একজন ইংরেজি শিক্ষক যদি তাঁর ক্লাসে ‘অতিশয়োক্তি’ শব্দটি উদাহরণসহ ব্যাখ্যা করতে চান, তবে গত সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বুলেটিনে উল্লেখিত নীচের বাক্যটিই সেরা: ‘সবচেয়ে শক্তিশালী দেশগুলির নেতারা, দেশভিত্তিক গোষ্ঠীগুলি এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি নতুন দিল্লিতে সমবেত হওয়ার কারণে গত মাসে পৃথিবীর ভরকেন্দ্র স্থানান্তরিত হয়ে গিয়েছিল ভারতে।’
আরবিআইয়ের মতে, পৃথিবীর ভরকেন্দ্র রোম (২০২১) থেকে বালি (২০২২) থেকে নতুন দিল্লিতে (২০২৩) স্থানান্তরিত হয়েছে। এটি ২০২৪ সালে স্থানান্তরিত হবে রিও ডি জেনেইরোতে। ভরকেন্দ্রটি নতুন দিল্লিতে স্থানান্তরিত হওয়ার ফলে আমরা কম্পনও অনুভব করেছি: মণিপুরে আগুন জ্বলা শুরু হয়েছিল গত ৩ মে। সেখানে আগুন এখনও নেভেনি। কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদী হামলা বারংবার হচ্ছে। ভূমিধস ও বন্যায় ধ্বংস হচ্ছে হিমাচল প্রদেশ এবং আরও একাধিক রাজ্য। এআইএডিএমকে তামিলনাড়ুতে তাদের জোট থেকে বিজেপিকে বাদ দিয়ে দিয়েছে কোনওরকম সৌজন্য ছাড়াই!
জুমলা প্যারেড
পৃথিবীর ভরকেন্দ্র ভারতে স্থানান্তরিত হওয়ার ফলে আমরা আরও কিছু ঘোষণা এবং ঘটনা আশা করতে পারি। ২০-২১ সেপ্টেম্বর একটি ঘটনা ঘটেছে: মহিলা সংরক্ষণ ‘জুমলা’ বিল সংসদে পাস হয়েছে। ২০২৯ সালের পরে যে নির্বাচন হবে এটি সেখানে বাস্তবায়িত হতে পারে। আর যেসব জুমলা ‘যন্ত্রস্থ’ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুটি হল—‘ওয়ান নেশন ওয়ান ইলেকশন’ (ওএনওই) এবং ‘ইউনিফর্ম সিভিল কোড’ (ইউসিসি)। ওএনওই পরিকল্পনা (কোবিন্দ কমিটি বনাম আইন কমিশন) এবং অভিন্ন দেওয়ানি বিধির খসড়ার (উত্তরাখণ্ড বনাম অসম বনাম মধ্যপ্রদেশ) মালিকানা নিয়ে অবশ্য তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে।
এদিকে, ‘ধর্মান্তরণ’ এবং ‘লাভ জিহাদ’-এর ক্রমবর্ধমান ঘটনাগুলি নিয়ে আরএসএসের সরসঙ্ঘচালক (নেতা) মোহন ভাগবত উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। আরএসএস সদস্যদের উদ্দেশে তাঁর নির্দেশ, এসবের মোকাবিলা করতে হবে ‘আক্রমণাত্মকভাবে’। অতএব গির্জা, যাজক, ধর্মপ্রচারক এবং খ্রিস্টান প্রার্থনা সভায় আক্রমণের জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখুন। অল্পবয়সি ভিন্নধর্মের দম্পতিদের নৈতিক-ধর্মীয় ব্রিগেড থেকে সাবধান থাকা উচিত, কারণ হিন্দু মেয়েদের ‘সম্মান’ রক্ষায় ব্রতীদের ছোঁ তাঁদের উপর যেকোনও সময় নেমে আসতে পারে। (আমি এটাও ভাবছি যে, অ-হিন্দু মেয়েদের সঙ্গে যেসব হিন্দু ছেলেকে পাওয়া যায় তাঁদের ‘সম্মান’ রক্ষা করবে কে?)
