বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

গণতন্ত্রই বিপন্ন, ইট-কাঠ-পাথরের সংসদে লাভ কী?
হিমাংশু সিংহ

আচ্ছে দিন মরীচিকা হয়ে থাকলেও আচ্ছে সংসদ ঘোর বাস্তব হয়েই ধরা দিচ্ছে। কীর্তি, সাফল্য তাঁর পিছু ছাড়ে না। ভক্তকুল নানা অবতারে তাঁর গরিমাকে তুলে ধরে। তবু সাধারণ মানুষের সমস্যা কমে না। বিতর্ক তাড়া করে প্রতি মুহূর্তে। সংবিধান ও গণতন্ত্রের সূতিকাগৃহ হল সংসদ। ন’বছর আগে এই ভবনেরই চৌকাঠে মাথা ঠুকে শাসনক্ষমতায় হাতেখড়ি হয়েছিল সুদূর গুজরাতের তিনবারের দাপুটে মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির। আশা ছিল, তাঁর আমলে শুধু উন্নতিই হবে না, বদলে যাবে দেশের সামগ্রিক চেহারা। মানুষ দু’মুঠো খেতে পাওয়ার সঙ্গে কাজ পাবে। মিলবে মাথার ছাদ। পড়শি শত্রুরা সমীহ করবে। সেই সাহস আর সঙ্কল্প নিয়েই শুরু হয়েছিল যাত্রা। ন’বছর পর আজ, যখন বেকার সমস্যা মেটার কোনও লক্ষণ নেই, মূল্যবৃদ্ধি আকাশছোঁয়া, ব্যবসা তলানিতে তখন দৃষ্টি ঘোরাতে শুধু ৮৬২ কোটির নতুন সংসদ ভবনে কি চিঁড়ে ভিজবে? কিংবা গুটিকতক নতুন মন্দিরে। লেলিয়ে দেওয়া এজেন্সি সন্ত্রাসে বিধ্বস্ত বিরোধীরা ইতিমধ্যেই রবিবারের অনুষ্ঠান বয়কটের ডাক দিয়েছেন। তাঁদের দাবি প্রধানমন্ত্রী নয়, গণতন্ত্রের এই মন্দিরের উদ্বোধন করার ষোলোআনা হক রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর। শীর্ষ সাংবিধানিক পদে আসীন তিনিই। বিতর্কের শেষ এখানেই নয়, বরং শুরু। আধুনিক ভারতের নয়া সংসদ ভবনের উদ্বোধনের জন্য কেন সাভারকারের জন্মদিনকে বাছা হল, ক্ষোভ দানা বেঁধেছে তা নিয়েও। সুবিশাল এই উদ্বোধন অনুষ্ঠানকে স্মরণীয় করতে হঠাৎই আমদানি করা হয়েছে ব্রিটিশ রাজদণ্ড (মোটেই ন্যায়দণ্ড নয়!) সেঙ্গোলের। লর্ড মাউন্টব্যাটেন ওই দণ্ড নেহরুজির হাতে তুলে দিয়েছিলেন। তারপর তার ঠাঁই হয়েছিল অন্ধকারে। আজ মোদিজি সেই ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি করছেন দক্ষিণের তামিল ব্রাহ্মণদের ভোট জিততে। এই তাঁর উদারমনা রাজনীতির উদাহরণ!
