বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

ভারতের সঙ্গে লড়াইয়ে বিশ্বমঞ্চে একা ট্রুডো
মৃণালকান্তি দাস

সবরমতী আশ্রমে চরকা কাটা থেকে মুম্বইয়ে শাহরুখ খানের সঙ্গে ছবি তোলা কিংবা অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে রুটি বেলা— এতকিছুর পরও কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর ভারত সফর ছিল মূষিক প্রসব!
২০১৮-র ফেব্রুয়ারিতে সেই সফর প্রসঙ্গে ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের বক্তব্য ছিল, খলিস্তানি আন্দোলনে কানাডার সক্রিয় সমর্থনই এখন গলার কাঁটা। ট্রুডোর লিবারাল পার্টির সঙ্গে খলিস্তানি সংগঠনের যোগাযোগ কোনও গোপন ঘটনা নয়। তাই সেই সফরে তাঁকে শুনতে হয়েছিল, খলিস্তানি আন্দোলনে অর্থ আসছে কানাডা থেকে। অবিলম্বে তা বন্ধ করতে হবে। তখনও ভারতের চোখে চরম শত্রু হয়ে ওঠেননি ট্রুডো। সেই পর্যায়ে পৌঁছতে আরও কয়েক বছর সময় লেগেছে।
২০২০ সালে ভারতে কৃষক আন্দোলন চলাকালীন সেই আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে বার্তা দিয়েছিলেন ট্রুডো। যা নয়াদিল্লি ভালো চোখে দেখেনি। বিজেপি সেই সময় প্রচার করেছিল, কৃষক আন্দোলনের পিছনে রয়েছে খলিস্তানিদের ষড়যন্ত্র। দেশের শাসক গোষ্ঠীর প্রচারের জেরে সেই সময়ই এদেশের মাটিতে ফিরে এসেছিল আশির দশকের খলিস্তানি ভূত। তৎপরতা বেড়ে গিয়েছিল গোয়েন্দা সংস্থাগুলির। 
স্বাধীনতার পর বার বার অশান্ত হয়েছে পাঞ্জাব। স্থিতাবস্থা সরিয়ে চলতি বছরে পাঞ্জাবে নতুন করে নেমে আসে অশান্তির কালো মেঘ। সেই অশান্তির নেপথ্যে ‘পাঞ্জাব ওয়ারিস দে’ নামে ধর্মীয় সংগঠন। এই স‌ংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা পাঞ্জাবের অভিনেতা তথা রাজনীতিক দীপ সিধু। ২০২২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান দীপ। তাঁর মৃত্যুর পর সংগঠনের প্রধান হন অমৃতপাল সিং নামে ৩০ বছরের এক যুবক। স্বঘোষিত খলিস্তানপন্থী নেতা অমৃতপাল প্রকাশ্যে জানিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি জার্নেল সিংহ ভিন্দ্রানওয়ালের গোঁড়া ভক্ত। অমৃতপালকে ধরতে পাঞ্জাব পুলিসের তৎপরতা বলিউড-ছবির চিত্রনাট্য মনে করিয়ে দিয়েছিল। ৩৬ দিন ধরে পুলিসের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে বেড়ানোর পর গত ২৩ এপ্রিল পাঞ্জাবের মোগা জেলা থেকে অমৃতপালকে গ্রেপ্তার করা হয়।
গোয়েন্দাদের দাবি, অমৃতপাল দুবাইয়ে খলিস্তান আন্দোলন নিয়ে প্রচার শুরু করেন। পাঞ্জাবে ফিরে মাদক-বিরোধী মঞ্চ গড়ে তোলেন অমৃতপাল। কিন্তু তলে তলে তা ছিল খলিস্তান-সমর্থন ও দলবল বাড়ানোর কৌশল। মাদক-বিরোধী মঞ্চের মুখ হয়ে নিজেই জড়িত মাদকের লেনদেনে এবং বেআইনি অস্ত্র মজুত করার কাজে— এমন সব অভিযোগ রয়েছে পাঞ্জাব পুলিসের এফআইআর-এ। মাদক, বেআইনি অস্ত্র, খলিস্তান ও সর্বোপরি আইএসআই— এই চার সংযোগে অমৃতপাল এখন জেলবন্দি, তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে মামলা হয়েছে জাতীয় নিরাপত্তা আইনে। অন্যদিকে তখন লন্ডন ও সানফ্রান্সিসকোয় ভারতীয় হাই কমিশন ও কনসুলেটে ভাঙচুর চালিয়ে শক্তি সঞ্চয় করেছে খলিস্তানপন্থীরা। ভেঙেছে গান্ধীমূর্তিও। ভারতীয় গোয়েন্দাদের সন্দেহ, পাঞ্জাবের মাটিতে যাতে আশি এবং নব্বইয়ের দশকের মতো জঙ্গি কার্যকলাপ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, সেই উদ্দেশ্যেই খলিস্তানি নেতা অমৃতপালদের ব্যবহার করছে পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই।
