শচীন পাইলট? নাকি ৫০০ টাকায় রান্নার গ্যাস? গত এক মাস ধরে এই দু’টি বিষয় ছাড়া রাজস্থানে ভোটের আলোচনায় অন্য কিছু নেই। রণথম্ভোরে কেল্লার দরজায় দাঁড়ানো গার্ড থেকে জয়সলমিরের সোনার পাথরবাটির দোকান—সর্বত্র এই এক চর্চা। এমনিতে প্রতি পাঁচ বছরে এই মরুরাজ্যে সরকার বদলের একটা ট্রেন্ড রয়েছে। মাঝে কিছু ব্যতিক্রম থাকলেও এটাই এখানকার নিয়ম। মানে, রাজস্থানের লোকজন মনে করেন, পাঁচ বছরে সরকার বদলালে রাজ্যের উন্নয়ন ঠিকমতো হয়। যে পার্টি সরকারে আসে, তারা জানপ্রাণ দিয়ে ভোটারদের মন জয়ের চেষ্টা চালিয়ে যায়। এবারই অঙ্কটা একটু অন্যরকম। সৌজন্যে অশোক গেহলট। অঙ্কটা আগেই বুঝেছিলেন তিনি। তাই সামাজিক প্রকল্প নিয়ে তেড়েফুঁড়ে নেমেছেন ময়দানে। মহিলাদের আর্থিক সাহায্য, অর্ধেক দামে রান্নার গ্যাস, বিদ্যুতে ছাড়, গোশালা... লক্ষ্য ছিল তাঁর একটাই—রাজ্যের একটা ঘরও যেন সরকারি সুযোগ-সুবিধার আওতা থেকে বাদ না যায়। সোজা কথায়, বেনিফিশিয়ারি ভোটটা যতদূর সম্ভব নিশ্চিত করে নেওয়া। শচীন পাইলটের সঙ্গে মল্লযুদ্ধটা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন তিনি। এটাও জানতেন, যেভাবে শচীনের পাকা ধানে মই পড়েছে, মুখ্যমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও এই ভোটে যুবনেতার সাহায্য খুব একটা পাবেন না। শচীন পাইলট দলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা হয়তো করবেন না, কিন্তু নিজের কেন্দ্র ছাড়া বাকি সর্বত্র গা এলিয়ে থাকবেন। অর্থাৎ, দলের একটা বড় অংশ ভোট ‘করানোর’ ক্ষেত্রে গেহলটের পাশে থাকবে না। তাই তিনি জানতেন, নির্বাচনী বাজি হবে সামাজিক প্রকল্পই। হয়েছেও তাই। রাজস্থানের আম পাবলিকের মুখে মুখে আজ শুধুই গেহলটের প্রকল্প। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভাষায় ‘রেউড়ি’। তাহলে কি এবার অশোক গেহলট হেলায় ভোটে জিতে যাবেন? এখানেও চিত্রনাট্যে একটা টুইস্ট আছে।
আমাদের স্বাধীন ভারতে প্রথম বিধানসভা ভোট হয়েছিল ১৯৫২ সালে। আর প্রথম কোন রাজ্যে সেই ভোট হয়? রাজস্থান। মাত্র পাঁচ বছর আগে দেশ স্বাধীন হয়েছে। কংগ্রেস এবং জওহরলাল নেহরুর জনপ্রিয়তা তখন মধ্যগগনে। আর কোনও রাজনৈতিক দল তাদের কয়েকশো যোজনের মধ্যে আসতে পারে, এমনটা মনে হওয়ারও কারণ ছিল না। রাজস্থানের প্রথম বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস জিতল ঠিকই, কিন্তু তাদের রীতিমতো দুশ্চিন্তায় ফেলে দিল নতুন একটি দল—অখিল ভারতীয় রাম রাজ্য পরিষদ (আরআরপি)। ১৪০টি কেন্দ্র, কিন্তু আসন ছিল ১৬০টি। কারণ, ২০টি কেন্দ্রে দু’টি করে আসনে ভোট হয়েছিল। অর্থাৎ, ওই ২০টি কেন্দ্রে জয়ী প্রার্থী ছিল ৪০ জন। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, আরআরপি ১৬০টির মধ্যে জিতেছিল ২৪টি আসন। কংগ্রেস ৮২টি আসনে জিতে সরকার গড়লেও ভোট পেয়েছিল ৩৯ শতাংশ। জনসঙ্ঘ জিতেছিল আটটি আসন। পরিসংখ্যান থেকে পরিষ্কার, হিন্দুত্ববাদী ভোট সেই সময়ও ছিল। এবং নজর করার মতো মাত্রায়। উত্তরপ্রদেশের ব্রাহ্মণ ঘরের সন্তান ছিলেন হর নারায়ণ ওঝা। সংসার ছাড়ার পর তাঁর নাম হয় স্বামী কারপত্রী। এই স্বামীজির হাতেই তৈরি আরআরপি। তখনকার হিন্দু কোড বিলের বিরোধিতা, গোরক্ষা আন্দোলন... এই সবেরই পিতামহ ভীষ্ম তিনি। আর হিন্দুত্বের নামেও যে ভোট টানা যায়, সেটা ওই ৭০ বছর আগে দেখিয়েছিল অখিল ভারতীয় রাম রাজ্য পরিষদ। পরে এই দল মিশে যায় জনসঙ্ঘের