উদয়নিধি স্ট্যালিন কি ঠিক কাজ করলেন? ভোটমুখী ভারতের বাজারে এটাই এখন লাখ টাকার প্রশ্ন। কারণ, তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিনের ছেলে কামানের মুখ ঘুরিয়েছেন সনাতন ধর্মের দিকে। ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়ার সঙ্গে সনাতন ধর্মের তুলনা করেছেন তিনি। এবং এই ধর্মের বিনাশও চেয়েছেন। সাধারণ কোনও চুনোপুঁটি নেতা এমন কথা বললে সোশ্যাল মিডিয়ায় খানিক ঢেউ ওঠার বেশি কিছু হতো না। কিন্তু উদয়নিধি তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রীর ছেলে, তার উপর আবার মহাজোট ইন্ডিয়ার শরিক দলের ফার্স্ট ইলেভেনে চলে আসবেন। তাই এমন কথা যে মোদি জনতা পার্টি লুফে নেবে, তাতে আর সংশয় কী? নরেন্দ্র মোদি লুফলেন। এবং ইস্যুটি ধরে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। রে রে করে উঠল হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি। আদালতে মামলা পর্যন্ত হল। আর মধ্যপ্রদেশে শোনা গেল স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর কাতর আর্তি, ইন্ডি জোট ক্ষমতায় এলে সনাতন ধর্ম বাঁচবে না। দেশের আনাচে কানাচে তিনি নামিয়ে দিলেন নেতা-মন্ত্রীদের। প্রত্যেকের জন্য অভিন্ন নির্দেশ, টানা ব্যাটিং চালিয়ে যেতে হবে সনাতন ধর্ম ইস্যুতে। মানুষকে বোঝাতে হবে, নরেন্দ্র মোদিই সনাতন ধর্মের একমাত্র রক্ষাকর্তা। তিনি ছাড়া গতি নেই। অর্থাৎ, মেরুকরণ। একদিকে থাকবে সনাতন, অন্যদিকে বাকি সব। ভোটের ঘণ্ট পাকবার আগেই মোটামুটি মঞ্চ তৈরি হয়ে যাবে ‘ডিভাইড’-এর। আর ‘রুল’-এ তো তিনি নিজেই আছেন। ধরতাই দেওয়ার কাজ? সেটা মহাত্মা গান্ধী বা স্বামী বিবেকানন্দের প্রসঙ্গ টেনে তিনি সামলে দেবেন। লক্ষ্য একটাই—সনাতন।
রাজনীতির এই অশ্বমেধের ঘোড়ায় খানিক ব্রেক কষা যাক। আগে দেখা যাক, যে গোঁফ চুরি গেল বলে দিকে দিকে হাহাকার পড়ে গিয়েছে, সেই সনাতন ধর্ম আসলে কী? অধিকাংশ মানুষই বলবেন, এতে আর নতুন কী আছে? সনাতন ধর্ম মানেই তো হিন্দুধর্ম! বেশিটাই ঠিক, কিন্তু কিছুটা উল্টো যুক্তিও আছে। কেন? একটু ব্যাখ্যায় যাওয়া যাক। সনাতন শব্দটির অর্থ কী? যা সৃষ্টি বা তারও আগে থেকে রয়েছে। ভবিষ্যতেও থাকবে। যার লয়-ক্ষয় নেই। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাকে যদি ধর্মগ্রন্থের আকর ধরা হয়, তাহলে তাতে সনাতন শব্দটির উল্লেখ মেলে। অর্জুনকে ধর্ম-অধর্ম, ন্যায়-অন্যায়ের পাঠ দেওয়ার সময় সনাতন ধর্ম শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। তাঁর কথায়, কোনও জাতির অন্দরে যদি অবক্ষয়ের বীজ বপন হয়ে যায়, তাহলে সেই জাতির সনাতন ধর্মের বিনাশ হবে।
