বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

আদালতের নির্দেশে হুঁশ
ফিরবে কি কেন্দ্রের?
তন্ময় মল্লিক

এবার কি ১০০ দিনের প্রকল্প নিয়ে বাংলাকে কেন্দ্রের ল্যাজে খেলানো বন্ধ হবে? কলকাতা হাইকোর্ট কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে জবাব চাওয়ায় এনিয়ে শুরু হয়েছে চর্চা। প্রায় দেড় বছর ধরে মনরেগা প্রকল্পের টাকা বাংলাকে দিচ্ছে না নরেন্দ্র মোদির সরকার। তাতে বিপাকে পড়েছে গ্রামের গরিব মানুষ। তাঁদের হাতে টাকা নেই। রাজ্য সরকার প্রাপ্য মিটিয়ে দেওয়ার বারবার দাবি জানিয়েছে। লাভ হয়নি। তবে আদালত হস্তক্ষেপ করায় অনেকেই বলছেন, এবার একটা হেস্তনেস্ত হবে। এরপরেও কেন্দ্র যদি নানা অজুহাতে টাকা দিতে টানবাহানা করে? তাহলে বুঝতে হবে, ১০০ দিনের প্রকল্পে দুর্নীতির চেয়েও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা অনেক বেশি। আর তার হিসেব বিজেপিকে চোকাতে হবে এই পঞ্চায়েত ভোটেই।
১০০ দিনের কাজ নিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মধ্যে সংঘাত চলছে দেড় বছর। বঙ্গ বিজেপি একটা চিঠি পাঠালেই চলে আসছে কেন্দ্রীয় টিম। তদন্ত হচ্ছে। নির্দেশ দিচ্ছে ব্যবস্থা নেওয়ার। সেব্যাপারে পদক্ষেপ করে রাজ্য পাঠিয়ে দিচ্ছে ‘অ্যাকশন টেকেন’ রিপোর্টও। তাতেও বাংলাকে ভাতে মারার রাস্তা থেকে কেন্দ্রকে একচুলও নড়ানো যাচ্ছে না। কিন্তু ভাতে মারতে গেলে ভোটে মরার আশঙ্কা যে প্রবল হয়, সেটা কি বিজেপি বুঝতে পারছে না? গরিবের শ্রমের টাকা আটকে দেওয়ায় পঞ্চায়েত ভোটে বিজেপি পড়তে পারে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে।
বকেয়া টাকা মিটিয়ে দেওয়ার দাবিতে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করেছে পশ্চিমবঙ্গ খেতমজুর সমিতি। তার পরিপ্রেক্ষিতেই আদালত প্রশ্ন তুলেছে, কেন দীর্ঘদিন আটকে রাখা হচ্ছে টাকা? হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি টি এস শিবজ্ঞানমের বক্তব্য, যদি দুর্নীতি হয়ে থাকে, পদক্ষেপ নিন। শস্য থেকে তুষ ঝেড়ে ফেলুন। টাকা আটকে রেখে এভাবে যোগ্যদের বঞ্চিত করা যায় না।
হাইকোর্টের মহামান্য প্রধান বিচারপতি রাজ্যের খেটে খাওয়া মানুষের মনের কথাটাই বলে দিয়েছেন। বকেয়া আদায়ের জন্য প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গত বছর ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে তদন্ত বন্ধের আর্জি জানাননি। বলেছিলেন, তদন্ত  চলুক। কিন্তু রাজ্যের প্রাপ্য মিটিয়ে দিন। গরিবের পেটে লাথি মারবেন না। তাতেও চিড়ে ভেজেনি।
কেন্দ্র এরাজ্যে ১১৭টি টিম পাঠিয়ে দু’টি অর্থবর্ষে কাজের জন্য মোট ৫কোটি ৭৯ লক্ষ টাকা উদ্ধারের নির্দেশ দিয়েছিল। রাজ্যের সোশ্যাল অডিটে উঠে এসেছিল আরও আড়াই কোটি টাকার অনিয়ম। 
তার বেশিরভাগই আদায় হয়েছে। শেষ দু’বছরে সৃষ্টি হওয়া ৩৬ কোটি ৪২ লক্ষ শ্রমদিবসের মধ্যে আঙুল উঠেছে ১ লক্ষ ৩৬ হাজারের দিকে। মাত্র ০.০৩ শতাংশ। আর এরজন্যই টাকা দিচ্ছে না কেন্দ্র। এমনটাই দাবি রাজ্যের।
