চরিত্র থেকে। তার সঙ্গে নিজেদের শিল্পভাবনা কাজে লাগিয়ে সত্যজিতের সৃষ্টির মেলবন্ধন তাঁরা ঘটিয়েছেন নানা পোশাকে। বাঙালি সেইসব পোশাক থেকে সত্যজিৎকেই মনে করবেন প্রতিনিয়ত, আশা তাঁদের। 

ডিজাইনের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পেয়েছে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘দেবী’ গল্প অবলম্বনে তৈরি সত্যজিতের জনপ্রিয় ছবিটি। ডিজাইনার অগ্নিক ঘোষের মতে, ‘দেবী’-র মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় আদ্যন্ত বাঙালি নারীর প্রতিচ্ছবি। যে নারী নিজের সত্তাকে আবিষ্কার করলে পরিবারের সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্ব অনিবার্য। সে সাধারণ নারী না কোনও মহিয়সী দেবী? এই প্রশ্নের সঙ্গে মিশে যায় সমাজের কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতার লড়াই। ছবির সেই দ্বন্দ্ব থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই ব্র্যান্ড ‘অগ্নিক কলকাতা’ তৈরি করেছে ‘দ্বন্দ্ব, দ্য কনফ্লিক্ট উইদিন’ পোশাকের রেঞ্জ।’ ছবির সাজপোশাক থেকে প্রভাবিত হয়ে এই ব্র্যান্ডের সৃষ্টিতে এসেছে এথনিক ওয়্যারের এমন একটি সংগ্রহ যা সময়ের দ্বন্দ্বকেই ফুটিয়ে তোলে। লাল আর কালো শেডস-এর যথেচ্ছ ব্যবহার রয়েছে অগ্নিকের কালেকশনে। তার সঙ্গে রয়েছে বেজ আর চন্দনকাঠের নরম রং যা পবিত্রতার সঙ্গে জড়িত এবং লাল-কালোর সঙ্গে একটা স্ট্রাইকিং কম্বিনেশন তৈরি করতে পারে। ছবির দৃশ্য থেকে প্রভাবিত হয়ে এই ডিজাইনার কাঁথাকাজে সুতির ব্লাউজের পিছন দিকে তুলে এনেছেন শর্মিলারূপী দয়াময়ীর মুখের আদল। এর মধ্যে একটিতে আবার রয়েছে মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়া দেবীত্বের যন্ত্রণার মুখচ্ছবি। তার নাম অগ্নিক দিয়েছেন ‘রক্তলেখা’, ১৭০০ সালের রক্ষণশীল বিশপ-দের পোশাকের আদলে তৈরি করা হয়েছে কালো ব্লাউজটি। আর পিঠের দিকের বেজ অংশে রাঙা সুতোয় বোনা ‘দেবী’ লেখা। লেখার ডিজাইনে মনে হচ্ছে তা যেন রক্তে লেখা। শাড়িতে রয়েছে গাঢ় জবাফুলের ছবি। এই সিরিজে পুরুষদের জন্য কুর্তাও বানিয়েছেন অগ্নিক। তার সব ক’টি সৃষ্টিই রঙের বৈপরীত্যে সুন্দর। সঙ্গে রয়েছে মনের মধ্যে চলতে থাকা লড়াইয়ের প্রতিফলন। 

ডিজাইনার গৌরী সাহা সত্যজিতের ছবি ‘পথের পাঁচালি’ থেকে অনুপ্রেরণা খুঁজে পেয়েছেন। শুধু জন্মশতবর্ষ বলে নয়, তিনি এমন কাজ শুরু করেছেন আগে থেকেই। তাঁর আর সন্দীপ সাহার ব্র্যান্ড ‘নক্স দ্য লেবেল’ কখনও শাড়িতে এনেছে ‘পথের পাঁচালি’র প্রভাব, কখনও বা ‘মহানগর’। গৌরী নিজের চোখে ‘পথের পাঁচালি’-র দুর্গাকে অন্যভাবে দেখতে চান। তিনি বলেন, ‘এই দুর্গাকে আমরা কেউ ভয় পাই না। বরং সে আমাদের