চলতি বছরের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ছবির নাম কী? আপনি হয়তো বলবেন ‘জওয়ান’। কারণ, এই ছবিতে অস্ত্র দুর্নীতি আছে, কৃষক মৃত্যু, সিস্টেমের সর্বত্র কাটমানি খাওয়া, বেহাল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, ইভিএম এমনকী ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতার নামে ভোট না দেওয়ার আবেদনও রয়েছে। রান্নায় এমন ভরপুর মশলা থাকলে তাকে রাজনৈতিক ছবি ছাড়া আর কীই বা বলা যায়! কিন্তু তাও কেন জানি, ‘জওয়ান’কে সবচেয়ে বেশি নম্বর দেওয়া যাচ্ছে না। কারণ, এক্ষেত্রে তার সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড়িয়ে গিয়েছে সংসদের পাঁচ দিনের বিশেষ অধিবেশন। কেন? ১) এর একটা টিজার ছিল—আচমকা বিবৃতি, সংসদ বসবে। সামনে শীতকালীন অধিবেশন। তা সত্ত্বেও! কেন? সাসপেন্স। ২) এর একটা ট্রেলারও ছিল—প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঘোষণা, ‘ঐতিহাসিক কিছু একটা ঘটতে চলেছে। নজর রাখুন।’ কী সেই ঐতিহাসিক ঘটনা? মন্ত্রিসভার বৈঠক বসল। তারপরও ‘নো ব্রিফিং’। অর্থাৎ, এখানেও সাসপেন্স। ৩) ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো ছিল—পুরনো সংসদ ভবন থেকে নতুন সদনে ‘গণতন্ত্রে’র স্থানান্তর। তাও আবার সংবিধান হাতে নিয়ে, হেঁটে এবং নরেন্দ্র মোদির জন্মদিনকে উপলক্ষ করে। এর থেকে মারাত্মক ওপেনিং শো আর কীই বা হতে পারে? ৪) চিত্রনাট্যে টুইস্ট—মহিলা বিল পেশ। নতুন নামে। নতুন মোড়কে। ৫) টানটান ক্লাইম্যাক্স। সংসদে দাঁড়িয়ে একজন বিজেপি এমপি এক বিরোধী দলের সাংসদকে ধর্ম তুলে সরাসরি আক্রমণ করছেন। বাছাই করা শব্দ ব্যবহার করছেন। সন্ত্রাসবাদের প্রসঙ্গ টানছেন... যে সব শব্দ কি না সিনেমায় থাকলে সেন্সর বোর্ডও ছেঁটে ফেলে। এখানেও সেই সব কথাবার্তা বাতিল করা হয়েছে। সংসদীয় পরিভাষায় এক্সপাঞ্জ। কিন্তু সেই নেতাকে সংসদ বা দল, কোনও ক্ষেত্র থেকেই বহিষ্কার করা হয়নি। অর্থাৎ, ক্লাইম্যাক্সে একটা স্পষ্ট বার্তা তিনি দিয়ে গিয়েছেন—মেরুকরণের। এই ক্রেডিট সিনের উপর নির্ভর করেই আসছে লোকসভা ভোট। ‘কৃপেয়া কুর্সি কি পেটি বাঁধ লিজিয়ে।’
সিটবেল্ট শক্ত করে বাঁধার মতোই সময় বটে। কারণ, ভোটের ঢাকে কাঠি পড়ে গিয়েছে। একটা চাপা টেনশন কাজ করছে রাজনীতির দরবারে। জল্পনা অনেক। মোদিজি কি তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন? বিজেপি কি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে? আবার ধর্মের নামে হানাহানি শুরু হবে না তো? বিরোধী মহাজোট ‘ইন্ডিয়া’ কি পারবে মোদি সরকারকে ফেলতে? যদি সেটাই হয়, প্রধানমন্ত্রী পদে কে বসবেন? উত্তর একটারও জানা নেই। সবটাই ভয়ঙ্কর দোলাচলে দুলছে। তবে একটা বিষয় নিশ্চিত, বিজেপির অন্দরের রিপোর্ট তাদের ভবিষ্যতের জন্য খুব সুবিধার নয়। মেরুকরণ গত দুটো লোকসভা নির্বাচনে গেরুয়া শিবিরকে