বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

এক জাতি, এক মেরু
পি চিদম্বরম

আমি লোকজনের কাছে জানতে চেয়েছি, কোন ‘একটা জিনিস’ তাকে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন করে। কিন্তু প্রায় সকল উত্তরদাতাই—‘একটা জিনিস’ নয়, সাধারণত, দু-তিনটে জিনিস সম্পর্কে বলতে চান। কেন এটা, তা পুরো বোঝা যায়। উদ্বেগের বিষয় হিসেবে, একজন মা এবং গৃহকর্মে নিযুক্ত মহিলা শুধু মুদ্রাস্ফীতি বা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের অগ্নিমূল্যের বিষয়টাই বেছে নিতে পারেন কী করে? তাঁর সন্তানের নিরাপত্তার বিষয়টা কি তিনি বলতে পারেন না? একজন কারখানা শ্রমিক অস্থির এলাকায় জনতার হিংসার প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে, কীভাবে শুধু তাঁর চাকরির নিরাপত্তার জন্য কথা বলতে পারেন? কোনও অল্পবয়সি দম্পতিকে কেবল তাঁদের বাবা-মায়ের সম্মতির কথা ভাবলেই কি চলবে, এলাকার ‘মরাল বিগ্রেড’-এর নিগ্রহের ভয়ের কথা কী করে উপেক্ষা করবেন তাঁরা?
উত্তরগুলোই আমাদের বহু সমস্যার কথা মনে করায়, যেসব নিয়ে ভারতের মানুষ জর্জরিত। 
এই অজুহাত দেওয়া চলে না যে শত শত বছরের না-হলেও, সমস্যাগুলি বহু দশকের। এই ধরনের নির্মমতার জবাবে আমাকে এটাই বলতে হবে 
যে, ‘যেসব অনাচার এতকাল ছিল তা যদি চলতেই থাকে এবং তাদেরই জয় হয়, তাহলে তিন তিনটি প্রজন্ম ধরে কেন আমরা স্বাধীনতা ও স্বশাসনের জন্য লড়াই করেছিলাম?’
রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিবিধ মডেল
সরকার হল জনগণের, জনগণের দ্বারা এবং জনগণের জন্য। একটি দেশের উন্নয়ন, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, মানবাধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতা, সংস্কৃতির বিকাশ, অগ্রগতি, সমতা এবং সৌভ্রাতৃত্ব নিশ্চিত করার এটাই হল সর্বোত্তম উপায়। গত আড়াইশো বছর যাবৎ এই ধারণার গ্রহণযোগ্যতাই ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। এই লক্ষ্যগুলিই জাপানের মতো এক-জাতি (সিঙ্গল এথনিক) থেকে শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মতো সর্বাধিক বহু জাতির সমাজকে পর্যন্ত চ্যালেঞ্জ করে। আমি বিশ্বাস করি যে, চ্যালেঞ্জ শুধুমাত্র একটি উপায়েই মোকাবিলা করা সম্ভব—সেটা হল ‘ঐক্যবদ্ধ’ জনগণের সরকার। আর সেই সরকার পাওয়া যেতে পারে—‘নিঃস্বার্থ’ জনগণের দ্বারা ‘সকল’ মানুষের জন্য প্রতিষ্ঠিত হলে।
