বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

রাষ্ট্র দেশবাসীকে অনিশ্চয়তাই দিয়ে চলেছে
সমৃদ্ধ দত্ত

কর্ণাটকের চিত্রগুড়ার খ্যাতনামা একটি পথচলতি খাবার দোকান শ্রী লক্ষ্মীভবন টিফিন রুম। সেই দোকানে ঢোকার মুহূর্তেই প্রবেশদ্বারে এবং ক্যাশকাউন্টারে বড় বড় করে নোটিস লাগানো হয়েছিল ২০১৭ সাল থেকেই। নোটিসে লেখা ছিল, ২ হাজার টাকার নোটের খুচরো নেই। অনুগ্রহ করে খাবারের দাম যা হয়েছে, ঠিক সেটাই মিটিয়ে দিন অথবা ছোট নোট দেবেন। সোজা কথায় ২ হাজার টাকার নোট ওই দোকান নেবে না। ২০১৭ সালের শেষার্ধ থেকেই এই নোটিস পড়ে যায়। স্থায়ীভাবে সেটি রাখা রয়েছে। ওই দোকানের মালিককে বিখ্যাত সাংবাদিক পি সাইনাথ প্রশ্ন করেছিলেন, নোটবাতিলের পর এখন তো  আবার সব টাকা বাজারে এসে গিয়েছে। নতুন ২ হাজার টাকা, ৫০০ টাকা সবই পাওয়া যাচ্ছে। কিছু মাস আগে পর্যন্ত সমস্যা ছিল। এখন আর নেই। তাহলে আপনি কেন এভাবে ২ হাজার টাকার নোট প্রত্যাখ্যান করছেন? মালিক এস মূর্তি হেসে বলেছিলেন, কে জানে আবার কবে কী হয়! তাই রিস্ক নিচ্ছি না! অর্থাৎ তিনি সরাসরি না বললেও বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, তিনি আর সরকারকে বিশ্বাস করেন না। তাঁর স্থির বিশ্বাস, এরা যখন তখন যা ইচ্ছে করতে পারে, মতিস্থির নেই। 
ঠিক রাগ, দুঃখ, ক্ষোভ নয়। আসলে একটা ভয়ের জন্ম হয়। যখন আমরা জানতে পারি রাষ্ট্র তার দেশবাসীর সঙ্গে প্রতারণা করছে। আবার রাষ্ট্রকে দেশবাসী বিশ্বাসও করছে না। রাষ্ট্র তার দেশবাসীকে মানুষ হিসেবে নয়, পুতুল হিসেবে দেখছে। রাষ্ট্র ভাবছে, আমি যখন যা করব, সেটা দেশবাসীর মেনে নেওয়াই ভবিতব্য। সে প্রতিবাদ করলেই তাকে অ্যান্টি ন্যাশনাল বলা হবে। আর প্রতিবাদ করার মতো সময় কোথায় তার। গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করতে করতেই সারাদিন সময় মেলে না সিংহভাগ দেশবাসীর। আরও ভয় বুকে দানা বাঁধে, যখন দেখা যায় যে, রাষ্ট্র অথবা সরকার দেশবাসীকে স্বস্তি দিতে চায় না। বরং একটা আশ্চর্য নিষ্ঠুরতায় ভর করে সে সারাক্ষণ ভাবছে কীভাবে দেশবাসীকে নানারকমভাবে ব্যতিব্যস্ত করে রাখা যায়। কিছুতেই এই মানুষগুলিকে ভাবনাহীন স্বাভাবিক জীবনে থাকতে দেব না। এরকমই যেন ভাবছে রাষ্ট্র। তারই প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে বছরের পর বছর ধরে। 
এটা দেশবাসীর কাছে দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু একটি সূক্ষ্ম বিপজ্জনক প্রবণতা গ্রাস করছে ভারতকে। সেটি হল, মানুষ আর দেশের পরিচালকদের বিশ্বাসই করে না। রাষ্ট্রের পরিচালকরা অথবা সরকারের প্রধান যাঁরা, তাঁরা বুঝতে পারছেন না যে, এভাবে আসলে নিজেদের অজান্তে তাঁরা অবিশ্বাসী চরিত্রে পর্যবসিত হয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের কোনও কথায়, কোনও সিদ্ধান্তে, কোনও বক্তব্যে, কোনও আশ্বাসে, কোনও প্রতিশ্রুতিতে আর মানুষ বিশ্বাস করবে না। করছেও না। ক্রমেই তাঁদের কথাকে সিরিয়াসলি নেওয়া হচ্ছে না আর। 
