বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

রাজনীতি যখন মার্কেটিং
শান্তনু দত্তগুপ্ত

সাবানের বিজ্ঞাপন। আটের দশকের শেষে দূরদর্শনে খেলা বা সিনেমা দেখার ফাঁকে উদয় হতো তার। সেই সময়ের নামজাদা কোনও নায়িকা, তিনি সাবান মাখছেন, আর সুন্দর হয়ে উঠছেন। এটাই ছিল মোদ্দা ব্যাপার। মানে ওই কোম্পানি বাজার অর্থনীতিকে বোঝাতে চাইত, আপনিও এই সাবান মাখুন... নায়িকার মতো সুন্দর হয়ে উঠবেন। সময় বদলেছে। সেই সঙ্গে স্ট্র্যাটেজিও। আম জনতা বুঝেছে, সারাদিন রোদে-জলে গাধার খাটুনি খেটে, সংসার সামলে, ছেলেমেয়ে পড়িয়ে আর যাই হোক, নায়িকার মতো সুন্দর হওয়ার ব্যাপারটা সোনার পাথরবাটি জাতীয় ধোঁকা। সেই আঁচ পেয়েছে কোম্পানিগুলিও। তাই এখন বিজ্ঞাপনে নায়িকার বদলে এসেছে খুব সাধারণ, পাশের বাড়ির মেয়েটি। সে বলছে, সাবানটা মাখলে কেমন আলাদা অনুভূতি হয়। স্কিন নরম লাগে। নিজেকে অন্তর থেকে সুন্দর মনে হয়। আর বিজ্ঞাপনের ক্যাচলাইন? প্রত্যেক নারী সুন্দর। শুধু নায়িকারা নন।
মনে হতে পারে, হঠাৎ বিজ্ঞাপনের এই অবতারণা কেন? আসলে সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষা রিপোর্ট দেখে রাজনীতিতেও বেচুবাবু গোছের আইডিয়ার ব্যাপারটা মাথায় এল। মর্নিং কনসাল্ট নামে একটি সংস্থা সমীক্ষাটা করেছে। বিষয়বস্তু, নিজের নিজের দেশে কোন রাষ্ট্রনেতার জনপ্রিয়তা কতটা। রিয়েল টাইম সার্ভে। মানে এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে যা মনে হচ্ছে, উত্তরদাতাকে সেটা বলতে হবে। ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, ২২টা বড় দেশের মধ্যে মাত্র চারটির ক্ষেত্রে মানুষের ভোট তাঁদের রাষ্ট্রনেতার জন্য ৫০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। আর তার শীর্ষে রয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। ৭৮ শতাংশ ভারতীয় নাকি তাঁকে জনপ্রিয়তম বলে মন করে। খুবই আকর্ষক সমীক্ষা। তাও ভোটের ঠিক ন’-দশ মাস আগে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মার্কেটিংয়ের খুব ভালো ছাত্র। রাজনীতি এবং সরকারি দায়িত্ব­-কর্তব্যেরও যে চূড়ান্ত বিপণন সম্ভব, তা তিনি গত ন’বছরে দেখিয়ে দিয়েছেন। কোনও আম নাগরিকের বাড়িতে সরকার বিদ্যুৎ পৌঁছে দিল, মোদিজি তার বিজ্ঞাপন করলেন। পরীক্ষা ও ইন্টারভিউ দিয়ে কোনও যুবক সরকারি চাকরি পেলেন, প্রধানমন্ত্রী তাঁর হাতে তুলে দিলেন নিয়োগপত্র। দেশ দেখল, আহা! আমাদের নেতা কত কী না করছেন আমাদের জন্য! কিন্তু আমরা একবারও নিজেদের প্রশ্ন করলাম না, বাড়ি বাড়ি বিদ্যুৎ, কিংবা সরকারি চাকরি তো গত ৭৫ বছরে প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত হয়েছে। এত বছর কি তার এমন বিজ্ঞাপন আমরা দেখেছি? উত্তর হল, না দেখিনি। এই সবই আমরা সরকারের দায়িত্ব এবং কর্তব্য বলে জেনে এসেছি। যাকে বলে স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড। তাহলে আজ হঠাৎ করে টিভির পর্দায়, বা সোশ্যাল মিডিয়ার দেওয়ালে দেওয়ালে এই ছবি ফুটে উঠছে কেন? মোদিজি জানেন, রাজনীতিরও ধারা বদলেছে। এখন জয়প্রকাশ নারায়ণের মতো অরাজনৈতিক কোনও মঞ্চ থেকে হুঙ্কার দিলেই সরকার পড়ে যাবে না। আবার নিঃশব্দে কাজ করে গেলেই যে পরের নির্বাচনে দেশবাসী আপনাকে উজাড় করে ভোট দেবে, তেমনটাও নয়। তাহলে উপায় একটাই, মার্কেটিং। যো দিখতা হ্যায়, উও হি বিকতা হ্যায়। মোদিজি এই পলিসিতে বিশ্বাসী। কাজেই জনপ্রিয়তার এই সার্ভে তিনি এবং তাঁর দলবল যে দারুণভাবে কাজে লাগাবেন, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। 