মহাত্মা গান্ধীর নাতি তুষার গান্ধী তাৎপর্যপূর্ণ টুইট করেছেন। তাঁর দাবি, এতই যখন হল তখন নয়া সংসদ ভবনের নাম রাখা হোক ‘সাভারকার সদন’। আর গরিব জনগণের দেওয়া করের কোটি কোটি টাকায় তৈরি ভবনের সবচেয়ে বড় যে সভাকক্ষ, যেখানে প্রায় ১,২০০ নির্বাচিত সদস্যের বসার জায়গা থাকছে, পরিভাষায় যাকে সেন্ট্রাল হল বলে, তার নাম রাখা হোক ‘মাফি কক্ষ’। প্রশ্ন একটাই, সেই অর্থে সাভারকারকে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম সারির কোনও মুখ বলা যায় কি? তিনি কোনও অর্থেই নেহরু, প্যাটেল, মহাত্মা গান্ধী, চিত্তরঞ্জন দাশ, বাঘাযতীনের সমকক্ষ ছিলেন না। যতই মহান সাজানোর চেষ্টা হোক, এখনও দেশবাসী ভুলতে পারে না আন্দামানের সেলুলার জেলে থাকার সময় ‘মহামান্য’ সাভারকারই ব্রিটিশ সরকারের কাছে ক্ষমা চেয়ে চিঠি লিখেছিলেন। প্রথমবার তাঁর প্রার্থনা খারিজ হয়ে যায়। অথচ ক্ষমা প্রার্থনা যাঁদের রক্তে নেই, সেই আপসহীন নেতাজিকে চিরদিন ব্রাত্য রেখে, গান্ধীজিকে দূরে সরিয়ে আজ ২৮ মে সাভারকারের জন্মদিনে উদ্বোধন হচ্ছে নয়া সংসদের। সামনেই দেশের ৭৬তম স্বাধীনতা দিবসের মতো পবিত্র মুহূর্ত অপেক্ষা করছে। অপেক্ষা করছে সংবিধানের ৭৫তম বর্ষও। ২৬ নভেম্বর ১৯৪৮, সংবিধান উপহার পেয়েছিলাম আমরা। তবু  ইতিহাসকে পিছনে ঠেলে দ্রুত বিতর্কিত সাভারকারের জন্মদিনকে বেছে নেওয়া কেন, সেই প্রশ্ন আজ প্রাসঙ্গিকভাবেই উঠছে।
একথা বলতেই হবে, দেশের শ্রেষ্ঠ বীর এই বাংলার পরাক্রমী পুরুষ নেতাজির সঙ্গে সেই অর্থে সাভারকারের কোনও তুলনাই চলে না। তাঁর খ্যাতি-অখ্যাতি মূলত হিন্দুত্বের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে, স্বাধীনতার লড়াইয়ের আপসহীন সংগ্রামী হিসেবে নয়। তাও সীমাবদ্ধ অঙ্গরাজ্য মহারাষ্ট্রে। আজ হিন্দুত্বের ধ্বজাধারীরাই দেশের শাসন ক্ষমতায়। এহেন হিন্দুত্বের মুখ সাভারকারকে স্বাধীনতার লড়াইয়ের প্রধান মুখ হিসেবে তুলে ধরার তাই উচ্চকিত আয়োজন। কিন্তু একইসঙ্গে মনে রাখতে হবে তাঁর জন্মদিনে ১,২০০ আসনের রাজকীয় সংসদ ভবনের উদ্বোধন করে সেই বিভাজনের রাজনীতিতেই শান দিলেন নরেন্দ্র মোদি। তাই তাঁর মুকুটে এটি মোটেই ধর্মনিরপেক্ষ কোনও পালক নয়। অতঃপর সব কা সাথ, সব কা বিকাশের ঢক্কানিনাদ ওই নয়া ভবনের ইট কাঠের আড়ালে গুমরে মরবেই। শান্তি পাবে না দেশের জন্য প্রাণ দেওয়া শতশত স্বাধীনতা সংগ্রামীর আত্মাও।
