বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

দেশে অসন্তোষ, বিপদের গন্ধ পাচ্ছেন মোদিজি
হিমাংশু সিংহ

কৃষি বিল পাশ হয়েছে, কিন্তু কৃষক খুশি হওয়ার বদলে বিদ্রোহ করেছে। এক বছর ঠায় রাস্তায় বসে থাকতে বাধ্য হয়েছে ফসল ফলানোর কারিগররা। শেষে আইনটাকেই বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে মোদি সরকার। ঐতিহাসিক জিএসটি চালু হয়েছে ৬ বছর আগে। নিঃসন্দেহে অত্যন্ত বড় পদক্ষেপ। এখানেও ব্যবসা বাণিজ্য সরল ও সহজ হওয়ার পরিবর্তে আরও জটিল হয়েছে। ছোট ও মাঝারি উদ্যোগীদের নাভিশ্বাস উঠেছে। ৩৭০ রদ ও কাশ্মীরকে দু’ভাগ করার চমক গোটা উপত্যকাকে জেলখানায় পরিণত করেছে, কিন্তু সন্ত্রাসবাদ খতম হয়নি। এখনও সেনার লাশ ফেরে কফিনে। স্বভাবতই উপত্যকার মানুষ খুশি হওয়ার বদলে ফুঁসছে। নোট বাতিলে কালো টাকা শেষ হয়নি, বরং আরও বেড়েছে। আর তিন তালাক কি বন্ধ হয়েছে? শুধু আইন করলে ভোটের বাজার গরম হয়, সামাজিক ব্যাধি দূর হয় না। তারজন্য চাই সচেতনতা বৃদ্ধি ও আত্মবিশ্বাস বাড়ানো। তা কিন্তু হয়নি। জি-২০ সম্মেলন নিয়ে দেশ কেন গোটা বিশ্ব তোলপাড়। ভালো কথা। কিন্তু এক সপ্তাহের মধ্যেই কানাডা ও চীনের সঙ্গে যে তীব্র কূটনৈতিক সংঘাত শুরু হয়েছে, তাতে কি ‘বিশ্বগুরু’র মর্যাদা অটুট রইল? এর থেকে শিক্ষা একটাই, ঢাক বাজিয়ে দু’টো ভোট আসে, কিন্তু অন্ধকার কাটে না। ঠিক তেমনই, সামাজিক ভিত্তি শক্ত না হলে শুধু আইন করে নারী স্বাধীনতাও আসবে না, সংরক্ষণের সুফলও গরিবের ঘরে অলীক কল্পনা হয়েই থেকে যাবে। 
তবু এদেশে ভোট এলেই সম্ভব হোক কিংবা অসম্ভব, সরকার দু’হাতে প্রতিশ্রুতি বিলোয়। আইনও পাশ হয় দেদার। নতুন সংসদ ভবন বলে কথা। দামি পালিশ, এলাহি ব্যবস্থা আর তাক লাগানো আসবাবের গন্ধে এখনও ম ম করছে চারদিক। তার মধ্যেই দরাজ হাসি আর শান্তির জল ছেটাচ্ছেন মন্ত্রী-সান্ত্রিরা। পাঁচ বছরের ক্ষোভ বিক্ষোভ, বঞ্চনা, অনেক না পাওয়া, মঞ্চ থেকে দেওয়া কথা না রাখার জমাট হতাশা তাতে ঢেকে যায় বইকি। কথার চাতুরিতে ভোট বাড়ে, মানুষ তাৎক্ষণিক ঘোষণায় ভোলে। তারপর নির্বাচন মিটলে, সরকার গড়া হয়ে গেলে আবার যে কে সেই। কেউ সেসব মনে রাখে না। বিলকিস বানু, হাতরাসের ধর্ষিতারা সুবিচার পায় না। নেতার ছেলের লিমুজিন পিষে দেয় অসহায় ফুটপাতবাসিনীকে। এফআইআরও হয় না। ওরা সংরক্ষণের মানে বোঝে! মাথা কুটে মরতে হয় সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পানকে। এখনও নিয়মিত কেরল থেকে এসে হাজিরা দিতে হয় লখনউয়ের আদালতে। সবাই জানে, একবার নির্বাচন পার করতে পারলেই আবার পাঁচ বছর পর হবে হিসেবনিকেশ। তার আগে নয়। আর ভোটে হারলে তো কথাই নেই। যে জয়ী হয়ে এল এবার প্যালা সামলানোর পালা তার। প্রথমদিন গণতন্ত্রের মন্দিরে মাথা ঠোকো, তার পরের দিন থেকে জনতা তোমার পায়ে হত্যে দেবে, এই হচ্ছে স্বাধীনতার অমৃতকাল!