প্রমাণ দাও
ধর্মান্তরণ ও লাভ জিহাদের এসব অপ্রমাণিত অভিযোগে আমি হতবাক। হাজার হাজার ছেলেমেয়ে খ্রিস্টানদের দ্বারা পরিচালিত স্কুল ও কলেজে পড়ে (কারণ তারা সেরাদের অন্যতম)। অনুগ্রহ করে জিজ্ঞাসা করুন, তাদের মধ্যে ক’জনকে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করার অপচেষ্টা হয়েছে? অনুগ্রহ করে নিজেকেও প্রশ্ন করুন, গত একবছরে আপনার শহরে কিংবা গ্রামে কতগুলি ভিন্নধর্মে বিবাহ হতে দেখেছেন? নারায়ণ মূর্তির একটি বিখ্যাত উক্তি মনে পড়ে যায়, ‘আমি ভগবানে বিশ্বাস করি; অন্যসব কিছুর জন্য আমার কাছে ডেটা বা তথ্য আনুন।’ আরএসএস প্রধান কি ধর্মান্তরণ এবং লাভ জিহাদের ব্যাপারে আমাদের প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য দেবেন?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করেছেন। তিনি দাবি করেছেন, ‘সনাতন ধর্ম’ আক্রমণের শিকার। মোহন ভাগবত আরএসএসের অস্ত্রাগার থেকে ‘ধর্মান্তরণ’ এবং ‘লাভ জিহাদ’ নামক দুটি মহাস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে ‘উপহার’ হিসেবে উপস্থাপন করা হবে মহিলা সংরক্ষণ বিলটিকে (যদিও এটি একটি দেউলিয়া ব্যাঙ্কের পোস্ট-ডেটেড চেক ছাড়া কিছু নয়)। এইসঙ্গে আরও একটি কাজ করা হবে—জি-২০ সম্মেলনের ভিডিও ও ছবিগুলি খোলাখুলি ও বাধ্যতামূলকভাবে ভিস্যুয়াল এবং সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে সম্প্রচার করা হবে, যাতে বিশ্বের দরবারে ভারতকে ‘বিশ্বগুরু’ প্রতিপন্ন করা যায়।
ঐক্য এবং এজেন্ডা
উল্টোদিকে, আইএনডিআইএ (ইন্ডিয়া) শরিকরা যেসব ইস্যুকে প্রাসঙ্গিক মনে করে এবং যেগুলির দ্বারা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা প্রভাবিত হয়, সেগুলিই গ্রহণ করার জন্য তৈরি হচ্ছে তারা। এগুলির মধ্যে রয়েছে মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক সংঘাত, ঘৃণার ভাষণ এবং ঘৃণামূলক অপরাধ, স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের মতো বিয়য়গুলি। স্বাধীনতার ইস্যুগুলির মধ্যে রয়েছে বাকস্বাধীনতা, রাজ্যগুলির অধিকারে হস্তক্ষেপ, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার অবক্ষয়, সংবিধানের উপর আক্রমণ ও আদালত বা বিচারব্যবস্থাকে দুর্বল করার মতো বিষয়গুলি। ‘ইন্ডিয়া’র নজরে গুরুত্বপূর্ণ অন্য ইস্যুগুলি হল—চীনা অনুপ্রবেশ, সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ, মন্থর অর্থনৈতিক বৃদ্ধি, বেড়ে চলা বৈষম্য, যোগসাজশের পুঁজিবাদ (ক্রোনি ক্যাপিটালিজম), কল্যাণমূলক ব্যবস্থায় কাটছাঁট, জাতীয় ঋণবৃদ্ধি, গোয়েন্দা ও তদন্তকারী সংস্থাগুলির অপব্যবহার, সংসদীয় প্রতিষ্ঠান ও রীতিনীতিগুলির গুরুত্ব হ্রাস, ক্রমবর্ধমান কেন্দ্রিকতা এবং কর্তাব্যক্তির মহিমা প্রচারের সংস্কৃতি। অর্থ, পেশি এবং আইনের অপব্যবহারের মাধ্যমে বিরোধীদের আক্রমণকে ভোঁতা করে দিতে মরিয়া বিজেপি।
অর্থনৈতিক দুর্দশার লক্ষণ এবং সেসব মোকাবিলায় সরকারের ব্যর্থতার দিকগুলি এবার সামনে আনা যাক।
বেকারত্ব: ২০২৩ সালের আগস্টে বেকারত্বের হার ছিল ৮.১ শতাংশ। যুবদের (১৫-২৪ বছর) মধ্যে বেকারত্বের হার ২৩.২২ শতাংশ ছিল ২০২২ সালে। স্টেট অফ ওয়ার্কিং ইন্ডিয়া ২০২৩ রিপোর্ট অনুসারে, স্নাতকদের মধ্যে এটি ছিল ৪২ শতাংশ। ২০২৩ সালের আগস্টে, মনরেগার (১০০ দিনের কাজের গ্যারান্টি প্রকল্প) অধীনে কাজের দাবি জানিয়েছিল ১ কোটি ৯১ লক্ষ ৬০ হাজার পরিবার।
দাম ও মুদ্রাস্ফীতি: রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বুলেটিন অনুসারে, ২৩ আগস্ট সিপিআই মুদ্রাস্ফীতি ছিল ৬.৮ শতাংশ, জ্বালানি ও আলোর জন্য মুদ্রাস্ফীতি ছিল ৪.৩ শতাংশ। অন্যদিকে, ৯.২ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি ছিল খাদ্যদ্রব্যের ক্ষেত্রে। ৬ শতাংশের যে সহনশীলতার সীমা ধরা হয়েছে, সিপিআই মুদ্রাস্ফীতি ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে তার উপরে রয়েছে।
গৃহস্থালির আর্থিক পরিস্থিতি: জিডিপির শতাংশ হিসেবে পারিবারিক আর্থিক সম্পদ ২০২০-২১ অর্থবর্ষে ১৫.৪ শতাংশ ছিল। সেটি ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে ১০.৯ শতাংশে নেমে এসেছে। একই সময়ে, পারিবারিক আর্থিক দায় ৩.৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫.৮ শতাংশে পৌঁছেছে। নিট আর্থিক সম্পদের ১১.৫ শতাংশ থেকে অতিদ্রুত ৫.১ শতাংশে পতন ঘটেছে।
শীর্ষ তিন ব্যক্তি-কেন্দ্রিক পরীক্ষায় বিশ্রীরকমের ব্যর্থ হয়েছে মোদি সরকার। ১৯৭৭ সাল থেকে এই পর্যন্ত ‘ব্যাটল লাইন’ এতটা তীব্রভাবে আঁকা হয়নি।
লেখক সাংসদ ও ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। মতামত ব্যক্তিগত