এই ঘটনায় কেউ দোষী প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কেউ ছাড়া পাবে না।— প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি
সিগন্যালিংয়ে ইন্টারফেয়ারেন্স হয়েছে। অন্তর্ঘাতের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।— জয়া ভার্মা সিনহা (রেলবোর্ডের সদস্য)
দুর্ঘটনার কারণ এবং সন্দেহভাজনদের চিহ্নিত করা গিয়েছে। এর বেশি এখনই বলা যাবে না।— রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব
গাঢ় নীলরঙা চুড়িদার পরা মহিলা গত তিনদিন ধরে রেল ট্র্যাকের পাশেই বসে আছেন। কখনও ছুটছেন লাশকাটা ঘরে, কখনও হাসপাতালে... নম্বর মেলাচ্ছেন। তারপর আবার এসে বসছেন রেললাইনের ধারে। কাছের মানুষের খোঁজ যে এখনও মেলেনি! আশায় আছেন, ফিরবে তারা। খুঁজবে তাঁকে
করমণ্ডল এক্সপ্রেসের কামরার কঙ্কালের আশপাশেই। তাই এখানে বসে আছেন তিনি। একের পর এক নেতানেত্রী আসছেন... এলাকায় ঘুরছেন, টিভি চ্যানেলে বাইট দিচ্ছেন, তারপর ফিরে যাচ্ছেন। রেলমন্ত্রী বারবার এসেছেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও। কিন্তু হুঁশ নেই তাঁর। বসে আছেন অপেক্ষায়। হেলিকপ্টারের ব্লেডের হাওয়ায় চুল উড়ছে তাঁর। এসপিজি এসে তাড়া দিচ্ছে। তাও তিনি ভাবলেশহীন। একটা ভোট, একটা আসন কিংবা শাসকের কুর্সি হারানোর থেকেও অনেক বেশি যন্ত্রণা বুকের মধ্যে বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। বিস্ফোরণ এখনও ঘটেনি। কিন্তু সেটাও হবে। পরিজনরা নিখোঁজ থেকে গেলে।
যে কোনও বড় ট্রেন দুর্ঘটনার ট্র্যাজেডি এটাই—নিখোঁজের সংখ্যা। দূরপাল্লার ট্রেনের ইঞ্জিনের আলো টার্মিনাল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দেখা মাত্র অদ্ভুত একটা উত্তেজনার স্রোত এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। অসংরক্ষিত কামরায় ওঠার লড়াইয়ের বাঁশিটা বেজে যায় ওই মুহূর্তেই। বন্ধ দরজা ধরে ঝুলে পড়ে চার-পাঁচটা শরীর। আর তারপর শুরু হয় সেই দরজা খোলার মরিয়া চেষ্টা এবং জানালা দিয়ে ব্যাগ রাখার যুদ্ধ। আগে ঢুকতে পারলে বসার একফালি জায়গা মিলবে। তাই এই লড়াই। ১২ ঘণ্টা, ২৪ বা ৩৬ ঘণ্টা... দীর্ঘ যাত্রায় ওটাই একমাত্র স্বস্তির ছোঁয়া। তিনজনের সিটে বসে ছ’জন, দু’জনের আসনে চারজন। এটাই নিয়ম। অলিখিত। এরা কারা? কেউ যাচ্ছে কাজের খোঁজে, আবার কেউ প্রাণান্ত পরিশ্রম শেষে বাড়ি ফিরছে স্ত্রী-সন্তানের মুখ দেখবে বলে। করমণ্ডল এক্সপ্রেসেও এমন অনেকে ছিলেন। তাঁদের পরিচয় কী? শুধুই টিকিটের নম্বর। আসন সংরক্ষণ করে যাত্রাশুরুর টাকা ছিল না তাঁদের কাছে। অথচ, আমাদের দেশে এই সংখ্যাটাই সবচেয়ে বেশি। এদের অনেকেরই উপার্জন দিনে ১০০ টাকার আশপাশে। তাদের পক্ষে আসন রিজার্ভ করে সফর করা মানে বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। ফলে শুক্রবার রাত থেকে যে অঙ্ক কষা শুরু হয়েছে, তাতে প্রাথমিকভাবে জায়গা হচ্ছে না এই আম ভারতীয় নাগরিকদের। এই প্রবণতা চিরকালীন। সরকার বদলেছে, প্রযুক্তি উন্নত হয়েছে, কিন্তু উদাসীনতার এই মেগা সিরিয়ালের চিত্রনাট্য বদলায়নি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দাবি করেন, কংগ্রেস আমলে যা হয়েছে, সব খারাপ। অথচ, যে খারাপ প্রবণতা সমাজ এবং সরকারের হাড়েমজ্জায় ঢুকে পড়েছে, তা বদলের চেষ্টা কি তিনি করেছেন? মোদিজি নিজেই পৌঁছে গেলেন