প্রায় সাড়ে তিন দশকের চেষ্টায় নতুন সংসদ ভবনের প্রথম অধিবেশনে একটা ঐতিহাসিক বিল পাশ হয়েছে। লোকসভা ও বিভিন্ন রাজ্য বিধানসভায় ৩৩ শতাংশ আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত হল। ভোটের বাজারে অযোধ্যার মন্দির আর হিন্দুত্বের কড়া টনিকের পাশাপাশি এটাকেও তুরূপের তাস করতে চলেছে বিজেপি মায় মোদিজির পার্ষদেরা। কিন্তু আমার সবিনয় প্রশ্ন, এমপি সংখ্যা দূরে থাক, বড় রাজনৈতিক দলগুলি এক তৃতীয়াংশ মহিলা প্রার্থী দিতে প্রস্তুত তো? গতবারের হিসেব দেখছিলাম। সারা দেশে মোট ৮ হাজার ৫৪ জন প্রার্থীর মধ্যে মাত্র ৭২৬ জন মহিলা প্রার্থী দাঁড়িয়েছিলেন। সাকুল্যে দশ শতাংশও নয়। তার মধ্যে আবার এক তৃতীয়াংশেরও বেশি নির্দল। অর্থাৎ কোনও জাতীয় রাজনৈতিক দলই মহিলাদের এই উত্তরণে শামিল হয়নি। অথচ আজ দেখুন কারও উৎসাহের খামতি নেই। 
এটা মোদিজি যেমন জানেন, তেমনি ইন্ডিয়া জোটের নেতারাও বিলক্ষণ মানেন। তাই বিতর্কের শেষে লোকসভায় ভোটের ফল হয় ৪৫৪-২ আর রাজ্যসভায় ২১৪ -০। লোকসভায় যে দু’জন বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন তাঁরা হচ্ছেন, আসাদুদ্দিন ওয়াইসি ও ইমতিয়াজ জালিল। কেউ সামনে মহিলা বিদ্বেষী হয়ে ভোট হারাতে চান না। কিন্তু আইন আপাতত কার্যকর হওয়া ঝুলে থাকলেও ৬ মাস পর নির্বাচনে কোন কোন রাজনৈতিক দল এক তৃতীয়াংশ প্রার্থী দিতে সমর্থ হয় সেটাই দেখার। কারণ আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা মোটেই ভালো নয়। আর কে না জানে এই বিলেও যেটুকু উপকার হবে তা সাবর্ণ মহিলাদেরই। ওবিসি ও মুসলিম মহিলারা যে তিমিরে সেই তিমিরেই থেকে যাবেন।
পাঁচদিনের বিশেষ সংসদীয় মহাযজ্ঞে খুড়োর কল ঝোলানো ছাড়া দেশ ও দেশের নারী শক্তি কী পেল, এটা নিঃসন্দেহে বড় প্রশ্ন। প্রায় সাড়ে তিন দশক পেরিয়ে যে বিলটি পাশ হয়ে আইনে পরিণত হওয়ার অপেক্ষায় তা কি আসন্ন লোকসভা ভোটে পরিণতি পাবে? সহজ উত্তর, না পাবে না। স্পষ্ট বলা হচ্ছে, চব্বিশের সাধারণ নির্বাচনের পর একে একে ডিলিমিটেশন ও জনগণনা হবে। তার চেয়েও বড় কথা, রাজ্যভাগ হবে। মোদিজি আস্তিনে লুকনো এই তাসটাকে এখন কিছুটা উহ্যই রাখছেন। মোদ্দা কথা, বিরোধীদের কোণঠাসা করেই কার্যকর হবে ৩৩ শতাংশ মহিলা সংরক্ষণ। ততদিনে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি ও এক দেশ এক নির্বাচনের ফুলও ফোটানোর চেষ্টা হবে। এক ফুল দো মালি এখানে খাটে না, বরং এক মোদিজি অউর হাজার গুলদস্তা!
