উত্তাল সময়ে চীনে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯২৪ সালে। ভ্রমণ করেছিলেন ৪৯ দিন। বক্তৃতা করেছিলেন একাধিক জায়গায়। আর পরিবর্তনের সেই ঝোড়ো হাওয়ায় কী বলবেন কবি, সেই দ্বিধা ছিল তাঁর প্রথম বক্তৃতাতেই: ‘আপনাদের ধর্ম এবং প্রথা সম্পর্কে এত বিরোধী মতামতের কথা আমি পড়েছি যে, ভাবছিলাম এঁরা আমাকে কিসের জন্য আমন্ত্রণ করেছেন, এঁদের কল্যাণের জন্য কোন বাণী বহন করে নিয়ে যাওয়া আমার কর্তব্য।’
রবীন্দ্রনাথ মূলত শুনিয়েছিলেন শান্তির কথা। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মানুষের সামগ্রিক উন্নয়নের কথা। কিন্তু বিনা বিতর্কে তাঁর কথা চীনে গৃহীত হয়নি। ক্রমেই জমে উঠছিল সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিক্রিয়া, প্রতিরোধও। এমনকী, পেইচিং বক্তৃতামালার দ্বিতীয় দিনে ছাত্ররা রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে হ্যান্ডবিল ছাপিয়ে বিলি করেছিল। যাতে লেখা হয়েছিল: রবীন্দ্রনাথ বলছেন ব্রহ্মের কথা আত্মার মুক্তির কথা। এই অকর্মণ্য তত্ত্বের বিরুদ্ধে আমাদের আপত্তি। কবির আগের বক্তৃতার সারমর্ম ছিল, ‘ভাববাদকে ফিরিয়ে আনতে হবে, সে কারণে ধ্বংস করতে হবে বস্তুবাদকে’। এই দর্শন মেনে নিতে পারেননি তরুণ বিপ্লবীরা। তাঁদের আশঙ্কা, এটা আয়োজকদেরই ষড়যন্ত্র আর তাদের হয়েই কথা বলছেন রবীন্দ্রনাথ! সেই সময় উঠতি তরুণ বিপ্লবী মাও সে তুং একটি পত্রিকায় ‘রবীন্দ্রনাথের কাছে আমাদের প্রত্যাশা’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন: রবীন্দ্রনাথের কাছে যে উপহার আমরা প্রত্যাশা করি তা আধ্যাত্মিক জীবনসাধনা নয়, বরং সেই বেদনা ও উৎসাহ জাগানো ‘একলা চলো রে’।
শুধু চীনারা নয়, জাপানিরাও কবিকে ছেড়ে কথা বলেনি। জাপানি পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, ‘রবীন্দ্রনাথ পরাজিত ও শৃঙ্খলিত জাতির কণ্ঠস্বর। তাঁকে গুরুত্ব না দিলেও চলবে।’ আমেরিকানরাও বলেছিল, ‘রবীন্দ্রনাথের বাণী অসুস্থ ভাবালুতায় আচ্ছন্ন, তিনি মহৎ আমেরিকার যুবসমাজের মনে বিষ ছড়ানোর তালে আছেন।’ তবে চীন ভ্রমণ বোধহয় ছাপিয়ে গিয়েছিল অন্য সব বিড়ম্বনাকে। বিরোধটা রবীন্দ্রনাথের প্রতি ছিল না, ছিল তাঁর মতাদর্শের প্রতি। বক্তব্য চলাকালীন তাঁকে শুনতে হয়েছে, ‘পরাধীন দেশে ফিরে যাও। আমরা এই দর্শন চাই না। চাই বস্তুবাদ।’ সেই রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে চীনাদের ধারণা এখন উচ্চমার্গীয়। বিশ্বকবিকে নিয়ে আজ সেদেশে গবেষণার অন্ত নেই।
কবি কিন্তু চীনকে চিনতে ভুল করেননি। ১৯১৬ সালে হংকংয়ে পা দিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘কাজের শক্তি, কাজের নৈপুণ্য এবং কাজের আনন্দকে এমন পুঞ্জীভূতভাবে দেখতে পেয়ে আমি মনে মনে বুঝতে পারলুম, এই বৃহৎ জাতির মধ্যে কতখানি ক্ষমতা সমস্ত দেশজুড়ে সঞ্চিত হচ্ছে। চীনের এই শক্তি আছে বলেই আমেরিকা চীনকে ভয় করছে। কাজের উদ্যমে চীনকে সে জিততে পারে না, গায়ের জোরে তাকে ঠেকিয়ে রাখতে চায়।’ কবি বুঝেছিলেন, ‘এই এত বড়ো একটা শক্তি যখন আধুনিককালের বাহনকে পাবে, অর্থাৎ যখন বিজ্ঞান তার আয়ত্ত হবে, তখন পৃথিবীতে তাকে বাধা দিতে পারে এমন কোন শক্তি আছে? তখন তার কর্মের প্রতিভার সঙ্গে তার উপকরণের যোগ সাধন হবে।’