ঘরের মেয়ে। সর্বজয়া যেভাবে তাকে ভালোবাসেন, হরিহর যেভাবে মেয়ের জন্য স্নেহপরায়ণ বা অপু যেভাবে তার দিদিকে মনে করে— আমাদের কাছে দুর্গা তো তাই। এই দুর্গা অনেক সম্ভাবনার কথা বলেও ‘আশ্বিনের জ্বরে’ ভুগে থমকে যায়। ফিরে যেতে চায় প্রকৃতির কাছে। প্রকৃতিই তার সব। কাশের বিস্তৃত বন, মাঠের ভেতর দিয়ে ট্রেনের ছুটে যাওয়া দেখে দুর্গার দৃষ্টিতে প্রশংসা আর বিস্ময়মাখা। এই দুর্গা বৃষ্টিতে ভিজে নারীত্ব উদযাপনে বিশ্বাসী। এই দুর্গা মাঝপথে আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ায় মন ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। সঙ্গে রয়ে যায় অপু। অপুর চোখেই এবার দুনিয়াটা দেখব আমরা। তাই আমার মনে হয়েছিল দুর্গার জন্য একটা দুনিয়া থাক যেখানে তাকে আশ্বিনের জ্বরে চলে যেতে হবে না। যেখানে অপুর সঙ্গে কাশবন দিয়ে দুর্গা বিস্ময়মাখা চোখে দৌড়বে শুধু  ট্রেনের এক ঝলক দেখতে পাওয়ার আশায়।’ ‘পথের পাঁচালি’র অপু-দুর্গার সেই দৌড়নোর শট থেকে প্রভাবিত হয়ে ওয়াল আর্ট করেছে নক্স। আর দুর্গা-অপুর মুখ নিজের মতো করে এঁকে শাড়িতে ফুটিয়ে তুলেছেন গৌরী। তাঁর তৈরি আর একটি শাড়ির আঁচলে রয়েছে ‘মহানগরে’র আরতিরূপী মাধবী মুখোপাধ্যায়ের ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে নেওয়ার সেই শটটিও। গৌরী ছবির শটটি দেখার পরে নিজের মতো করে এঁকে ফেলেছিলেন সেই মুহূর্তটি। তারপর সেটি প্রিন্ট হয়েছে আঁচলে। 
ডিজাইনার পরমা ঘোষও অনেকদিন ধরেই সত্যজিতের সৃষ্টির অনুপ্রেরণায় কাজ করছেন। ‘দেবী’র পোস্টার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে হুবহু পোস্টার থেকে সরে এসে তার আদলে দয়াময়ীর মুখ তুলে এনেছিলেন শাড়ি ও ব্লাউজে। পরবর্তীকালে একটি বইয়ে খোঁজ পান সত্যজিতেরই করা ‘দেবী’র অব্যবহৃত একটি পোস্টারের। যেটি সত্যজিৎ তৈরি করলেও কখনও কোথাও ব্যবহার করেননি। তাতে দয়াময়ীর মুখ নেই, একটি বড় জবাফুল আর ‘দেবী’ লেখাটি একইভাবে রয়েছে। সেটি থেকে প্রভাবিত হয়ে ‘পরমা’ ব্র্যান্ড কালো সুতির শাড়িতে তুলে এনেছে বড় একটি লাল জবা, যা হ্যান্ড এমব্রয়ডারি ও জামদানি কাজে হয়েছে শাড়ি ও ব্লাউজে। সাধারণত দেবী বলতেই সিনে-পর্দায় দেখা শর্মিলা ঠাকুরের মুখটা মনে পড়ে। তবে শুধু জবা ফুলটির ব্যবহারে কিছুটা ব্যতিক্রমী হয়েছে পরমার সেই শাড়ি।