যথেষ্ট অক্সিজেন দিয়েছিল। তবে সেই সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির প্রতি সাধারণ মানুষের বড় একটা অংশের আশা-ভরসাও ছিল অনেকটা। বহু সংখ্যালঘু মানুষ এতশত বিভাজনের রাজনীতি সত্ত্বেও ‘আচ্ছে দিনে’র আশায় বিজেপিকে ভোট দিয়েছিল। ১০ বছর পর অবশ্য প্রাপ্তির ঝুলি হাতড়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়া তেমন কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। সেটা বিজেপিও জানে। তাই মেরুকরণ নিয়ে তেড়েফুঁড়ে ভোটের বাজার করতে নেমে পড়েছে তারা। গত কয়েক বছরে গেরুয়া বাহিনী প্রমাণ করেছে, খালি পেটেও ধর্ম হয়। অন্তত ধর্মের নামে ভোট তো হয়ই! সেটাই যথেষ্ট। এবং বিস্ময়করভাবে, তাদের একটা অংশ তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসার ব্যাপারে রীতিমতো নিশ্চিত। তাই এখন থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছে ভোট পরবর্তী প্ল্যানিং। প্রথমে সেন্সাস, তারপর রাজ্যভাগ, তৃতীয় ধাপে ডিলিমিটেশন বা আসন পুনর্বিন্যাস এবং সবশেষে মহিলা সংরক্ষণ আইন কার্যকর।
শেষবার আমাদের দেশে জনগণনা হয়েছিল ২০১১ সালে। তার আগে ২০০১। সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে ২০০২ সালে গঠন হয়েছিল ডিলিমিটেশন কমিশন। আসন পুনর্বিন্যাস হয়েছিল সেই শেষ। ২০১১ সালে জনসংখ্যা বাড়লেও পুনর্বিন্যাস কিন্তু হয়নি। এবার হওয়ার কথা। বা বলা ভালো, এই দফায় ডিলিমিটেশন নিশ্চিত। ২০২১ সালে জনগণনা হওয়ার ছিল। কিন্তু হয়নি। যুক্তি ছিল, কোভিড। কিন্তু করোনা ভাইরাস বিদায় নেওয়ার পরও সেই পথে হাঁটেনি মোদি সরকার। কারণ দু’টি। প্রথমত, ২০২১ সালে সেন্সাস হলে তার ভিত্তিতে লোকসভা এবং বিধানসভা আসন পুনর্বিন্যাস করতে হতো। তার মানে গোটা দেশে নতুন করে ঘুঁটি সাজানো। কোথায় কত ভোটার, নতুন কেন্দ্র, রাজ্যের বদলে যাওয়া চরিত্র এবং মেরুকরণের নতুন হিসেব। সময়টা বড্ড কম। নামতে থাকা জনপ্রিয়তার পারদ দেখে সেই ঝুঁকি নিতে চায়নি সরকার। আর দ্বিতীয়ত, একটি প্রচার—সংখ্যালঘু মানুষের সংখ্যা নাকি এতই বেড়ে গিয়েছে যে হিন্দুত্ব খতরেমে হ্যায়। যাঁরা জনতা এবং ভোট সংক্রান্ত কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত, সেই অফিসারদের সূত্রে কিন্তু উল্টো খবর পাওয়া যাচ্ছে। তাঁরাই বলছেন, নতুন সেন্সাসে হিন্দু এবং সংখ্যালঘুদের অনুপাত আগের তুলনায় কমবে। আর সেটা সামনে চলে এলে বিভাজনমূলক প্রচারের কী হবে! তাই এখন দেওয়া থাক সেন্সাসে তালা। কোনওরকমে ভোটটা জিতে ফিরলেই হয়, শুরু থেকে নেমে পড়া যাবে আটঘাট বাঁধার কাজে। লক্ষ্য শুধু ২০২৯ নয়, আরও দূরের। তার জন্য ডেমোগ্রাফিটাকে নিজেদের সুরে বাঁধতে হবে। রাজ্যভাগ এবং আসন পুনর্বিন্যাস সেই অস্ত্র।