রবীন্দ্রনাথ ভারতে ব্রিটিশ শাসনের কড়া সমালোচক ছিলেন বলে এশিয়ার প্রাচীন সভ্যতাগুলির মধ্যে পুরনো বন্ধন ও ঐতিহ্যকে আবার নতুন করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। সেই সময়কার চীনা বুদ্ধিজীবীরা কবিগুরুর এই আকাঙ্ক্ষা মোটেও গুরুত্ব দেননি। তাঁরা মনে করতেন, পশ্চিমকে ঠেকাতে হলে পশ্চিমের শিক্ষা গ্রহণ করেই তাকে ঠেকাতে হবে, সেখানে প্রাচীন সংস্কৃতি বা ঐতিহ্য তেমন কাজে আসবে না। সেইসময় পিকিং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চেন-তু শিউ বলেছিলেন, চীনের তরুণদের ‘ভারতীয়করণের’ প্রয়োজন নেই। তারা নিশ্চিত চাইবে না, তাদের কফিন একদিন ঔপনিবেশিক শক্তির গোড়ালির নীচে পড়ে থাকুক।
রবীন্দ্রনাথ পশ্চিমের বস্তুবাদকে পরিত্যাগ করে যন্ত্রের অন্ধকূপ থেকে যে আত্মার মুক্তি চেয়েছিলেন এবং দুই দেশকে এক হতে বলেছিলেন, সেই আত্মার মুক্তি নিয়ে এখন কারও মাথাব্যথা নেই। ফলে দু’দেশের সম্পর্ক জটিল কাঁটাতারে আটকে। প্রায় একশো বছর পরও চীনের বুদ্ধিজীবীরা ভারতকে এখনও পশ্চাৎপদ বলেই মনে করেন। এটা ঠিক, ভারত যখন স্বাধীন হয়, তখন ক্রয়ক্ষমতার বিচারে ভারতের মাথাপিছু আয় চীনের চেয়ে বেশি ছিল। কিন্তু ১৯৯০-এর দশকে এসে চীন ভারতকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছে। চীনের প্রতি ভারতের দৃষ্টিভঙ্গিতেও একসময় ভয় ছিল, ঈর্ষা ছিল। আর ছিল তাদের সমান হওয়ার অপূরণীয় আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু এখন হিমালয়ের নীচে যে টেকটনিকগুলি রয়েছে, সেগুলি নড়াচড়া শুরু করছে। দ্রুত বদলে যাচ্ছে অবস্থা। চীনের পাশাপাশি ভারতের উত্থানও নজিরবিহীন। ভারত উন্নয়নশীল বিশ্বের শক্তিশালী নেতা হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করেছে। পশ্চিম দুনিয়ার কিছু বিশেষজ্ঞ একে অশনিসঙ্কেত বলেই মনে করছেন। ইতিমধ্যে ব্রিটেনের জনপ্রিয় পত্রিকা ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ সেই আগ বাড়িয়ে লিখেই ফেলেছে, ‘চীন ও ভারত বন্ধু হয়ে গেলে কী হবে?’ পশ্চিম দুনিয়ার ধারণা, চীন-ভারতের সামরিক-অর্থনৈতিক সম্পর্কের মূল ভিত্তিগুলি দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে এবং সেটা এত দ্রুত পাল্টাচ্ছে যে আমেরিকাকেও তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। তাদের ধারণা, যে সীমান্ত সংঘাতের কারণে দু’টি দেশের সম্পর্ক দানা বাঁধতে পারছে না, সেই সংকট মিটে গেলে এই অঞ্চলে পশ্চিমের প্রভাব ক্ষীণ হয়ে আসবে।
এখন পর্যন্ত আমেরিকা যা চেয়েছে, তা-ই হয়েছে। ২০০৮ সালে ভারত আমেরিকার সঙ্গে ‘সিভিল নিউক্লিয়ার কো-অপারেশন প্যাক্টে’ সই করেছে। ২০২০ সালের রক্তাক্ত সীমান্ত সংঘাতের পর ভারত পাকিস্তানের সীমান্ত থেকে ৭০ হাজার সেনা, ফাইটার জেট এবং সারফেস টু এয়ার মিসাইল চীনা সীমান্তে নিয়ে এসেছে। এ ছাড়া আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের সঙ্গে যৌথ সামরিক অনুশীলন ও প্রশিক্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে ভারত। নরেন্দ্র মোদি জুন মাসে আমেরিকা সফরে গিয়ে ড্রোন কেনা ও ভারতের মাটিতে যৌথভাবে ফাইটার জেট ইঞ্জিন তৈরি করার চুক্তিতে স্বাক্ষরও করে এসেছেন। উল্টো দিকে এটাও ঠিক, সীমান্তে শান্তি ফেরাতে ভারত-চীন আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে অন্তত ১৮ বার বৈঠক হওয়ার পর এখন সেখানকার অস্থিরতা অনেকটা থিতু হয়েছে। এ ব্যাপারে যথেষ্ট মরিয়া সাউথ ব্লকও। ভারত চায়, আমেরিকা-চীনের দ্বন্দ্বকে পাশ কাটিয়ে বহুমেরুর বিশ্বব্যবস্থার দিকে এগতে।