প্রশ্ন হল, খলিস্তানিরা কী চায়? তাদের আন্দোলন আসলে তো বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। তারা চায় শিখদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র। যার মধ্যে থাকবে ভারতের পাঞ্জাব ও পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশ। থাকবে হিমাচল প্রদেশ, রাজস্থান ও হরিয়ানারও কিছু অংশ। আর এই খলিস্তানি মডিউলের পিছনে কলকাঠি চালায় আইএসআই। অমৃতপালকে দেখে অনেকেরই অশান্ত আটের দশকের কথা মনে পড়ে গিয়েছে। যখন খলিস্তানি নেতা ভিন্দ্রানওয়ালের বিরুদ্ধেও সরকারের নাকের ডগায় বসে সমান্তরাল প্রশাসন চালানোর অভিযোগ উঠেছিল। গোঁড়া এবং রক্ষণশীল শিখনেতা ভিন্দ্রানওয়ালের বিরুদ্ধে শান্তিকামী, তুলনায় নরমপন্থী শিখ এবং হিন্দুদের হত্যা করার অভিযোগ উঠেছিল। প্রশাসনের বহু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিও ভিন্দ্রানওয়ালের রোষে পড়েছিলেন। ভিন্দ্রানওয়ালের পাশে দাঁড়ানোর অভিযোগ ওঠে শিখদের অন্যতম শীর্ষ ধর্মীয় সংগঠন অকাল তখ্‌তের বিরুদ্ধে। ভিন্দ্রানওয়ালে বিপুল অস্ত্রশস্ত্র, দলবল নিয়ে অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরের ভিতরে ঘাঁটি গাড়লে, ১৯৮৪ সালের ১ জুন ‘অপারেশন ব্লু স্টার’ চালানোর সিদ্ধান্ত নেয় ইন্দিরা গান্ধীর সরকার। ভারতীয় সেনার হামলায় ভিন্দ্রানওয়ালে মুক্ত হয় শিখদের পবিত্র তীর্থ স্বর্ণমন্দির। ১৯৮৪ সালের অক্টোবর মাসে দুই শিখ দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত হন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা। এরপর খানিকটা নিস্তেজ হয়ে পড়লেও খলিস্তান আন্দোলন পাঞ্জাবের রাজনীতি থেকে কখনওই হারিয়ে যায়নি। বার বার তা ভেসে উঠেছে। আর তার রেশ আছড়ে পড়েছে ‘খলিস্তানিদের আঁতুড়ঘর’ কানাডায়। একটির ঠিকানা উত্তর আমেরিকা, অন্যটির এশিয়া। দু’দেশের মধ্যে দূরত্ব ১১ হাজার ৪৬২ কিলোমিটার।
দু’দেশের সম্পর্কে অবনতি হতে থাকে কানাডার নাগরিক তথা খলিস্তানপন্থী সংগঠন ‘খলিস্তান টাইগার ফোর্স’ (কেটিএফ)-এর প্রধান হরদীপ সিং নিজ্জরের (৪৫) হত্যাকাণ্ডের জেরে। গত ফেব্রুয়ারিতে ‘কেটিএফ’কে ইউএপিএ ধারায় জঙ্গি সংগঠন বলে ঘোষণা করে ভারতের বিদেশ মন্ত্রক। অভিযোগ, পাঞ্জাবে জঙ্গি কার্যকলাপের পুনরুজ্জীবনে এবং দেশের সুরক্ষা ও সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ জানানোই নিজ্জরের এই সংগঠনের লক্ষ্য। আর তারপর গত ১৮ জুন কানাডার সারে এলাকায় গুরু নানক শিখ গুরুদ্বার সাহিব চত্বরের পার্কিং লটে দু’জন অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতীর গুলিতে নিহত হন নিজ্জর। এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে ভারতের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ তোলে কানাডা। উল্টোদিকে ভারত জানিয়ে দেয়, কানাডা খলিস্তানপন্থীদের সমর্থন করে, আশ্রয় দেয়। আজ নয়, দীর্ঘদিন ধরেই কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো সরকার শিখ উগ্রপন্থী সংগঠনগুলির বিরুদ্ধে নরম মনোভাব নিয়ে চলছে। বিষয়টি ভারতের কূটনৈতিক ডেস্কের অজানা নয়। তার কারণ ট্রুডো একটি সংখ্যালঘু সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যে সরকার টিকিয়ে রাখার জন্য তাঁকে সমর্থন নিতে হচ্ছে নিউ ডেমোক্র্যাটিক পার্টির। এই নিউ ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতা জগমীত সিং খলিস্তানি নেতাদের ঘনিষ্ঠ হিসেবেই পরিচিত।
কানাডার পাল্টা অভিযোগ, এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে ভারতের ‘রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং’ (র)-এর কানাডীয় প্রধানের হাত রয়েছে। কোথা থেকে মিলেছে এই তথ্য? বিতর্ক উস্কে কানাডায় নিযুক্ত আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ডেভিড কোহেন একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, খলিস্তানপন্থী শিখ নেতার হত্যায় কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর অভিযোগের প্রেক্ষিতে গোয়েন্দা তথ্য আদানপ্রদান করেছে পাঁচটি দেশ। কূটনৈতিক স্তরে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ব্রিটেন এবং আমেরিকা— এই পাঁচ দেশ ‘পঞ্চ নেত্র’ বলেই পরিচিত। এই ‘পঞ্চ নেত্র’-র মধ্যে বিনিময় করা গোয়েন্দা তথ্য কানাডাকে দেওয়া হয়েছে। যদিও নিজ্জর খুনের ঘটনায় দায় অস্বীকার করেছে ভারত। বিদেশ মন্ত্রক জানিয়ে দিয়েছে, ট্রুডো সরকারের মদতে অন্তত ২১ জন কট্টরপন্থী খলিস্তানি নেতা কানাডায় আশ্রয় পেয়েছেন। কানাডা সরকার আগে নিজের ঘর পরিষ্কার করুক!