আমরা ভোট দিই। আমরা আয়কর দিই। আমরা জিএসটি দিই। আমরা প্রতিটি আইন মেনে চলি। যখন যা নির্দেশ আসে, সেগুলি পালন করি।  কিন্তু রাষ্ট্র এসবের বিনিময়ে আমাদের শাস্তি দেয়। জীবনকে প্রতিনিয়ত অনিশ্চিত করে দিচ্ছে। কিছু না কিছু কারণে লাইনে দাঁড় করাচ্ছে। এই কার্ডের সঙ্গে ওই কার্ডের লিঙ্ক। সেই কার্ডের কে ওয়া‌ই সি। আধার আপডেট না করলে সুবিধা মিলবে না। যখন তখন আমাদের পরিকল্পিতভাবে হেনস্তা করা চলছে। আর রাষ্ট্র যখন তখন এমন সব সিদ্ধান্ত আমাদের উপর চাপিয়ে দিতে পারে, যাতে আমাদের জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ আবার বাধাপ্রাপ্ত হয়। নতুন নতুন  চিন্তা, উদ্বেগ, সমস্যার পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। কর্ণাটকের চিত্রগুড়ার সেই দোকানমালিক ঠিক কতটা দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ছিলেন আজ সেটা বোঝা গেল। তিনি রাষ্ট্রের খামখেয়ালি মনোভাবকে সঠিক ধরে ফেলেছিলেন একেবারে প্রথম দিন থেকে। তাই ২ হাজার টাকার নোট গ্রহণই করেননি। আজ ৬ বছর পর তাঁর আশঙ্কাই সত্য হল। প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে সেই নোট আচমকা। আবার লাইনে দাঁড়াও জমা করার জন্য। 
২ হাজার টাকার নোট হঠাৎ প্রত্যাহার করে নেওয়ার সিদ্ধান্তের মধ্যে দিয়ে ঠিক এই মনস্তত্ত্বই প্রকট হল, শুধু যে মানুষ তাদের বিশ্বাস করছে না তাই নয়, এখন আর আমাদের রাষ্ট্র নিজের কথাকেই নিজে বিশ্বাস করে না।  ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে দুটি নোট বাতিল করে দিয়ে নতুন নোট চালু করে আমাদের আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল এবার আর কোনও সমস্যা আসবে না। এখন থেকে স্বস্তিকর দিন চলবে। আমরা সেই আশ্বাসকে ভর করেই সেই নোট নিয়েই জীবন চালিয়েছি। প্রশ্ন হল, কোনও সাধারণ নাগরিক যদি সরকারের উপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে তার ঘরে যখনই সময় পেয়েছে ২ হাজার টাকার নোটই সঞ্চয় হিসেবে জমিয়ে রাখে, তাহলে সে অন্যায়টা কী করেছে? কালো টাকা, আয় বহির্ভূত টাকা না হলেই হল।  ২ হাজার টাকার নোট আইনত বৈধ। তাই সে রেখেছে। অসময়ের ভরসা হিসেবে। সে এরপর যদি আগামী দিনে কোনও নোটকেই বিশ্বাস না করে? যে কোনও সময় যে কোনও নোটই সরকার বাতিল করে দিতে পারে এরকম একটি বার্তাই কি সরকার দিতে চায়? কেন দিতে চায়? অর্থাৎ মানুষকে সর্বদা একটি অনিশ্চয়তার জীবনের দিকেই কেন ঠেলে দেওয়া হচ্ছে? আগামী দিনে ১ হাজার টাকার নোট চালু করা হলে আর কি সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে সেই টাকাকে ভরসা করবে? লেনদেনে বিশ্বাস থাকবে?