ব্রিটেনের পত্রিকা ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ লিখছে, আগে এই দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য তেমন একটা ছিল না। কিন্তু ২০২০ সালে সেটা ৮৮ বিলিয়ন ডলারে এসে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য এখানে চীনের পাল্লাটা ভারী, ভারতের চেয়ে ৪৬ বিলিয়ন ডলার বেশি। ফলে চীন এখন ভারতের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক অংশীদার। প্রযুক্তি, প্রপার্টি, পরিকাঠামো ইত্যাদি ক্ষেত্রে ভারতে চীনের বিনিয়োগ এখন বিশাল। ২০২০ সালের সীমান্ত সংঘাতের পর ভারত চীনা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলির উপর নানা রকম বিধিনিষেধ আরোপ করলেও ২০২১ ও ’২২ সালে দু’দেশের আন্তঃবাণিজ্য ৪৩ শতাংশ এবং ৮.৬ শতাংশ বেড়েছে। ভারত সরকারের নানা রকম বিধিনিষেধ এড়ানোর জন্য চীনারা এখন সিঙ্গাপুর হয়ে বা রিলায়েন্স গ্রুপের মতো ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের অংশীদার হয়ে ভারতে ব্যবসা করছেন। এতে স্পষ্ট ভারতকে যেমন চীনের দরকার, চীনকেও দূরে সরিয়ে রাখা ভারতের অসম্ভব।
তবে ভারতও এখন পশ্চিমের মতো চীনের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে চাইছে। কিন্তু ভারতীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, জিডিপি ধরে রাখতে হলে আরও বহু বছর চীনের উপর নির্ভর করতে হবে। যেমন ভারতীয় ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলিকে এখনও তাদের ৭০ শতাংশ উপাদানের জন্য চীনের উপর নির্ভর করতে হয়। মিত্রের সঙ্গে পুরোপুরি ঝুঁকে না পড়ে কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন না হয়ে বৈদেশিক সম্পর্কের পথ বেছে নিয়েছে ভারত। চীন সম্পর্কে খানিকটা আক্রমণাত্মক এদেশের সরকার যে আসলে ব্যবসাটা ভালো বোঝে। যেখানে মুনাফা, সেখানেই সরকার। তাই যদি আমেরিকায় জিনিসপত্র রপ্তানি করতে বা আমেরিকা প্রযুক্তিপ্রসূত বিভিন্ন চীনা শৈল্পিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ভারত জুড়ে যেতে পারে, তা হলে ভারতীয় শিল্পের উপকার হবে। এই নীতির ফলে দেশের কতটা সামগ্রিক উন্নতি হবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়, তবে দেশের ভিতরের কিছু সংস্থা যে ফুলেফেঁপে উঠবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। অভ্যন্তরীণ রাজনীতির স্বার্থরক্ষা করতে গিয়ে সেই কথাটা ভুললে বিপদ।
যাঁরা ভয়ঙ্কর চীন বিরোধিতায় আচ্ছন্ন, তাঁরা ভুলে যাবেন না, ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চীনের প্রেসিডেন্ট জি জিনপিংকে গুজরাতে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং পরের বছর নিজে বেজিংয়ে গিয়ে বলেছিলেন, ‘বর্তমান আন্তর্জাতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে আমরা একে অন্যের অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করতে পারি।’
আসলে চীন-ভারতের সম্পর্কের দিকে তাকিয়ে গোটা দুনিয়া। সাউথ ব্লকের ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’র অবস্থান সব তালগোল পাকিয়ে দিয়েছে।