ট্রুডোর অভিযোগের প্রেক্ষিতে ভারতের তরফে প্রকাশিত ডসিয়েরে বলা হয়েছে, নিহত জঙ্গি হরদীপের সঙ্গে পাকিস্তানের যোগাযোগ ছিল। পাকিস্তানে অস্ত্র ও বিস্ফোরক তৈরির প্রশিক্ষণও সে নিয়েছিল। ওই ‘ডসিয়েরে’ দেখানো হয়েছে, ১৯৮০ সাল থেকেই নানা অপরাধমূলক কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত ছিল হরদীপ। তার জেরেই দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। ডসিয়েরে বলা হয়, ১৯৯৬ সালে হরদীপ পাসপোর্ট জালিয়াতি করে কানাডায় যায়। সেই সময়ে ট্রাকচালক হিসেবে কাজ করত সে। পাঞ্জাবের জলন্ধরের বাসিন্দা হরদীপ ক্রমশ আন্তর্জাতিক দুনিয়ার কুখ্যাত জগতে পরিচিতি তৈরি করে। ১৯৮০ থেকে ’৯০-এর মধ্যে জঙ্গি সংগঠন খলিস্তান কমান্ডো ফোর্সের সঙ্গে যুক্ত হয় সে। ২০১২ সাল থেকে খলিস্তান টাইগার ফোর্সের প্রধান জগতার সিং তারার ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে হরদীপ। জগদীপের সূত্রেই হরদীপের পাকিস্তান যোগ গভীর হয়। পাকিস্তান থেকে ফিরে সে মাদক ও চোরাচালানে প্রাপ্ত অর্থ সন্ত্রাসমূলক কার্য়কলাপে ব্যবহার করতে শুরু করে। জগদীপের সঙ্গে যুক্ত হয়েই পাঞ্জাবে নাশকতামূলক কার্যকলাপের ছক কষেছিল হরদীপ। ফান্ডিং করছিল পাকিস্তান। ভারতের এমন একের পর এক অভিযোগে অনেকটাই ব্যাকফুটে ট্রুডো। তার প্রমাণও মিলেছে।
রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে অংশ নিতে চলতি সপ্তাহে নিউ ইয়র্কে গিয়েছিলেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী। সেখানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে পড়েন তিনি। নিউ ইয়র্কে সাংবাদিকদের প্রশ্নের তোড়ে ট্রুডোর মুখে চিরচেনা সেই হাসি আর দেখা যায়নি। তিনি বলেন, ‘আমরা কোনও উস্কানি দেওয়ার বা সমস্যা ডেকে আনার চেষ্টা করছি না। আমরা নিয়মভিত্তিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার পক্ষে কাজ করছি।’ এই সময় এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, কানাডার মিত্ররাও কি তা–ই চায়? পাশ থেকে আরও একজন তো বলেই বসেন, ‘আপনাকে তো দেখে বড্ড একা মনে হচ্ছে।’ সবচেয়ে হতাশাজনক অবস্থান আমেরিকার। রাষ্ট্রসঙ্ঘে ভারত প্রসঙ্গ তুলেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তবে হরদীপ ইস্যুতে নিন্দা জানাতে নয়। বরং, নতুন একটি বাণিজ্যিক পথ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ভারতের সহযোগিতার প্রশংসা করতে।
কূটনীতিকরা বলছেন, আসলে চীনকে ঠেকানোর কৌশলগত দিক দিয়ে ভারতের ব্যাপক গুরুত্বের তুলনায় কানাডার স্বার্থ এই মুহূর্তে পশ্চিমীদের কাছে ফিকে হয়ে এসেছে। এটা না বুঝলে কানাডারই বিপদ। গোটা দুনিয়ার কাছে কানাডা হয়ে উঠবে ‘নয়া পাকিস্তান’!

28th     September,   2023
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