প্রথম থেকেই গেরুয়া শক্তির একটাই এজেন্ডা নেহরুর ইতিহাসকে মুছে ফেলার। ১৯২৭ সালে স্থপতি গ্রাহাম লুটিয়েনের পরিকল্পনায় পুরনো সংসদ ভবনের পত্তন হয়। পুরনো ভবনের বয়স প্রায় ৯৬ বছর। স্বাধীনতার ৭৫ বছরের বহু উত্থান পতনের সাক্ষী এটি। কিন্তু আজ কংগ্রেসকে বিসর্জন দিতে গিয়ে নেতাজি সহ অন্যদেরও ভুলে যাওয়া কেন? নতুন যে সংসদ ভবনের আজ উদ্বোধন হচ্ছে তাঁর স্থপতি কোনও লুটিয়েন নয়, মোদি ঘনিষ্ঠ গুজরাতি বিমল প্যাটেল। বারাণসীর মন্দিরে প্রবেশের চোখ ধাঁধানো প্রশস্ত করিডরের নকশাও তাঁরই। সাধারণ নির্বাচনের আর একবছরও দেরি নেই। নয়া সংসদ ভবনের পর অযোধ্যার রামমন্দিরের উদ্বোধন হবে মোদিজির হাত দিয়েই। এবছরের শেষে কিংবা নতুন বছরের শুরুতে। ক্রমশ সেই মাহেন্দ্রক্ষণও এগিয়ে আসছে। কে জানে, কয়েক মাসের মধ্যে হয়তো বারাণসীর জ্ঞানবাপী মসজিদও ভোটের স্বার্থে ঢাকা পড়বে শিবলিঙ্গের ছায়ায়। সব মিলিয়ে হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের দু’শো আয়োজন। এককথায় বেঁচে থাকার সমস্যা সমাধানের ব্যর্থতা ঢেকে দিয়ে হিন্দুত্বের গগনভেদী জয়োল্লাসে ভোট বৈতরণী পার করার মরিয়া প্রয়াস।
এই লেখা আজ যখন পাঠকের হাতে পৌঁছচ্ছে তখন ৮৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে নয়া সংসদ ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান পুরোদমে শুরু হয়ে গিয়েছে। ভোর থেকে প্রধানমন্ত্রী যজ্ঞ শুরু করেছেন দেশের প্রথম সারির পণ্ডিতদের পাশে বসিয়ে। ওই যজ্ঞে তিনি একাই থাকবেন একনায়কের মতো। বাজপেয়িজি বেঁচে থাকলে আদবানিজিও শামিল হতে পারতেন। এই সরকারে এক আর দু’নম্বরের মধ্যে বিস্তর ফারাক। তাই ওটা হওয়ার নয়। দুপুর ১২টায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে অন্যদের। প্রায় ২০টি স্বীকৃত রাজনৈতিক দল অনুষ্ঠান বয়কট করেছে। এককথায় গণতন্ত্রই যে-দেশে বিপন্ন, বিরোধীরা এজেন্সি আর আইনের ফাঁসে নাস্তানাবুদ, সেখানে এত বিশাল খরচের গণতন্ত্রের মন্দিরের প্রয়োজনটা কী?
ভক্তকুল ওসব মানে না। তাঁরা সোচ্চারে বলতেই থাকে ৯ বছরের কীর্তির খতিয়ান। দু-দু’বার নোট বাতিলের অভাবনীয় ‘সাফল্য’। জিএসটি কার্যকর করার অনন্য ‘নজির’। সব বিরোধী নেতাকে জেলে পুরে কাশ্মীর দু’ভাগ করার ঐতিহাসিক পদক্ষেপ, তিন তালাক বন্ধ করার ‘অতুলনীয় কীর্তি’। সিবিআইয়ের দাপাদাপি। শূন্য সংসদে ধ্বনি ভোটে একের পর এক বিল পাশের অসাধারণ রেকর্ড। পাকিস্তানের ভিতরে ঢুকে সার্জিকাল স্ট্রাইক। এমন বুক ফুলিয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারা প্রধানমন্ত্রী এর আগে আসেননি বলে ঢাক বাজতেই থাকে। তবু বেকার সমস্যা গত ৪৫ বছরের মধ্যে রেকর্ড উচ্চতা ছুঁয়েছে। এত