এখন দেখতে হবে আসন পুনর্বিন্যাস কতটা জরুরি। ২০০৯ সালে দেশে ভোটার সংখ্যা ছিল প্রায় ৭১ কোটি। ২০১৪ সালে সেই সংখ্যাটা বেড়ে হয় ৮৩ কোটি, আর ২০১৯ সালে প্রায় ৯২ কোটি। পরিসংখ্যানে স্পষ্ট, প্রতি লোকসভা নির্বাচনে তালিকাভুক্ত ভোটার গড়ে ১০ কোটি বাড়ছে। নির্বাচন কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি ভোটার সংখ্যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ৯৪ কোটি। নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে, নতুন ভোটারদের মধ্যে নাম নথিভুক্তির আগ্রহও বাড়বে। চব্বিশের ভোটে সংখ্যাটা ৯৮ কোটির কাছাকাছি দাঁড়াবে বলে অনুমান। এই হিসেব অনুযায়ী আসন পুনর্বিন্যাস করাটা সত্যিই জরুরি। কেন্দ্র তাই অপেক্ষায় আছে জনগণনার ফলের। উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র ভাগের যে প্ল্যানিং কেন্দ্রের রয়েছে, তা খুব অযৌক্তিক নয়। দু’টি রাজ্যই আকারের দিক থেকে বেশ বড়। ভাগ হলে প্রশাসনিক সুবিধা থাকবেই। এছাড়া জনসংখ্যা সত্যিই একটা বড় ফ্যাক্টর। কারণ, জনসংখ্যা বৃদ্ধির দিক থেকে এই দু’টি রাজ্যই রয়েছে প্রথম সারিতে। আর আছে বিহার। এখন যা পরিস্থিতি, সেই অনুযায়ী আসন পুনর্বিন্যাস করলে উত্তরপ্রদেশের লোকসভা আসন ৮০ থেকে বেড়ে হওয়া উচিত ১২৮টি, মহারাষ্ট্র ৪৮ থেকে বেড়ে ৬৮টি এবং বিহার ৪০ থেকে বেড়ে ৭০। কর্ণাটকের ক্ষেত্রে যা হিসেব পাওয়া যাচ্ছে, আসন সংখ্যা ছ’টি বাড়তে পারে। বাংলার ক্ষেত্রে ৪২ থেকে বেড়ে সংখ্যাটি ৫৩ হওয়ার সম্ভাবনা। তাহলে প্রশ্নটা হল, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, এমনকী বিহারও মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু বাংলার ক্ষেত্রে রাজ্যভাগের যুক্তি কি খাটে? সেই হিসেবে তো গুজরাতও ভাগ হওয়া উচিত। কারণ, নরেন্দ্র মোদির রাজ্যে লোকসভা আসন সংখ্যা ২৬ থেকে বেড়ে ৩৯ হওয়া প্রায় নিশ্চিত। আসলে বাংলার ক্ষেত্রে রাজ্যভাগের অঙ্কটা একেবারে আলাদা। বিজেপি বুঝে গিয়েছে, ২০১৯ সালের ভোটে ১৮টি আসন জিতে যে হাঁকডাক তারা শুরু করেছিল, তার ধারেকাছেও এবার পৌঁছনো মুশকিল। দক্ষিণবঙ্গের অধিকাংশ জেলায় ভোটব্যাঙ্ক নিয়ে রীতিমতো সংশয় রয়েছে। বঙ্গ বিজেপির তিনটে গোষ্ঠীর মধ্যে লাগাতার টেনশন। টিকিট বণ্টনের সময় আবার নতুন কী খেল শুরু হবে, সে নিয়ে চিন্তা রয়েছে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের। আর বাকি উত্তরবঙ্গ। এখানে জনসমর্থন কমতির দিকে থাকলেও আশা একবারে মরে যায়নি বিজেপির। তাই বিহারের কিষানগঞ্জ সহ কিছু এলাকার সঙ্গে উত্তরবঙ্গ জুড়ে আলাদা একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করে দিতে পারলেই কেল্লা ফতে। রাজ্য হলেও ক্ষতি নেই। বিহারের সীমাঞ্চল বলে পরিচিত অংশটি মোটামুটি সংখ্যালঘু প্রভাবিত। বিশেষত কিষানগঞ্জ এবং তার লাগোয়া কেন্দ্রগুলি গেরুয়া শিবিরকে বেগ দিয়েই থাকে। একে যদি উত্তরবঙ্গের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া যায়, তাহলে ভোটব্যাঙ্কে একটা ব্যালেন্স আসবে। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনে গেলেও তেমন অসুবিধা থাকবে না।