তাঁর পোশাকে উঠে এসেছে ‘নায়ক’ ছবির শেষ দৃশ্যটিও। সেখানে শর্মিলার মুখে ‘মনে রেখে দেব’ সংলাপটি শুধু নকশায় লিখে তুলে দেওয়া হয়েছে পরমার ব্লাউজের পিছনে। সামনে বুননে করা আছে ফাউন্টেন পেন আর চশমার মোটিফ। যেন সেটি ব্লাউজে গোঁজা। যেমনটা ছবির চরিত্রটিতে দেখা গিয়েছিল। পরমা বলেন, ‘সত্যজিতের যত ছবি দেখেছি, তার মধ্যে ওই দৃশ্যটাই আমার কাছে সবচেয়ে রোম্যান্টিক। তাই সেটা তুলে আনতে চেয়েছি।’ এর পাশাপাশি ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’-তে মেমরি গেম খেলার সময় কাবেরী বসু যে জামদানি শাড়িটি পরেছিলেন, তার পাড়ের আদল আগেই পরমা তুলে এনেছেন ব্লাউজের বর্ডারে, যার নাম দিয়েছেন কাবেরী বসু ব্লাউজ। এবার ‘চারুলতা’ থিমেও ব্লাউড বানিয়েছেন তিনি। ব্লাউজের হাতায় অতীতের মতো ফ্রিল ও লেস দেওয়া। এটিও হাতে বোনা জামদানি দিয়ে। ব্লাউজের নামও চারুলতা। সাদায় লালের কম্বিনেশনে সেটি বাঙালিয়ানায় ভরপুর। ‘চারুলতা’র পোস্টার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আগে শাড়িও করেছেন পরমা। এর সঙ্গেই ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এ শশীবাবুর সেই দুর্গাপ্রতিমা গড়ার দৃশ্যটি তাঁকে প্রভাবিত করেছে। ‘শশীবাবু একটা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। তিনি তাঁর হাতের কাজটা শেষ করে যেতে পারলেন না। এই যে একটা অসম্পূর্ণতা, এটা ভাবিয়েছিল আমায়,’ বলেন পরমা। তাই তার শাড়ির মধ্যেও রয়েছে সেই অসম্পূর্ণতা। ‘ঠাকুর গড়া শাড়ি’ নামে তাতে এমনই একটি দৃশ্য উঠে এসেছে, যা হুবহু ছবির মতো নয়, কিন্তু মনে করায় শশীবাবুকে। শাড়ির নকশাতেও ঠাকুরের মূর্তি গড়া শেষ হয়নি। আঁচলে রয়েছে কুমোরটুলির মানচিত্র, ঠাকুর গড়ার আদত জায়গার ছবি। সত্যজিৎ থেকে অনুপ্রেরণা পেলেন কীভাবে? ‘ছোট থেকে পড়েছি রবীন্দ্রনাথ আর সত্যজিৎ। রবীন্দ্রনাথ গানে-নাটকে বেশি জড়িয়ে যান শৈশবে। তারপর একটু বড় হয়ে কৈশোরে সত্যজিৎকে বুঝতে শেখা। সেই সময় থেকে ফেলুদার পাশাপাশি সত্যজিতের অন্য ছোটগল্প পড়ে মনে হতো, যেন তিনি অনেক কাছের লোক। আমার হল-এ প্রথম দেখা বাংলা ছবি গুপি গাইন বাঘা বাইন। আমাদের জীবনে সত্যজিতের মতো অসম্ভব বুদ্ধিদীপ্ত ব্যক্তিত্বের দ্বারা অনুপ্রাণিত না হয়ে উপায় কী! কেননা বিশ্লেষণী চিন্তা তো মাথায় এসেছে ফেলুদার কাছ থেকেই। কত ছোট জিনিস খেয়াল করা, ফেলুদার চোখ থেকেই তো শেখা। আমার ডিজাইনিং-এর চোখটা যেন তৈরি হয়েছে সেভাবেই,’ বললেন এই ডিজাইনার।
পিতার সৃষ্টির এমন বহুধা বিস্তৃত বিস্তার দেখে অখুশি নন পুত্র সন্দীপ রায়। তাঁর মতে, এ ধরনের কাজ প্রশংসনীয়। তবে ডিজাইনাররা কপিরাইট নিয়ে ওয়াকিবহাল আছেন তো? প্রশ্ন তুলেছিলেন তিনি। ডিজাইনাররা অবশ্য জানালেন, তাঁরা পুরোপুরি অনুকরণ করেননি। বরং তাঁদের কাজে সত্যজিৎ প্রতিফলিত হয়েছেন শুধুমাত্র অনুপ্রেরণা হিসেবে। বাঙালির গর্ব সকলের মনের মণিকোঠায় এভাবেই উজ্জ্বল থাকুন। 

15th     May,   2021
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