প্রাক্তন বিচারপতি, অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস কর্তার পর এবার কি কোনও পড়ুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ অলঙ্কৃত করতে চলেছেন? প্রশ্নটা অবান্তর মনে হতেই পারে। কিন্তু উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। কারণ পড়ুয়াকে উপাচার্য করাটা আমাদের মাননীয় রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের বাসনা। তা তিনি চেপে না রেখে ব্যক্ত করেছেন কালিম্পংয়ে এক কলেজের অনুষ্ঠানে। বলেছেন, ‘এবার বাংলা থেকে একজন পড়ুয়া উপাচার্য পাবে। উজ্জ্বল ও সেরা পড়ুয়াকে উপাচার্য করা হবে। তিনি হয়তো এখন গবেষণা করছেন। তবে অতি দ্রুত উপাচার্য হবেন। যা ভারতে প্রথম।’ ভাবা যায়? ইউজিসির গাইড লাইন, ন্যূনতম ১০ বছরের অধ্যাপনার অভিজ্ঞতার নিয়ম মানার কোনও বালাই নেই! পড়ুয়া হবেন উপাচার্য? ভাবা না গেলেও ভাবতে শিখতে হবে। কারণ মহামহিম শেষ দেখে ছাড়ার হুমকি দিয়েছেন। সেটা আবার রবীন্দ্রনাথ, নেতাজি এবং সুভাষচন্দ্রের নামে শপথ করে। তাই জল শেষপর্যন্ত কোথায় গড়াবে, তা কল্পনাও করা যাচ্ছে না।
রাজ্যপাল রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান। তাই তাঁকে সংবিধান নানা সুরক্ষাকবচ দিয়ে রেখেছে। কিন্তু পদটি আলঙ্কারিক। সেই সাংবিধানিক প্রধান যখন প্রশাসনিক কর্তাকে ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন তখনই বাধে দ্বন্দ্ব। তবে, ‘ডাবল ইঞ্জিন’ সরকার হলে রাজ্যপালের তেমন কাজ থাকে না। কিন্তু বিরোধী দলের সরকার হলেই ওয়ার্ক লোড বেড়ে যায়। প্রায় ৫০ বছর কেন্দ্রে ও বাংলায় সরকার রয়েছে ভিন্ন দলের। তাই রাজ্য ও রাজ্যপালের সংঘাত লেগেই থাকে। তবে, একুশের নির্বাচনের পর লড়াইটা চরমে উঠেছে। সেই লড়াইয়ে কেন্দ্রের অন্যতম সেনাপতি সিভি আনন্দ বোস।
রাজ্যপাল কাগজে কলমে রাজ্যের অভিভাবক। কিন্তু রাজ্যবাসীর কাছে কাজের জবাবদিহি করতে হয় না। তাই মনোনীত পদাধিকারীর একটাই লক্ষ্য, নিয়োগকর্তাকে খুশি রাখা। নিয়োগকর্তাকে সন্তুষ্ট রাখতে পারলে প্রশস্ত হয় পদোন্নতির রাস্তাও। সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গিয়েছেন প্রাক্তন রাজ্যপাল জগদীপ ধনকার।
জগদীপ ধনকার কে ছিলেন? সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী। দেশের ক’জন তাঁকে আইনজীবী হিসেবে চিনতেন? আইনজীবী থেকে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল। তিনি যতদিন এই চেয়ারে অধিষ্ঠান করেছেন ততদিন রাজ্য সরকারের মুণ্ডপাত করে গিয়েছেন। এমনকী বিপুল জনাদেশ নিয়ে তৃণমূল তৃতীয়বার ক্ষমতায় ফেরার পরেও তিনি খোঁচা দিতে ছাড়েননি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শপথ নেওয়ার দিনেই তিনি তাঁর ‘জাত’ চিনিয়েছিলেন। সবাইকে চমকে দিয়ে বলেছিলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক হিংসা ক্রমবর্ধমান’। সেইদিনই দিল্লির বিজেপির প্রমোশনের তালিকায় উঠে গিয়েছিল তাঁর নাম। ছিলেন রাজ্যপাল, হয়ে গেলেন দেশের উপরাষ্ট্রপতি।
এখন তিনি রাজ্যসভায় বসে বাঘা বাঘা নেতা, মন্ত্রীদের নির্দেশ দেন, প্রয়োজন মনে করলে ধমকান। তাঁর ধমক খেয়ে দাপুটে মন্ত্রীও স্যার, স্যার করে বসে পড়েন। জনগণের টাকায় বিশ্বের যে কোনও দেশে ঘুরতে পারছেন। প্রাসাদের মতো বাংলোয় বিলাসবহুল জীবন কাটাচ্ছেন। এমন সুখভোগের হাতছানি থাকলে কে আর নিয়োগকর্তার দেওয়া টার্গেট পূরণ করতে দু’বার ভাববেন?