শ্রীকৃষ্ণের বাণী। তাই সনাতন ধর্ম বলতে হিন্দুধর্মকেই যে বোঝানো হচ্ছে, সে ব্যাপারে মানুষের সন্দেহ থাকার কথা নয়। কিন্তু একটা প্রশ্ন এরপরও ওঠে—কোনও জাতির সনাতন ধর্ম কেন বললেন শ্রীকৃষ্ণ? তাহলে কি জাতিভিত্তিতে সনাতন ধর্মের বদল ঘটে? হিন্দুধর্মই কি একমাত্র সনাতন ধর্ম নয়? নরেন্দ্র মোদি যাঁকে গুরু, আদর্শ বলে প্রচার করেন, সেই স্বামী বিবেকানন্দ কী বলতেন? শিকাগো ধর্ম মহাসভায় গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘হিন্দু, জরাথ্রুষ্ট্রীয় ও ইহুদী—এই তিনটি ধর্মই প্রাগৈতিহাসিক যুগ হইতে বর্তমান কাল অবধি এই পৃথিবীতে প্রচলিত রহিয়াছে। এই ধর্মগুলির প্রত্যেকটিই প্রচণ্ড আঘাত সহ্য করিয়াছে, তথাপি লুপ্ত না হইয়া এগুলি যে এখনও জীবিত আছে, তাহাতেই প্রমাণিত হইতেছে যে, ইহাদের মধ্যে মহতী শক্তি নিহিত আছে।’ অর্থাৎ, তিনটি ধর্মকে একই সারিতে বেঁধে ফেলেছিলেন স্বামীজি। বোঝাতে চেয়েছিলেন, সৃষ্টি কিংবা সভ্যতার আদিকাল থেকে এই তিনটি ধর্ম মানব সমাজে রয়েছে। তাহলে কি শুধুই হিন্দুধর্মকে সনাতন আমরা বলতে পারি? তর্ক এবং প্রচারের খাতিরে সেটাও না হয় ধরে নেওয়া গেল। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের একাংশের কথায়, পালি ভাষায় প্রথম ধর্মের ক্ষেত্রে সনাতন শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায়। অর্থাৎ, বৌদ্ধধর্মে। স্বামী বিবেকানন্দের কথায় এবং লেখাতেও কিন্তু বৌদ্ধধর্মের উল্লেখ মেলে। শিকাগোতেই তিনি বলেছিলেন, ‘হে বৌদ্ধগণ! বৌদ্ধধর্ম ছাড়া হিন্দুধর্ম বাঁচিতে পারে না; হিন্দুধর্ম ছাড়িয়া বৌদ্ধধর্মও বাঁচিতে পারে না। অতএব উপলব্ধি করুন—আমাদের এই বিযুক্ত বিচ্ছিন্নভাব স্পষ্টই দেখাইয়া দিতেছে যে, ব্রাহ্মণের ধীশক্তি ও দর্শনশাস্ত্রের সাহায্য না লইয়া বৌদ্ধেরা দাঁড়াইতে পারে না এবং ব্রাহ্মণও বৌদ্ধের হৃদয় না পাইলে দাঁড়াইতে পারে না।’ হিন্দুধর্মের সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের সম্পর্ক এক নিমেষে স্থাপন করে দিয়েছিলেন স্বামীজি। বুঝিয়েছিলেন, সনাতন শব্দটি শুধু দাবির মধ্যে বেঁচে থাকে না। একে ধরতে পারার ক্ষমতা ধর্মের কোনও কারবারির নেই। তাই হিন্দুধর্মের ব্যাখ্যায় যত না তিনি সনাতন ব্যবহার করেছেন, তার থেকে অনেক বেশি শোনা গিয়েছে বেদোক্ত বা বৈদিক শব্দটি। সনাতন ধর্ম মাত্রেই আসে আত্মা-পরমাত্মার প্রসঙ্গ। পূর্বজন্মের প্রসঙ্গ। ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ছত্রে ছত্রে তার উল্লেখ করেছেন স্বামীজি। কিন্তু সনাতন ধর্মে যদি জাতিভেদ কিংবা বিদ্বেষ-বিভাজনের প্রসঙ্গ আসে? তার ঘোরতর নিন্দা করেছেন স্বামীজি। বলেছেন, ‘ভারতে উচ্চতম বর্ণের মানুষও সন্ন্যাসী হইতে পারে, নিম্নতম বর্ণের মানুষও সন্ন্যাসী হইতে পারে, তখন উভয় জাতিই সমান। ধর্মে জাতিভেদ নাই; জাতিভেদ কেবল সামাজিক ব্যবস্থা।’ যদি বলা হয়, উদয়নিধি স্ট্যালিন শুধুই এই জাতিবিদ্বেষ এবং বিভাজনের ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার কথা বলেছেন? তাহলে কি খুব ভুল বলা হবে। বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক শুরু হওয়ার পর তিনি নিজেও কিন্তু এমন যুক্তিই দিয়েছেন। এবং বলেছেন, তাঁর মন্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা হচ্ছে। যে স্বামীজিকে ভোট এলেই মোদিজির মনে পড়ে (কিংবা বাংলায় প্রচারে এলে), তাঁর হিন্দুধর্মের বিশ্লেষণের সারমর্মও কিন্তু এটাই ছিল। উদয়নিধি বা ডিএমকে তাদের রাজনীতি করছে। দক্ষিণী রাজনীতিতে তাদের ভাষা এবং ধর্মীয় মতাদর্শকে উত্তরের থেকে আলাদা করে দেখানোর প্রবণতা আজকের নয়। পেরিয়ার করেছেন, জয়ললিতা-করুণানিধি করেছেন, স্ট্যালিনও করছেন। দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিড়ীয় সংস্কৃতি ও ধর্ম দেশের মধ্যে প্রাচীনতম। বলা হয়, শুধু ভারত নয়, বিশ্বের ইতিহাসে আজিবীকের থেকে প্রাচীন ধর্ম অন্য কিছু নেই। তাই তারা নিজেদের সংস্কৃতিকে রাজনীতির দরবারে নিয়ে আসবেই। ঠিক যেভাবে গেরুয়া ব্রিগেড চালিয়ে যাচ্ছে হিন্দুত্বের মেরুকরণ। বিতর্কিত এই ইস্যুতে মাদ্রাজ হাইকোর্টও বলেছে, সনাতন ধর্ম যদি হিন্দুদের জীবন যাপনের জন্য কয়েকটি বৈষম্যমূলক ‘কর্তব্যমাত্র’ হয়ে থাকে, তাহলে তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয়। বিচারপতি প্রশ্ন তুলেছেন, ‘একজন নাগরিক কি তাঁর দেশকে ভালোবাসবেন না? দেশের জন্য কাজ করা কি তাঁর কর্তব্য নয়?’ ধর্মে তো এমন কর্তব্য পালনের কথাও বলা আছে। তা অবশ্যই শিরোধার্য। কিন্তু দিনের শেষে সবটাই ছুৎমার্গ এবং জাতপাতে এসে দাঁড়িয়ে গেলে, সনাতন ধর্মেরও দেশে স্থান থাকা উচিত নয়। কারণ, তা ভারতের মৌলিক অধিকারের বিরুদ্ধাচরণ করছে। সংবিধানকে মান্যতা দিচ্ছে না।