ঘটনাস্থলে। এব্যাপারে প্রশাসনের হর্তাকর্তারা খানিকটা নিমরাজিই ছিলেন। কারণ, প্রধানমন্ত্রী যাওয়া মানে উদ্ধারকাজে কিছুটা হলেও ছেদ পড়বে। তাঁর নিরাপত্তা, হেলিকপ্টার ল্যান্ডিং, আশপাশের ‘অবাঞ্ছিত’ লোকজনকে সরানোর কাজে বেশি মন দিতে হবে। তাও প্রধানমন্ত্রী গেলেন। আগামী বছর ভোট। এমন সুযোগ কি ছাড়া যায়? উদ্ধারকাজে তিনি হাত লাগাবেন না, দাঁড়িয়ে থেকে বগির স্তূপ সরানোর নির্দেশ দেবেন না, ট্র্যাক সারানোর প্রযুক্তিগত পরামর্শ দেবেন না। তাও তিনি গিয়েছেন। তাঁকে আর দোষ দিয়ে লাভ কী? এটাই তো বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ হয়ে এসেছে। যে কংগ্রেসকে তিনি মনেপ্রাণে ঘৃণা করেন, তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেই যে মোদিজি চলছেন! কংগ্রেস বা ভারতীয় রাজনীতির এই প্রথা-প্রবণতা থেকে তিনি বেরতে পারেননি। বলা ভালো বেরতে চাননি। কারণ, এটাই যে প্রচারের মূলমন্ত্র! গোটা দেশ দেখবে, আমাদের শাসক কতটা সহানুভূতিশীল। তবেই না ভোটের যন্ত্রে তার ছায়া দেখা যাবে! তিনি তাই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করলেন, লোকজনের সঙ্গে কথা বললেন, তারপর ফোন কানে একধারে দাঁড়িয়ে গেলেন। আমরা দেখলাম, খুব সিরিয়াস হয়ে ফোনের ওপারে কাউকে কিছু বলছেন তিনি। হয়তো দ্রুত উদ্ধারকাজ শেষ করার কথা, দুর্ঘটনার শিকড় পর্যন্ত পৌঁছনোর কথা, শেষ দেখবার কথা। গোটা দেশ সাধু সাধু করে উঠল। ভক্তকুল সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখতে শুরু করল, এই তো হল নেতা। দেশের অভিভাবক। যেভাবে পৌঁছে গেলেন তিনি দুর্ঘটনার এপিসেন্টারে, তা শিক্ষণীয়। অন্য কোন দলের কোন নেতানেত্রী এমনটা পারেন না... ইত্যাদি। কিন্তু তাঁরা কি দেখলেন, প্রধানমন্ত্রী ফিরে আসার পর দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা ২৮৮ থেকে কমে ২৭৫ হয়ে গিয়েছে? শেষ বগি ক্রেন দিয়ে তোলার পরও বেরিয়েছে মৃতদেহের স্তূপ। তারা কি হিসেবের আওতায় এসেছে? অকুস্থলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কারও হাত, কারও পা, কারও বা দেহের কোনও একটা অংশ। কালো ব্যাগে ভরে সেই সব ছুড়ে তোলা হয়েছে ট্রাকের পিছনে। দু’টি দেহ মিলেমিশে একটা তালে পরিণত হয়েছে। ছবি ওঠেনি তাদের। চেনার সম্ভাবনা নেই। পরিজন যাঁরা জানতেন, তাঁদের ছেলে-মেয়ে-বাবা এই ট্রেনে যাচ্ছিলেন, তাঁরা উদভ্রান্তের মতো ঘুরছেন স্টেশনে। লাশকাটা ঘরে। মোদিজি, এঁরা কি ক্ষতিপূরণের টাকা পাবেন? আপনারা ইঙ্গিত দিচ্ছেন অন্তর্ঘাতের। বলে দিচ্ছেন, ঠিক কী কারণে হয়েছে এই ‘দুর্ঘটনা’। এমনকী কে বা কারা এর নেপথ্যে রয়েছে, সেটাও নাকি আপনাদের সরকার চিহ্নিত করে ফেলেছে। তারপরও সিবিআই তদন্তের সুপারিশ হচ্ছে। কেন? সবই যদি দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে আর এজেন্সি নিয়ে টানাহেঁচড়া কেন? নাকি সবটাই গাফিলতি ঢাকা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা?আপনারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমালোচনা করে বলছেন, অ্যান্টি কলিশন ডিভাইস বা কবচ প্রযুক্তি এক্ষেত্রে কাজ করত না। তাহলে কোন প্রযুক্তি কার্যকরী হতো? আপনারা তো নতুন ভারতের, উন্নততর ভারতের স্লোগানে ভারতের আকাশ-বাতাস গেরুয়া করে তুলেছেন। অথচ এমন একটা প্রযুক্তি ১০ বছরে আবিষ্কার করতে পারলেন না... যাতে এই ৩০০ লোকের প্রাণ বাঁচানো যায়? ওড়িশার পুলিস আধিকারিক ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, মৃতের সংখ্যাটা ৫০০ ছাড়িয়ে যাবে। আন্দাজে ঢিল ছোড়ার শিক্ষা নিয়ে তিনি ওই চেয়ারে বসেননি। রাজনীতির গিমিকও তাঁকে আইপিএস বানায়নি। যে কোনও শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ নিশ্চিতভাবে রাজনীতির কারবারিদের থেকে এই আইপিএসকেই বেশি বিশ্বাস করবেন। তারপরও অবশ্য নিখোঁজের রং ধীরে ধীরে ফ্যাকাশে হয়ে যাবে। জ্ঞানেশ্বরী নাশকতার এক যুগ পরও অনেকে এভাবে বেহদিশ হয়ে থেকে গিয়েছেন। আত্মীয়রা কেউ এখনও তাঁদের খুঁজে চলেছেন, অনেকে হাল ছেড়ে মেনে নিয়েছেন নিয়তিকে। সাধারণ ভোটারের এটাই যে ভবিতব্য। তারপরও তাঁরা ট্রেনে চড়বেন। বেরিয়ে পড়বেন কাজের খোঁজে। কাতারে কাতারে। কেন? কাকতালীয়ভাবে বেঁচে ফেরা বাংলার ওই মানুষগুলোকে মোদিজি একবার প্রশ্নটা করতেই পারতেন। কিন্তু তিনি করবেন না। কারণ, উত্তরটা আমাদের প্রধানমন্ত্রীর জানা। প্রায় দেড় বছর পশ্চিমবঙ্গে ১০০ দিনের কাজের টাকা বন্ধ। আবাসের কাজ হচ্ছে না। যাঁরা এই প্রকল্পে গতর খাটিয়ে দিন গুজরান করতেন, তাঁরা আজ নিরুপায়। বেরিয়ে পড়ছেন তাঁরা ঘরবাড়ি ছেড়ে। উঠে পড়ছেন ট্রেনে। মহারাষ্ট্র, চেন্নাই, বেঙ্গালুরু... যেখানে যা কাজ পাওয়া যায়। পেটটা তো চালাতে হবে! যে অর্থনৈতিক অবরোধ নরেন্দ্র মোদির সরকার বাংলার বিরুদ্ধে শুরু করেছে, তার ফল মৃত্যু ছাড়া কিছু নয়। কেউ মারা যাচ্ছেন করমণ্ডলের দুর্ঘটনায়, কেউ হয়তো মারা যাবেন অপুষ্টিতে। আর আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশজুড়ে বন্দে ভারত ট্রেন উদ্বোধন করে বেড়াবেন। দেখাবেন, তাঁরা কত উদ্যোগী। দেশ কত উন্নত। কিন্তু গিমিকের রাজনীতির এই প্রদীপের নীচেই থেকে যাবে অপ্রাপ্তি, অবিচারের অন্ধকার। এই অন্ধকারে ঠেলাঠেলি করে জীবন কাটিয়ে চলেছেন আম আদমি। দেশের মন্ত্রীদের তাঁরা ভোট দিয়ে রাজধানীর ওই কুর্সিতে বসিয়েছেন। এখন তাঁরা বিস্মৃত। তবে মনে পড়বে তাঁদের, মাস ছয়েক পরেই। তারই প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে। জোরকদমে।
আসলে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কপাল বেশ চওড়া। বারবার তার প্রমাণ পেয়েছে এই দেশ। ২০০২ সালের গোধরা পরবর্তী সংঘর্ষের পর মনে করা হয়েছিল, নরেন্দ্র মোদির রাজনৈতিক কেরিয়ারটাই শেষ হয়ে গেল। কিন্তু না। মানুষের বিপুল
সমর্থনে ভোটে জিতে এসেছিলেন তিনি। মাথার উপর ছিল আরএসএসের বিরাট ছাতা। অটলবিহারী বাজপেয়ির মতো ব্যক্তিত্বের সমালোচনাও তাঁকে টলাতে পারেনি। ক্যালেন্ডারের বছর বদলেছে, কিন্তু সেই সমর্থন বা আচ্ছাদনে খামতি আসেনি। বরং তা বেড়েই চলেছে। হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির এজেন্ডায় শক্ত হচ্ছে তাঁর মাটির তলার জমি। বর্তমানের দিকে পিছন ফিরে তিনি ভবিষ্যতের জন্য দেশের নিলাম ডাকছেন। আর একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার আস্থা মিশে যাচ্ছে ধুলোয়। পাশের বাড়ির মানুষ, সাধারণের দুঃখ বোঝার মতো মনের অধিকারী এখন বদলে গিয়েছেন শুধুই শাসকে। ভক্তকুলের প্রতি আবেদন, গেরুয়া জামা আর সর্বাধিনায়কের চশমাটা খুলে একবার মানুষের মধ্যে এসে দাঁড়ান। প্রত্যেক রাস্তার মোড়ে খুঁজে পাবেন নীল চুড়িদার পরা ওই মহিলাকে... যিনি খুঁজে চলেছেন ভরসা... নিরাপত্তা। তার আজকের নতুন ভারতে বড় অভাব।