সাথে, যা এখন বিজেপি। দলের নাম বদলেছে, বদলায়নি হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি। আর বদলাবেই বা কেন? এ যে চেনা রণনীতি! তাই রাজস্থানে আজও প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার মশলার সঙ্গে মিশেছে হিন্দুত্বের নুন। এটাই চিত্রনাট্যের টুইস্ট। বিজেপি ভাবছে, এই পরিচিত রান্নার সঙ্গে যদি কংগ্রেসের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বটা ঠিকঠাক কাজ করে যায়, তাহলেই রেসিপি হিট। শর্ত একটাই, শচীন পাইলট যেন কোনওমতে গেহলটের হয়ে পুরোদমে আসরে না নামেন। শচীন গুর্জর সম্প্রদায়ের হলেও ওই পরিচয়ে তাঁর কেন্দ্রে ভোট হয় না। তাঁর অনুগামীরাও জাতপাতের পাকানো ঘণ্টের বাইরে বেরিয়ে তাঁকে সমর্থন করেন। ভোটে জেতান এবং শচীন যাঁকে জেতাতে বলেন, তাঁর জন্য জান লড়িয়ে দেন। কংগ্রেসে প্রবীণ ও নবীনের দড়ি টানাটানি যত বেশি থাকে, ততই বিজেপির লাভ। শুধুমাত্র এই অঙ্কেই কিন্তু নানা জনমত সমীক্ষা দাবি করছে, ২০০ কেন্দ্রের রাজস্থানে ১১৪টির মতো আসন বিজেপি পেতে পারে। সেক্ষেত্রে কংগ্রেসের ৭০ পেরনোর কথা নয়। কিন্তু সত্যিই কি তা হবে? গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের পাহাড়প্রমাণ চাপ কি গেরুয়া শিবিরেও নেই?
নামটা বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়া। গোয়ালিয়রের রাজকুমারী, দু’বারের মুখ্যমন্ত্রী, একবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং রাজস্থানে বিপুল জনপ্রিয় নেত্রী। তিনি আজও সভা করতে গেলে বজরং দল বা গেরুয়া বাহিনী তাঁর জন্য অপেক্ষা করে না। বরং স্কুলের ছাত্রছাত্রী, সদ্য স্টার্ট আপ শুরু করা কিছু তরুণ-তরুণী, দিনমজুররা বসুন্ধরা রাজের প্রচারের সঙ্গী। তাঁরা এখনও বিশ্বাস করেন, বিজেপি জিতলে বসুন্ধরাই এ রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা ধরেন। নরেন্দ্র মোদি নন, কারও মুখ দেখিয়ে যদি গেরুয়া শিবির রাজস্থানে বাজিমাত করতে পারে, তাহলে তিনি বিজয়া রাজে সিন্ধিয়ার মেয়ে। তাহলে তিনিই আজ লাস্ট বেঞ্চে কেন? আসলে ঔদ্ধত্য মোদি জনতা পার্টির সব সময়ের সঙ্গী। নরেন্দ্র মোদির থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এই ভূভারতে কেউ নেই, থাকতে পারেও না। ঠিক যে কারণে শিবরাজ সিং চৌহান পিছনের সারিতে চলে গিয়েছেন। ঠিক যে কারণে বসুন্ধরা রাজে নামে এক ডাকসাইটে মহিলা বিজেপিতেই তাঁর অস্তিত্ব হারাতে বসেছেন। তবে প্রধানমন্ত্রী হয়তো ভুলে যাচ্ছেন, গেরুয়া পরিহিতদের লাগাতার গ্যাস খাওয়ানো কমে গেলেও এই সিন্ধিয়ার দাপট এতটুকু কমেনি। অন্তত তাঁর এলাকায়। প্রচার তিনি এখনও চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে শুধু তাঁর নিজের জন্য, অনুগামী এবং বিশ্বস্তদের জন্য। মরুদেশে বিজেপির অভ্যন্তরীণ উত্তাপ তাঁকে যত কঠিন করে তুলছে, ততই ভিড় বাড়ছে তাঁর সভায়। যোগী আদিত্যনাথ বা হিমন্ত বিশ্বশর্মার জনসভাও বসুন্ধরার জনপ্রিয়তার ধারকাছ পর্যন্ত পৌঁছতে পারছে না। প্রতিপক্ষের থেকে বাড়তে হলে তাঁকে মেরেই যে এগতে হবে, তা নাও হতে পারে। সমান্তরালভাবে প্রতিপক্ষের থেকে এগিয়ে যাওয়া মানেও সেটা ওস্তাদের মার। বসুন্ধরা রাজে সেটাই করছেন। এবার প্রশ্ন হল, সাধারণ এলেবেলে মানুষ এই ফর্মুলাটা বুঝছে, আর মোদিজি টের পাচ্ছেন না? তিনিও বুঝছেন। বিলক্ষণ বুঝছেন। তারপরও তাহলে কেন বসুন্ধরার সামনে থেকে বিজেপি ‘ব্যারিকেড’ সরাচ্ছে না?