সবাই জানে, গত একুশ সালেই জনগণনা বা সেনসাস হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কোভিডের কারণে তা সম্ভব হয়নি। ফলে এখনও ২০১১ সালের জনগণনার তথ্যই সরকারের সম্বল। তার ভিত্তিতে কোনও ডিলিমিটেশন প্রক্রিয়া চালানো সম্ভব নয়। সরকার কোভিডকে অজুহাত হিসেবে খাড়া করলেও প্রধান যে কারণে জনগণনা প্রক্রিয়াটি ঝুলে, তা 
হচ্ছে এনআরসি ও সিএএ নিয়ে টানাপোড়েন। সংসদে বিল পাশ হওয়ার পর কয়েক বছর কেটে গেলেও সিএএ আইনের রুলই তৈরি করতে পারল না সরকার। সেই কারণেই দ্রুত জনগণনা নিয়েও বড় প্রশ্নচিহ্ন তৈরি হয়েছে। আর ডিলিমিটেশন তো বহু দূর। সেক্ষেত্রে জনগণনা ও ডিলিমিটেশন কার্যকর করতে আরও এক দশক কেটে যাওয়াও মোটেই অসম্ভব নয়। ফলে ২০২৯ কেন, আগামী একদশকেও মহিলা সংরক্ষণ কার্যকর হওয়া দূর অস্ত! ২০২৯ সালে মোদিজির বয়স হবে প্রায় ৮০। আর ২০৩৯ সালে প্রায় ৯০। আপাতত বিল পাশের কৃতিত্বটুকু নিয়েই তৃতীয়বার কুর্সিতে বসার পথ সুগম করতে মরিয়া অমিত শাহ অ্যান্ড কোম্পানি। 
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, নারী জাতির ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে সত্যি বিজেপি কি খুব উদগ্রীব? নাকি দেশজুড়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুব একটা অনুকূল নয়, একের পর এক রাজ্য থেকে খারাপ খবর আসছে বলেই তড়িঘড়ি খুড়োর কল ঝোলানোর রাস্তায় হাঁটলেন নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর অনুগামীরা। যাতে গরিবি, বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, পেট্রল ডিজেলের দাম থেকে মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে ফেলা সম্ভব হয়। কিন্তু নোটবাতিলের মতো মধ্যরাত থেকে নয়, আগামী নির্বাচনেও নয়, অনির্দিষ্টকালের জন্য ঝুলিয়ে রাখা হল কোন স্বার্থে? অবশ্য অমিত শাহ ইঙ্গিতে বোমাটা ছুড়েছেন, যদি রাহুল গান্ধীর ওয়েনাড় আসনটাই সংরক্ষিত হয়ে যায় তখন? 