জগদীপ ধনকারের পদোন্নতি দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী। অবসরের সময় এগিয়ে আসছে। তাই তাঁরও একটা ভালো ‘বার্থ’ দরকার। সেইজন্য একবার মুখ্যমন্ত্রীকে, একবার নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেনকে কুৎসিতভাবে আক্রমণ করছেন। কারণ দু’জনেই কট্টর বিজেপি বিরোধী। নরেন্দ্র মোদির ঘোর সমালোচক। তিনিও বুঝেছেন, এমন কিছু করে দেখাতে হবে যাতে ‘নিয়োগকর্তা’র কৃপাদৃষ্টি তাঁর উপর পড়ে।
মুখের কথায় কাজ হচ্ছে না দেখে বিদ্যুৎবাবু এখন বিশ্বভারতীর ওয়েবসাইটকে কাজে লাগাচ্ছেন। সেখানে এমন সব মন্তব্য করছেন যাতে শুধু একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গরিমা ক্ষুণ্ণ হচ্ছে তা নয়, সম্প্রীতি নষ্টের আশঙ্কাও প্রবল। তা সত্ত্বেও বিজেপির কোনও শীর্ষ নেতা বা কেন্দ্রীয় সরকার তাঁকে থামানোর প্রয়োজন মনে করেনি। কারণ কেন্দ্রীয় এজেন্সি ও কেন্দ্র নিযুক্ত প্রতিনিধিকে দিয়ে বিরোধীদের হেনস্তা ও বিব্রত করাটাই বিজেপির এজেন্ডা।
অনেকে বলছেন, নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহের আমলে নিযুক্ত রাজ্যপালদের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিরোধী দলের সরকারকে অপদস্থ করা। সেই লক্ষ্যেই সিভি আনন্দ বোস একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যকে সরিয়ে দিয়েছেন। সেখানে বসাচ্ছেন আরএসএস ঘনিষ্ঠদের। রাজ্য সরকারের অভিযোগ, তিনি কোনও নিয়ম, গাইডলাইন মানছেন না। তাই মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক প্রধানের ফারাকটা বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন। আর তাতেই ফোঁস করে উঠেছেন বোস সাহেব।
বঙ্গ বিজেপির নেতাদের পিছনে ফেলে দিয়ে রাজ্য সরকারকে কড়া চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বসেছেন তিনি। দফায় দফায় আঙুল তুলে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার শপথ নিয়েছেন। তাঁর এই আচরণে বঙ্গ বিজেপির কেউ কেউ অবশ্যই খুশি। এবার বোস সাহেবকে তাঁরা জগদীপ ধনকারের যোগ্য উত্তরসূরি মনে করছেন। কিন্তু একজন সাংবিধানিক প্রধানের এমন আচরণ কি সাধারণ মানুষ ভালোভাবে নেবে?