অস্ত্র, হুঙ্কার, আস্ফালন সত্ত্বেও চীন, পাকিস্তানের দৌরাত্ম্য একচুল কমেনি। সীমান্ত পেরিয়ে অরুণাচলে ঢুকে সেতু পর্যন্ত উড়িয়ে দিয়েছে লালফৌজ। আর আমরা অসহায় দর্শক হয়ে দেখেছি। এই অস্থিরতার সঙ্গেই কখনও ক্ষুধার সূচকে একশো দেশের নীচে লজ্জাজনক অবস্থান, আবার কখনও পেট্রল-ডিজেল-গ্যাসের আকাশছোঁয়া দাম বেমালুম মিলে যায় এক বিন্দুতে। মূল্যবৃদ্ধির ছ্যাঁকা লাগছে, তবু মুখে বলে কার সাধ্য? স্বাধীন মতামত প্রকাশের পরিসরটুকুও আজ কমতে কমতে নিশ্চিহ্ন। উত্তরপ্রদেশের মতো দিকে দিকে ডাবল ইঞ্জিন সরকারের হাতছানি। তবু হালে কর্ণাটক, হিমাচল সেই জাল কেটে আবার সিঙ্গল ইঞ্জিন রাজ্যের দিকে ফিরেছে। দু’হাতে লাড্ডুর আহ্লাদে মানুষ আর ভুলছে না। উন্নয়নের চকমকিও তাই কেমন যেন ম্লান!
১০ ডিসেম্বর, ২০২০। দেশ তখন কোভিডের আঘাতে দিশাহারা। প্রধানমন্ত্রী তাতে আমল না দিয়েই নয়া সংসদ ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তারপর রেকর্ড সময়ে সেন্ট্রাল ভিস্তার প্রথম পর্বের সূচনা। চিদম্বরম সাহেব নয়া সংসদ ভবন সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, গণতন্ত্রের ধ্বংসাবশেষের উপরই নতুন সংসদের পত্তন করা হয়েছে। আসলে বড় সংসদ মানে শুধু লোকসভা ও রাজ্যসভার সদস্য বৃদ্ধিই নয়, এর মধ্যেই সুপ্ত রয়েছে আগামী দিনের রাজ্যভাগের পরিকল্পনা (পড়ুন, ষড়যন্ত্র)। যেসব রাজ্যে এখনও বিজেপি তেমন প্রভাব বিস্তার করতে ব্যর্থ, সেখানে রাজ্য ভেঙে একটি অংশের উপর দখলদারি কায়েমের মরিয়া চেষ্টা আগামী দিনে আরও বেপরোয়া হয়ে নখ দাঁত বের করবে। ইতিমধ্যেই বঙ্গ বিজেপি বুঝে গিয়েছে, বাংলায় দক্ষিণবঙ্গে ভোটে জেতা দূর অস্ত। তাই উত্তরবঙ্গকে বিচ্ছিন্ন করে দখলদারি কায়েমের চক্রান্তে ক্রমাগত ইন্ধন দিয়েই চলেছে তারা। আবার সিএএ না-হলেও, মতুয়াদের নানা টোপ দিয়ে কাছে টানার জঘন্য ষড়যন্ত্রও চলছে। রাজ্য ভাগ হলে এই বিভাজনের তাস আরও কদর্য রূপ নিতে বাধ্য। 
উদ্দেশ্য পরিষ্কার, শুধু সাম্প্রদায়িক বিভাজন নয়, রাজ্যভাগের তাস খেলেও ভোটবাক্সে ঝড় তোলার চেষ্টা শুরু হচ্ছে। নয়া সংসদ ভবন তারই ইঙ্গিতবাহী। কিন্তু মানুষে মানুষে বিভেদ বাড়লে যেমন নেতাদের লাভ, তেমনি মস্তবড় লোকসান দেশের। ভাগ বাটোয়ারার এই খেলায় দেশের আত্মাটাই ক্রমশ বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। ‘বিবিধের মাঝে মিলন মহান’-এর গৌরবময় উপলব্ধির কঙ্কালটুকু ছাড়া আর অবশিষ্ট রইল কী!

28th     May,   2023
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