বঙ্গ বিজেপির নেতা থেকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের একটাই কথা, ‘দুর্নীতির তদন্ত চলছে। তাই বাংলাকে টাকা দেওয়া হবে না।’ ফাটা রেকর্ডের মতো এই কথাটা বাজিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার এখনও দুর্নীতির কোনও পরিসংখ্যান প্রকাশ করেনি। এনিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের প্রশ্নও করা যাচ্ছে না। প্রশ্ন করলেই বিরক্ত হচ্ছেন। কেউ কেউ আবার মওকা বুঝে দিচ্ছেন ‘নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা’র শিক্ষাও।
মানুষ কখন বিরক্ত হয় বা রেগে যায়? যখন তার কাছে যুক্তি থাকে না। এক্ষেত্রেও কি তেমনটাই হচ্ছে? অনেকে বলছেন, ১০০ দিনের টাকা দেওয়া নিয়ে অনেক রাজনীতি হয়েছে। এবার দুধ কা দুধ, পানি কা পানি হয়ে যাবে। কারণ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি শস্য থেকে তুষ আলাদা করে প্রকল্প চালুর পক্ষে মত দিয়েছেন। ১০০ দিনের প্রকল্পের ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’দের শাস্তি সুনিশ্চিত করার একটা সুযোগ কেন্দ্রীয় সরকার পেয়ে গিয়েছে। তদন্ত রিপোর্ট হাতেই আছে। বাংলার টাকা আটকে রেখেছে নিশ্চয়ই তারই ভিত্তিতে। কিন্তু এরপরেও কেন্দ্র যদি গড়িমসি করে? তাহলে আরও মজবুত হবে ‘প্রতিহিংসার রাজনীতি’র তত্ত্ব। মানুষ বুঝবে, একুশের নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে জেতানোর জন্য ‘দুর্নীতি’কে শিখণ্ডী করে বাংলার গরিবগুর্বোদের উপর ঝাল মেটাচ্ছে বিজেপি।
১০০ দিনের প্রকল্পে দুর্নীতি হয়নি, এমন দাবি অতি বড় তৃণমূল সমর্থকও করবেন না। অনেক জায়গায় একই পুকুর কাটানোর টাকা দু’বার তোলা হয়েছে। রাস্তা না করে টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। কাজ না করেও টাকা পাওয়া মানুষের সংখ্যাটাও কম নয়। সেই টাকার ভাগ পেয়েছেন শাসক দলের মাতব্বররা। নেতাদের মাটির বাড়ি দোতলা হয়েছে। সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিতে দিতে পায়ের পেশি শক্ত হয়ে যাওয়া ভুঁইফোড় নেতাও এখন চারচাকাতেই 
অভ্যস্ত। এলাকায় দাপট দেখানোর জন্য বেছে 
নেয় ছেলের মুখে ভাত বা বাবার শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানকে। করা হয় হাজার হাজার লোকের খাওয়া দাওয়ার এলাহি আয়োজন।
এমনটা হয়েছে বলেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের নজিরবিহীন পরিষেবা সত্ত্বেও এখনও সিপিএম, কংগ্রেস, বিজেপির মিছিল করার লোক পায়। এমনটা হয়েছে বলেই পেট্রল ১০৬ টাকায়, ডিজেল ৯৬ টাকায়, ১২০০ টাকায় গ্যাসের সিলিন্ডার কিনেও পশ্চিমবঙ্গের কিছু মানুষ এখনও বিজেপিকে ভোট দেয়। এসব না থাকলে কেউ বিরোধীদের দিকে ফিরেও তাকাত না।
বিজেপি ভাবছে, তারা যেটা বলবে মানুষ সেটাই বিশ্বাস করবে। তাই ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার জন্য ভুল স্বীকার না করে নজর ঘোরাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। মৃতদের মধ্যে কতজন বাংলার পরিষায়ী শ্রমিক, সেই প্রশ্নকে বড় করে দেখিয়েছে। প্রমাণ করতে চাইছে, বাংলায় কাজ না পেয়ে ভিনরাজ্যে যাওয়ায় তাঁদের এমন পরিস্থিতির শিকার হতে হয়েছে।