রেস শুরু হয়ে গিয়েছে। ফিনিশিং পয়েন্ট সংসদ ভবন। দিন দশেক হল ফল ঘোষণা হয়েছে কর্ণাটকের। কিন্তু এখনও কি বিজেপির ভরাডুবি খবরের শিরোনামে রয়েছে? না, নিঃশব্দে তা চলে গিয়েছে আড়ালে। বরং গত দু’-তিনদিন ধরে আলোচনায় রয়েছেন শুধুই মোদিজি। তাঁকে নিয়ে সমীক্ষা, জাপানের হিরোশিমায় তাঁর অবতরণ, তাঁর জ্যাকেট...। এটাই যে মার্কেটিং পলিসি! প্লাস্টিক বর্জ্য দিয়ে তৈরি জ্যাকেট পরে তিনি দাঁড়িয়েছেন বিশ্বমঞ্চে। বিলক্ষণ জানেন, সবাই স্যুট পরবে। কিন্তু আলোচনা হবে তাঁর জ্যাকেট নিয়েই। দুনিয়াভর। জেলেনস্কিকে তিনি বলবেন, যুদ্ধ থামানোর আপ্রাণ চেষ্টা করব। সেটাই খবর হবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে জড়িয়ে ধরবেন তিনি। পশ্চিম থেকে পূর্ব—ছবি ছাপা হবে প্রথম পাতায়। লিক হয়ে যাবে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তাঁর কথোপকথন। সেখানে বাইডেন বলবেন, ‘আপনি তো আমাকে ভীষণ বিপদে ফেলে দিয়েছেন! আপনার অনুষ্ঠানের জন্য গোটা দেশ থেকে অনুরোধ আসছে। সবাই উপস্থিত থাকতে চায়। এমনই আপনার জনপ্রিয়তা! আমাকেও একটা অটোগ্রাফ দিন!’ অত্যন্ত ব্যক্তিগত। তাও আজ দেশের অধিকাংশ ভোটার এই ঘটনা জানে। কেন? তিনি যে মহান, বারবার সেই প্রচার কি মোদিজি করতে পারেন! তাই বাকিরা করবে। আঙ্গপাঙ্গ ও অনুষঙ্গরা। টিভির পর্দায়, সোশ্যাল মিডিয়ার দেওয়ালে।
মার্কেটিংয়ের অ-আ-ক-খ হল, প্রথমে গ্রাহককে বোঝো, সেই অনুযায়ী পণ্য তৈরি করো, কাস্টমারকে সেটা জানাও, আর তারপর তাঁর হাতের নাগালে পৌঁছে দাও। চিরকাল এটাই বিপণনের সারসত্য। আজও তাই। কিন্তু সামান্য ফারাক হয়ে গিয়েছে। 
আগে গ্রাহকের প্রয়োজন মতো পণ্য তৈরি হতো। এখন প্রয়োজনটা তৈরি করা হয়। গ্রাহককে বোঝানো হয়, এটাই আপনার দরকার। এই পণ্য বা পরিষেবা ছাড়া আপনার গতি নেই। তাই যে কোনও মূল্যে ‘খরিদ’ করুন। মোদিজি এই ভাবনার প্রথম 
সারির পথিক। হোমওয়ার্ক চলছে, অক্লান্তভাবে। আর তাঁকে হোমওয়ার্ক করিয়ে দেওয়ার জন্য লোক আছে, রয়েছে টিমও। এছাড়া গেরুয়া শিবিরের প্রচার সর্বস্ব নেতা-মন্ত্রীরা তো মোদিজির মহানুভবতা দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বসেই আছেন। ঠিক যেমন বিমানবন্দরে মোদিজির পা ছুঁয়ে স্বাগত জানানো পাপুয়া নিউগিনির প্রধানমন্ত্রী জেমস মারাপের ছবি প্রত্যেক বিজেপি নেতার সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে গিয়েছে। 