শুধু বাংলা নয়, চব্বিশে জিতে এলে গোটা দেশেই এই ফর্মুলা প্রয়োগ করবে বিজেপি। মেরুকরণকে সামনে রেখে রাজ্যভাগ। সেই অনুযায়ী তারপর ডিলিমিটেশন। ফর্মুলা মতো একবার আসন পুনর্বিন্যাস হয়ে গেলে গেরুয়া বাহিনীকে আর পায় কে? সমগ্র উত্তর ভারত ও পশ্চিম ভারতের একটা বড় অংশ তখন মেরুকরণের ভিতের উপর দাঁড়িয়েই তাদের ডিভিডেন্ড দেবে। চাপে পড়বে কারা? দক্ষিণ ভারত। কারণ, পুনর্বিন্যাসে দক্ষিণের আসন সংখ্যা কমবে।
গত এক দশকে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সবচেয়ে ভালোভাবে করেছে দক্ষিণ ভারত। এখানকার রাজ্যগুলিতে পড়াশোনার চল বেশি। আর দেশের অর্থনীতিতে এই রাজ্যগুলিরই অবদান গত কয়েক বছরে সর্বাধিক। বিহারের তুলনায় কর্ণাটকের মাথা পিছু আয় পাঁচগুণ, উত্তরপ্রদেশের তুলনায় তেলেঙ্গানায় চারগুণ, অসমের তুলনায় কেরলের দ্বিগুণ। ডিলিমিটেশনের পর সবার আগে কিন্তু দক্ষিণের রাজ্যগুলির লোকসভা আসন সংখ্যা কমে যাবে। তার ফল? কেন্দ্রীয় বরাদ্দে ঘাটতি। ধাক্কা খাবে অর্থনীতি। আর আছে একটা রাজনৈতিক কারণ। দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলিতে মূলত আঞ্চলিক দল ক্ষমতাসীন। বিজেপি সেখানে খুব একটা দাঁত ফোটাতে পারে না। লোকসভা আসন সংখ্যা কমে গেলে বিপদ বাড়বে আঞ্চলিক দলগুলির। তাদের প্রতিনিধির সংখ্যা দিল্লিতে কমবে। সেটাই উল্লাসের কারণ হবে গেরুয়া শিবিরের। উত্তরপ্রদেশ, বিহারের মতো রাজ্যে ভোটব্যাঙ্ক বাড়িয়ে সংখ্যার দিক থেকে পিছনে ফেলে দেওয়া আঞ্চলিক দলগুলিকে। তারপর মহিলা সংরক্ষণ আইন কার্যকর তো হবেই। কংগ্রেস ও বিরোধী আঞ্চলিক দলগুলি মূলত চলে নেতানেত্রীর নামে। তাঁদের আসনই যদি ভোটের ঠিক আগে সংরক্ষণের আওতায় ফেলে দেওয়া যায়? অন্য আসনে তাঁরা দাঁড়াবেন। হয়তো জিতবেনও। কিন্তু কষ্ট করে। কমফোর্ট জোন ভেঙে দিলে কেউই অন্যদিকে মন বসাতে পারে না। ধরা যাক আমেথি এবং ওয়েনাড় মহিলা সংরক্ষিত হয়ে গেল। রাহুল গান্ধী তখন অন্য কোনও আসনে দাঁড়াবেন। নতুন জমিতে ফসল ফলাতে যা সময় তাঁকে দিতে হবে, তাতে দেশের অন্যত্র কংগ্রেস বা বিরোধী জোটকে সাহায্য করা তাঁর মাথায় উঠবে। বিজেপি বলতে পারে, সংরক্ষণ তো করবে নির্বাচন কমিশন। আমরা কী জানি এর? সতিই কি এটাই? তাহলে নির্বাচন কমিশনার বিল পাশ করাতে এত তৎপরতা কেন? অমিত শাহ-জে পি নাড্ডা কীভাবে সংসদে দাঁড়িয়ে বলেন, তাঁরাই সব করবেন? পাবলিক নিশ্চয়ই ঘাসে মুখ দিয়ে চলে না! আসলে এটাই মাস্টার প্ল্যান। ভবিষ্যৎকে সামনে রেখে। ততদিনে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি, সংবিধান সংশোধন, হিন্দুরাষ্ট্র—সব ইস্যুই আগাছার মতো ছড়িয়ে পড়বে সমাজের অন্দরে।
চিত্রনাট্য লেখা চলছে। বড় প্রজেক্ট। শতাব্দীর সেরা ছবি হবে ওটাই। নাম? হয়তো দ্য গ্রেটেস্ট ডিক্টেটর।