বিভিন্ন দেশ বিবিধ পথ বেছে নিয়েছে। বর্তমান বিশ্বে চীন একদলীয়, আধিপত্যবাদী (ওয়ান-পার্টি হেজিমোনিক) সরকারের মডেল দেখিয়েছে। রাশিয়ার বর্তমান মডেলটি হল—সামরিকপন্থী এবং সম্প্রসারণবাদী (মিলটারিস্টিক, এক্সপ্যানশনিস্ট)। মায়ানমারসহ অনেকগুলো দেশ সামরিক স্বৈরশাসনের (মিলিটারি ডিক্টেটরশিপ) মডেল সামনে এনেছে। ইরান, আফগানিস্তান এবং অন্য কয়েকটি দেশ দিয়েছে একটি দিব্যতান্ত্রিক, ধর্ম-প্রবণ (থিওক্র্যাটিক, রিলিজিয়ন-ইনফিউজড) মডেল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্সিয়াল মডেল হলেও ক্ষমতা পৃথকীকরণ এবং চেকস অ্যান্ড ব্যালান্সেস-এর ব্যাপারে তারা কঠোর। অন্যদিকে, ইউরোপের বেশিরভাগ দেশ, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং কানাডা সংসদীয় গণতন্ত্রের ব্রিটিশ মডেল অনুসরণ করে। এই ধরনের সরকারের শীর্ষে থাকেন একজন ‘এগজিকিউটিভ’, প্রতিটি দিনের জন্য তিনি তিন সংসদের কাছে দায়বদ্ধ।
ভারত ব্রিটিশ মডেল অনুসরণ করেছে। বিশ্বের সবচেয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ হিসেবে—এত এত জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, ইতিহাস ও সংস্কৃতি এবং রীতিনীতির মানুষের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য এর চেয়ে উত্তম উপায় কিছু ছিল না। আমি বিশ্বাস করি যে, ভারতের জন্য ব্রিটিশ মডেল এখনও সর্বোত্তম উপায়।
একতা প্রকল্প
বর্তমান শাসকরা—বিজেপি, তার মিত্ররা এবং বিজেপির গোপন সমর্থকরা তুলে ধরে এর উল্টো এক মডেল। কী সেটা? ভারতীয় জনগণ ‘এক’ এবং এই ‘একতা’র ভিতরে সমস্ত পার্থক্য অবশ্যই একীভূত হয়ে যাওয়া উচিত। ইতিহাস এবং গত ৭৫ বছরের জীবন্ত অভিজ্ঞতার সামনে এই একত্বের গবেষণা যে নস্যাৎ হয়ে যায়, তারা তা মানতে চায় না। তাদের একত্বের তত্ত্বটি ভাষা, খাদ্য, পোশাক, সামাজিক আচার-আচরণ, এমনকী ব্যক্তিগত আইন ও রীতিনীতিতেও নাক গলায়।
সুতরাং ভাষা হিসেবে তারা হিন্দিই চায়। ব্যাকরণ এবং সমৃদ্ধ সাহিত্যসমেত, তার চেয়ে প্রাচীনতর অনেক ভাষা থাকা সত্ত্বেও সেসব অগ্রাহ্য করা হবে।
সুতরাং, সংখ্যাগরিষ্ঠের হুকুমতোই স্কুল-কলেজে পোশাক বিধি জারি হবে এবং হস্টেলে খেতে হবে তাদেরই মতমতো খাবার। যেসব আইনে অসবর্ণ এবং ভিন্নধর্মে বিবাহের অনুমতি রয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদীদের ফতোয়ায় বাতিল হবে সেসব। তরুণ দম্পতিদের সামাজিক আচার-আচরণের উপর খবরদারির খুল্লামখুল্লা লাইসেন্স থাকবে মরাল ব্রিগেডের হাতে। সংখ্যালঘু শ্রেণি ও জনজাতিভুক্ত মানুষের নির্দিষ্ট প্রথা এবং ব্যক্তিগত আইন বাতিল করা হবে একটি অভিন্ন দেওয়ানি বিধি (ইউসিসি) চাপিয়ে দিয়ে। 
এছাড়া, মনরেগার শ্রমিকদের মজুরি প্রদানের জন্য একমাত্র আধারভিত্তিক পেমেন্ট সিস্টেম অনুসরণ বাধ্যতামূলক করার পদক্ষেপের নেপথ্যে রয়েছে একতার তাড়না। সংবাদ সংস্থা ‘ওয়্যার’ জানাচ্ছে, মনরেগা স্কিমের ওয়েবসাইটে গত ২৮ আগস্টের তথ্য বলছে, দেশের মোট ১৪ কোটি ৩৪ লক্ষ নথিভুক্ত সক্রিয় শ্রমিকের মধ্যে ১১ কোটি ৭২ লক্ষ শ্রমিক মজুরি পাওয়ার যোগ্য বিবেচিত হবেন। কাজ করতে ইচ্ছুক শ্রমিকদের প্রায় ২০ শতাংশ বঞ্চিত হবেন মজুরি প্রাপ্তি থেকে। মনে রাখবেন, এই বঞ্চিতরা হলেন দরিদ্রদের মধ্যে সবচেয়ে দরিদ্র। কারণ, তাঁরা বাড়ির কাছাকাছি জায়গায় অন্যকোনও কাজ খুঁজে পাচ্ছেন না।
