বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

ওরা যত বেশি জানে,
তত কম মানে
মৃণালকান্তি দাস

বিজেপি বেনেদের পার্টিই বটে। সুনিপুণ দক্ষতায় ধর্মনিরপেক্ষ-গণতান্ত্রিক দেশের তকমা মুছে দিয়ে হিন্দুরাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার একের পর এক কৌশল অবলম্বন করে চলছে। চরম দুঃসাহসিকতায়!
ঠিক যেমন কৌশল নিয়েছিল ইংরেজরাও। ব্যবসার ছদ্মবেশে ইংরেজরা উপনিবেশের ছক সাজিয়েছিল। বিজেপিও মনুসংহিতার প্রয়োগে দেশে ধর্ম ব্যবসার ফাঁদ পেতে গোটা দেশের কাঠামো বদলে দিতে 
চাইছে। ‘ধর্মকে ব্যবহার করে যারা ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছতে চায়, তাদের ভিতরে মনুষ্যত্ব, ন্যায়নীতির কোনও স্থান নেই। আছে শুধু হিংসার দ্বারা ভয় ভীতির সঞ্চার করে মানুষকে উত্যক্ত করার এক অদম্য স্পৃহা।’ এ দেশের গণতন্ত্র তার নির্বাচনী রাজনীতি, প্রশাসন ব্যবস্থা বা আইন-আদালত দিয়ে এই অন্যায় আটকাতে পারেনি। ফলে দ্রুত দুর্বল হচ্ছে গণতন্ত্র। গেরুয়া শিবির সেটাই চায়।
গণতন্ত্রের সংজ্ঞাটি বহুমাত্রিক। যার অন্যতম মাত্রা হল, জাতি-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে দেশের যে কোনও নাগরিকের অধিকারের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠা। নির্বাচিত সরকার সংবিধানের সম্মান বজায় রাখছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব দেশের বিচারবিভাগ আর সংবাদমাধ্যমের। তাই কোনও দেশে এই দু’টি স্তম্ভ স্বাধীন আর শক্তিশালী না হলে সেই দেশকে গণতান্ত্রিক বলা যায় না। গণতন্ত্রে সাধারণ মানুষের স্বার্থ দেখার দায়িত্ব নির্বাচিত সরকারের। সংবিধান প্রদত্ত গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা ও প্রসারিত করা এবং গণতান্ত্রিক ধ্যান ধারণাকে আরও জীবন্ত ও অর্থবহ করে তোলাই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচিত সরকারের দায়বদ্ধতা। মোদি জমানায় এই দায়বদ্ধতাই হারিয়ে যেতে বসেছে। বদলে তারা একদলীয় গণতন্ত্র তথা শাসকের গণতন্ত্রের এক সঙ্কীর্ণ আধিপত্যবাদী সংস্করণকে প্রোমোট করছে।
অন্তঃসারশূন্য চমক, নিজের গৌরব নিজে জাহির করা এখন নিত্যকর্মপদ্ধতির অন্তর্গত। সমাজের সর্বস্তরেই। বিশেষত রাজনীতির পরিসরে। এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি শ্রেষ্ঠত্বের দাবি জানাতেই পারেন। ঠিক যেমন নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধন করে বলেছিলেন, ‘ভারত গণতন্ত্রের জননী। মাদার অব ডেমোক্র্যাসি। এই নয়া সংসদ ভবন আত্মনির্ভর ভারতের সূর্যোদয়ের সাক্ষী হবে।’ আর গোটা দেশ দেখছে, ঠিক তার উল্টো। মোদি জমানায় আজ স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকার নেই। বিরোধী মতকে জাতীয়তা বিরোধী এবং রাষ্ট্রদ্রোহী বলে দেগে দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষাজগতের প্রখ্যাত ব্যক্তি-সহ সমাজকর্মী, ছাত্র-ছাত্রী, সাংবাদিকদের সরকারের সমালোচনা করার জন্য জেলে বন্দি করে রাখা হচ্ছে। বিভিন্ন সংবিধান অনুমোদিত সংস্থাগুলিকে সরকারি ও দলীয় নিয়ন্ত্রণে এনে তাদের স্বাধিকার ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এমনকী বিচার ব্যবস্থা এবং ক্যাগ (কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল) পর্যন্ত বাদ যাচ্ছে না। সরকার যা চায়, তা পাওয়ার জন্য অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের পুনর্নিয়োগ করা হচ্ছে যথেচ্ছভাবে। পার্লামেন্টকে অকেজো করে দেওয়া হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়া এবং ডিজিটাল মাধ্যমগুলিকে পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য চাপ সৃষ্টি করছে। আর যারা একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। একেই বলে সংখ্যাগুরু তোষণ। কিন্তু সংখ্যালঘুর মর্যাদা ছাড়া কি গণতন্ত্র টিকে থাকতে পারে? গণতন্ত্রের অর্থ তো কেবল সংসদমান্যতা নয়, সংবিধানমান্যতা: ব্যক্তি-অধিকার রক্ষাই যার লক্ষ্য।