কেন্দ্রীয় সরকার, প্রধানমন্ত্রী, শাসক দলের যারা ঘোরতর সমর্থক অথবা ভক্ত, তারা এখন কি ২ হাজার টাকার নোট গ্রহণ করছে? কেউ যদি তাদের কোনও আদানপ্রদানের সময় ২ হাজার টাকার নোট দেয়, তারা নিচ্ছে? যদি না নেয়, তাহলে কেন নিচ্ছে না? রিজার্ভ ব্যাঙ্ক তো বলছে ২ হাজার টাকার নোট বৈধ! এই টাকা বাতিল হয়ে গেল, এরকম তো বলা হয়নি! বিরোধীরা না হয় সেকথা বিশ্বাস না করে ওই টাকা আর কাছে রাখতে চাইছে না। কেউ দিলে নেবেও না। কিন্তু সরকারের সমর্থকরা নেবে? অথবা নিচ্ছে? যদি না নেয়, তাহলে প্রমাণ হচ্ছে, তারাও কিন্তু নিজেদের পছন্দের সরকারের কথায় আর বিশ্বাস করে না। যাকে তারা বিশ্বাস করে না, তাকেই সমর্থন করে! অর্থাৎ বিরোধী এবং সমর্থক, তাদের রাজনৈতিক অবস্থান যাই হোক, একটা ব্যাপারে তারা একমত যে, এই সরকারের বলা কথাকে আর বিশ্বাস করা যাবে না। এরা যে কোনও সময় যে কোনও সঙ্কটের দিকে ঠেলে দেবে মানুষকে।
মোদি সরকারের সমর্থকদের বিশ্বাসেই সবথেকে বেশি আঘাত লেগেছে। কারণ, ১৫ লক্ষ টাকা প্রত্যেকের অ্যাকাউন্টে দেওয়া হয়নি, সব কালো টাকা বিদেশ থেকে নিয়ে আসা হয়নি অথবা ৩৭০ নং ধারা অবলুপ্তির পর কাশ্মীরে  গিয়ে জমি কেনা হয়নি, এসব তাও সহ্য করা যায়। কিন্তু যা যা নিশ্চিত হওয়ার আশায় দিনের পর দিন, মাসের পর মাস বসে আছে এই সমর্থকরা, তাও আজ পর্যন্ত করতে পারেনি মোদি সরকার। কংগ্রেস মুক্ত ভারত দিতে পারেনি। দুর্নীতির অভিযোগে আজ পর্যন্ত গান্ধী পরিবারকে জেলে পাঠানো যায়নি। সিএএ আইন চালু করা হবে বলে হুমকি দিয়েও সেটা সম্পর্কে আর উচ্চবাচ্য করে না এই সরকার। এনআরসির নামগন্ধ নেই। সিবিআইয়ে আর ইডির উপর আর ভরসা করা যায় না। অ্যারেস্ট করে, জেলে রাখে, জামিন দেয় না। টিভিতে হেডলাইন দেয়। কিন্তু তদন্ত আর এগয় না। 
আজকের রাষ্ট্র গীতার বাণীর উপাসক। গীতায় বলা হয়েছে কর্ম করে যাও, ফলের আশা কোরো না। আজ রাষ্ট্র তার দেশবাসীকে বলতে চায়, সমর্থন করে যাও, অনুগত থেকে যাও, ঝামেলা সহ্য করে যাও। শুধু ফলের আশা কোরো না!

26th     May,   2023
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