হিসেব বলছে, বিগত লোকসভা ভোটে গেরুয়া দল ৩৭৪ জন প্রার্থী দিয়েছিল। তার মধ্যে মহিলা ছিলেন পঞ্চাশের আশপাশে। মাত্র ১২ শতাংশের মতো। এবারও প্রায় পৌনে চারশো কিংবা তার বেশি আসনে অমিত শাহরা যে প্রার্থী দেবেন তা নিশ্চিত। সেক্ষেত্রে অন্তত শতাধিক মহিলাকে লড়াইয়ে দেখতে পাব তো?
কিছু উন্নাসিক ভ্রু কোঁচকানো বাঙালি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোনও ভালোই দেখতে পান না। কিন্তু যতই সমালোচনা করুন না কেন তৃণমূল কিন্তু বিগত লোকসভা ভোটের লড়াইতেই প্রায় ৪১ শতাংশ মহিলা প্রার্থী দাঁড় করিয়েছে। নিন্দুকদের মুখে ছাই দিয়ে এবং অনেক প্রগতিশীল শক্তির ভণ্ডামিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মমতার এই উদ্যোগ কিন্তু একটা সর্বভারতীয় রেকর্ড। দ্বিতীয় স্থানে আছে ওড়িশার বিজু জনতা দল। 
সবচেয়ে লজ্জার কথা, নব্বইয়ের দশক থেকে মহিলা সংরক্ষণ নিয়ে কথা চলছে। পাঁশকুড়ার প্রয়াত সাংসদ গীতা মুখোপাধ্যায় সংসদের ভিতর ও বাইরে সরব হয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৫২ সালে সেই যে প্রথম নির্বাচনে ২৫ জন মহিলা এমপি (৫ শতাংশ) নির্বাচিত হয়েছিলেন তা থেকে খুব একটা কি উন্নতি হয়েছে 
সাত দশকের সংসদীয় ভোট রাজনীতির অভিযাত্রায়? বরং মাঝে বেশ কয়েক বার মহিলা এমপি সংখ্যা ২৫ এরও কম ছিল। ষষ্ঠ লোকসভায় মহিলা এমপির সংখ্যাটা ছিল ২১ জন। পঞ্চম ও নবম সংসদে সংখ্যাটা ছিল মাত্র ২৮। চলতি সপ্তদশ লোকসভায় সেই নিরিখে রেকর্ড ৭৮ জন মহিলা এমপি রয়েছেন, যা চোদ্দো শতাংশের মতো। বিশ্বের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বলে দাবি করা ভারতীয় জনতা পার্টির মহিলা এমপি সংখ্যা মাত্র ৪২ জন। আমেরিকায় মহিলা এমপির সংখ্যাটা ৩২ শতাংশ। আর পাশের বাংলাদেশে ২১ শতাংশ। আমরা কিন্তু দু’টোরই ধারেকাছে নই। প্রশ্ন একটাই। সত্তর বছর পরও যেখানে বড়দলগুলি ৩৩ শতাংশ মহিলা প্রার্থীই দিতে পারে না, সেখানে ১৮১ জন এমপি (লোকসভার আসন সংখ্যা ৫৪৩ ধরে তার এক তৃতীয়াংশ) মিলবে কীভাবে।  তাহলে একমাত্র মমতার তৃণমূল ছাড়া কেউ তো তৈরিই নয়। এটা কোনও অলীক কথা নয়, সংসদীয় রেকর্ডই তার প্রমাণ। 
তাহলে হঠাৎ সাড়ে ৯ বছর পর এত তৎপরতা কেন? ভারতের জনসংখ্যার প্রায় ৫০ শতাংশই মহিলা এবং সেই ভোটব্যাঙ্কটাকে দখল করতে হবে যে! তাই ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ ‘বসন্ত’। ভুলেও কেউ পাতা ঝরা ‘চৈত্র’ বলতে রাজি নয়! ঈশ্বরের অতি পছন্দের বরপুত্র তো নয়ই। তাঁকে নেহরু সহ সব অতীত ইতিহাস মুছে দেওয়ার জন্য পাঠানো হয়েছে যে!

24th     September,   2023
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