এসব অবশ্য মোদিজি মানবেন না। কারণ, তা তাঁর ভোটের জন্য সুখকর নয়। বিজেপির চাই মেরুকরণ। জাতপাতের রাজনীতি, বিদ্বেষ, বিভাজন। ওটা ভালোরকম চাপিয়ে দিতে না পারলে স্বস্তি নেই। উন্নয়ন? ও তো খাতায় কলমে। মুখে তাঁর বিকাশ, অমৃতকাল, ৫০ বছরের প্ল্যানিং। কিন্তু নির্বাচনী মরশুমে এসব পিছনের সারিতে। কারণ অমৃতকাল ভোটের ঝুলি ভরাবে না। হিন্দুধর্মকে কাজে লাগিয়ে সমাজটাকে টুকরো টুকরো করে দিতে হবে। সেটাই ভোটের সমীকরণ। পরীক্ষিত। অকৃত্রিম। হিন্দুত্ব তাই এসেছে সনাতনী মোড়কে। চব্বিশের নতুন প্যাকেজ। মোদিজি নিজে বলছেন সনাতন খতরে মে হ্যায়। কিন্তু ধন্দ লাগে, সনাতন ধর্মের আবার বিপদ কী? হাজার-লাখো বছর ধরে তার অধিষ্ঠান। বিরোধীদের একটা জোট ক্ষমতায় এসে গেলে তা ধ্বংস হয়ে যাবে? যুক্তিটা একটু কাঁচা হয়ে গেল না মোদিজি? লোকে বিশ্বাস করবে তো? আপনি ভাবছেন, হয়তো করে নেবে। কারণ, এদেশে এখনও বহু মানুষ হিন্দু ধর্ম বলতে হিন্দুত্ব বোঝে, গোঁড়ামিকে প্রশ্রয় দেয়, আবার আধপেটা খেয়ে মিছিলে-মিটিংয়ে ভক্তি দেখাতে যায়। সেই অংশের জন্য সঠিক স্ট্র্যাটেজি। কিন্তু ওই কয়েকটা লোক মিলে তো ভারতবর্ষ নয়! ১৩০ বছর আগে আমেরিকার মাটিতে দাঁড়িয়ে এক বাঙালি সন্ন্যাসী ঘোষণা করে গিয়েছিলেন, ‘বহুত্বের মধ্যে একত্বই প্রকৃতির ব্যবস্থা, হিন্দুগণ এই রহস্য ধরিতে পারিয়াছেন।... হিন্দুগণ আবিষ্কার করিয়াছেন: আপেক্ষিককে আশ্রয় করিয়াই নিরপেক্ষ পরম তত্ত্ব চিন্তা উপলব্ধি বা প্রকাশ করা সম্ভব।’ তারপরও গেরুয়া ব্রিগেড একত্বকে ভেঙে বহুত্ব প্রতিষ্ঠায় মেতে উঠবে আর আশা করবে, স্বামীজি তাদের বাঁচাবে!
স্বামী বিবেকানন্দ অফিসের দেওয়ালে টাঙানো কোনও ছবি নন, কোনও ব্যক্তি নন, রাজনীতির খিচুড়ির চাল-ডালও নন। তিনি একটি চেতনা। শতবর্ষ ধরে যা মানুষের মননে বসে রয়েছে। জাত, ধর্মের অনেক ঊর্ধ্বে থাকা কর্মযোগী। সন্ন্যাসী। আত্মার মতোই সেই চেতনাকে তরবারি ছেদন করতে পারে না, অগ্নি দগ্ধ করতে পারে না, জল আর্দ্র করতে পারে না এবং বায়ু শুষ্ক করতে পারে না। রাজনীতি কোন ছাড়!
১৩০ বছর আগে ঠিক আজকের দিনে বিশ্বের সর্বধর্মের মানুষের সামনে বৈদিক ধর্মকে তুলে ধরেছিলেন স্বামীজি। না, আসলে তিনি তুলে ধরেছিলেন ভারতকে, এই দেশের সহনশীলতাকে, আধ্যাত্মিক চেতনাকে। তিনিই কি না এখন জাতপাত, বিভাজনের রাজনীতির ভাষণে প্রাসঙ্গিক? একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না তো? আপনি বরং আচ্ছে দিনের স্বপ্ন নিয়ে থাকলেই ভালো। আজ না হোক, ২০৪৭ সালের একটা টার্গেট তো রয়েইছে। আমরা নাও থাকতে পারি, স্বামীজি কিন্তু তখনও থাকবেন। সনাতন ধর্মও থাকবে। প্রার্থনা করি, বিভাজন-বিদ্বেষ আর থাকবে না।