নরেন্দ্র মোদি জানেন, প্রচারের বাঘের পিঠে সওয়ার তিনি হয়ে পড়েছেন। এখন হার-জিত, সবেরই দায় ও দায়িত্ব তাঁর। জিতলে সবাই বলবে, ওই তো মোদিকে দেখে ভোট হয়েছে। এ আর নতুন কী! আর হারলে? মোদি ম্যাজিক শেষ। অর্থাৎ, নরেন্দ্র মোদির উভয় সঙ্কট। বাঘের পিঠে চড়ে থাকা মুশকিল। আর নেমে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে বাঘে খাবে। উপায়? এসপার-ওসপার। ২০২৪ সাল পর্যন্ত এমনটাই বজায় রাখতে হবে। এটা তাঁর শেষ সুযোগ... ইন্দিরা গান্ধীর সমকক্ষ হওয়ার। ইন্দিরা গান্ধীর অবশ্য একটা ক্রিকেট বিশ্বকাপও ছিল। সেটা আর নরেন্দ্র মোদির হল না। তাঁর নামাঙ্কিত সাধের স্টেডিয়ামে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হারল ‘ইন্ডিয়া’। শেষ চেষ্টা, তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়া। যে কোনও মূল্যে এই ফ্রেমটা তাঁর ড্রইং রুমের দেওয়ালে চাই। কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। দেশের আনাচে কানাচে, রাজধানীতে। ব্লু প্রিন্ট তৈরি হচ্ছে রেউড়ির। কীভাবে মানুষকে আরও পাইয়ে দেওয়া যায়, চলছে তার হিসেব। গত কয়েক বছরে তেল-গ্যাস, আয়করে যা বাড়তি লাভ হয়েছে, তেমনই হাজার হাজার কোটি টাকার তহবিলের তালা খুলছে এবার মানুষের জন্য। থুড়ি, ভোটের জন্য। চব্বিশ হয়ে উঠেছে মোদিজির জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বছর। তবে আগে খানিক ওয়ার্ম আপ প্রয়োজন... পাঁচ রাজ্যের ভোটে।
মোদিজি হয়তো ভাবছেন, রাজস্থানের মানুষই প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার অঙ্কে তাঁকে জিতিয়ে দেবেন। তার উপর ‘লাল ডায়েরি’ দেখিয়ে বড়সড় দুর্নীতির ভান্ডা ফোঁড় হয়েছে বলে মনে করছে তাঁর দল। সত্যিই কি তাই? আসলে ইডি, সিবিআই, দুর্নীতি নামক বিষয়গুলি সমাজের উচ্চস্তরের কাছে চায়ের সঙ্গে ‘টা’য়ের মতো। ভোটার লিস্টে এঁরা কতটা জায়গা নিয়ে থাকতে পারেন? ৩ শতাংশ? ৫ শতাংশ? এর বেশি কি হবে? বাকি ৯৫ শতাংশই কিন্তু খেটে খাওয়া মানুষ, কিংবা অশোক গেহলটের বেনিফিশিয়ারি। মোদিজি যাই ভাবুন, সহজে এই রাজ্য তাঁর দল পাচ্ছে না। তবে রাজস্থান যে হাড্ডাহাড্ডি হতে চলেছে, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। শেষ লগ্নের কোনও ‘স্কুপ’ ভোটের বলটাকে বাউন্ডারির ওপারে নিয়ে ফেলবে। এখন অপেক্ষা হল, কার হাত থেকে বেরবে সেই শট? মোদিজি? নাকি শচীন পাইলট?