বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

নির্জলা নিয়তির অপেক্ষা!
মৃণালকান্তি দাস

মাত্র তিন মাসের মধ্যে জলশূন্য হয়ে যাবে গোটা কেপটাউন শহর! বিশেষজ্ঞদের এই ভবিষ্যদ্বাণী মিলে গিয়েছিল ২০১৮ সালেই। দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন শহরের প্রায় ৪০ লক্ষ নাগরিক রীতিমতো যুদ্ধের মুখোমুখি হয়েছিল। জল বাঁচানোর লড়াইয়ে নেমেছিল গোটা শহর। যুদ্ধে শামিল সাধারণ মানুষ থেকে বড় বড় সংস্থাও। যে কেপটাউনে একসময় গৃহস্থালির ব্যবহারে প্রতিদিন প্রায় ৫০ কোটি লিটার জল খরচ হতো, তা কমিয়ে ২৫ কোটি লিটারের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল। কিন্তু তাতে কি বিপর্যয় ঠেকানো যায়? শুধু কেপটাউন নয়, জলসঙ্কট আজ গোটা বিশ্বে এতটাই ভয়াবহ যে, অদূর ভবিষ্যতে এই জলের জন্যই না তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়!
জলবায়ুর ক্রমাগত পরিবর্তনের ফলে ২০১৮-র আগের তিন বছর কেপটাউন-সহ গোটা পশ্চিম কেপ প্রদেশে বৃষ্টি হয়েছিল নামমাত্র। শহরবাসীর দৈনন্দিন চাহিদা মেটানো ও ক্রমবর্ধমান নগরায়নের ফলে ২০১৮-র জানুয়ারি মাসে এসে বোঝা গিয়েছিল, জলের ভাঁড়ারে রীতিমতো টান পড়েছে। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে কেপটাউন পুরসভা ঘোষণা করে, তিন মাস পরে কেপ টাউনবাসীকে তারা আর জল সরবরাহ করতে পারবে না। ১২ মে, ২০১৮ দিনটিকে চিহ্নিত করা হয়েছিল ‘ডে-জিরো’ হিসেবে। অর্থাৎ ওই দিনের পরে শহরের কোনও কল থেকে আর জল পড়বে না। গোটা বিশ্ব এই খবরে স্তব্ধ, কেপটাউনবাসী বিভ্রান্ত ও সন্ত্রস্ত— এর পরে কী হবে?
পুরসভা হিসেব করে বলেছিল, প্রত্যেক শহরবাসীকে দৈনিক জলের ব্যবহার ৫০ লিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। তার মধ্যে পুরসভা থেকে মিলবে ২৫ লিটার পর্যন্ত। একটা গাইডলাইন বানানো হয়েছিল জনগণের সুবিধার্থে। এই গাইডলাইন পোস্টারের আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ, অফিস, দোকানপাট, শপিংমল সর্বত্র। প্রতি ১০-১৫ মিনিট অন্তর এফএম রেডিও, টেলিভিশনে সচেতনতা-প্রচার। এগিয়ে এসেছিল যুবসমাজ। ছড়িয়ে দিয়েছিল নতুন ট্যাগলাইন: #ওয়াটারওয়াইজ। জলজ্ঞানী। কে কীভাবে ‘জলজ্ঞানী’ হয়ে কতটা জল বাঁচাতে পারে, সেই সব ধ্যান-ধারণা ছড়িয়ে পড়েছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়। নিশ্চিত আপনি ভাবছেন, এ তো কেপটাউনের গল্প। এসব জেনে লাভ কী?