গণতন্ত্রের উপর এই আঘাত নরেন্দ্র মোদি গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীনই দেখা গিয়েছিল। ২০০২ সালে গুজরাতের গণহত্যার কথা সকলের স্মরণ আছে। সেই ভয়াবহ দিনগুলির জন্য মোদিকে প্রত্যক্ষভাবে দায়ী করেছে বিবিসি-র তথ্যচিত্র। দেশবাসী জানেন, সে দিনের দাঙ্গার পরিকল্পনাকে বাস্তব করেছিল সেখানকার গোঁড়া হিন্দুত্ববাদীরা। আমাদের দেশে এরা নতুন নয়, ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে সুস্থ চিন্তার বিরুদ্ধে এদের আস্ফালন বারে বারে দেখা গিয়েছে। সংবিধানে যে কথা পরিষ্কার লেখা আছে, আদালত বিভিন্ন সময়ে যা পালন করার সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছে, কেন্দ্রে শাসক তা মানতে নারাজ। বরং ক্ষমতার জোরে এবং ধর্মীয় চেতনা তথা ভাবাবেগকে রাজনীতির অস্ত্র করে মুহুর্মুহু তা লঙ্ঘন করে চলেছে। এই সবই বুঝিয়ে দেয়, শাসক চাইছে ‘গণতন্ত্র’ মুছে দিয়ে এক অতিনিয়ন্ত্রিত, একতান্ত্রিক, কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র গড়ে তুলতে। রাজনীতি, ধর্ম, সমাজ, শিক্ষা, সর্ব ক্ষেত্রেই বিজেপির এই ছকটি মাথাচাড়া দিচ্ছে।
ইতিহাস বিজয়ীরাই লেখে। দু’ভাবে সেই লেখার কাজ চলে। এক, নিজের সাফল্যকে বাড়িয়ে দেখানো। দুই, নিজের ব্যর্থতাকে আড়াল করা। বর্তমান শাসকদের প্রচারযন্ত্র এই দু’টি কৌশলকেই এক চরম রূপ দিয়েছে। গেরুয়া শিবির চায়, সেই প্রচারযন্ত্র আর সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে নেতাকে দেবতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে। আর সেই নেতাকে জেতাতে পারলেই ভিতর থেকে গণতন্ত্রের ভিত্তিকে দুর্বল করে দেওয়া যায়। উন্নত বা উন্নয়নশীল, সব দেশেই এই ভিত্তিকে দুর্বল করার প্রধান অস্ত্র ঘৃণা। কখনও এই ঘৃণার লক্ষ্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, কখনও অনুন্নত দেশ থেকে আসা নাগরিকরা, কখনও বা অন্য কোনও দেশ। কর্তৃত্ববাদী নেতারা তখন হয়ে ওঠেন প্রবল জাতীয়তাবাদী। আসলে এই নেতারা চান, গণতন্ত্রের মানবিক অধিকারের দিকটিকে যতখানি সম্ভব দুর্বল করতে। একবার ক্ষমতায় এসে এই কাজটি করতে সফল হলে যে কোনও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের উত্থানকে অনেকখানি রুখে দেওয়া সম্ভব। গণতন্ত্রের পরিসরের মধ্যে এই নেতাদের উত্থান তাই সেই সব দেশের গণতন্ত্রের এক প্রবল সঙ্কটের ইঙ্গিত।
বর্তমান সময়ের ভয়ঙ্করত্বের ছবি এঁকে গিয়েছিলেন রবি ঠাকুর। লিখেছিলেন, ‘বর্তমান চায় বর্তিয়ে থাকতে।/ সে চাপাতে চায়/ তার সব বোঝা তোমার মাথায়,/ বর্তমান গিলে ফেলতে চায়/ তোমার সব-কিছু আপন জঠরে।/ তার পরে অবিচল থাকতে চায়/ আকণ্ঠপূর্ণ দানবের মতো/ জাগরণহীন নিদ্রায়।/ তাকেই বলে প্রলয়।’ ভারতের দুর্ভাগ্য, যে সরকার এই দেশকে গণতন্ত্রের বিশ্বগুরু বলে প্রচার করে, সেই সরকারই গণতন্ত্রের আব্রু-রক্ষায় আগ্রহী নয়। উল্টে তারা প্রচার করে, বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্র রক্ষার দায় নাকি শাসক-বিরোধী সহ দেশের সমস্ত নাগরিকের। কিন্তু গণতন্ত্র যখন একমুখী হয়ে পড়ে, কিংবা, তা যখন স্বৈরাচারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তখন 