বিরোধীরা বলছে, পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক অবস্থা খারাপ বলেই রাজ্যের শ্রমিকদের বাইরে যেতে হয়। কিন্তু সত্যিটা কি তাই? আচমকা লকডাউন ঘোষণার সময় দেশের পরিস্থিতি কী হয়েছিল? লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক বিভিন্ন রাজ্যে আটকে পড়েছিলেন। কেন্দ্র কোনও ব্যবস্থা না নেওয়ায় তাঁরা হেঁটেই ফিরতে চেয়েছিলেন বাড়ি। কিন্তু অনেকেরই বাড়ি ফেরা হয়নি। তার আগেই কারও প্রাণ গিয়েছিল ট্রাকের ধাক্কায়। কারও দেহ খণ্ড খণ্ড হয়ে গিয়েছিল মালগাড়ির চাকায়। তাঁদের বেশিরভাগই ছিলেন অন্য রাজ্যের বাসিন্দা।
১ মে থেকে পরিযায়ী স্পেশাল চালু হয়েছিল। ১৫দিন পর তৎকালীন রেলমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল একটা পরিসংখ্যান দিয়েছিলেন। তাতে দেখা যাচ্ছে, ১৫ দিনে চালানো ১০৪৭টি স্পেশাল ট্রেনের মধ্যে উত্তরপ্রদেশকে ৩৮৭টি, বিহারকে ২৬৯টি এবং মধ্যপ্রদেশকে ৮১টি দেওয়া হয়েছিল। ১৪ লক্ষ শ্রমিক ট্রেনে বাড়ি ফিরেছেন। তার ৮০ ভাগই উত্তরপ্রদেশ ও বিহারের। কেবল পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা কোনও রাজ্যের অর্থনীতির মাপকাঠি হতে পারে না। কারণ কাজ চাইলেই পাওয়া যায় না। কাজ পেতে লাগে দক্ষতা। যেমন আমাদের রাজ্যে মুর্শিদাবাদের রাজমিস্ত্রিরা নির্মাণকাজে পটু। তাই তাঁরা রাজ্যের সর্বত্র, এমনকী দেশজুড়ে কাজ করেন। মুম্বইয়ে স্বর্ণ 
ও জরি শিল্পীদের একটা বড় অংশ বাংলার। কারণ তাঁদের শিল্পকর্মে মুগ্ধ হন মুম্বইয়ের তাবড় তাবড় অভিনেত্রী। আবার এরাজ্যের হিমঘরে, রাইসমিলে যাঁরা কাজ করেন তাঁদের অধিকাংশই ভিনরাজ্যের। ইটভাটায়, স্পঞ্জ আয়রন কারখানায় তো এরাজ্যের শ্রমিক খুঁজে পাওয়াই কঠিন।
তাই ১০০ দিনের কাজ শুরু হলে পরিযায়ী শ্রমিকের ছবিটা বদলে যাবে, এমনটা নয়। কারণ এটাই রেওয়াজ। যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। তবে, ১০০ দিনের কাজ শুরু হলে গ্রামের গরিব মানুষের হাতে টাকা আসবে। তাতে মজবুত হবে বাংলার গ্রামীণ অর্থনীতি। তাই চলছে রাজ্যের হক আদায়ের লড়াই। সেই লড়াইয়ে শামিল হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ খেতমজুর সমিতি। সংগঠনটি আড়েবহরে এমন কিছু নয়। কিন্তু তাদের উদ্যোগ বাংলায় জ্বালিয়েছে আশার আলো।
মানুষ ভোট দিয়ে সরকার গড়ে। সরকার তার ‘নিয়োগকর্তা’দের পরিষেবা দেয়। পরিষেবায় খুশি হলে সেই দলকে ফের ক্ষমতায় বসিয়ে পুরস্কৃত করে। কাজ পছন্দ না হলে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে শিক্ষা দেয়। এটাই গণতন্ত্রের নিয়ম। কিন্তু ক্ষমতার দম্ভে বিজেপি উল্টো দিকে ঘোরাতে চাইছে সেই চাকা। প্রত্যাখ্যাত হয়ে সংযত না হয়ে মানুষকেই দিতে চাইছে ‘শিক্ষা’। সেই জন্য শস্য থেকে তুষ না বেছে পুরো ‘শস্যভাণ্ডার’টাই ধ্বংস করে দিতে চাইছে। তাই পড়েছে আদালতের কৈফিয়তের মুখে। সব কিছুরই শেষ আছে। সেটা ষড়যন্ত্র হলেও।

10th     June,   2023
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