যোগ্যতার তুলনায় উচ্চাকাঙ্ক্ষা বেশি হলে তাঁদের দিয়ে যে কোনও কাজ করানো সহজ হয়। তাঁরা নীতি নৈতিকতার ধার ধারেন না। সেই কারণে প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক দল দক্ষ এবং যোগ্য অপেক্ষা ‘ইয়েস ম্যান’ বেশি পছন্দ করে। আজ যে বামপন্থীরা উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে রাজ্যের শাসক দলের বিরুদ্ধে আঙুল তুলছে তারা হয়তো নিজেদের ইতিহাস ভুলে গিয়েছে। কিন্তু মানুষ বাম আমলে শিক্ষাঙ্গনে ‘অনিলায়নে’র কথা ভোলেনি।
আশির দশকের মাঝামাঝি সময় সন্তোষ ভট্টাচার্যকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য করেছিলেন তৎকালীন রাজ্যপাল এ পি শর্মা। সন্তোষবাবু কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। কিন্তু ১৯৬৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টি বিভাজনের সময় সন্তোষবাবু সিপিআইয়ে থেকে গিয়েছিলেন। সেটাই ছিল জ্যোতি বসু, অনিল বিশ্বাসদের গোঁসার কারণ। তাই সন্তোষবাবুকে পদত্যাগে বাধ্য করার জন্য বামপন্থীরা সবরকমভাবে চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিল।
উপাচার্য হিসেবে সন্তোষবাবুকে বামপন্থীদের স্বাগত জানানোর ধরনটা আজও দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। সিঁড়ি থেকে তাঁর ঘরের সামনে পর্যন্ত বামপন্থী কর্মচারী সংগঠনের সদস্যরা সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁদের মুখে ছিল ‘সন্তোষ ভট্টাচার্য মুর্দাবাদ’ স্লোগান। তবে, তাতেও লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্সের গবেষকের আত্মবিশ্বাসে বিন্দুমাত্র চিড় ধরেনি। বামপন্থীদের সর্বাত্মক অসহযোগিতা সত্ত্বেও তিনি পূর্ণ সময় উপাচার্য ছিলেন। শোনা যায়, সন্তোষবাবুর অনমনীয় মানসিকতাকে দুমড়ে মুচড়ে দিতে জ্যোতি বসুকেও মাঠে নামানো হয়েছিল। জ্যোতিবাবু রাইটার্সে ডেকে তাঁকে ধমকানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু লাভ হয়নি। তিনি জ্যোতিবাবুর মুখের উপর ‘বাই’ বলে বেরিয়ে এসেছিলেন।
সন্তোষবাবু উপাচার্য হিসেবে কী পরিস্থিতির মধ্যে কাজ করেছিলেন তা লিখে গিয়েছেন তাঁর ‘রেড হ্যামার ওভার ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি’ বইয়ে। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘ওরা(সিপিএম) জানত, আমার রাজনৈতিক অতীত এবং মতাদর্শ। সেই সঙ্গে ওরা বুঝেছিল, আমি কোনও দিনই ওদের কথামতো চলব না।’ তিনি সিপিএমের উপর এতটাই বিরক্ত ছিলেন যে মৃত্যুর পর তাঁর দেহ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে না নিয়ে যাওয়ার কথা পরিবারের সদস্যদের বলে রেখেছিলেন। সেই জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও সন্তোষবাবুর মরদেহ ক্যাম্পাসে নিয়ে যেতে দেওয়া হয়নি। হ্যাঁ, এরপরেও সিপিএমের নেতারা কথায় কথায় ‘মেরুদণ্ডে’র কথা বলে অন্যকে উপহাস করেন।
দিল্লি বিজেপি রাজ্যপালের মতো অত্যন্ত সম্মানীয় পদটিকেও তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগাচ্ছে। তারা বুঝিয়ে দিতে চাইছে, রাজ্যপাল এখন আর কেবল সংবিধানের রক্ষাকর্তাই নন, নিয়োগকর্তার টার্গেট পূরণ করাও তাঁদের ডিউটি। ফলে বিজেপির আমলে রাজ্যপাল পদটি অনেকের কাছেই হয়ে উঠেছে স্রেফ ‘কেরিয়ার’। তাঁরা বুঝে গিয়েছেন, নিয়োগকর্তার তৈরি করে দেওয়া রোস্টার মেনে কাজ করলেই চাকরি পাকা। উপরওয়ালার নেক নজরে পড়লে হওয়া যায় উপরাষ্ট্রপতিও। আর সত্যি ফাঁস করলে? হতে হয় সত্যপাল মালিক। তাই নিয়োগকর্তাকে সন্তুষ্ট করাই তাঁদের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারজন্য ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ গোল্লায় গেলেও, প্রাক্তন উপাচার্যরা রাস্তায় বসলেও কুছ পরোয়া নেই। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ জি-২০এর সাফল্য কামনায় গঙ্গাপুজো করা। তাতে উজ্জ্বল হয় ‘কেরিয়ার’। আর ‘রাজনৈতিক প্রভু’রা তো সেটাই চান।