যাঁরা এই প্রশ্ন তুলে জলসঙ্কটকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন, তাঁদের ভয়াবহ ভবিষ্যতের কথা শুনিয়েছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্কুল অব জিওগ্রাফি’। চলতি বছরে তাদের গবেষণাপত্রে দাবি করেছে, প্রবল গরম ও খরার মুখোমুখি হতে চলেছে বিশ্বের ৯০ শতাংশ জনসংখ্যা। গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে ‘নেচার সাসটেনেবিলিটি’ পত্রিকায়। জলহাওয়া বিচার করে বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, প্রবল গরমে স্থলভাগে জলসঙ্কট দেখা দেবে। অর্থাৎ জমিতে জলের ভাগ কমবে। খরা তৈরি হবে অবধারিতভাবে। অক্সফোর্ডের গবেষক লুইস স্লেটার জানিয়েছেন, এ ভাবে চললে সমাজের জন্য তা বিপজ্জনক। প্রভাব পড়বে বাস্তুতন্ত্রে। ধাক্কা খাবে অর্থনীতি। এবং শেষে তৈরি হবে সামাজিক বৈষম্য। গরিব মানুষ আরও গরিব হবেন। গ্রামীণ এলাকাগুলিতে ক্ষতি হবে বেশি। শুধু তাই-ই নয়, জলসঙ্কট ‘কার্বন সিঙ্ক’-এর ক্ষমতা হ্রাস করবে। ‘কার্বন সিঙ্ক’ হল অরণ্য, সমুদ্র বা অন্যান্য প্রাকৃতিক পরিবেশ, যা বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড শুষে নিতে পারে। ফলে সে দিক থেকেও পৃথিবীর বাতাসে বিপদ ঘনাবে।
বিশ্বব্যাঙ্কের রিপোর্টও বলছে, আগামী কয়েক দশকে ভারতের একাধিক জায়গায় তাপপ্রবাহ এত তীব্র হয়ে উঠবে যে কার্যত ধ্বংসের সম্মুখীন হবে নাগরিক জীবন। তাপমাত্রা সহনশীলতার সীমা ছাড়ানোর ফলে এক একটি জনবহুল এলাকা হয়ে পড়বে বসবাসের অযোগ্য। ‘ক্লাইমেট ইনভেস্টমেন্ট অপরচুনিটিজ ইন ইন্ডিয়াজ কুলিং সেক্টর’ শীর্ষক ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে পরিবেশের উষ্ণায়ন ও তাপপ্রবাহের ফলে বৈষম্য থেকে বিপুল জীবনহানির আশঙ্কা রয়েছে। ভারতের কিছু এলাকায় তাপমাত্রা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছতে পারে যেখানে কোনওভাবেই আর মানিয়ে নিতে পারবে না মানুষ। পাশাপাশি, তীব্র খরা পরিস্থিতির আশঙ্কাও রয়েছে পুরো মাত্রায়। এখানেই শেষ নয়! খোদ ভারতের নীতি আয়োগের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, কয়েক বছরের মধ্যে ২১টি ভারতীয় শহরে ভূগর্ভস্থ জলের ভাণ্ডার শেষ হয়ে যাবে। যার মধ্যে রয়েছে দিল্লি, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই, হায়দরাবাদ। এর ফলে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে অন্তত ১০ কোটি মানুষ। ২০৩০-এ দেশের ৪০ শতাংশ মানুষ পানীয় জলের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন।
তবু আমরা নির্বিকার! আফ্রিকার দেশগুলিতে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আমাদের টলাতে পারেনি। উষ্ণায়নের কারণে বিশ্বজুড়ে ধ্বংসাত্মক সাইক্লোনের বাড়বাড়ন্ততেও আমরা টলব না বলে স্থির প্রতিজ্ঞ। অভিজ্ঞতা তো অন্তত সেটাই বলে। তবুও আমরা অবাধে গাছ কাটছি। আর প্রকৃতি হারাচ্ছে তার কার্বন শোধনের ফিল্টার। যা বাড়াচ্ছে সমুদ্রের তাপ, গরম হচ্ছে পৃথিবী, গলছে হিমবাহ, বাড়ছে বন্যা এবং ধ্বংস হচ্ছে সম্পদ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গ্লাসগোর পরিবেশ রক্ষা নিয়ে আন্তর্জাতিক বৈঠক কপ ২৬-এ প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছেন, ভারত ২০৭০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণের ক্ষেত্রে ‘নিট জিরো’ হয়ে উঠবে। এর মোদ্দা কথা, আমরা যা কার্বন নিঃসরণ করব তা সবুজের আচ্ছাদন ফিল্টার করে উঠতে পারবে। এটা করতে কার্বন নিঃসরণ কমাতে হবে, বাড়াতে হবে সবুজের আচ্ছাদন। কিন্তু যে হারে গাছ কাটা এখনও চলছে তাতে এই লক্ষ্যমাত্রা আমরা আদৌ ছুঁতে পারব কি না সন্দেহ। কিন্তু এর তোয়াক্কা করে কে? কারই বা এত সময় আছে? আমরা সবাই জিডিপি-তে বুঁদ। সেনসেক্সে আচ্ছন্ন। আসলে আমরা বাঁচছি আজকের জন্য। কালকের জন্য নয়। আগামীর কথা ভাবার সময় কোথায়? ভারতে ‘সবুজ বিপ্লবের’ জনক এম এস স্বামীনাথনের ভাষায় যা ‘ইকোলজিক্যাল সুইসাইড’!