এতকিছুর পর রাজনীতির দৌড়ে কে-ই বা তাঁর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামার সুযোগ পাবেন! মোদিজি একাই দৌড়বেন, তিনিই ফার্স্ট হবেন। এমন পরিস্থিতি তৈরিই লক্ষ্য তাঁর বাহিনীর। তারপরও প্রতিযোগিতা আছে। কীভাবে? বোঝা যায় নানা জল্পনায়। তারই মধ্যে একটা হল, দক্ষিণ ভারতে প্রার্থী হতে পারেন ভারতের ‘জনপ্রিয়তম’ নেতা। টুইস্ট যে এখানেই! গত লোকসভা ভোটে রাহুল গান্ধী ওয়েনাড় থেকে প্রার্থী হওয়ায় মস্করার অন্ত রাখেনি বিজেপির তাঁবেদাররা। হাসিঠাট্টায় তারা বলেছিল, উত্তর ভারতে জিততে পারবেন না বুঝেই রাহুল দক্ষিণে গিয়েছেন ভোটে দাঁড়াতে। বিষয়টা অস্বীকার করার মতো নয়। কারণ, গান্ধী পরিবারের কার্যত ‘ব্যক্তিগত’ আসন আমেথিতে রাহুল ২০১৯ সালে হেরে গিয়েছিলেন স্মৃতি ইরানির কাছে। গত ১০ বছর ধরে কংগ্রেসের হাল জাতীয় রাজনীতিতে সত্যিই খারাপ। ৬০-এর গণ্ডি পেরতেই তারা রীতিমতো ধুঁকছে। প্রত্যেক বড় দলের কাছেই নির্বাচনী হালচালের ইঙ্গিত থাকে। রাহুলের কাছে ছিল না, তেমন ভাবার কারণ নেই। তাই ধরে নেওয়া যেতেই পারে, আমেথি হাত থেকে বেরিয়ে যেতে পারে বুঝেই ওয়েনাড়ে প্রার্থী হয়েছিলেন তিনি। এবার নরেন্দ্র মোদি যদি সত্যিই দক্ষিণ ভারতের কোনও কেন্দ্র থেকে প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ান, তাহলে সেই সমীকরণ উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। কারণ, যোগীরাজ্যের মতো উত্তর ভারতের দু’-একটা রাজ্য ছাড়া প্রায় সবই কংগ্রেস কিংবা অন্য বিরোধীরা দখল করে নিয়েছে। মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তিশগড়ে ভোট আসন্ন। তাতেও বিজেপি মারাত্মক ফল করবে বলে মনে করছেন না চূড়ান্ত মোদিভক্তও। সেক্ষেত্রে বিজেপিকে কী করতে হবে? যে সব রাজ্যে এতদিন তারা দাঁত ফোটাতে পারেনি, নজর দিতে হবে সেদিকে। অর্থাৎ, দক্ষিণ ভারত। নরেন্দ্র মোদি নিজে দক্ষিণ ভারতে প্রার্থী হলে সেই সুবিধা কিছুটা হলেও পাবে গেরুয়া শিবির। প্রথমত, জনপ্রিয়তার বিচারে তিনি জিতবেন বলেই ধরে নেওয়া যায়। আর দ্বিতীয়ত, সেই রাজ্য এবং আশপাশেও তার প্রভাব পড়বে। কিন্তু যদি তিনি খুব কম মার্জিনে হলেও হেরে যান? বিজেপি কিন্তু তাহলে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে বলে মনে হয় না। কারণ, মোদি জনতা পার্টির কাছে প্রধানমন্ত্রীর মুখের ম্যাজিক আর হিন্দুত্ব ছাড়া কিছু নেই। পরিষেবা নামক ভোটের অস্ত্রটি গোঁত্তা খেয়ে মাটিতে এসে আছাড় খেয়েছে। বাংলার মতো অনেক রাজ্যই ১০০ দিনের কাজের মতো প্রকল্পের টাকা থেকে বঞ্চিত (মনে রাখতে হবে, সেই সব রাজ্যেই অবিজেপি সরকার)। তাহলে কী দেখে মানুষ বিজেপিকে ভোট দেবে? শুধুই মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি?
গত কয়েকদিনে আলোচনা না হলেও আগ্রহ কিন্তু আরও একটি বিষয় নিয়ে রয়েছে। বিরোধী জোট। নীতীশ কুমার ছুটছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কথা বলছেন, অরবিন্দ কেজরিওয়াল আসরে নেমে পড়েছেন। মানুষ জানতে আগ্রহী, সত্যিই কি এই জোট দিনের আলো দেখবে? বহু দলের সমাবেশ হলে স্বার্থের সংঘাত হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। এক্ষেত্রেও তেমন কিছু হবে না তো? আজকের তারিখে দাঁড়িয়ে বিরোধীদের এটাই একমাত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য—মানুষকে বোঝানো, আমরা সব পরিস্থিতিতেই জোটবদ্ধ। এখন থেকেই। আপনারা ভরসা করতে পারেন। তবে মানুষ ভোট দেবে মহাজোটের প্রার্থীদের। এটাই যে একমাত্র পথ রাজনীতির রেসে নরেন্দ্র মোদির পাশে জায়গা করে নেওয়ার। লক্ষ্য হবে সংসদ ভবন। পুরনো হোক, বা নতুন।

23rd     May,   2023
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