এই ‘একতা’র ধারণা বলবৎ করার পরিণামে গরিবদের সঙ্গে বঞ্চনার আর একটি উদাহরণ হল—ওয়ান নেশন ওয়ান রেশন কার্ড (ওএনওআরসি)। এই ব্যবস্থার জাঁতাকলে পড়ে তারা খাদ্য পাচ্ছে না। দেশে আনুমানিক ৪৫ কোটি অভ্যন্তরীণ অভিবাসী (ইন্টারনাল মাইগ্রান্টস) রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে প্রায় ৫ কোটি ৪০ লক্ষ হলেন আন্তঃরাজ্য অভিবাসী (ইন্টার-স্টেট মাইগ্রান্টস)। ওএনওআরসির অধীনে, আধার-সংযুক্ত একটি রেশন কার্ড মারফত ওই কার্ডধারীর দেশের যেকোনও ন্যায্যমূল্যের দোকান থেকে রেশন পাওয়ার কথা। ‘ইন্ডিয়াস্পেন্ড’-এর মতে, সরকারি তথ্য বলছে যে—২০১৯ এবং ২০২৩-এর মধ্যে, আন্তঃরাজ্য লেনদেন হয়েছে বছরে গড়ে মাত্র ১০ লক্ষ ৪০ হাজার। কেন ওয়ান নেশন স্কিম ৫ কোটিরও বেশি দরিদ্র আন্তঃরাজ্য অভিবাসীদের খাদ্য সরবরাহ করতে অক্ষম হল? কারণ ওএনওআরসির অধীনে কোনও ‘রাজ্য’ দায়ী নয় এবং জবাবদিহির কোনও দায়বদ্ধতা নেই ‘প্রযুক্তি’র।
সিদ্ধান্তমূলক পর্যায়
ওয়াননেস প্রজেক্ট বা একতার প্রকল্প নিয়ে আমরা একটা সিদ্ধান্তমূলক পর্যায়ে চলে যাচ্ছি। সেটা হবে ‘ওয়ান নেশন, ওয়ান পোল’ বা ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’। আইন কমিশন এবং অন্য একাধিক কমিটি পরিষ্কার করে দিয়েছে যে, এই ধারণা কার্যকর করার সামনে বিপুল রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক আপত্তি তো আছেই, ওইসঙ্গে অন্তত পাঁচটি সাংবিধানিক সংশোধনীও জরুরি। তা সত্ত্বেও একটা পুতুল কমিটি নিয়োগ করেই সরকার এই প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করতে চাইছে। লক্ষ্য এক ‘নির্বাচন (one poll)’ নয়; আসল লক্ষ্য হল একটি ‘মেরু’ (one pole)—কেন্দ্রীয় শাসক দল বিজেপির চারপাশের সমগ্র রাজনৈতিক ব্যবস্থা পুনর্গঠিত হয়ে যাবে। জাতীয় ও রাজ্য নির্বাচন একত্রে করার মাধ্যমে বিজেপি চাইছে—লোকসভায় দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জিতে ফিরতে এবং অনেকগুলো রাজ্যেও ক্ষমতা দখল করতে। আর এই প্রচেষ্টা সফল হলে সংবিধানের আমূল পরিবর্তনের পথটা প্রশস্ত হয়ে যাবে, সমস্ত বাধাও দূর হয়ে যাবে হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সামনে থেকে। এ এক দুঃসাহসিক জুয়া। এখন দেখার জিতবেন কে—মোদি নাকি জনগণ?
 লেখক সাংসদ ও ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। মতামত ব্যক্তিগত

11th     September,   2023
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