গত বছরে গরমের মরশুমে তীব্র তাপপ্রবাহে পুড়েছে ইউরোপের বিস্তীর্ণ অংশ। কোথাও নদী পুরোপুরি শুকিয়ে মাঠ হয়ে গিয়েছে, তো কোথাও ভয়ঙ্কর দাবানলে পুড়েছে বনাঞ্চল আর তার সংলগ্ন বসতি। সম্প্রতি আবহাওয়া নিয়ে প্রকাশিত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) এক রিপোর্ট বলছে, গত পাঁচশো বছরে এমন ভয়াবহ খরা দেখেনি গোটা মহাদেশ। আগামী কয়েক বছরে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে বলে আগে থেকেই সতর্ক করে রাখছেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা। কম বৃষ্টিপাতের জন্য ব্যাহত হচ্ছে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন। তীব্র দাবদাহের ফলে মানুষের মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে। বহু এলাকায় খরা আর দাবানলের ফলে আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছেন কয়েক হাজার ইউরোপবাসী। খরা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে মূলত ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জার্মানি, হাঙ্গেরি, ইতালি, লুক্সেমবুর্গ, মলডোভা, নেদারল্যান্ডস, সার্বিয়া, পর্তুগাল, ব্রিটেন, স্পেন, রোমানিয়ার মতো দেশে।
আমেরিকার অস্টিনের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়, হংকং পলিটেকনিক বিশ্ববিদ্যালয় ও টেক্সাস টেকনোলজি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের যৌথ গবেষণা জানাচ্ছে, তাপপ্রবাহের তীব্রতা তো বাড়বেই। তার সঙ্গে এবার বাড়বে ‘হড়পা খরা’ (ফ্ল্যাশ ড্রট)-র ঘটনা, তীব্রতাও। আগের চেয়ে হড়পা খরা আরও ঘন ঘন হবে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল-সহ দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া আর উত্তর আমেরিকার মধ্যাঞ্চলে। এই গ্রীষ্মে দু’তিন দিনের মধ্যেই মাটি ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। ফুটিফাটা মাটিতে কোনও ফসল উৎপাদনই সম্ভব হবে না। ফলে, ব্যাপক আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হবে ভারত-সহ দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মূলত কৃষিনির্ভর দেশগুলির। ব্যাপক আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হবে উত্তর আমেরিকার মধ্যাঞ্চলের স্টেটগুলিরও। গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকা ‘নেচার কমিউনিকেশন্স’-এ। হড়পা বান যেমন কোনও দিনক্ষণ মেনে, আগেভাগে ইঙ্গিত দিয়ে হয় না, হড়পা খরাও তেমনই। আগে এই ধরনের খরা বিশ্বের কোথাও নজরে পড়েনি বিজ্ঞানীদের। কিন্তু গত দু’দশক ধরে এই ঘটনা পরিলক্ষিত হচ্ছে। হড়পা খরা খুব চটজলদি হয়। আর তা হয় একেবারেই আকস্মিক ভাবে। পাঁচ থেকে সাত দিনের মধ্যে কোনও বিশাল এলাকার মাটি ফেটে চৌচির হয়ে যায়। সেই মাটিতে আর কোনও ফসলই ফলানো সম্ভব হয় না।
শুধু বীরভূম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়াই নয়, প্রকৃতির ভয়ঙ্কর ধাক্কা এসে লেগেছে রবীন্দ্র সরোবরেও। দক্ষিণ কলকাতার ‘ফুসফুস’ রবীন্দ্র সরোবর আজ বিপন্ন। সরোবরের জলস্তর যেভাবে হু হু করে নামছে, তাতে আশঙ্কিত পরিবেশবিদরা। বর্তমানে সরোবরের একাংশে চর পড়ে ঘাস জন্মেছে। গত এক বছর ধরে তেমন বৃষ্টি না হওয়াতেই এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। দক্ষিণ কলকাতার প্রাণকেন্দ্র রবীন্দ্র সরোবরের জল এই ভাবে শুকিয়ে গেলে বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা। ফুসফুস যদি বিকল হয়, তবে শরীর কি সুস্থ থাকতে পারে? কে কাকে বোঝাবে, অপচয় যথেচ্ছ হলে কুবেরের ভাণ্ডারও নিঃশেষ হয়। কলকাতার জলসঞ্চয়ের অবস্থাও সেই রকম। গত কয়েক বছর ধরে সংবাদে প্রকাশ, কলকাতার ভূগর্ভস্থ জলস্তর উদ্বেগজনক হারে নামছে, এবং প্রস্থে কমছে গঙ্গা। অর্থাৎ, তলে তলে শুকচ্ছে শহর। তীব্র জলসঙ্কট শুধুমাত্র এখন সময়ের অপেক্ষা। নির্জলা কেপটাউনের মতো কবে ‘ডে-জিরো’ ঘোষণা হবে, তার অপেক্ষায় মহানগরবাসী!

1st     June,   2023
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