নাগরিক হাঁসফাঁস করে ওঠেন। তার প্রমাণ মিলেছে একাধিক রিপোর্টে। ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স’ সংস্থা প্রকাশিত বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে ২০১৬ সালে ভারতের অবস্থান ছিল ১৩৩, ২০২১ সালে আরও নিম্নগামী হয়ে ১৪২, ২০২২ সালে তা দাঁড়িয়েছে ১৫০তম স্থানে। ২০২১ সালে আমেরিকার সংস্থা ‘ফ্রিডম হাউস’ ভারতকে ‘মুক্ত গণতন্ত্র’-এর তকমা থেকে ছেঁটে ‘আংশিক মুক্ত গণতন্ত্র’-এর সারণিতে নামিয়ে এনেছে। সুইডেনের ভি-ডেম ইনস্টিটিউট-এর পর্যবেক্ষণ, ভারত এখন নির্বাচন-ভিত্তিক স্বৈরতান্ত্রিক দেশ। এসব কোনও তথ্যই মানতে চায় না মোদি প্রশাসন।
২০১৪ সালের অভিষেকপর্ব থেকে তিনি এবং তাঁর বাহিনী বিরামহীন, বেলাগাম এবং গগনভেদী আত্মপ্রশস্তির যে ইতিহাস রচনা করেছেন, তা রীতিমতো শ্বাসরোধকর। সেই আত্মপ্রশস্তি টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন ‘গণতন্ত্র’ শব্দটাই মুছে দেওয়া। তাই সম্প্রতি পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ পড়েছে ‘গণতন্ত্র’ নামে অধ্যায়। ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং (এনসিইআরটি)-র দশম শ্রেণির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সিলেবাস থেকে গণতন্ত্র সংক্রান্ত আস্ত অধ্যায় ছেঁটে ফেলেছে কেন্দ্র। ‘ডেমোক্রেটিক পলিটিক্স-২’ বই থেকে সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া হয়েছে মোট তিনটি অধ্যায়, ‘গণতন্ত্র ও বৈচিত্র্য’, ‘জনপ্রিয় আন্দোলন’ এবং ‘গণতন্ত্রের সঙ্কট’। স্বৈরতন্ত্রের অবসানে গণতন্ত্রের ভূমিকা, কীভাবে ধর্মঘটের মাধ্যমে শ্রমিকেরা বিভিন্ন দেশে নিজেদের দাবি আদায় করে নিয়েছে, তা নিয়েও বর্ণনা ছিল ওই অধ্যায়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন,‘বিজেপি বা সঙ্ঘ পরিবারের চেষ্টাই হল সাধারণ মানুষের মনে গণতন্ত্রের প্রতি যে আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে সেই ভিতকে নাড়িয়ে দেওয়া। সেই কারণে সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করতে মোদি সরকার তৎপর।’ শাসককে নিরন্তর প্রশ্ন করার স্বাধীনতা যথার্থ গণতন্ত্রের এক অপরিহার্য শর্ত। অথচ বর্তমান শাসকরা প্রশ্ন করার কোনও সুযোগ দিতেই নারাজ।
এ এক হীরক রাজার দেশ। রাজার স্তুতি, ‘লেখাপড়া করে যে, অনাহারে মরে সে’। ‘জানার কোনও শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই’। নিজেকে ভগবানের আসনে বসানো রাজা বলেন, ‘ওরা যত বেশি পড়ে, যত বেশি জানে, তত কম মানে।’ 
সবাই পারে না, তবে ‘হীরক রাজার দেশে’ উদয়ন পণ্ডিত পেরেছিলেন। রাজার চোখে চোখ রেখে বলেছিলেন, ‘যায় যদি যাক প্রাণ, ... রাজা শয়তান।’ দেশের ভবিষ্যৎ তথা ছাত্রদের শিক্ষার জন্য তিনি লড়ে গিয়েছেন শাসকের বিরুদ্ধে। হীরক রাজার চোখে তিনি রাজদ্রোহী। পাঠশালা বন্ধ হয়ে গেলেও তাঁর ছাত্রদের তিনি দিয়েছেন ভবিষ্যতের আশার আলো। প্রয়োজনে তিনি যুদ্ধের পক্ষে, যে যুদ্ধে ‘কেউ মরবে না, রাজাকে শুধু তার গদি থেকে টেনে নামিয়ে দেব’।
মোদিজি জেনে রাখুন, এ দেশে উদয়ন পণ্ডিতদের মৃত্যু নেই। অতএব গণতন্ত্রের পাঠ চলবেই!

8th     June,   2023
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